Advertisement

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬

আজকের পদার্থবিদঃ নিলস বোর

আজ ৭ অক্টোবর। ১৮৮৫ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ নিলস বোর। ড্যানিশ এই পদার্থবিজ্ঞানীর কল্যাণেই পরমাণুর মৌলিক গঠন উদঘাটিত হয় এবং ভিত্তি স্থাপিত হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর

বিশেষ করে তিনি পরমাণুর জন্যে বোর মডেল প্রস্তুত করেন। পরে আবার তৈরি করেন লিকুইড ড্রপ মডেল। কোপেনহেগেন থাকার সময় অসংখ্য পদার্থবিদ তাঁর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেতেন। একত্রে কাজও করেছেন অনেকের সাথে। এখানে থাকা অবস্থায়ই হাইজেনবার্গের সাথে মিলে তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen interpretation) তৈরি করেন। বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এই বিজ্ঞানী ১৯২২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, পরমাণুর গঠন ও তা থেকে নির্গত বিকিরণ নিয়ে গবেষণার জন্যে।

নিলস বোর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৮৮৫ সালের ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। বোরের বাবা একজন অধ্যাপক ছিলেন এবং কোপেনহেগেনের সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোর মাঝে বোরের পরিবার ছিল অন্যতম। বোরের পরিবারের সবাই ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁর ছোট ভাই হ্যারাল্ড বোরও পরবর্তীতে একজন দক্ষ গণিতবিদ হয়েছিলেন। বোরের বাবার কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর করাতে বাল্যকালে বোর কিছুটা সুবিধা পেয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে তিনি বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও দর্শনে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯০৫ সালে বোর তরলের পৃষ্ঠটানের উপর একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, যা সবার মনোযোগ কাড়ে। তিনি পুরস্কৃতও হন এর জন্যে। এর পরেই বোর গণিত ও দর্শন ছেড়ে ঢুকে পড়েন পদার্থবিদ্যার জগতে। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯১১ সালে বোর তাঁর ডক্টরেট থিসিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তী গবেষণার জন্য ডেনমার্ক ছেড়ে বোর ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকেই তাঁর চমক দেখানোর শুরু।

চাপা স্বভাবের বোর ছোটবেলায় ভাষা শিখতে অনেক দেরী করে ফেলেছিল বলে ড্যানিশ ভাষা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেননি। আবার পড়ালেখার জন্য ইংরেজী শিখলেও ইংরেজী ভাষার শব্দ জ্ঞান তাঁর ছিল খুব সীমিত। ইংল্যান্ডে আসার পর ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্যার জে.জে. থমসনের অধীনে গবেষণা শুরু করলেও তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। থমসনের উদাসীনতা বোরকে ভীষণভাবে হতাশ করলেও ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের সঙ্গ বোরকে অনেক উৎসাহ- অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে মহান শিক্ষক রাদারফোর্ডের অধীনে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে বোর গবেষণা শুরু করেন।

ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে থাকাকালীন আইসোটোপ, তেজস্ক্রিয়তার ভাঙন সুত্র এবং পর্যায় সারণী নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেন। ১৯১১ সালে আলফা- কণা বিক্ষেপণের ফলাফলের উপর নির্ভর করে রাদারফোর্ড তার পরমাণু মডেল প্রকাশ করলে এতে অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বোর সেগুলোর কয়েকটি সমাধান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, তিনি রাদারফোর্ডকে তা বোঝাতে অক্ষম হন। ১৯১২ সালে বোর কোপেনহেগেনে ফিরে আসেন এবং জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি মার্গ্রেথকে বিয়ে করেন। বোর- মার্গ্রেথ দম্পতির পরবর্তীতে ৬টি সন্তান- সন্তুতি হয়েছিল, যাদের মাঝে ২ জন নাবালক অবস্থায় মারা গেলেও বাকি ৪ জন পিতার মতোই বিভিন্ন শাখায় দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তন্মধ্যে, বোরের সন্তান অউ নিলস বোর ১৯৭৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

১৯১২ সালের গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটানোর সময় বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল থেকে চিরায়ত বলবিদ্যাকে বিদেয় করে তাতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করেন। তার স্ত্রী মার্গেথ এই সময় বোরকে তার গবেষণাপত্র (scientific paper) তৈরিতে খুব সহায়তা করেন। বোরের গবেষণাপত্রগুলো মূলত তার স্ত্রী মার্গেথেরই লেখা। মার্গেথ তার স্বামীর কথা বোঝার চেষ্টা করতেন এবং তা লিখে রাখতেন। ১৯১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বোর পরমাণু সম্পর্কে এমন ৩টি অনুমান করেন, যা দ্বারা রাদারফোর্ডের অস্থায়ী পরমাণু, পরমাণুর ভৌতিক(?) বর্ণালীসহ নানা সমস্যা সমাধান করা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বোরের সেই অমর কর্ম- ‘পরমাণুতে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধে ঘুরতে পারে না, শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট অনুমোদিত(কোয়ান্টায়িত) কক্ষপথেই ঘুরে’ এই সময়েই প্রকাশ পায়। বোরের দেওয়া পরমাণুর এই চিত্র বোরের কোয়ান্টাম পরমাণু মডেল নামে পরিচিত।

১৯২১ সালে বোর কোপেনহেগেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের বাকি সময় তিনি এর পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৬- ২৭ সালে এই সমিতিতেই হাইজেনবার্গ বোরের অধীনে কাজ করেন এবং প্রদান করেন তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূতিকাগার ছিল মূলত তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সমিতিটিই। আলোর দ্বৈত ধর্ম, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বোরের এই সমিতির অবদান অনস্বীকার্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানি ডেনমার্ক আক্রমণ করলে বোর এর প্রতিবাদ করেন এবং নাৎসিবিরোধি মনোভাবের কারণে জার্মানদের রোষানলে পড়েন। ১৯৪৩ সালে বোর দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং সুইডেন হয়ে ইংল্যান্ড গমন করেন। এইসময় বোর নিউক্লিয়ার ফিশান এবং ইউরেনিয়াম- ২৩৫ নিয়ে কাজ করেন। তিনি সারাজীবনই পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে আমেরিকায় ম্যানহাটন প্রজেক্টে ধীরে ধীরে তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং আণবিক বোমা তৈরির এই প্রকল্পে একজন সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে পদোন্নতি পান। এইসময় বোর ছদ্মনাম হিসেবে নিকোলাস বেকার নাম গ্রহণ করেন। তবে বোর আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েতের সাথে প্রকাশ্যে আলাপ চালাতে শুরু করেন পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহার রোধের জন্য। এই কারণে বোরকে নিরাপত্তার ঝুঁকি মনে করে আমেরিকা থেকেও বের করে দেয়া হয়।

বোর ১৯৪৭ সালে বীরের বেশে দেশে ফিরে আসেন। তাকে ডেনমার্কের সর্বোচ্চ পদক অর্ডার অব দি এলিফ্যান্ট প্রদান করা হয়। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি রয়্যাল ড্যানিশ একাডেমির সভাপতি ছিলেন। শেষ বছরগুলোতে বোর তার গবেষণা বন্ধ করে দিলেও নিউক্লিয়ার শক্তির অপব্যবহার রোধে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। ১৯৫০ সালে জাতিসংঘে শান্তির পক্ষে তার খোলা চিঠিটি তার শান্তি আন্দোলনে স্মরণীয় একটি পদক্ষেপ।

বোর কোপেনহেগেনেই ১৯৬২ সালের ১৮ নভেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। নিলস বোরের স্ত্রী মার্গ্রেথ আরো প্রায় ২০ বছর জীবিত ছিলেন।

নিলস বোরের পরমাণু ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর কাজ বিজ্ঞানের সকল শাখায় যে কত বড় অবদান রেখেছে তা কল্পনাতীত। আইনস্টাইনের একটা উক্তির অংশবিশেষ দিয়েই শেষ করছি।
'বোর  না থাকলে পরমাণু সম্পর্কে যে আমরা কতটুকু জানতে পারতাম তা কেউই জানে না।' 
তাঁর ছাত্র থাকাকালীন সময়ের একটি মজার কাহিনী পড়ুন এখানে।

সূত্রঃ
১। http://www.famousscientists.org/niels-bohr/
২। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_bohr.html


Advertisement 02

Unknown

লেখকের পরিচয়

আব্দুল মুহাইমিন মঈন। পড়াশোনা নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি দিচ্ছেন ২০১৭ সালে।
কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ভক্ত।
লেখকের সব লেখা এখানে। ফেসবুকে লেখকঃ Abdul Muhaymin Moin

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...