Advertisement

মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩

১৬৩৯ সালের এক মেঘলা বিকেল। সে বিকেলে যুগান্তকারী এক কাজ করে ফেললেন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ জেরেমায়া হরকস। কী সেই কাজ? আর এই মানুষটা-ই বা কে? নামটা অপরিচিত লাগছে। না চেনার একটা কারণ আমরা সোনার তরীর ফসল নিয়ে মেতে থাকি। ভুলে যাই সোনার ফসলের চাষীকে। 


 জেরেমায়া হরকস:  জ্যোতির্বিদ্যার অচেনা নায়ক 

সেদিন বিকেলে এই মানুষটি নির্ভুলভাবে পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব বের করেন। এছাড়াও পূর্বাভাস প্রদান করেন শুক্রগ্রহের ট্রানজিট বা অতিক্রমন। আমরা জানি, চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে চলে এলে পৃথিবী থেকে সূর্যকে দেখা যায় না। সূর্য ঢাকা পড়ে যায় চন্দ্রের পেছনে। এটাই সূর্যগ্রহণ। একইভাবে শুক্র গ্রহ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে এলে হয় শুক্রের অতিক্রমন। পৃথিবী থেকে চাঁদের তুলনায় শুক্র অনেক দূরে। ফলে আসলে বড় হলেও শুক্রকে আকাশে দেখা যায় ছোট। তাই শুক্র সূর্যকে চাঁদের মতো ঢেকে দিতে পারে না। তবে সূর্যের আলোকে বাধাগ্রস্থ একটু করেই। সেটাই সূর্যের গায়ে কালো দাগ হিসেবে দেখা যায়। এটাই শুক্রের অতিক্রমন বা ট্রানজিট। ব্যাপারটা ঘটে অন্য গ্রহের বেলায়ও।


চাঁদ কত দূরে আছে? 


শুক্র গ্রহের গল্প 


এমন একটি সূক্ষ্ম ব্যাপার সঠিকভাবে অনুমান করেন হরকস। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। আর এরই মাধ্যমে নির্মাণ হয় পরবর্তীতে নিউটনের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর। 


মহাবিশ্বের কেন্দ্র কোথায়?


হরকসের আগে মহাবিশ্বের পরিধি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। শুক্র গ্রহের অতিক্রমন নিয়ে হরকসের প্রবন্ধ অল্পের জন্যে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। গৃহযুদ্ধ ও লন্ডনের মহাঅগ্নি থেকে বেঁচে যায় শুধু ল্যাটিন ভাষায় লিখিত একটি পাণ্ডুলিপি। 


এ প্রবন্ধ ২০ বছর ধরে জ্যোতির্বিদদের হাত ঘুরছিল। পরে ১৬৬২ সালে এক পোলিশ জ্যোতির্বিদের বইয়ের পরিশিষ্টে প্রকাশিত হয়। কিন্তু নিউটনের হাতে আসার আগে কেউ এই প্রবন্ধের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনি। 


১৬৩৯ সালে হোরকসের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি বছর। এ অল্প বয়সেই তিনি এক বড় গাণিতিক সাফল্য অর্জন করেন। জোহানেস কেপলারের মতো জ্যোতির্বিদের হিসাবের ভুল বের করেন। করেন সংশোধনও। কেপলার বলেছিলেন ১৬৩৯ সালে অল্পের জন্য অতিক্রমন হবে না। 


হরকসের সংশোধনী থেকে দেখা যায়, শুক্র গ্রহের পরবর্তী অতিক্রমন কয়েক দিনের মধ্যেই হতে যাচ্ছে। আর পরের অতিক্রমন ১৭৬১ সালের আগে হবে না। হরকস ছাড়া আর কেউ এটা বলতে পারেনি। তাঁর এক বন্ধু ছিল শখের জ্যোতির্বিদ ও কাপড়ের ব্যবসায়ী। হরকস ছুটে যান তার কাছে। ম্যানচেস্টারের এ ভদ্রলোকের নাম উইলিয়াম ক্র‍্যাবট্রি। 


শুক্রের অতিক্রমন দেখতে দুজনে দুই জায়গায় ছুটে যান। দুই আলাদা স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করেন সূর্যের গায়ে শুক্রের ছায়ার চিহ্ন। এর মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যার এমন কিছু পরিমাপ সম্ভব হয়ে ওঠে, যা অন্যদের নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছিল। আগে সূর্যের দূরত্ব বের করতে হলে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে একটি বস্তুকে স্থির ধরে ত্রিভুজ বানানো লাগত। 


এ সময় হরকস একটি সরল হেলিওস্কোপ যন্ত্র বানান। এটা দিয়ে সূর্যের আলোকে টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে ফোকাস (মিলিত) করে সমতল পৃষ্ঠে দেখা যেত। এতে করে সূর্যের বিম্ব নিরাপদে দেখা যেত। পর্যবেক্ষণ থেকে হরকস শুক্রের আকারও ভালভাবে অনুমান করেন৷ আগে শুক্রকে পৃথিবীর চেয়ে বড় অ আরও কাছে ভাবা হত। তিনি পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব বের করেছিলেন ৯ কোটি ৫০ লক্ষ কিলোমিটার। সঠিক দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার হলেও সে সময়ের তুলনায় সেটা ছিল অনেক ভাল হিসাব। 


প্রায় ১৪-১৫ বছর বয়সে তিনি ল্যাংকাশায়ার থেকে ক্যামব্রিজে আসতেন পায়ে হেঁটে। শুধুই নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য। বাবা ঘড়ির কাজ করতেন। আর হরকস ক্যামব্রিজে পড়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কিছু কাজ করতেন। সহপাঠীদের কক্ষ পরিস্কার করাসহ বিভিন্ন কাজ করে দিতেন বেতনের টাকা যোগাড় করতে। ক্যামব্রিজের বিভিন্ন কলেজ থেকে বই ধার নিতেন। শেষ পর্যন্ত ডিগ্রি না নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। সম্ভবত পড়ার মতো বই শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্যামব্রিজে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। 


পরিবারের লোকেরা ঘড়ির কাজ করত বলে জ্যোতির্বিদ্যার প্রাথমিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে পরিবারের অন্যদের সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি। দিনে পরিবারকে ঘড়ির কাজে সাহায্য করতেন। রাতে বাবা ও চাচারা তাঁকে যন্ত্র বানাতে সহায়তা করতেন। তরুণা বয়সেই তিনি তার সময়ে প্রাপ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব জ্ঞান অর্জন করেন। সেগুলোর ভুলও বের করেন। সতের বছর বয়স থেকেই নতুন গবেষণার জন্ম দিতে থাকেন। 


অল্প বয়সেই তিনি গভীর গাণিতিক জ্ঞান অর্জন করেন। সাধারণ টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের সাথে কাজে লাগান গাণিতিক বিদ্যা। এরপর আসেন এমন উপসংহারে যা প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে তুলে নেওয়া সহজ কাজ ছিল না। 


হরকসই প্রথম দেখাবন, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। তিনি এ থেকে অনুমান করেন, ধূমকেতুও একই পথে চলবে। চাঁদের কক্ষপথ তৈরিতে চাঁদ ও পৃথিবীর ভূমিকার কথা তিনি তুলে আনেন। নিউটন প্রিন্সিপিয়ায় বলেছিলেনও, তাঁর চাঁদের গতিপথ নির্ণয়ে হরকসের অবদান আছে৷ শেষ জীবনে হরকস জোয়ার-ভাটায় চাঁদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করার কাজ করছিলেন। 


হরকস খ্যাতি ও স্বীকৃতি না পাবার অন্যতম কারণ অল্প বয়সে মৃত্যু। এর ফলে তিনি নিজের গবেষণা প্রকাশ ও প্রচার করার সুযোগ পাননি। ফলে অন্য জ্যোতির্বিদরা তাঁর গবেষণার কথা জানতেই পারেনি। আর সে কারণেই তিনি কেপলার ও গ্যালিলিওর মতো সাধারণ মানুষের প্রশংসা পাননি। যদিও তিনি কোপার্নিকাস, টাইকো ব্রাহে, গ্যালিলিও ও কেপলারদের সাথে নিউটনের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। 


তবে জ্যোতির্বিদ্যায় হরকস এখন অচেনা এক নাম। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর অবদানের কথাও জানেন অল্পসংখ্যক মানুষ। আগে এর জন্য আমি আমাদের নিজেদের দুষলেও এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তাঁর স্বল্পায়ু। ভদ্রলোক বেঁচেছিলেন মাত্র ২২ বছর। জীবদ্দশায় তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়নি। তাঁর অসামান্য গাণিতিক অবদান তাই পায়নি বহুল পরিচিতি ও স্বীকৃতি। ১৬৮৭ সালে নিউটন প্রিন্সিপিয়ায় হরকসের পর্যবেক্ষণের অবদানের কথা স্বীকার করেন। হরকসের পর্যবেক্ষণ ছাড়া নিউটনের পক্ষে মহাকর্ষের কাজ শেষ করা ছিল অসম্ভব। 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

লেখাটি ইতোপূর্বে বিজ্ঞানচিন্তার মে, ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত। 

Category: articles

শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩

আজ ১৬ জুন। ১৯৬৩ সালের এই দিনে রুশ নভোচারী ভ্যালেনটিনা তেরেশকোভা মহাশূন্যে যান। কাজটি করেন ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে। একইসাথে সবচেয়ে কমবয়সী মহাকাশচারীও তিনি। 




ভোস্টোক অভিযানের যানে চড়ে একা-ই মহাশূন্যে পাড়ি জমান তেরেশকোভা। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন ৪৮ বার। মহাশূন্যে থাকেন প্রায় তিন দিন। তাঁর পরে আর কোনো নারী একা মহাকাশে যাননি। 


সোভিয়েত মহাকাশ প্রোগ্রামে যুক্ত হবার তেরেশকোভা ছিলেন টেক্সটাইল কারখানার কর্মী। শখের বশে স্কাইডাইভিং করতেন। পরে কসমোনট কর্পসের অংশ হিসেবে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। 


জন্ম ১৯৩৭ সালে। ভলগা নদীর তীরের এক গাঁয়ে। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম। তাঁর বাবা-মায়ের আদিনিবাস বেলারুস। তেরেশকোভার দুই বছর বয়সেই বাবা মারা যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। তেরেশকোভারারা ছিলেন তিন ভাইবোন। ১৭ বছর বয়সে স্কুল পাশ করে টায়ার কারখানায় চাকরি নেন তেরেশকোভারা। পরে যোগ দেন টেক্সটাইল মিলে। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ওদিকে শুরু করেন স্কাইডাইভিং প্রশিক্ষণ। ২২ বছর বয়সে প্রথম জাম্প করেন। এর মধ্যে শুরু করেন প্যারাশুট চড়ার প্রতিযোগিতা। 


১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মহাকাশে গেলেন। নিকোলাই কামানিন তখন নভোচারী প্রশিক্ষণের পরিচালক। তিনি আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখলেন, নারী নভোচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তা দেখে তিনি বললনে,"মহাকাশে প্রথম নারী যুক্তরাষ্ট্রের কেউ হবে তা হতে দেওয়া যায় না। সোভিয়েত নারীদের দেশপ্রেমবোধের প্রতি এটা হবে অপমানের শামিল" 


অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৯৬২ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি তেরেশকোভা নির্বাচিত হন। আরও অনেকগুলো প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তেরেশকোভার জন্য ভোস্টক ৬ যান চূড়ান্ত করা হয়। এর দুইদিন আগে মহাকাশের উদ্দেশ্যে ছুটে যায় যুক্ত অভিযানের অপর যান ভোস্টক ৫। এতে একমাত্র যাত্রী ছিলেন ভ্যালেরি বিকোভস্কি। এটি সফলভাবে যাত্রা করার পর ১৬ জুন সকালে তেরেশকোভা ও তার বিকল্প সোলোভিয়োভা প্রস্তুত হন। 


দুই ভোস্টক একসঙ্গে মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ায় প্রায় তিন দিন। সব মিলিয়ে দুই দিন আগে যাওয়া ভোস্টক ৫ থাকে পাঁচ দিন। আর তেরেশকোভা থাকেন ২ দিন ২২ ঘণ্টা। দুই যান একে অপরের পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত কাছে আসে। নামার সময় ভূপৃষ্ঠের চার মাইল উপরে ক্যাপসুল থেকে বের হন। প্যারাসুটে করে অবতরণ করেন কাজাখস্তানে (সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ)। বিকোভস্কি নামেন তিন ঘণ্টা পরে। 


আজ পর্যন্ত মহাশূন্যে একাকী যাওয়া একমাত্র নারী তেরেশকোভা। আবার সবচেয় কমবয়সীও তিনি। 


প্রথম মহাকাশ স্টেশন


মহাশূন্যে প্রথম আমেরিকান স্টেশন


মহাকাশে প্রথম মানুষ

Category: articles

বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩

আজ জুন মাসের ১ তারিখ। ১৬৩৩ সালের এই দিনে জন্ম নেন ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জেমিনিয়ানো মনতানারি৷


জেমিনিয়ানো মনতানারি

তিনি বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক পদ্ধতির অন্যতম প্রস্তাবক। তিনি সবচেয়ে পরিচিত অ্যালগল নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণের জন্য। তিনি দেখেন নক্ষত্রটির উজ্জ্বলতা পরিবর্তন ঘটছে। পারসিয়াস বা পরশু মণ্ডলের দ্বিতীয় উজ্জ্বল তারা অ্যালগল৷ অন্যরাও ব্যাপারটা খেয়াল করে থাকতে পারেন। তবে মনতানারিই সর্বপ্রথম এ তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। নক্ষত্রটি নামের অর্থ পিশাচ, যা থেকে বোঝা যায় এর উজ্জ্বলতার অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি আগে থেকেই মানুষ জানত।


উজ্জ্বল তারাদের গল্প

মনতানারির জন্ম ইতালির মাদিনা শহরে। দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান। বিশ বছর বয়সে মধ্য-ইতালির শহর ফ্লোরেন্সে যান আইন পড়তে। এ শহরে ছিলেন বছর তিনেক। যার মন পড়ে আছে জ্যোতির্বিদ্যায়, আইন কি তাকে ফিরিয়ে রাখতে পারে! শুরু করেন শনি গ্রহের পর্যবেক্ষণ। শনির বিভিন্ন দশা পর্যবেক্ষণে অংশ নেন।

১৬৫৬ সালে ফ্লোরেন্স ছেড়ে অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ আসেন। আইন ডিগ্রিটা এখানে এসেই সম্পন্ন করেন। তবে সবচেয়ে সুবিধাটা হয় পাওলো দেল বুয়োনোর সাথে দেখা হয়ে। এই লোক ছিলেন গ্যালিলিওর সর্বশেষ প্রত্যক্ষ শিষ্য। তাঁর অধীনে নতুন করে শুরু করেন গণিতের পাঠ।

১৬৬১ সালে ফিরে আসেন মাদিনায়। হন দরবারি দার্শনিক ও গণিতবিদ। ইতোমধ্যে পরিচয় হয় কর্নেলিয়ো মালভাসিয়ার সাথে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের বড় ও প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষক। মাদিনার কাছেই নিজের গাঁয়ের বাড়িতে ভদ্রলোক বানিয়েছিলেন মানমন্দির। দুজনে একসঙ্গে কিছু কাজ করেছিলেন।

১৬৬৪ সালে যোগ দেন বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। এ শহরে থাকতেই চাঁদের একটি প্রায় নিঁখুত মানচিত্র আঁকেন। এতে ব্যবহার করেন নিজের বানানো আইপিস মাইক্রোমিটার। পদার্থবিদ্যায় সান্দ্রতা নিয়েও কিছু কাজ করেন৷

আকাশ দেখতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ১৬৭৬ সালের ২১ মার্চ একটি উল্কা মধ্য-ইতালির আকাশ অতিক্রম করে। পর্যবেক্ষণ করেন ১৬৮২ সালের ধূমকেতুও। যা এডমন্ড হ্যালিও দেখেন। নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার তৃতীয় খণ্ডে তাঁর ১৬৮০ সালের ধূমকেতুর পর্যবেক্ষণের কথা দুইবার উল্লেখ আছে।

তারা দেখে ভবিষ্যৎ বলার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করেন। তিনি প্রমাণ করেন, তারা দেখে ভবিষ্যদ্বাণী আর মনগড়া ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা সমান। চাঁদের বুকের একটি গর্ত তাঁর নাম ধারণ করে আছে। ১৬৮৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র: ব্রিটানিকা ডট কম
Category: articles

মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩

আজ ১১ এপ্রিল। ১৮৬২ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন অ্যামেরিকান জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম ওয়ালেচ ক্যাম্পবেল। 

১৯০১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি লিক অবজারভেটরির পরিচালক ছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যায় বর্ণালীবীক্ষণে অসামন্য অবদানের জন্য স্মরণ করা হয় তাঁকে। 




জন্ম ওহাইও অঙ্গরাজ্যে। ১৮৮৬ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায়ই জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ এতে মূলত অবদান সাইমন নিউকমের বই পপুলার অ্যাস্ট্রোনমি। 

পড়াশোনা শেষ করে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপনা শুরু করেন। তবে কিছুদিন বাদেই ফিরে আসেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়ানো শুরু করেন জ্যোতির্বিদ্যা। 

১৮৯১ সাল। তাঁকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয় লিক অবজারভেটরিতে। বর্ণালীবীক্ষণ নিয়ে কাজের জন্য। এখানে এসেই তিনি স্মরণীয় হয়ে ওঠার মতো কাজ শুরু করেন। 


নক্ষত্রের রেডিয়াল বা অরীয় (radial) বেগ বের করা শুরু করেন। অরীয় বেগ মূলত বহির্গ্রহ খুঁজে পাওয়ার একটি পদ্ধতি। পাশাপাশি তুলতে থাকেন সূর্যগ্রহণের ছবি। ১৮৯৩ সালে আবিষ্কার করেন এইচডি ১৮৪৭৩৮ নক্ষত্র। অপর নাম ক্যাম্পবেলের হাইড্রোজেন এনভেলপ স্টার। এটি একটি উলফ রায়েট ধরনের তারা। 

১৯১৪ সালে ক্যাম্পবেল ও জার্মান জ্যোতির্বিদ ফ্রেন্ডলিখ রাশিয়া যান সূর্যগ্রহণের ছবি তুলতে। ফ্রেন্ডলিখ ছিলেন বার্লিন অবজারভেটরির পর্যবেক্ষক। দুজনের উদ্দেশ্য ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পরীক্ষা করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁদের যন্ত্রপাতি রুশ সেনারা কব্জা করে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ দেশ হওয়ায় ক্যাম্পবেল কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। তবে আকাশে মেঘ থাকায় ছবি তোলা সম্ভব হয়নি।

১৯১৮ সালে আবার চেষ্টা চালান। তবে চার বছর আগে রাশিয়ায় ভাল যন্ত্রপাতি রেখে আসতে হয়েছিল। লিক অবজারভেটরিতে থাকা যন্ত্রপাতি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে আইনস্টাইনের পূর্বাভাস অনুসারে আলোর বাঁকের পরিমাপ এখানকার ক্যামেরা দিয়ে মাপ সম্ভব ছিল না। 

এই কাজটাই আর্থার এডিংটন করেন পরের বছর। ১৯১৯ সালে। তবে কিছু কারণে তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি তখনো মেলেনি। চূড়ান্ত ও অকাট্য স্বীকৃতি মেলে ক্যাম্পবেলের ১৯২২ সালের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। লিক অবজারভেটরির পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় সূর্যগ্রহণের ছবি থেকে পাওয়া যায় এ নিশ্চয়তা। 

মহান এ বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয় করুণভাবে। তিনি চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। বয়স হয়েছিল ৭৬। অন্ধত্ব ও বাকশক্তি লোপ পাওয়ার হতাশা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছিলেন। এর মধ্যে আছে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের লাঁলা পদক। পেয়েছেন রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিকেল সোসাইটির স্বর্ণ পদক। চাঁদ ও মঙ্গলের দুটি খাতের নামের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। গ্রহাণু ২৭৫১ ক্যাম্পবেল তাঁর নাম ধারণ করে আছে।
Category: articles

বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

আজ ৮ নভেম্বর। 
১৬৫৬ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ এডমান্ড হ্যালি। 

হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ হিসাব করার জন্যে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত। বলাই বাহুল্য ধূমকেতুটির নামকরণ তাঁর নামেই হয়েছে। একই সাথে তিনি ছিলেন গণিত, ভূ-পদার্থ, আবহাওয়া ও পদার্থবিদ। 

এডমান্ড হ্যালি

জন্ম ৩৬১ বছর আগে। ইংল্যান্ডের লন্ডনের কাছের একটি গ্রামে। বাবা সাবানের ব্যবসা করে ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হ্যালির ঝোঁক ছিল গণিতের দিকে। শুরুতে অধ্যয়ন করেন সেন্ট পলস স্কুলে। ১৬৭৩ সালে চলে আসেন অক্সফোর্ডের কুইনস কলেজে। ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি সৌরজগত ও সৌরদাগ (sunspot) নিয়ে পেপার প্রকাশ করেন। 

সপ্তদশ শতকটি উদীয়মান বিজ্ঞানীদের জন্যে ইংল্যান্ড ছিল খুব অনুকূল জায়গা। লন্ডনের রয়েল সোসাইটি এ শতকেই (১৬৬০) প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যালি তখন ছোট্ট এক শিশু। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এখানে মিলিত হতেন প্রতি হপ্তায়। জন ফ্ল্যামস্টিড ছিলেন প্রথম অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল। 

১৬৭৩ সালে কুইনস কলেজে এসে ফ্ল্যামস্টিডের সাথে সাক্ষাৎ হয় হ্যালির। বিভিন্ন সময়ে ফ্ল্যামস্টিডের সাথে দেখা করে তিনি জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। 

এ সময় ফ্ল্যামস্টিড একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন। উত্তর আকাশের তারাগুলোর একটি তালিকা চাই। তবে খালি চোখে নয়। এত দিনে টেলিস্কোপ চলে এসেছে। হ্যালি ভাবলেন, আমিও একই কাজ করব। তবে উত্তরের বদলে দক্ষিণের আকাশ নিয়ে। 

১৬৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি দক্ষিণে যাত্রা করলেন। চুকিয়ে আসলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠটিও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজে চেপে চলে এলেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। সবচেয়ে কাছের ভূখণ্ড রিও ডি জেনিরো থেকে আড়াই হাজার মাইল পুবে। বাবার অঢেল টাকা থাকায় ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হল না। 

খারাপ আবহাওয়ার কারোণে কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু তবুও তিনি কিন্তু খালি হাতে ঘরে ফেরেননি। ১৬৭৮ সালে ফিরে আসার সময় তাঁর কাছে ছিল ৩৪১ টি তারার তথ্য। পর্যবেক্ষণ করেন বুধ গ্রহের দুর্লভ একটি অতিক্রমণও (transit)। 

তাঁর প্রকাশিত নক্ষত্রের এই ক্যটালগ ছিল একটি বড় সাফল্য। এই ধরনের কাজ এটাই প্রথম। দক্ষিণের নক্ষত্রগুলোকে এর আগে কেউ টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি। জানতে চেষ্টা করেনি তাদের অবস্থান। জ্যোতির্বিদ হিসেবে এটাই হ্যালির প্রথম সাফল্য। একই বছর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। নির্বাচিত হন রয়েল সোসাইটির ফেলো। 

১৬৮৪ সালে আসেন কেমব্রিজে। দেখা হয় নিউটনের সাথে। নিউটন ও রবার্ট হুকসহ রয়েল সোসাইটির কয়েকজন বিজ্ঞানী তখন গ্রহদের গতির ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন। হ্যালিও যোগ দিলেন এই দলে। মজার ব্যাপার হল, অন্য সবার চেয়ে তাঁর বয়স কম। জানার চেষ্টা চলছে কীভাবে ও কেন গ্রহরা সূর্যের চারদিকে ঘোরে। সবাই চাচ্ছিলেন অন্যদের আগে কীভাবে সমাধান বের করে ফেলা যায়। দরকার এমন একটি মডেল যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাবে যে কেন গ্রহরা সূর্য থেকে দূরে ছিটকে যায় না, বা সোজা সূর্যের দিকে চলে যায় না। 

হ্যালি ও হুক এর একটি সমাধান পেলেন। তাঁরা একটি বলের প্রস্তাব করলেন, যেটি একটি গ্রহকে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ধরে রাখবে। এই বল দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে কমবে। এই নিয়মকেই এখন আমরা বিপরীত বর্গীয় সূত্র (inverse-square law) হিসেবে জানি। 

হ্যালি ও হুক ঠিক পথেই ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এর একটি তত্ত্বীয় রূপ তত্ত্ব দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলেন, যা দিয়ে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা যাবে। হ্যালি গেলেন নিউটনের কাছে। তাঁর মতামত তুলে ধরলেন। এও বললেন, যে তিনি বিষয়টি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিউটন হ্যালির কাছ থেকে অনুপ্রেরণ নিলেন। এর জের ধরেই প্রকাশিত হল তাঁর ম্যাথমেটিক্যাল প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল ফিলোসফি, সংক্ষেপে যার নাম প্রিন্সিপিয়া। 

রয়েল সোসাইটি এই প্রবন্ধের সম্পাদনার ভার দিলেন হ্যালিকেই। এর কৃতিত্ব নিয়ে নিউটন ও হুকের দ্বন্দ হ্যালি খুব কৌশলে সমাধান করেন। তিনি এর প্রুফ দেখেন ও লাতিন ভাষায় এর ভূমিকা লিখে দেন। 

হ্যালি আবহাওয়া বিদ্যায়ও অবদান রাখনে। ১৬৮৬ সালে তিনি একটি বিশ্ব মানচিত্র তৈরি করেন। এতে ছিল বিপুল পরিমাণ তথ্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বায়ুগুলো সম্পর্কে এই মানচিত্রে তথ্য ছিল। মনে করা হয়, এটাই আবহাওয়াবিদ্যার প্রথম প্রকাশিত মানচিত্র। 

দুই একটি বিষয়ে অবদান রেখে হ্যালির যেন মন ভরছিল না।  তিনি কাজ করতে লাগলেন বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে। মৃত্যুর হারের সাথে বয়সের সম্পর্ক নিয়েও তিনি কাজ করেন। তাঁর এই অবদান পরে জীবন বিমার জন্যে কাজে লাগে। 

১৭০৪ সালে অক্সফোর্ডে জ্যামিতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর প্রকাশ করেন ধূমকেতু নিয়ে গ্রন্থ- আ সিনোপসিস ইন অ্যাস্ট্রোনমি অফ কমেটস। এতে তিনি ২৪ টি ধূমকেতুর কক্ষপথের বিবুরণ লেখেন। ১৩৩৭ থেকে ১৬৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছিল এই ধূমকেতুগুলো। 

এদের মধ্যে তিনটি ধূমকেতু তাঁর খুব নজর কাড়ে। এগুলো দেখা গিয়েছিল যথাক্রমে ১৫৩১, ১৬০৭ ও ১৬৮২ সালে। তিনি বললেন, এগুলোর মধ্যে এত বেশি মিল দেখা যাচ্ছে যে এরা আসলে একই ধূমকেতু না হয়েই যায় না। আর ফিরে আসে ৭৬ বছর পর পর। এটা ছিল যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত। তিনি পূর্বাভাস দিলেন, ধূমকেতুটি আবার ফিরে আসবে। সালটি হল ১৭৫৮। তিনি বললেন, 
১৪৫৬ সালে... পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে একটি ধূমকেতুকে দেখা গিয়েছিল। অতএব, আমার সিদ্ধান্ত হল, ১৭৫৮ সালে এটি আবারও ফিরে আসবে। 
হ্যালির ধূমকেতু 
১৭২০ সালে হ্যালি ফ্ল্যামস্টিডের স্থলাভিষিক্ত হন। নিয়োগ পান দ্বিতীয় অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল হিসেবে।

তিনি ৮৫ বছর বেঁচে ছিলেন। মারা যান ১৭৪২ সালে। তাঁর পূর্বাভাসকৃত ধূমকেতু ঠিকই পরে দেখা যায়। তবে ১৭৫৮'র বদলে ১৭৫৯। কারণ, ওটা ঠিক ৭৬ বছর ফেরে না। একটু এদিক-ওদিক হয়। সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৬ সালে, আবার ২০৬১ সালে দেখা যাবার কথা রয়েছে। তত দিনে বেঁচে থাকলেও আপনি বুড়ো হয়ে যাবেন। 

হ্যালির ধূমকেতু একবার দেখার পর ভাগ্যক্রমে আবারও দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে যাবেন। 


আরো পড়ুনঃ

সূত্রঃ
১। http://earthsky.org/space/today-in-science-edmond-halley-nov-8-1656
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Edmond_Halley
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Royal_Society
৪। 
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি।

১৯৫৬ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন বিখ্যাত ভারতীয় ও বাঙালি জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি বিজ্ঞানজগতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তাকে সাহা আয়নীকরণ সমীকরণ –এর জনক বলা হয়। তাঁর আবিষ্কৃত এই সমীকরণ নক্ষত্রের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি ব্যাখ্যায় ব্যাবহৃত হয়।

জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা 

মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার কাছে শ্যাওড়াতলী গ্রামে। তখন ঢাকা শহর ব্রিটিশদের শাসনাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গরীব ঘরে জন্ম তার। বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদি দোকানদার। ছেলেবেলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঝুটা কাজের বিনিময়ে থেকে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। অর্থাভাবে বহু প্রতিকূলতার মাঝে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং পরে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন।  কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও জে এন মুখার্জির সহপাঠী ছিলেন।  আর আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন তাঁর শিক্ষক।

তিনি পদার্থের তাপীয় আয়নীকরণ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। এই গবেষণার ফলস্বরূপ তিনি একটি সমীকরণ প্রদান করেন। এটিই সাহা সমীকরণ নামে পরিচিত। তারকাসমূহের বর্ণালি সম্পর্কিত গবেষণার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোনো তারার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিমাপ করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করে কোনো তারকা বা নক্ষত্র গঠনকারী বিভিন্ন উপাদানসমূহের আয়নিত অবস্থা সম্পর্কে তারা অবগত হন।  সৌররশ্মির ওজন ও চাপ নির্ণয়ে সাহা একটি যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম।

এক পরমানুক গ্যাসীয় পদার্থের জন্য সাহা সমীকরণ

শিক্ষাঙ্গনেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে মনোনীত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯২৭ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন। সাহা ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ২১ তম অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার প্রসারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ গড়ে তোলেন। এছাড়াও ১৯৪৯ সালে কলকাতায় ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠাতেও তার অসামান্য অবদান ছিল। পরবর্তীতে তার সম্মানার্থে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় “সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স”।

সাহা Science and Culture নামে  একটি পত্রিকাও চালু করেন ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও তার নেতৃত্বে বেশ কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক সংগঠন গড়ে ওঠে।  এগুলোর মাঝে ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স (১৯৩০), দ্যা ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি (১৯৩৪) ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কালটিভেশন অব সায়েন্স (১৯৪৪ ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতের নদী পরিকল্পনার প্রধান স্থপতি ও দামোদর উপত্যকা প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

এত সাফল্যের পরেও মেঘনাদ সাহার জীবনে কিছুটা অতৃপ্তি ছিল। তিনি যে কখনও নোবেল পুরষ্কার লাভ করতে পারেননি! তবে তিনি বেশ কয়েকবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি ডি এম বোস এবং শিশির কুমার মিত্র কর্তৃক পদার্থবিদ্যায় ১৯৩০ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। নোবেল কমিটি সাহার কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানায়।  তারা তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফলকে “গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটাকে “আবিষ্কার” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। ফলে সেবার তিনি নোবেল পুরষ্কার অর্জনে ব্যার্থ হন। এরপর ১৯৩৭ এবং ১৯৪০ সালে কম্পটন ও ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৩ সালে শিশির কুমার মিত্র পুনরায় নোবেলের জন্য মেঘনাদ সাহাকে মনোনীত করেন। তবে নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় প্রতিবারই তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল।

বিজ্ঞানজগতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি অধরা থাকলেও সমস্ত বাঙ্গালির গর্ব মেঘনাদ সাহা তৎকালীন খ্যাতনামা সকল বিজ্ঞানীর প্রশংসা পেয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন,
Dr. M.N. Saha has won an honored name in the whole scientific world     

সূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়াঃ Meghnad Saha
২। উইকিপিডিয়াঃ মেঘনাদ সাহা 

Category: articles

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি।

১৮৯৮ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিটজ জুইকি।  তাত্ত্বিক ও পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে তিনি বিখ্যাত। বিশেষ করে সুপারনোভার  নামকরণ ও এদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি অবদান রাখেন, যার ফলে পরবর্তীতে মহাবিশ্বের বয়স ও সাইজ পরিমাপ করা সহজ হয়ে যায়।


ফ্রিট্‌জ জুইকি

জুইকির জন্ম বুলগেরিয়ার ভারনা শহরে। বুলগেরিয়াতে জন্মালেও তার বাবা মা দুজনই ছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরক। ৩ ভাই বোনের মাঝে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ১৯০৪ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে তাকে তার পৈত্রিক নিবাস সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যারাসে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি  দাদা দাদির কাছে বড় হতে থাকেন।  প্রথমে পড়াশোনা শুরু করেনবাণিজ্য বিভাগ নিয়ে। পরবর্তীতে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর ফলশ্রুতিতে তিনি সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউটে গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

১৯২৫ সালে সুইজারল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। রকিফেলার ফাউন্ডেশন থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অর্জনের ফলে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকনের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মহাজাগতিক তত্ত্ব নিয়ে  গবেষণা করতে থাকেন। জুইকি সাধারণত একাকী থাকতেই পছন্দ করতেন। এমনকি গবেষণার সময় সমস্ত গাণিতিক হিসাব নিকাশ করতেন নিজে নিজেই।

১৯৪২ সালে তিনি ক্যালটেকের জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত অ্যারোজেট ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের গবেষক দলের পরিচালক বা পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরি ও পালোমার অবজারভেটরি নামক জ্যোতির্বিদ্যার দুইটি বিখ্যাত গবেষণাগারেও কাজ করেন। তিনি বেশ কিছু জেট ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। এদের মধ্যে আন্ডারওয়াটার জেট, ইনভার্টেড হাইড্রো পালস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সনাতন পদ্ধতির এই জেটইঞ্জিনগুলোর আবিষ্কারের ফলে তিনি ৫০টি পেটেন্ট লাভ করেছিলেন।

বিজ্ঞানী হিসেবে জুইকি প্রথমে আয়নিক ক্রিস্টাল ও তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তবে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে করা অনুসন্ধানই তাকে বিখ্যাত করে তোলে।
১৯৩৪ সালে তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষক ওয়াল্টার বাডে সর্বপ্রথম সুপারনোভা শব্দটি ব্যাবহার করেছিলেন। একটি সাধারণ তারকা নিউট্রন তারকাতে রূপান্তরিত হবার মধ্যবর্তী অবস্থাকে তাঁরা সুপারনোভা বলে অভিহিত করেন। তাঁরা সুপারনোভাকে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এই ধারণাটিই মহাবিশ্বের আকার এবং বয়সের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।

আরও পড়ুন
 নিউট্রন তারকা কাকে বলে?

এই স্বীকার্য প্রমানের জন্য জুইকি  সুপারনোভার খোঁজ চালাতে থাকেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সর্বমোট ১২০টি সুপারনোভার সন্ধান পেয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৩৫ সালে তিনি ও বাডে মিলিতভাবে মাউন্টেন টপ অবজারভেটরিতে প্রথম স্মিট (Schmidt) টেলিস্কোপ ব্যাবহার করেছিলেন।

১৯৩৭ সালে জুইকি পূর্বে আবিষ্কৃত আইনস্টাইন ইফেক্টের মাধ্যমে অনুমান করেন, গ্যালাক্সিগুলো মহাকর্ষীয় লেন্স হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। তবে আইনস্টাইন ইফেক্ট আবিষ্কার করা হলেও বিজ্ঞানীরা এটি সম্পর্কে তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলেন না। পরবর্তীতে “টুইন কোয়াসার” পর্যবেক্ষণের দ্বারা তারা আইনস্টাইন ইফেক্টের সত্যতা খুঁজে পান।

১৯৩৩ সালে কোমা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার নিয়ে গবেষণা কালে তিনিই সর্বপ্রথম অদৃশ্যমান বস্তুর অস্তিত্ব নিরূপণে ভিরিয়াল উপপাদ্য (বলবিদ্যার একটি বিশেষ সূত্র) প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি সেই অদৃশ্য বস্তুর নাম দিয়েছিলেন Dunkle Materie। একেই বর্তমানে আমরা ডার্ক ম্যাটার বলে চিনি। তিনি ক্লাস্টারের মাঝে থাকা গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষীয় ভর পরিমাপ করেন এবং দেখেন এই ভরের মান গ্যালাক্সিগুলোর ঔজ্জ্বল্য অনুসারে অনুমিত ভরের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। এর অর্থ দাঁড়ায়, মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থানই ডার্কম্যাটার দ্বারা পূর্ণ। বর্তমানে দৃশ্যমান ও আলোকিত পদার্থসমূহের ভরের মান বৃহৎ বিবেচনা করে হিসাব করার ফলে এই ফলাফলের কিছুটা এদিক-ওদিক হয়েছে। তবে তার এই ধারণাটি এখন পর্যন্ত সঠিক বলেই গৃহীত হয়।

জুইকির আবিষ্কৃত গ্যালাক্সি আইজুইকি১৮এ। ছবিটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা। 


নিউট্রন স্টার আবিষ্কারের পর জুইকি নিউক্লিয়ার গব্লিনের  ধারণা প্রদান করেছিলেন। তার প্রস্তাবনা অনুসারে, গব্লিন একটি তারার মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে চলাচল করতে পারে। তবে তারাটির অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের অঞ্চলে পৌঁছানো মাত্রই এটি বিস্ফোরিত হয়। নক্ষত্রের বিস্তারন সহ উদ্গীরনজাত বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যায় তাঁর এই অনুমান যথেষ্ট কাজে লেগেছিল। এছাড়াও তিনি কৃত্রিম উল্কাপিণ্ড তৈরি করতে সমর্থ হন।

মহাকাশ গবেষণায় অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতিসরূপ তার নামে একটি গ্রহাণু (১৮০৩ জুইকি) ও চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি বড় গর্তের (জুইকি) নামকরণ করা হয়। এছাড়াও ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় রকেট পরিচালনায় অসামান্য অবদান রাখায় তাকে ১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে তাকে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির এমিরেটাস অধ্যাপক বানানো হয়। ১৯৭২ সালে তাকে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিদদের জন্য এটিকেই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞানী হিসেবে জুইকি সকলক্ষেত্রে সফলতার স্বাদ পেলেও পারিবারিক জীবন ততটা মসৃণ ছিল না।  ১৯৩২ সালের এপ্রিলে তিনি এগবার্ট গেটস নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী সিনেটরের কন্যা ডোরোথি ভারনান গেটসকে বিয়ে করেন। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের চাচাতো ভাই নিকোলাস রুজভেল্ট এগবার্টের আরেক মেয়ে তিরজাহ গেটসকে বিয়ে করেছিলেন। ফলে বিবাহসূত্রে জুইকি আর নিকোলাসের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। অপরদিকে ডোরোথিকে বিয়ে করায় তিনি বেশ ভালো অর্থ উপঢৌকন হিসেবে লাভ করেন। ১৯৩০ সালের দিকে আর্থিক মন্দার সময় পালোমার অবজারভেটরির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তিনি এই অর্থ ব্যয় করেন।

তবে ১৯৪১ সালে ডোরোথি ও জুইকি তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টানেন এবং আপোষের মাধ্যমে পরস্পর আলাদা হয়ে যান। ১৯৪৭ সালে সুইজারল্যান্ডে অবস্থানকালে জুইকি অ্যানা মারগারিটা যার্চার নামক এক মহিলাকে পুনরায় বিবাহ করেন। পরবর্তীতে জুইকি ৩ কন্যা সন্তানের বাবা হন। তার সন্তানদের নাম ছিল মারগারিট, ফ্রাঞ্জিস্কা ও বারবারিনা।

সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যারাসে জুইকির নামে একটি জাদুঘর (জুইকি মিউজিয়াম) স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে তার বিভিন্ন গবেষনাপত্র ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর এই প্রথিতযশা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনা শহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সুইজারল্যান্ডের মলিসে তাকে সমাহিত করা হয়।

সূত্র
১।  উইকিপিডিয়া
২।  ফেমাস অ্যাস্ট্রোনোমারস ডট অরগ
Category: articles

বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৬

আজ ১৯ অক্টোবর।
১৯১০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশীয়- মার্কিন জ্যোতির্পদার্থবিদ সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর।

তিনি নক্ষত্রের বিবর্তন ও তাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে গবেষণার জন্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। ভারী নক্ষত্রদের জীবনের শেষের দিকের অবস্থা নিয়ে তিনি বিশেষভাবে কাজ করেছেন. হিসাব করে বের করেছেন চন্দ্রশেখর সীমা (Chandrasekhar limit)। এই সীমা হচ্ছে শ্বেত বামন নক্ষত্রদের সর্বোচ্চ ভরের পরিমাপ। ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফাউলারের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বহু তাত্ত্বিক বিষয়ে অবদান রাখলেও তাঁর নোবেল পেতে ভূমিকা রেখেছে তাঁর প্রাথমিক জীবনের কাজগুলোই।
চন্দ্রশেখর 
পুরো নাম পদ্ম বিভূষণ সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর। ১৯১০ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে লাহোরের (বর্তমান পাকিস্তান) একটি তামিল হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান রেলওয়ের হিসাবরক্ষক। পাশাপাশি ছিলেন ভায়োলিন ও মিউজিকোলজিস্ট। মাও ছিলেন শিক্ষিতা মহিলা। বলা হয় তাঁর মা-ই প্রথম জীবনে তাঁর মধ্যে জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করেন। অন্য দিকে তাঁর চাচা চন্দ্রশেখর ভেংকট রমনও ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ, যিনি আলোর বিক্ষেপণ ও রমন ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্যে ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।

প্রাথমিক জীবনে চন্দ্রশেখর বাসায় বসেই পড়াশোনা করতে থাকেন। পরবর্তীতে মাদ্রাজের কাছে হিন্দু হাই স্কুলে ভর্তি হন। এখানে ১৯২২ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কাটিয়ে দেন। গুণধর চাচার পথ অনুসরন করে এরপরে চলে আসেন মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে কাটান ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ সালা নাগাদ। ১৯৩০ সালে অর্জন করেন বিএসসি ডিগ্রি। একাডেমিক সাফল্যের কল্যাণে ভারতীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন ট্রিনিটি কলেজে। এখানে র‍্যালফ ফাউলারের রিসার্স সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। আরেক ক্যামব্রিজ প্রফেসর পল ডিরাকের পরামর্শে এক বছর কাটিয়ে আসেন কোপেনহেগেনে। এখানে তিনি ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স প্রতিষ্ঠানে নিলস বোরের সাথে কাজ করার সুযোগ পান।

১৯৩৩ সালেই ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি পেয়ে যান। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ট্রিনিটি কলেজে প্রাইজ ফেলোশিপ পদে নির্বাচিত থাকেন। এ সময়েই তাঁর সাথে পরিচয় হয় জ্যোতির্পদার্থবিদ স্যার আর্থার এডিংটন ও আর্থার মিলনের সাথে। ১৯৩৬ সালে বিয়ে করেন ললিতা দোরাইস্বামীকে। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁরা এক সঙ্গেই কাটিয়ে দেন।

সবচেয়ে বড়ো সাফল্যটি সম্ভবত চন্দ্রশেখর তাঁর প্রথম জীবনেই পেয়ে যান। তখন তিনি ট্রিনিটি কলেজের তরুণ ফেলো। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি 'চন্দ্রশেখর লিমিট' সম্পর্কে অনেকগুলো পেপার প্রকাশ করেন। কাজ শুরু করেন তাঁর গুরু র‍্যালফ ফাউলারের করা কাজ থেকে। ইলেকট্রন ডিজেনারেসি প্রেসারের কারণে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ ভরের অঘূর্ণনশীল বস্তু মহাকর্ষের কারণে গুটিয়ে যাওয়া থেকে নিস্তার পেতে পারে তা তিনি হিসাব করেন। এই সীমাই হচ্ছে শ্বেত বামন নক্ষত্রের সর্বোচ্চ ভর। অন্য কথায়, এটিই হচ্ছে সর্বোচ্চ ভর, যা অতিক্রম করে গেলে একটি নক্ষত্র শ্বেত বামন না হয়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোল হয়ে যাবে। তিনি হিসাব করে এই ভর পেলেন ১.৪৪ সৌর ভরের সমান (সূর্যের ভরের ১.৪৪ গুণ)।

তিনি প্রথম তাঁর চন্দ্রশেখর সীমা প্রকাশ করলে আর্থার এডিংটন এর তীব্র বিরোধীতা করেন। আইনস্টাইনও মানতে অস্বীকার করলেন যে চন্দ্রশেখরের প্রাপ্ত ফলাফলের কারণে কোনো নক্ষত্র গুটিয়ে একটি বিন্দুর সমান (ব্ল্যাক হোল) হয়ে যেতে পারে। ইউরোপের কোনো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীই চন্দ্রশেখরের কথা আমলে নিলেন না। এর প্রধান কারণ, এডিংটনের মতো বিজ্ঞানী যে মতের বিরোধীতা করেছেন তা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি কিঞ্চিত হতাশ হলেন। এও বুঝলেন, কোনো ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী পোস্ট পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।

তাই ১৯৩৭ সালে যখন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহকারী অধ্যাপক পদের প্রস্তাব পেলেন, আর অপেক্ষা করলেন না। ক্যামব্রিজ ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়। পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়ে দেন এখানেই- পুরো ৫৮ বছর। ১৯৪২ সালে হন সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৪৪ সালে পূর্ণ অধ্যাপক। ১৯৪৭ সালে তাঁকে থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর বানানো হয়। ১৯৮৫ সালে হন এমেরিটাস প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়েরকিস পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে তিনি কিছু কাজ করেন। নাসার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অ্যান্ড স্পেইস ল্যাবেও করেন কিছু কাজ। এই ল্যাবটি ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মেরিল্যান্ডের ব্যালিস্টিক রিসার্চ ল্যাবে কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে আমেরিকার নিয়মিত নাগরিক হন।

চন্দ্রশেখরের জীবনকে কিছু সুনির্দিষ্ট পর্বে ভাগ করা যায়। এর প্রতিটি পর্বে তিনি একটি বই বা মনোগ্রাফ লিখেছেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত গবেষণা করেন নক্ষত্রের গঠন নিয়ে। বিষেশভাবে কাজ করেন শ্বেত বামন (White dwarf) নক্ষত্রদের নিয়ে। এই গবেষণাকে কেন্দ্র করেই ১৯৩৯ সালে লিখেন অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অব স্টেলার স্ট্রাকচার বইটি।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত মেতেছিলেন নক্ষত্রের ডাইন্যামিক্স বা গতিবিদ্যা (Stellar dynamics) নিয়ে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয় বই প্রিনসিপালস অব স্টেলার ডাইন্যামিক্স। এরপর নজর দেন বিকিরণগত স্থানান্তরের দিকে (Radiative transfer)। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত কাজ করেন হাইড্রোজেনের ঋণাত্মক আয়নের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে। ১৯৫০ সালে লিখেন আরেকটি বই, রেডিয়েটিভ ট্রান্সফার
১৯৫০ থেকে ১৯৬১ সাল নাগাদ কাজ করেন হাইড্রোডাইন্যামিক ও হাইড্রোম্যাগনেটিক স্টেবিলিটি নিয়ে। এ শিরোনামেই ১৯৬১ সালে বইও প্রকাশ করেন। ১৯৬০ এর দশকে কাজ করেন ইলিপসয়ডাল ফিগারের সাম্যবস্থা নিয়ে। উপবৃত্তের (Ellipse) ত্রিমাত্রিক অবস্থাকে ইলিপসয়েড বলে। এ নিয়ে প্রকাশিত তাঁর বইটি হল ইলিপসয়ডাল ফিগারস অব ইকুলিব্রিয়াম। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে।তিনি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছেন।
১৯৭১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন ব্ল্যাক হোলের গাণিতিক তত্ত্ব নিয়ে। ১৯৮৩ সালে এ নিয়েও বই লিখেন। আগের মতোই গবেষণার বিষয়বস্তুর সাথে বইয়ের নামের দারুণ মিল, দি ম্যাথমেটিক্যাল থিওরি অব ব্ল্যাক হোলস। আশির দশকের শেষের দিকে কাজ করেন মহাকর্ষ তরঙ্গের উপরিপাতন নিয়ে।
আরো পড়ুনঃ
☛ ব্ল্যাক হোলের গভীরে
☛ মহাকর্ষ তরঙ্গঃ কী, কীভাবে?

১৯৪৪ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এর সম্মানসূচক সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।
সারা জীবনে অনেকগুলো প্রাইজ ও পদক পেয়েছেন তিনি। ১৯৫২ সালে পান ব্রুস মেডাল। ১৯৫৩ সালে পান রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোয়াসিটির গোল্ড মেডাল। ১৯৬৭ সালে তাঁকে সম্মানীত করা হয় ন্যাশনাল মেডাল অব সায়েন্স দিয়ে। ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৭১ সালে হেনরি ড্রেপার এবং ১৯৮৪ সালে কোপলে মেডাল অব রয়েল সোসাইটি পদক লাভ করেন।
১৯৮৩ সালে পান ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ। তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করলেও একটু মন খারাপ করেন। এর কারণ হল, অবদান হিসেবে শুধু তাঁর প্রথম জীবনের কিছু কাজকেই বিবেচনা করা হয়েছে। নক্ষত্রের বিবর্তন ও গঠন প্রক্রিয়ার ভৌত প্রসেস নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণাকে তাঁর অবদান হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, এতে করে তাঁর বাকি সব গবেষণাকে খাটো করা হয়েছে। আসলেও তাই মনে হবার কথা।
১৯৯৫ সালের ২১ আগস্ট তারিখে তিনি হৃদযন্ত্রের সমস্যার কাছে হার মেনে পরলোকে পাড়ি জমান। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৮৪ বছর। তখনো তাঁর স্ত্রী বেঁচে ছিলেন, যিনি ১০২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকেন।
-০-
পরিভাষাঃ
মনোগ্রাফঃ একটি বিশেষায়িত বিষয় বা তার একটি অংশ নিয়ে গবেষণার বিস্তারিত লিখিত রূপ।

সূত্রঃ
১। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_chandrasekhar.html
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Subrahmanyan_Chandrasekhar
Category: articles

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬

আজ ৭ অক্টোবর। ১৮৮৫ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ নিলস বোর। ড্যানিশ এই পদার্থবিজ্ঞানীর কল্যাণেই পরমাণুর মৌলিক গঠন উদঘাটিত হয় এবং ভিত্তি স্থাপিত হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর

বিশেষ করে তিনি পরমাণুর জন্যে বোর মডেল প্রস্তুত করেন। পরে আবার তৈরি করেন লিকুইড ড্রপ মডেল। কোপেনহেগেন থাকার সময় অসংখ্য পদার্থবিদ তাঁর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেতেন। একত্রে কাজও করেছেন অনেকের সাথে। এখানে থাকা অবস্থায়ই হাইজেনবার্গের সাথে মিলে তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen interpretation) তৈরি করেন। বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এই বিজ্ঞানী ১৯২২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, পরমাণুর গঠন ও তা থেকে নির্গত বিকিরণ নিয়ে গবেষণার জন্যে।

নিলস বোর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৮৮৫ সালের ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। বোরের বাবা একজন অধ্যাপক ছিলেন এবং কোপেনহেগেনের সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোর মাঝে বোরের পরিবার ছিল অন্যতম। বোরের পরিবারের সবাই ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁর ছোট ভাই হ্যারাল্ড বোরও পরবর্তীতে একজন দক্ষ গণিতবিদ হয়েছিলেন। বোরের বাবার কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর করাতে বাল্যকালে বোর কিছুটা সুবিধা পেয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে তিনি বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও দর্শনে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯০৫ সালে বোর তরলের পৃষ্ঠটানের উপর একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, যা সবার মনোযোগ কাড়ে। তিনি পুরস্কৃতও হন এর জন্যে। এর পরেই বোর গণিত ও দর্শন ছেড়ে ঢুকে পড়েন পদার্থবিদ্যার জগতে। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯১১ সালে বোর তাঁর ডক্টরেট থিসিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তী গবেষণার জন্য ডেনমার্ক ছেড়ে বোর ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকেই তাঁর চমক দেখানোর শুরু।

চাপা স্বভাবের বোর ছোটবেলায় ভাষা শিখতে অনেক দেরী করে ফেলেছিল বলে ড্যানিশ ভাষা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেননি। আবার পড়ালেখার জন্য ইংরেজী শিখলেও ইংরেজী ভাষার শব্দ জ্ঞান তাঁর ছিল খুব সীমিত। ইংল্যান্ডে আসার পর ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্যার জে.জে. থমসনের অধীনে গবেষণা শুরু করলেও তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। থমসনের উদাসীনতা বোরকে ভীষণভাবে হতাশ করলেও ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের সঙ্গ বোরকে অনেক উৎসাহ- অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে মহান শিক্ষক রাদারফোর্ডের অধীনে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে বোর গবেষণা শুরু করেন।

ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে থাকাকালীন আইসোটোপ, তেজস্ক্রিয়তার ভাঙন সুত্র এবং পর্যায় সারণী নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেন। ১৯১১ সালে আলফা- কণা বিক্ষেপণের ফলাফলের উপর নির্ভর করে রাদারফোর্ড তার পরমাণু মডেল প্রকাশ করলে এতে অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বোর সেগুলোর কয়েকটি সমাধান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, তিনি রাদারফোর্ডকে তা বোঝাতে অক্ষম হন। ১৯১২ সালে বোর কোপেনহেগেনে ফিরে আসেন এবং জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি মার্গ্রেথকে বিয়ে করেন। বোর- মার্গ্রেথ দম্পতির পরবর্তীতে ৬টি সন্তান- সন্তুতি হয়েছিল, যাদের মাঝে ২ জন নাবালক অবস্থায় মারা গেলেও বাকি ৪ জন পিতার মতোই বিভিন্ন শাখায় দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তন্মধ্যে, বোরের সন্তান অউ নিলস বোর ১৯৭৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

১৯১২ সালের গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটানোর সময় বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল থেকে চিরায়ত বলবিদ্যাকে বিদেয় করে তাতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করেন। তার স্ত্রী মার্গেথ এই সময় বোরকে তার গবেষণাপত্র (scientific paper) তৈরিতে খুব সহায়তা করেন। বোরের গবেষণাপত্রগুলো মূলত তার স্ত্রী মার্গেথেরই লেখা। মার্গেথ তার স্বামীর কথা বোঝার চেষ্টা করতেন এবং তা লিখে রাখতেন। ১৯১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বোর পরমাণু সম্পর্কে এমন ৩টি অনুমান করেন, যা দ্বারা রাদারফোর্ডের অস্থায়ী পরমাণু, পরমাণুর ভৌতিক(?) বর্ণালীসহ নানা সমস্যা সমাধান করা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বোরের সেই অমর কর্ম- ‘পরমাণুতে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধে ঘুরতে পারে না, শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট অনুমোদিত(কোয়ান্টায়িত) কক্ষপথেই ঘুরে’ এই সময়েই প্রকাশ পায়। বোরের দেওয়া পরমাণুর এই চিত্র বোরের কোয়ান্টাম পরমাণু মডেল নামে পরিচিত।

১৯২১ সালে বোর কোপেনহেগেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের বাকি সময় তিনি এর পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৬- ২৭ সালে এই সমিতিতেই হাইজেনবার্গ বোরের অধীনে কাজ করেন এবং প্রদান করেন তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূতিকাগার ছিল মূলত তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সমিতিটিই। আলোর দ্বৈত ধর্ম, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বোরের এই সমিতির অবদান অনস্বীকার্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানি ডেনমার্ক আক্রমণ করলে বোর এর প্রতিবাদ করেন এবং নাৎসিবিরোধি মনোভাবের কারণে জার্মানদের রোষানলে পড়েন। ১৯৪৩ সালে বোর দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং সুইডেন হয়ে ইংল্যান্ড গমন করেন। এইসময় বোর নিউক্লিয়ার ফিশান এবং ইউরেনিয়াম- ২৩৫ নিয়ে কাজ করেন। তিনি সারাজীবনই পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে আমেরিকায় ম্যানহাটন প্রজেক্টে ধীরে ধীরে তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং আণবিক বোমা তৈরির এই প্রকল্পে একজন সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে পদোন্নতি পান। এইসময় বোর ছদ্মনাম হিসেবে নিকোলাস বেকার নাম গ্রহণ করেন। তবে বোর আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েতের সাথে প্রকাশ্যে আলাপ চালাতে শুরু করেন পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহার রোধের জন্য। এই কারণে বোরকে নিরাপত্তার ঝুঁকি মনে করে আমেরিকা থেকেও বের করে দেয়া হয়।

বোর ১৯৪৭ সালে বীরের বেশে দেশে ফিরে আসেন। তাকে ডেনমার্কের সর্বোচ্চ পদক অর্ডার অব দি এলিফ্যান্ট প্রদান করা হয়। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি রয়্যাল ড্যানিশ একাডেমির সভাপতি ছিলেন। শেষ বছরগুলোতে বোর তার গবেষণা বন্ধ করে দিলেও নিউক্লিয়ার শক্তির অপব্যবহার রোধে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। ১৯৫০ সালে জাতিসংঘে শান্তির পক্ষে তার খোলা চিঠিটি তার শান্তি আন্দোলনে স্মরণীয় একটি পদক্ষেপ।

বোর কোপেনহেগেনেই ১৯৬২ সালের ১৮ নভেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। নিলস বোরের স্ত্রী মার্গ্রেথ আরো প্রায় ২০ বছর জীবিত ছিলেন।

নিলস বোরের পরমাণু ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর কাজ বিজ্ঞানের সকল শাখায় যে কত বড় অবদান রেখেছে তা কল্পনাতীত। আইনস্টাইনের একটা উক্তির অংশবিশেষ দিয়েই শেষ করছি।
'বোর  না থাকলে পরমাণু সম্পর্কে যে আমরা কতটুকু জানতে পারতাম তা কেউই জানে না।' 
তাঁর ছাত্র থাকাকালীন সময়ের একটি মজার কাহিনী পড়ুন এখানে।

সূত্রঃ
১। http://www.famousscientists.org/niels-bohr/
২। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_bohr.html
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর। ১৯০১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইতালীয় পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি।

তিনি তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণভিত্তিক পদার্থবিদ্যা- এই দুটোতেই সমানে অবদান রেখে গেছেন। বর্তমান যুগে যেখানে একের অধিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা কঠিন, তাতে তাঁর এই অবদান তাঁকে একটু বিশেষভাবে নজরে আনার জন্যে যথেষ্ট। নিউক্লীয় চুল্লির (nuclear reactor) উন্নতি সাধনের জন্যে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এছাড়াও তিনি মাথা কাজে খাটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব, কণা পদার্থবিদ্যা ও পরিসংখ্যান বলবিদ্যায়ও। ১৯৩৮ সালে তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি 

১৯০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি ইতালির রোম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলবার্তো ফার্মি ছিলেন দেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান পরিদর্শক। ছোট বেলায় যোগ দেন স্থানীয় গ্রামার স্কুলে। অল্প বয়স থেকেই গণিতের প্রতি অনুভব করতেন তীব্র ভালোবাসা। এতে ঘি ঢেলে দেন তাঁর পিতার এক সহকর্মী। ১৯১৮ সালেই ইতালির বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এসএনএস থেকে ফেলোশিপ লাভ করেন। এটি বর্তমানেও ইতালির এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২২ সালে এখান থেকে পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

এর অল্প কয় দিন পরেই, ১৯২৩ সালে ইতালীয় সরকারের পক্ষ থেকে বৃত্তি অর্জন করেন। কয়েক মাস সময় কাটান আরেক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাক্স বর্ন এর সাথে। ১৯২৪ সালে রকফেলার ফেলোশিপ নিয়ে চলে আসে লেইডেন (হল্যান্ড)। কাজ করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল এহরেনফেস্ট এর সঙ্গে। সে বছরই আবার ফিরে আসেন ইতালিতে, যোগ দেন ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ও বলবিদ্যার প্রভাষক হিসেবে।

১৯২৬ সালে তিনি পরিসংখ্যানের একটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যা বর্তমানে 'ফার্মি পরিসংখ্যান' নামে পরিচিত। যেসব কণিকা পাউলির বর্জন নীতি (Pauli's exclusion principle) মেনে চলে তাদের জন্যে প্রযোজ্য তাঁর এই সূত্র। তাঁর নাম থেকেই বর্তমানে এই কণিকাদের নাম হয়েছে ফার্মিয়ন। এরা হল বোসন কণিকাদের বিপরীত, যারা মেনে চলে বোস- আইনস্টাইন পরিসংখ্যান।

পরের বছর, অর্থ্যাৎ ১৯২৭ সালে তিনি রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক মনোনীত হন। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এই পদটি ধরে রাখেন তিনি। সে বছরই নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন, আর ইতালির একনায়ক মুসোলিনির হাত থেকে বাঁচতে রোম ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকা।

রোমে থাকার সময় তড়িৎগতিবিদ্যার বিভিন্ন সমস্যা ও বর্ণালী বিষয়ক তাত্ত্বিক গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। বহিঃস্থ ইলেকট্রনদের ছেড়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নজর দিয়েই পেয়ে গেলেন বিশেষ কিছু। ১৯৩৪ সালে বিটা ক্ষয় তত্ত্বের উন্নতি সাধন করলেন। এর মাধ্যমে পূর্বের বিকিরণ তত্ত্বের সাথে পাউলির নিউট্রিনোর ধারণার সেতুবন্ধন ঘটল। ১৯৩৪ সালে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পর তিনি দেখান যে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে যে কোনো নিউক্লিয়াসকে অন্য নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত করা যায়। এই ধারণার উপর ভর করেই একই বছর আবিষ্কৃত হয় ধীর নিউট্রন, যার ফলে পরে আবিষ্কৃত হয় নিউক্লিয়ার ফিসান বা ভাঙন (যেখানে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে দুই বা তার অধিক নিউক্লিয়াস তৈরি হয়)। সে সময় পর্যন্ত পর্যায় সারণিতে যে মৌলগুলো ছিল তার বাইরেও মৌল তৈরি সম্ভব হয় এর ফলেই।

১৯৩৮ সালের দিকে তিনিই ছিলেন নিউট্রন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। আমেরিকা ফিরে এসেও তিনি এই বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখেন। এখানে এসে যোগ দেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে।

১৯৩৯ সালে হান ও স্ট্রাসম্যান ফিসান প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। এটা থেকে তাঁর মাথায় আসে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে চেইন বা শৃঙ্খল বিক্রিয়া পরিচালনা করা যায়। পরমাণু বোমা তৈরির সময় বিভিন্ন সমস্যা সমধানেও তিনি কাজ করেন। তিনি ছিলেন ম্যানহাটন প্রোজেক্টের এক দল পদার্থবিদের অন্যতম নেতা, যেখানে নিউক্লীয় শক্তি ও পরমাণু বোমা নিয়ে কাজ হচ্ছিল। এসব অবদানের জন্যে তাঁকে নিউক্লীয় যুগ ও পরমাণু বোমার স্থপতি বলা হয়।

১৯৪৪ সালে তিনি আমেরিকার নাগরকিত্ব লাভ করেন। যুদ্ধের পর (১৯৪৬ সালে) শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। ১৯৫৪ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এখানেই থাকেন। এখানে তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল উচ্চ- শক্তির পদার্থবিদ্যা। এছাড়াও তিনি পাইওন- নিউক্লিয়ন গবেষণায়ও নেতৃত্ব প্রদান করেন।

জীবনের শেষের দিনগুলো ব্যয় করেন মহাজাগতিক রশ্মির রহস্যময় উৎস নিয়ে। প্রস্তুত করেন একটি তত্ত্ব।

সব মিলিয়ে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণভিত্তিক পদার্থবিদ্যার উপর অনেকগুলো গবেষণাপত্র লেখেন তিনি। প্রভাষক হিসেবে তাঁর চাহিদা সব সময়ই ছিল বেশি। মিশিগান, স্ট্যানফোর্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি বিভিন্ন কোর্স নিতেন।

১৯২৮ সালে তিনি লরাকে বিয়ে করেন। তাঁদের গিওলিও নামে একটি ছেলে ও নেলা নাম্নী একটি মেয়ে ছিল। হাঁটাহাঁটি, পাহাড়ে চড়া ও শীতকালের বিভিন খেলাধুলা ছিল তাঁর অবসরের প্রিয় কাজের মধ্যে অন্যতম।
১৯৫৪ সালের ২৮ নভেম্বর তারিখে তিনি এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারের উদ্দেশ্যে।

তথ্য সূত্রঃ
১। http://www.nobelprize.org/nobel_prizes/physics/laureates/1938/fermi-bio.html
২। http://www.famousscientists.org/enrico-fermi/

Category: articles

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর। ১৯৩০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদের বুকে অবতরণ করা অন্যতম মার্কিন নভোচারী জন ইয়ং। আজ তাঁর ৮৫ তম জন্মবার্ষিকী।

অ্যাপোলো- ১০ অভিযানের সময় ইয়ং 

১৯৬৯ সালের অ্যাপোলো- ১১ মিশনে নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের চাঁদে অবতরণ নিয়ে নানান মুখরোচক গল্প ও বিতর্ক আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে। এই বিতার্কিকদের খুব বড়সড় একটা অংশ এটা মনেই রাখেন না যে এই দু'জন ছাড়াও '৬৯ পরবর্তী ৩ বছরে আরও পাঁচটি অ্যাপোলো মিশনে উপরের দুইজন ছাড়াও আরও ১০জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি চাঁদের বুকে পা রেখেছেন এবং লুনার রোভারও চালিয়েছেন।

ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি হলেন অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান নভোচারী ক্যাপ্টেন জন ইয়ং। তিনি নবম ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল চাঁদে অবতরণ করেন। তিনদিন চাঁদের বুক চষে তিনি এবং তাঁর টিম ৯৫.৭১ কে.জি. নমুনা সংগ্রহ করে ২৪ এপ্রিল তারিখে চাঁদের বুক ত্যাগ করে চাঁদের কক্ষপথে ফিরে আসেন। অ্যাপোলো- ১৬ এর এই অভিযানে তিনি ছিলেন মিশন কমান্ডার। এই মহান ব্যক্তি তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ছিলেন একাধারে নৌ-অফিসার, নভোচারী, বিমান প্রশিক্ষক ও অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

তাঁর নামের আগে ঘটা করে "মহান" বলার কিঞ্চিৎ রহস্য আছে। কারণ তিনি অনেক দিক থেকেই পৃথিবীর মানুষদের মাঝে প্রথম এবং একমাত্র! চলুন সংক্ষেপে তার ছোট্ট (!) ক্যারিয়ার থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসি।

নৌবাহিনীতে চাকরীর শেষভাগে এসে ক্যাপ্টেন জন ইয়ং ১৯৬২ সালে নাসায় যোগ দেন। এ সময় তিনি "অ্যাস্ট্রোনাট গ্রুপ-২" এ ছিলেন, যেখানে নিল আর্মস্ট্রংও একই গ্রুপের অধীন ছিলেন। পরবর্তীতে ইয়ং ১৯৬৫ সালে "প্রথম" মনুষ্যবাহী অভিযান জেমিনাই মিশনে অংশ নেন এবং তার পরের বছরের "জেমিনাই মিশনের" কমান্ডার হন। এবারও আরেকদিক থেকে তিনি "প্রথম" হলেন। এবার তিনি অভিযুক্ত হলেন "প্রথম স্পেস স্মাগলার" হিসেবে!! মজার ঘটনা হল, সেবার তিনি ভুট্টা আর মাংসের তৈরী একটা স্যান্ডুইচ স্মাগলিং করেছিলেন। এজন্য অবশ্য তাকে কম মূল্য দিতে হয়নি। ফলস্বরূপ পরবর্তী কয়েকটি ফ্লাইটে তিনি আর অংশ নিতে পারেননি।

নাসা অবশ্য চতুর এই পাইলটকে নিয়ে কী করা যায় যে ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিল। কারণ তিনি অন্যদের তুলনায় ছিলেন অনেক মেধাবী এবং সাহসী। তাই তাঁকে আবারও স্পেস প্রোগ্রামের আওতায় আনা হল, তবে কিছুদিন পর।

এবার ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো- ১০ মিশনে তিনি অংশ নেন এবং "প্রথম" ব্যক্তি হিসেবে একা চাঁদের কক্ষপথ আবর্তন করেন। ১৯৬৯ সালের ২৬ মে তারিখে পৃথিবীতে ফেরার সময় ইয়ং এর অ্যাপোলো- ১০ অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে (ঘন্টায় প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার বেগে) ছুটে চলে আরও একটি রেকর্ড করে। এবং এটাই ছিল মনুষ্যবাহী যে- কোনো যানের পক্ষে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা।

পরবর্তীতে ইয়ং ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো- ১৬ মিশনে অংশ নেন। এ সময় তিনি মিশন কমান্ডার ছিলেন। তিনি এবং তাঁর দল ১৯ এপ্রিল চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেন এবং ২১ এপ্রিল তিনি নবম ব্যক্তি হিসেবে চাঁদে অবতরণ করেন। এরই সাথে এবারই প্রথমবারের মত তিনি চাঁদের বুকে পা রাখেন। ২১ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এবং ডিউক  চাঁদের বুকে ৭১ ঘন্টা থাকেন।

এর মাঝে প্রথম দিন ৭ঘন্টা ১১মিনিট ২ সেকেন্ড , দ্বিতীয় দিন ৭ঘন্টা ২৩ মিনিট ৯ সেকেন্ড এবং তৃতীয় দিন ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ৩ সেকেন্ড সহ তিন দিনে মোট ২০ ঘন্টা ১৪ মিনিট ১৪ সেকেন্ড তাঁরা চাঁদের বুকে হেঁটে বেড়ান। এসময় ইয়াং চাঁদের বুকে "লুনার রোভিং ভেহিকল" নামক চন্দ্রযানও চালান। এই চন্দ্রযান দিয়ে তিনি চাঁদের বুকে ২৬.৭ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরেও বেড়ান। চাঁদ থেকে ফেরার সময় তিনি এবং তার সহযোগী ডিউক মিলে পৃথিবীর জন্য ৯৫.৮ কে.জি. চাঁদের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন।

ক্যাপ্টেন জন ইয়ং সেই তিনজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির মাঝে একজন , যাঁরা দুবারের মত চাঁদ-ভ্রমণ করেন। পরবর্তীতে ইয়ং ১৯৮১ সালে "স্পেস শাটল"এর প্রথম যাত্রাসহ দুইবার "স্পেস শাটল ফ্লাইট" এর কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন "অ্যাস্ট্রোনাট অফিস" এর প্রধান। তিনি ২০০৪ সালে নাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৪২ বছর নাসাতে কর্মরত অবস্থায় তিনি ছয়টি স্পেস ফ্লাইটে অংশ নেন এবং তিনিই "একমাত্র" নভোচারী যিনি এত্তবছর যাবত নাসায় সক্রিয় ভাবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি আরও অনেকদিক থেকেই একমাত্র! যেমন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যার নভোচারী এবং কমান্ডার হিসেবে চারটি ভিন্ন ধরণের মহাকাশযান (১. জেমিনাই, ২. অ্যাপোলো কমান্ড/ সার্ভিস মডিউল, ৩. এপোলো লুনার মডিউল এবং ৪. স্পেস শাটল) চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দীর্ঘ ৪২ বছর নাসায় কাজ করে ২০০৪ এর ডিসেম্বরের শেষ দিন তিনি অবসর নেন। ২০১২ সালে তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ফরএভার ইয়ং প্রকাশ করেন।

তথ্যসূত্রঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/John_Young_(astronaut)
২। http://www.space.com/20690-john-young-astronaut-biography.html
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আজ ২২ সেপ্টেম্বর। ১৭৯১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান শিক্ষা বা বিজ্ঞান চর্চা শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকত। নিম্নবিত্ত- দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা বিজ্ঞানচর্চায় অংশ নিতে পারত না। মাইকেল ফ্যারাডে সেই সময়ের একজন বিজ্ঞানী। তিনিও উঠে এসেছিলেন খুব দরিদ্র একটি পরিবার থেকে। তবুও তিনি সকল প্রতিকূলতা জয় করে হয়েছিলেন একাধারে জগদ্বিখ্যাত ব্যবহারিক পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং প্রকৃতি বিষয়ক দার্শনিক। তাঁর নামানুসারেই বৈদ্যুতিক ধারকত্বের এককের নাম রাখা হয়েছে ফ্যারাডে, যা F প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়।


১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মাইকেল ফ্যারাডে বর্তমান যুক্তরাজ্যর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেমস- মার্গারেট দম্পতির তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কামার এবং মা ছিলেন গৃহকর্মী। মোটকথা, মাইকেল ফ্যারাডের পরিবার নিম্নবিত্ত দরিদ্র জীবন-যাপন করত।

মাইকেল ফ্যারাডে তার গ্রামেরই একটি স্কুলে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এই স্কুল থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের দারিদ্যের কারণে তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে একটি বইয়ের দোকানে বই পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করেন। এই কাজে ফ্যারাডের কঠোর পরিশ্রম আর মনোযোগ দেখে বই এর দোকানের মালিক ফ্যারাডের উপর অনেক খুশি হন। এর ফলে তিনি ডেলিভারি বয় এর কাজ থেকে বাদ দিয়ে ফ্যারাডেকে বই বাঁধাই এর কাজ শেখার সুযোগ দেন। ফ্যারাডের বাল্যকাল শিক্ষানবীশ বই বাঁধাইকারী হিসেবেই শেষ হয়।


বিজ্ঞানের ছোঁয়াঃ

মাইকেল ফ্যারাডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা বন্ধ করে দিলেও পৃথিবী ও প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতুহল ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। দিনের পুরোটা সময় শুধু বই বাঁধাই করেই কাটাতেন না তিনি, সাথে সাথে যে বইগুলো বাঁধাই করতেন তা পড়েও ফেলতেন। ফ্যারাডে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, অন্য বইগুলোর চাইতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলো পড়তে বেশি ভালো লাগছে। কথিত আছে, ফ্যারাডের বই এর দোকানে এমন দু'টি বই আসে যা ফ্যারাডের অনেক ভালো লেগেছিল। বই দু'টি হল-

১। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ (The Encyclopedia Britannica)- ফ্যারাডের তড়িৎ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান এই বই থেকেই আসে।
২। Conversations on Chemistry (রসায়নের সহজ পাঠ)- সবার বোধগম্য করে জেন মাসেঁ কর্তৃক লিখিত রসায়নের একটি বই।

মাইকেল ফ্যারাডে এসব বই পড়ে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বই এর দোকানে কাজ করে যা সামান্য মাইনে পেতেন, তার অধিকাংশই তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির পেছনে খরচ করে ফেলতেন। এসব দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি কিনে মাইকেল ফ্যারাডে তার অবসর সময়ে পরীক্ষা করে দেখতেন যে, তিনি বই পড়ে যা শিখছেন তা কি আসলেই কাজ করে না কি না। এইজন্য মুখস্থ শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রায়োগিক শিক্ষার আন্দোলনে মাইকেল ফ্যারাডে একটা ভাল উদাহরণের নাম হতে পারে।

তিনি একদিন জানতে পারলেন যে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জন ট্যাটাম প্রাকৃতিক দর্শনের (মূলত পদার্থবিজ্ঞানের) উপর জনসম্মুখে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তব্য প্রদান করবেন। এই বক্তব্য শুনতে হলে প্রবেশ ফি দিতে হবে ১ শিলিং, যা দরিদ্র ফ্যারাডের জন্য অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। ফ্যারাডের বড় ভাই, যিনিও বাবার মত একজন কামার ছিলেন, তিনি ফ্যারাডের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে ঐ ১ শিলিং মুদ্রা দিয়েছিলেন। এর ফলে ফ্যারাডে ট্যাটামের সেই বক্তব্য শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে এভাবেই ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করে ফেললেন।

স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়: ফ্যারাডের নতুন জীবনঃ

উইলিয়াম ড্যান্স নামে ফ্যারাডের দোকানের এক খদ্দের ফ্যারাডের বিজ্ঞানভক্তির কথা জানতেন। তিনি একদিন ফ্যারাডেকে রয়েল ইন্সটিটিউশানে অনুষ্ঠিতব্য স্যার হামফ্রে ডেভির বক্তব্যর একটা টিকেট অফার করেন। স্যার হামফ্রে ডেভি ছিলেন তৎকালীন সময়ের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের একজন। ফ্যারাডে তাই এই অফার লুফে নিয়েছিলেন। স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়ের পর ফ্যারাডের বিজ্ঞানচর্চা আরো একধাপ উপরে উঠেছিল।

ফ্যারাডে এই সুযোগে হামফ্রে ডেভির ৪ টি সেমিনারে অংশ নেন। এগুলোর বিষয় ছিল রসায়নবিদ্যার একটা নতুন সমস্যা। সমস্যাটি হল এসিডের সংজ্ঞায়ন নিয়ে। ফ্যারাডে পরীক্ষণ ভিত্তিক বিজ্ঞানের উপর প্রচন্ড দূর্বল ছিলেন। এ কারণেই পরবর্তীতে তাঁর নাম অন্যতম একজন সফল ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের নামের তালিকায় উঠে এসেছিল। মাইকেল ফ্যারাডে সেমিনারে যে নোটটি করেছিলেন তার সাথে অনেক তথ্য যোগ করে তিনি তার হাতে লেখা নোটটি বাঁধাই করেন। তিনি দেখেছিলেন যে ডেভি সেমিনারের মাঝে বিভিন্ন পরীক্ষণ সম্পন্ন করছিলেন। এই জন্য তিনি সেমিনারের শেষে উৎসাহিত হয়ে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বাঁধাই করা নোটটি বই এর মতো করে হামফ্রে ডেভিকে উপহারস্বরুপ পাঠিয়ে দেন।

ফ্যারাডে এই সময়ে পেশাদার পরীক্ষণগুলোও সম্পন্ন করতে শুরু করে দেন। তার দোকানের পেছনেই একটি স্থানে তিনি একটি ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন, যাতে দস্তার পাত ও তামার মুদ্রা পরস্পর হতে আদ্র লবণাক্ত কাগজ দ্বারা পৃথক করা ছিল। ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের তড়িৎ বিশ্লেষণে তিনি তার এই ব্যাটারি ব্যবহার করতেন। ১৮১২ সাল পর্যন্ত ফ্যারাডে শিক্ষানবীশ হিসেবে সেই দোকানে কাজ করেন। তারপরেই ফ্যারাডের জীবনে আকস্মিক কিছু ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে তাঁর নতুন জীবনে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

স্যার হামফ্রে ডেভি ফ্যারাডের পাঠানো সেই বাঁধাই করা বইটা দেখে খুশি হয়েছিলেন। তিনি তখন থেকেই ফ্যারাডেকে চিনতেন। একদিন ডেভির ল্যাবরেটরিতে একটি পরীক্ষণ চলার সময় দুর্ভাগ্যবশত (ফ্যারাডের জন্য সৌভাগ্যবশত) একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে ডেভি গুরুতর আঘাত পান। এর ফলে তিনি সাময়িকভাবে লেখালেখি করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তাই তিনি ফ্যারাডেকে তার নোট করার জন্য কিছুদিনের জন্য ল্যাবরেটরিতে কাজ দেন। এই কাজের ফলে ডেভি ফ্যারাডের মেধা সম্পর্কে আরো ঘনিষ্টভাবে জানার সুযোগ পান। কিন্তু ডেভি সুস্থ হয়ে উঠলে ফ্যারাডেকে এই কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে দেয়া হয়।

কাজ শেষ করে ফ্যারাডে ডেভির ল্যাবরেটরিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করার আবেদন করেছি্লেন। এই ঘটনার কিছু আগে বা পরে ডেভির ল্যাবরেটরির একজন সহযোগীকে অসদাচারণের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তাই ডেভি ফ্যারাডেকে জানিয়েছিল যে ফ্যারাডে চাইলে তিনি ডেভির ল্যাবরেটরিতে কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারেন।

ফ্যারাডেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কাজটা নিতে চান কি না। রয়েল ইন্সটিটিউশানে পৃথিবীবিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর সাথে কি তিনি কাজ করতে চান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর 'হ্যাঁ' ছাড়া আর কিইবা হতে পারে! এই 'হ্যাঁ' এর মাধ্যমেই শুরু হল মাইকেল ফ্যারাডের নতুন জীবন।


রয়েল ইন্সটিটিউশানে ক্যারিয়ারঃ 

মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১ মার্চ ফ্যারাডে রয়্যাল ইন্সটিটিউশানে কাজ শুরু করেন। এখানে ফ্যরাডে পূর্বাপেক্ষা ভালোই বেতন পেতেন। রয়েল ইন্সটিটিউশান সংলগ্ন একটা চিলেকোঠায় তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফ্যারাডেকে নেয়া হয়েছিল ৫৪ বছরের চুক্তিতে। চুক্তি অনুসারে মেয়াদ শেষে ফ্যারাডে রসায়নের একজন অধ্যাপক হিসেবে বের হবার কথা।

যাই হোক, কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে ফ্যারাডে সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি তৈরি করতেন, যা রয়েল ইন্সটিটিউশানের বিভিন্ন প্রকার সেমিনার এবং পরীক্ষণে কাজে লাগত। সেখানে কাজ করার মাত্র ৭ মাসের মাথায় ডেভি ফ্যারাডেকে তার সেক্রেটারি হিসেবে দেড় বছরের লম্বা ভ্রমণে ইউরোপ নিয়ে যান। এই ভ্রমণে ফ্যারাডের সাথে পরিচয় ঘটে আন্দ্রে ম্যারি অ্যাম্পিয়ার এবং আলসান্দ্রো ভোল্টার সাথে। এদের নিকট হতে ফ্যারাডে তড়িৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন।

এত কিছুর পরেও মাইকেল ফ্যারাডে ব্যক্তিগতভাবে সুখী ছিলেন না। স্যার হামফ্রে ডেভির স্ত্রী তাঁর সাথে ব্যক্তিগত চাকরের মত ব্যবহার করতেন এবং ফ্যারাডেকে ডেভির সমতুল্য ভাবতে অস্বীকার করতেন। এর কারণ হল, ফ্যারাডের নিম্নবর্গের এবং নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ইউরোপের ভ্রমণ শেষে লন্ডনে ফিরে এলে রয়েল ইন্সটিটিউশান কর্তৃপক্ষ মাইকেল ফ্যারাডের বেতন বৃদ্ধি করে দেয় এবং চুক্তি নবায়ন করে। স্যার হামফ্রে ডেভিও ফ্যারাডের মেধা ও যোগ্যতার সম্মান করতেন এবং তার অনেক রিসার্চ পেপারেই তিনি মাইকেল ফ্যারাডের ঋণ ও কৃতজ্ঞতা অকপটে স্বীকার গেছেন।


উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহঃ 

১৮১৬ সালে ২৪ বছর বয়সে মাইকেল ফ্যারাডে তাঁর প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যর বিষয় ছিল পদার্থের বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম। এই বছরেই তিনি ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড নিয়ে তার একটি গবেষণাপত্র বের করেন, যা সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮২১ সালে যখন মাইকেল ফ্যারাডের বয়স মাত্র ২৯ বছর, সেই সময়েই তিনি রয়েল ইন্সটিটিউশানের আবাসিক ও ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি সারাহ বার্নাড নাম্নী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ফ্যারাডে আর রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের সেই চিলেকোঠায় ছিলেন না, তিনি পার্শ্বস্থ একটি পাকা দালানবাড়িতে জীবনের বাকি সময়ের অধিকাংশই কাটিয়ে দেন।

১৮২৪ সালে ৩২ বছর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির জন্য তিনি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এই সময়ই তিনি বিজ্ঞানীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন। পরের বছরই তিনি রয়্যাল ইন্সটিটিউশান ল্যাবরেটরির পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৮৩৩ সালে তিনি ব্রিটেন রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। যদিও '৪৮ ও '৫৮ সালে দুইবার তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব অফার করা হয়, তিনি সেই দায়িত্ব প্রত্যাখান করে রসায়নের অধ্যাপকের পদেই ফিরে যান। তাই মাইকেল ফ্যারাডে আমৃত্যু রয়েল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপকের পদে আসীন ছিলেন।


আবিস্কার ও উদ্ভাবনসমূহঃ 
১৮২১ সাল- তাড়িতচৌম্বকের যান্ত্রিক ক্রিয়া (মোটর)
১৮২৩ সাল- গ্যাস শীতলীকারক ও তরলীকারকের ধারণা দেন যার মূলনীতি ছিল মূলত ১৭৫৬ সালে উইলিয়াম কুলেনের দেয়া। ১৮৬২ সালে ফার্দিন্যান্ড ক্যাঁ ফ্যরাডের এই শীতলীকারক প্রদর্শন করেন।
১৮২৫ সাল- গ্যাসের তৈলাক্ত অবশেষ থেকে বেনজিন আবিস্কার
১৮৩১ সাল- তাড়িতচৌম্বকীয় আবেশ উদ্ভাবন (জেনারেটর)
১৮৩৪ সাল- তড়িৎ বিশ্লেষণ সম্পর্কিত ফ্যারাডের সুত্র।
১৮৪৫ সাল- ফ্যারাডে ইফেক্ট আবিস্কার (আলোক-চৌম্বক ক্রিয়া)
১৮৪৫ সাল- সকল পদার্থেরই মৌলিক ধর্ম হিসেবে ডায়াচৌম্বকত্ব আবিস্কার।

জীবনাবসানঃ
৭৫ বছর বয়সে ১৮৬৭ সালের ২৫ আগস্ট মাইকেল ফ্যারাডে মৃত্যুবরণ করেন। ফ্যারাডে- সারাহ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে জীবদ্দশায় একজন ধর্মপ্রাণ স্যান্ডাম্যানিয়ান খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বেই মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে তাকে সমাহিত করার। ব্রিটেনের রাজা- রাণী, আইজ্যাক নিউটন বা রাদারফোর্ডের মতো বিজ্ঞানীদের পাশে সমাহিত হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফ্যারাডে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত হবাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ড গেলে লন্ডনের হাইগেট সিমেট্রির নিকটে মাইকেল ফ্যারাডে ও সারাহ বার্ণাডের কবর দেখতে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ
১। শ্রেষ্ঠ আবিস্কার ও আবিস্কারকের গল্প by ইব্রাহীম খলিল।
২। http://famousscientists.org/michael-faraday
৩। http://en.wikipedia.org/wiki/Michael_Faraday
Category: articles

মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

আজ ৩০ আগস্ট।
১৮৭১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কিউই পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

রসায়ন থেকে পদার্থবিদ বনে যাওয়া বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড

নিউজিল্যান্ডের এই বিজ্ঞানী মূলত ছিলেন রসায়নবিদ। কিন্তু পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেন 'নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের জনক' হিসেবে । তিনিই সবার আগে ১৯১১ সালে আবিষ্কার করেন যে প্রতিটি পরমাণুর একটি চার্জিত ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস থাকে, যার চারপাশে থাকে বিশাল শূন্যস্থান। আর এই নিক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনরা সর্বদা বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই মতবাদ পরে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল (বা সৌর-মডেল) বলে পরিচিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে প্রোটন আবিষ্কার করার কৃতিত্বও তার। নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের অস্তিত্বের কথাও তিনিই প্রথম কল্পনা করেন। মৌলের ভাঙন ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের রসায়ন নিয়ে তার সফল গবেষণার জন্য তিনি ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

নিউজিল্যান্ডের নেলসন শহরের কাছে তৎকালীন স্প্রিং গ্রুভ (বর্তমান ব্রাইটওয়াটার) নামক স্থানে ক্ষুদ্র একটি কাঠের তৈরি বাড়িতে ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে রাদারফোর্ডের জন্ম। বাবা-মায়ের বারো সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তার মা মার্থা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং বাবা জেমস ছিলেন কৃষক। রাদারফোর্ড পরিবার প্রবল আর্থিক সংকটের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে কখনো দমে যাননি। বাল্যকালে হেভলক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর ১৬ বছর বয়সে নেলসন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৯ সালে বৃত্তিলাভ করে ওয়েলিংটনে ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ড এর ক্যান্টারবারি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৯৩ সালে গণিত এবং ভৌতবিজ্ঞানে দুইটি প্রথম শ্রেণিসহ এমএ পাশ করেন।

তিনি ক্যান্টারবারি কলেজে খুব অল্পকিছুদিনের জন্য গবেষণা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৮৯৪ সালে লাভ করেন স্নাতক ডিগ্রি। প্রতিটি পরীক্ষাতেই বৃত্তি নিয়ে ১৮৯৫ সালে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে এসে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। কাজ শুরু করেন জে জে থমসনের অধীনে, যিনি তার কিছুদিনের মাথায়ই ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন।

ক্যামব্রিজে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে রাদারফোর্ডের গবেষণা চালানোর সময় রাদারফোর্ড অনেক উন্নতমানের রেডিও ওয়েভ ডিটেক্টর তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন। অবশ্য পরবর্তীতে গবেষণা ছেড়ে অর্থ উপার্জনের এই পথে যেতে তাঁর মন সায় না দেওয়ায় তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। রাদারফোর্ড থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়াম এর তেজস্ক্রিয়তা থেকে দুটি ভিন্ন তেজস্ক্রিয়তার বর্ণনা দেন এবং তাদের যথাক্রমে আলফা ও বিটা নাম দেন। ১৮৯৭ সালে তাঁকে বিএ রিসার্চ ডিগ্রি এবং ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের কৌট-ট্রটার স্টুডেন্টশিপ প্রদান করা হয়।

১৮৯৮ সালের এপ্রিলে রাদারফোর্ড জানতে পারলেন যে কানাডার মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের চেয়ারটি খালি আছে। তিনি সেখানে আবেদন করে নিয়োগ পেয়ে গেলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে সেপ্টেম্বরে শেষদিকে তিনি মনট্রিলে এলেন এবং পরবর্তী ৯ বছর এখানেই থেকে গেলেন। ১৯০০ সালে তিনি ম্যারি জর্জিয়ানা নিউটনকে বিয়ে করেন। পরবর্তী বছর রাদারফোর্ড-ম্যারি দম্পতির ইলিন ম্যারি নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে রাদারফোর্ড মনট্রিলে তরুণ রসায়নবিদ ফ্রেডারিখ সোদির (যিনি ১৯২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন) সাথে একত্রে থোরিয়াম বিকিরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং প্রথাবিরোধী সিদ্ধান্ত নেন যে বিকিরণের মাধ্যমে এক পদার্থ অন্য পদার্থে পরিণত হয়। তার তেজস্ক্রিয়তার বিভেদ তত্ত্ব থেকে তিনি দেখান যে, তেজস্ক্রিয়তা কোনো আণবিক ঘটনা নয়, এটি একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়ার ঘটনা। তিনি আরো বললেন যে, তেজস্ক্রিয় মৌলের হ্রাসের হার সূচকীয় এবং যে সময় পরপর তেজস্ক্রিয় তীব্রতা আদি তীব্রতার অর্ধেক হয় তাকে অর্ধায়ু বলে।

এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি পৃথিবীর বয়স নির্নয় করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত পৃথিবীর বয়স ছিল সেই সময়ের বিজ্ঞানীদের অনুমিত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি। তেজস্ক্রিয়তার উপর তাঁর এই অসাধারণ কাজ তাকে নোবেল পুরস্কার (১৯০৮ সালে রসায়নে) এবং ম্যানচেস্টারে অধ্যাপক পদ দুটোই এনে দেয়। পারমাণবিক বোমার জনক বলে পরিচিত অটো হান রাদারফোর্ডের অধীনেই মনট্রিলের ল্যাবে ১৯০৫-০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন, যিনি পরবর্তীতে নিউক্লিয়ার ফিশান আবিস্কার করেন।

১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ড পদার্থবিদ্যার প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৮ সালের গ্রীষ্মে রাদারফোর্ড জার্মান বিজ্ঞানী গাইগারকে সাথে নিয়ে নিশ্চিত করলেন যে আলফা কণা হল দুটি ইলেকট্রন হারানো হিলিয়াম পরমাণু বা হিলিয়াম আয়ন। ১৯০৯ সালে তার অধীনেই হ্যানস গাইগার ও আর্নেস্ট মার্সডেন বিখ্যাত আলফা কণা বিক্ষেপণ (যা স্বর্ণপাত পরীক্ষণ নামেও পরিচিত) পরীক্ষণটি সম্পন্ন করেন। এই পরীক্ষা হতেই সর্বপ্রথম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ত্ব সম্বন্ধে অনুমান করা যায়।

আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা

এই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে পরমাণুর নতুন একটি মডেলের প্রস্তাব করেন। মডেলের বর্ণনামতে পরমাণুর কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র ধনাত্বক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস রয়েছে যাকে সার্বক্ষণিক প্রদক্ষিণ করছে ক্ষুদ্রতর ঋনাত্বক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। জে জে থমসনের দেয়া পরমাণুর কল্পিত চিত্রকে এই মডেল বাতিল করে দেয়। রাদারফোর্ফ তার মডেল নিয়ে এতটাই উচ্ছাসিত ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন,
Now I know what the atoms look like! It was nothing like Thomson.

১৯১২ সালে নিলস বোর রাদারফোর্ডের সাথে ম্যানচেস্টারে যোগ দেন। গুরু রাদারফোর্ডের দেয়া নিউক্লিয়াসের গঠনকে কোয়ান্টানাইজড করে বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম জগৎ উন্মোচন করেন যা আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত একটি তত্ত্ব। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বোর পরমাণুর কোয়ান্টায়ন করে সমাধান করেছিলেন। ১৯১৩ সালে রাদারফোর্ড এবং মোসলে ক্যাথোড রশ্মি দ্বারা বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর মাঝে সংঘর্ষ ঘটান এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্ণালী রেখা পান। এই পরীক্ষার পর থেকে মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা আসে যা দ্বারা প্রতিটি মৌলকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

১৯১৯ সালে রাদারফোর্ডকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদের অফার দেওয়া হলে তিনি ম্যানচেস্টার থেকে ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন এবং পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন। তাঁকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির সর্বকালের সেরা যোগ্য পরিচালক বিবেচনা করা হয়। একটা ছোট পরিসংখ্যান থেকে পরিচালক হিসেবে রাদারফোর্ডের দক্ষতা সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। তাঁর ল্যাবরেটরির ছাত্রদের মাঝে পরবর্তীতে ১১ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। নিলস বোর, জর্জ হ্যাভেস, চ্যাডউইক, পাওয়েল, ব্ল্যাকেট, সিজে ডারউইন সহ অনেক জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর ছাত্র এবং সহকর্মী ছিলেন।

১৯১৯ সালে তিনি তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াই কৃত্রিমভাবে এক মৌলকে অন্য মৌলতে পরিণত করে দেখাতে সক্ষম হন। তিনি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নাইট্রোজেন গ্যাসের মাঝে আলফা কণা চালনা করে অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করেন। গোল্ডস্টাইন ১৮৮৬ সালে একক ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট কণার স্রোত খুঁজে পেলেও পারমানবিক কণা হিসেবে রাদারফোর্ডই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রোটন আবিস্কার করেন। ১৯২১ সালে বোরের সাথে কাজ করার সময় রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াসের স্থায়ীত্ব ও ভর ঘাটতির ব্যাখ্যা দেবার সময় আধানহীন, একক ভরবিশিষ্ট একটি নিউক্লিয়নের কথা কল্পনা করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে বিজ্ঞানী বুথ ও বেকার খুঁজে পান এবং চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে একে নিউট্রন হিসেবে শনাক্ত করেন।

১৯১৪ সালে রাদারফোর্ডকে 'নাইট' উপাধি দেয়া হয়। ১৯২৫ সালে তিনি 'অর্ডার অব মেরিট' খেতাবও লাভ করেন। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি পদ লাভ করেন। এগুলোর মাঝে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য গবেষণা বিভাগের উপদেষ্টা মন্ডলীর চেয়ারম্যান, লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ক্যামব্রিজের রয়্যাল সোসাইটি মন্ড ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ অন্যতম। ১৯০৩ সালেই তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর বর্ণিল জীবনে অজস্র সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। তন্মধ্যে রামফোর্ড মেডেল, ফ্যারাডে মেডেল, কপলি মেডেল, ব্রেসা পুরস্কার, আলবার্ট মেডেলসহ অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রি এবং ডক্টরেট ডিগ্রি উল্লেখযোগ্য।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯৩৭ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে ক্যামব্রিজে নাড়ির অন্ত্রের অপারেশনের পরে খুব আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এর মাধ্যমে জীবনাবসান হয় একজন মহান ভৌত ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানীর। যুক্তরাজ্যর লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিনের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর অদূরেই সমাহিত আছেন মহাবিজ্ঞানী সার আইজাক নিউটন।

তথ্যসুত্রঃ
১। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_rutherford.html
২। http://www.famousscientists.org/ernest-rutherford/
Category: articles

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

আজ ১৫ আগস্ট।
১৮৯২ সালের এই তারিখে জন্মগ্রহণ করেন ফরাসী পদার্থবিদ লুই ডি ব্রগলি।

কোয়ান্টামতত্ত্ব নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজই সারা বিশ্বের নিকট তাকে পরিচিত করে তুলেছে। ১৯২৪ সালে তিনি তাঁর এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মের আবিস্কার করেছেন এবং প্রস্তাব করেন যে সকল পদার্থেরই তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে। এই কাজের জন্য ১৯২৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

পদার্থবিজ্ঞানী লুই ডি ব্রগলি

ব্রগলির বাবা-মায়ের বেঁচে যাওয়া ৪ সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন ৪র্থ। ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের দিপ্পে (Dieppe) শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার সামাজিক দিক থেকে অনেক উচ্চবংশীয় ছিল। তার বাল্যকালের পড়াশোনা বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের নিকট শুরু হয়। ১৯০৬ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই মরিস ডি ব্রগলির পরামর্শে ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম স্কুলে যান। স্কুল পাশ করার পর ইতিহাস নিয়ে লুই ডি ব্রগলির পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান, ফ্রেঞ্চ, দর্শন, ইতিহাস, রসায়ন ও গণিতে তার মত ভাল ছাত্র আর কেউ ছিল না। ১৯০৯ সালে ব্রগলি মাত্র ১৭ বছর বয়সেই দর্শন ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বড় ভাই মরিসের উৎসাহেই বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন লুই ডি ব্রগলি। ১৯১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানের উপর একটি ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তিনি ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাকে আইফেল টাওয়ারে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি এই স্থান হতেই বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং তরঙ্গ নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বড় ভাই মরিসের ল্যাবে তার সাথেই কাজ শুরু করেন ডি ব্রগলি।

মরিসের ল্যাবে ডি ব্রগলি যতগুলি কাজ করেছেন তার বেশিরভাগই ছিল এক্স-রশ্মি ও আলোর তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত। এইসব পরীক্ষণ হতেই ডি ব্রগলি আলোর কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave-partiucle dulaity) নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন। আরো ভালোভাবে বললে, 'যে কোনো কিছুর' কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। শীঘ্রই ১৯২৪ সালে ডি ব্রগলি পদার্থের কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে তত্ত্বটিকে তার পিএইচডি থিসিস পেপারে প্রস্তাব করলেন। সৌভাগ্যক্রমে এই থিসিস পেপার বিজ্ঞানী ল্যাংজেভিনের হাত হয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাতে এসে পড়ে। তিনি ডি ব্রগলির এই ধারণার অনেক বেশি প্রশংসা করেন। তরঙ্গ-বলবিদ্যার উত্থানে আইনস্টাইন এর এই প্রশংসা অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছিল।

কণা- তরঙ্গ দ্বৈততা

লুই ডি ব্রগলির এই তত্ত্ব পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের গতির হিসাব-নিকাশ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার সমাধান এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয়। কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে পৃথকভাবে জিপি থমসন, ক্লিনটন ডেভিসন এবং লেস্টার জারমারের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়। এ থেকে সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হয় যে পদার্থও তরঙ্গ ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। এই অসাধারণ কাজের জন্য ১৯২৯ সালে লুই ডি ব্রগলি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লুই ডি ব্রগলি তার ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর সরবোনেই অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত হেনরি পয়েনকেয়ার ইন্সটিটিউশনে ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি অবসরের যাবার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৫ সালে ডি ব্রগলি ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ইউনেস্কো প্রদত্ত কলিঙ্গ পুরস্কার লাভ করেন এবং ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির বৈদেশিক সদস্যপদ সাথে সাথে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমীর সদস্যপদ লাভ করেন। উনবিংশ শতকের শুরুতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিকাশে কণা-তরঙ্গের মিল প্ল্যাংক এবং আইনস্টাইনের হাত ধরে পরর বোর হয়ে লুই ডি ব্রগলির হাতে এসে পূর্ণতা পায়।

এই পূর্ণতাদানকারী বিজ্ঞানী ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ ফ্রান্সের ল্যুভেসিয়েনেসে (Louveciennes) মৃত্যুবরণ করেন। ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাও  লুই ডি ব্রগলির মত বিজ্ঞানীর জন্য খুব অল্প সময় হয়ত।

নোটঃ লুই ডি ব্রগলির নামের ফরাসি উচ্চারণ হল লুই দ্য ব্রোয়ি

তথ্যসূত্র:
১। http://www.famousscientists.org/louis-de-broglie/
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Louis_de_Broglie
৩। কণা তরঙ্গ, রেজা এলিয়েন, বর্ণায়ন, ঢাকা, ২০০৯
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, নিউটন সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী। মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই শুধু নিউটনের এই ফর্মুলা, সেই ফর্মুলা। ফিজিক্সে ও ম্যাথে সমানে গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন। দেখিয়েছেন পায়ের নিচে যে সূত্র (অভিকর্ষ) কাজ করে, আকাশেও তা (মহাকর্ষ) একইভাবে কাজ করে। আবিষ্কার করেছেন ক্যালকুলাস, যা ছাড়া আধুনিক পদার্থবিদ্যা পুরোপুরি অচল। আর কিছু আপাতত নাই বা বললাম।
কিন্তু মানুষটার ব্যক্তি জীবন ছিল আলাদা। নিউটন সাহবে খুব একটা সুবিধার মানুষ ছিলেন না। অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব খারাপ। জীবনের শেষের দিকে তার বেশির ভাগ সময় কেটেছে উত্তপ্ত বিতর্কের মধ্য দিয়ে। নিঃসন্দেহে তাঁর প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা ফিজিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বই। এটি প্রকাশের পরপরই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁকে রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। তিনিই বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথম নাইট হবার সুযোগ পান।

অল্প দিনের মধ্যেই তিনি রাজকীয় জ্যোতির্বিদ (প্রচলিত নাম অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল) জন ফ্ল্যামস্টিডের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। অথচ ইনিই নিউটনকে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্য- উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। তবে এবার নিউটনের সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ হল। নিউটনও ছেড়ে কথা বললেন না। তিনি রয়েল অবজারভেটরির পরিচালনা পর্ষদে স্থান করে নিতে সক্ষম হলেন। এবার দ্রুত উপাত্তগুলো প্রকাশনার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ফ্ল্যামস্টিডের গবেষণাকর্ম জব্দ করে ফেললেন। উপরন্তু এগুলো ফ্ল্যামস্টিডের জানের শত্রু এডমন্ড হ্যালিকে দিয়ে প্রকাশ করার জন্য সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। কিন্তু ফ্ল্যামস্টিড চলে গেলেন আদালত পর্যন্ত। ঠিক সময় মতোই তাঁর চুরি হওয়া গবেষণার প্রকাশনা বন্ধ করতে আদালতের আদেশ অর্জন করে নিতে পারলেন। নিউটনের মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে তাঁর প্রিন্সিপিয়ার পরবর্তী সংস্করণগুলো থেকে ফ্ল্যামস্টিডের সব রেফারেন্স ধীরে ধীরে উঠিয়ে নিলেন।
আরো ভয়াবহ বিবাদে লিপ্ত হন জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজের সাথে। নিউটন ও লিবনিজ দুজনেই গণিতের ক্যালকুলাস নামে একটি শাখা তৈরি করেন। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম ভিত্তি এই ক্যালকুলাস। এখন আমরা জানি যে নিউটন লিবনিজের অনেক বছর আগেই ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করেন অনেক দেরি করে। কে আগে আবিষ্কার করেছেন তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠল। দুই পক্ষেই কিছু বিজ্ঞানী শক্ত অবস্থান নিলেন। তবে মজার ব্যাপার হল, নিউটনের পক্ষে লেখা বেশির ভাগ রচনাই নিউটন নিজে লিখে বন্ধুদের নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।

বিতর্ক চরমে উঠলে লিবনিজ একটি ভুল করে বসলেন। তিনি রয়েল সোসাইটিকে এই বিতর্ক সমাধান করে দিতে প্রস্তাব দিলেন। এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিউটন অনুসন্ধান চালানোর জন্যে একটি 'নিরপেক্ষ' কমিটি করে দিলেন। মজার ব্যাপার হল, এই কমিটির সদস্যরা সবাই ছিল নিউটনেরই বন্ধু। কিন্তু এটাই শেষ নয়। নিউটন পরে নিজেই কমিটির রিপোর্ট লিখেন। রয়েল সোসাইটি রিপোর্ট প্রকাশও করল। এতে বলা হল, লিবনিজ গবেষণাকর্ম চুরি করেছেন। এতেও নিউটন শান্তি পাননি। তিনি রয়েল সোসালিটির নিজস্ব সাময়িকীতে রিপোর্টটি সম্পর্কে বেনামে একটি রিভিউ লিখেন। জানা যায়, লিবনিজের মৃত্যুর পরে নিউটন বলেন যে তিনি 'লিবনিজের বুক ভাঙতে পেরে' চরম তৃপ্তি পেয়েছেন।

এই দুই বিতর্কের সময়কালের মধ্যেই নিউটন ক্যামব্রিজ ও একাডেমিক জগত ছেড়ে চলে আসেন। তিনি ক্যামব্রিজে ক্যাথলিক বিরোধীতায় এবং পরবর্তীতে পার্লামেন্টের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। শেষ পর্যন্ত রয়েল মিন্ট এর ওয়ার্ডেনের মতো লোভনীয় পদ অর্জন করেন। এখানে এসে তিনি এবার সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাঁর বুদ্ধি খরচ করতে থাকেন উগ্র অপকৌশলের পেছনে। অবশ্য এখানে তিনি নকলবাজির বিরুদ্ধেও তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদণ্ডও দেন।

সূত্রঃ
[স্টিফেন হকিং এর বই 'A Briefer History of Time' থেকে অনূদিত। বইটির অনুবাদ সম্পন্ন করেছি।
সব কিছু ঠিক থাকলে বইটি আগামী বই মেলায় আলোর মুখ দেখবে। এটা Brief নয়, Briefer History of Time, বইটি আগের বইটির আপডেট ভার্সন] 
Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...