Advertisement

সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪

প্রতি দিন রাতের আকাশের দিকে নজর রাখলে একটি বিশেষ জিনিস চোখে পড়বে। প্রত্যেক রাতের একই সময়ে আকাশের তারাগুলো আগের রাতের চেয়ে একটু পশ্চিমে চলে আসে। এটা হয় সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে। পৃথিবী প্রতিনিয়ত কক্ষপথে অবস্থান বদল করার কারণে একেক সময় সূর্যকে আকাশের একেক দিকে অবস্থিত মনে হয়। সূর্যের এ আপাত অবস্থান যখন যে দিকে থাকে, সেদিকের তারাগুলো সে সময় সূর্যের প্রায় সাথে সাথে ডুবে যায়। তাই এ সময় তাদেরকে দেখ যায় না। কিছু দিন পর এ জায়গায় চলে আসে অন্য তারা। এভাবে এক বছর পর আবার একই সময়ে একই তারাদের দেখা মেলে রাতের আকাশে।


 গ্রহদের উল্টো গতি

সাধারণত তারকাদের এই চলাচলের কোনো ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু গ্রহরা এই নিয়ম মানে না। দূরবর্তী আপাত স্থির নক্ষত্রেদের তুলনায় রাতের আকাশে এদের গতি সাধারণত পূর্ব দিকে। চাঁদও কিন্তু গ্রহদের মতো প্রতি রাতে আগের রাতের তুলনায় পূর্ব দিকে চলে আসে। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায়, গ্রহরা স্বাভাবিক পূর্ব দিকের বদলে নক্ষত্রদের সাথে সাথে পশ্চিম দিকে চলছে। এই ঘটনা সবচেয়ে সহজে চোখে পড়ে বুধ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহের ক্ষেত্রে। বৃহস্পতি বা শনি তুলনামূলক দূরে হওয়াতে এই উল্টো গতি (retrograde motion) দেখতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। 


প্রাচীন কালের মানুষ এই উল্টে গতির ব্যাখ্যা জানত না। তখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা প্রচলিত। পৃথিবীকে মানে করা হত মহাবিশ্বের কেন্দ্র। এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই টলেমি মহাবিশ্বের একটি মডেল দাঁড় করান। সেই মডেলে পৃথিবীর চারদিকে আটটি গোলক কল্পনা করা হলো। চাঁদ ও সূর্যের জন্যে ছিল একটি করে কক্ষপথ। সেই সময়ে জানা পাচঁটি গ্রহের জন্যে (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি) ছিল আরও পাঁচটি কক্ষপথ। আরেকটি কক্ষপথ ছিল দূরবর্তী নক্ষত্রদের জন্যে। সময় সময় গ্রহদের উল্টো গতির ব্যাখ্যা দেবার জন্যে বলা হলো, পৃথিবীর চারদিকের কক্ষপথে ঘোরার পাশাপাশি এরা কক্ষপথের মধ্যেই আরেকটি বৃত্তপথে চলাচল করে। এই বৃত্ত পথের নাম ছিল মন্দবৃত্ত (epicycle)। এই চিত্রের মাধ্যমে গ্রহদের এলোমেলো চলনের ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও ত্রুটি ছিল এতে। এই নমুনা সঠিক হলে চাঁদ মাঝে মাঝে পৃথিবীর অর্ধেক দূরত্বে চলে আসার কথা, যা বাস্তবে ঘটে না।


টলেমির মহাবিশ্ব

এখন আমরা জানি, টলেমির মডেল ভুল ছিল। গ্রহদের চলাচলের সঠিক ব্যাখ্যা দেন জার্মান গণিত ও জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার। ব্যবহার করেন ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত। কেপলারের গ্রহের সূত্র অনুসারে, পৃথিবীসহ অন্য গ্রহরা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। উপবৃত্তের কোনো একটি উপকেন্দ্রকে ঘিরে এর প্রদক্ষিণ চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হল, কেপলারের সূত্র থেকে গ্রহদের উল্টো গতির ব্যাখ্যা খুব সহজেই পাওয়া যায়।


উল্টো গতির কারণ কক্ষপথের গ্রহদের আপেক্ষিক অবস্থা 

এটা বোঝার জন্যে ওপরের চিত্রটি দেখুন। মাথায় রাখতে হবে, যে গ্রহরা সূযের অপেক্ষাকৃত কাছে, তাদের বেগ দূরের গ্রহের তুলনায় বেশি। কক্ষপথের পরিধিও ছোট। ফলে কাছের গ্রহরা অপেক্ষাকৃত কম সময়েই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেলে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মঙ্গল বা বাইরের দিকের কোনো গ্রহ পৃথিবী ও সূর্যের সাথে একই রেখায় অবস্থান করলেও একটু পরেই পৃথিবী চলে যায় সামনে। পৃথিবী থেকে ভেতরের দিকের গ্রহরা আবার এগিয়ে যায় পৃথিবীর চেয়ে। আপাতত পৃথিবীর সাপেক্ষে মঙ্গলের আপেক্ষিক অবস্থানের দিকে লক্ষ করুন। ১ থেকে ৩ নং অবস্থান পর্যন্ত স্বাভাবিক গতি দেখা যাচ্ছে। তবে ৪ নং অবস্থানে গিয়ে পৃথিবী থেকে দেখতে মঙ্গলের অবস্থান পেছনে (পশ্চিমে) সরে এসেছে। ৫নং-এও তাই। তবে তারপর আবার স্বাভাবিক পূর্ব দিকে চলছে।


বোঝাই যাচ্ছে, এরকম গতির পেছনে মূল কারণ হল, পৃথিবীর তুলনায় অন্য গ্রহদের কক্ষপথের পরিধি ও বেগের কম-বেশি।

Category: articles

সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। ঋতুর পরিবর্তনের জন্য সূর্য দায়ী তা ঠিক। তবে ভূমিকা আছে পৃথিবীর নিজেরও। পৃথিবী সূর্যের দিকে বিশেষভাবে হেলে আছে বলেই ঘটছে এ পরিবর্তন। এর মূল কারণ, পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ কক্ষীয় তলের সাথে ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে আছে। 


পৃথিবীর বিষুবরেখা কক্ষীয় তলের সাথে ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে আছে

বছরের দুটি দিন সূর্য বিষুবরেখা বরাবর খাড়াভাবে আলো দেয়। ২০শে মার্চ ও ২২শে সেপ্টেম্বর। বছরভেদে তারিখ এক-দুই দিন এদিক-সেদিক হতে পারে। এসময় দুই গোলার্ধই সূর্যের আলো সমানভাবে পায়। পৃথিবীর সব জায়গায় দিন-রাত (প্রায়) সমান হয়। 

মহাবিষুবের দিন পৃথিবীর সব জায়গায় দিন-রাত (প্রায়) সমান হয়।

২০শে মার্চের পর পৃথিবীর উত্তর মেরু ক্রমেই সূর্যের দিকে হেলতে থাকে। এভাবে যেতে যেতে ২০শে জুনের দিকে সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখার (Tropic of Cancer) ওপর খাড়াভাবে আলো দেয়। কল্পিত এ রেখা ভূপৃষ্ঠের ২৩.৫ উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত। এটাই সূর্যের পৃথিবীর সর্বউত্তরের অবস্থান। বিশেষ নাম তাই উত্তরায়ণ (northern solstice)। ঐ দিন উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে বড় দিন ও সবচেয়ে ছোট রাত হয়। ২০শে জুনের আগে-পরে মিলিয়ে প্রায় তিন মাস উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল থাকে। একইসময়ে দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে শীত। দক্ষিণ গোলার্ধে আলো বাঁকাভাবে পড়ায় তীব্রতা কম থাকে। 


২০শে জুনের দিকে সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখার (Tropic of Cancer) ওপর খাড়াভাবে আলো দেয়।


২০শে জুন সূর্যের উত্তরায়ণের শেষ দিন। এবার আবার উত্তর মেরুর সূর্যের দিকে হেলে থাকার পরিমাণ কমতে থাকে। গরম কমতে শুরু করে। (প্রায়) ২২শে সেপ্টেম্বর সূর্য আবার বিষুবরেখায় খাড়াভাবে আলো ফেলে। দুই মহাবিষুবের একটি এটি। উত্তর গোলার্ধে এর নাম শারদ বিষুব (autumnal equinox)। দক্ষিণ গোলার্ধে নাম বাসন্ত বিষুব (vernal equinox)। এদিনের আগে-পরে উত্তর গোলার্ধে শরৎ ও দক্ষিণ গোলার্ধে বসন্তকাল। 


পৃথিবীর ঋতুচক্র ও তার কারণ

এবার সূর্যের দিকে হেলতে শুরু করে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু। দক্ষিণ গোলার্ধে দিন বড় হতে থাকে। রাত ছোট হতে থাকে। গরমের আগমন শুরু হয়। উত্তরে রাত ছোট হতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে ২২শে ডিসেম্বর সূর্য দক্ষিণের মকরক্রান্তি রেখার (Tropic of Capricorn) ওপর খাড়াভাবে আলো দেয়। কল্পিত এ রেখা ভূপৃষ্ঠের ২৩.৫ দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থিত। এ তারিখের দেড় মাস আগে থেকেই উত্তরে শীত ও দক্ষিণে গরম পড়তে থাকে। এদিন উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে ছোট দিন ও সবচেয়ে বড় রাত। দক্ষিণ গোলার্ধে তার উল্টো। 


দক্ষিণ মেরুর হেলে থাকা এবার আবার কমতে থাকে। ২০শে মার্চ এসে সূর্য আবার বিষুবরেখায় খাড়া আলো দেয়। আরেকটি মহাবিষুব (equinox)।  দক্ষিণ গোলার্ধে এর নাম শারদ বিষুব (autumnal equinox)। উত্তর গোলার্ধে নাম বাসন্ত বিষুব (vernal equinox)।  এদিনও পুরো পৃথিবীতে দিন-রাত (প্রায়) সমান হয়। এরপর আবার পৃথিবীর উত্তর মেরু সূর্যমুখী হতে থাকে। আগেই তা বলা হয়েছে। মহাবিষুবের দিন আসলে পুরো পৃথিবীতে দিন-রাত সমান হয় না। তবে দিন-রাতের দৈর্ঘ্য খুব কাছাকাছি হয়। 


পুরো ব্যাপারটি বুঝতে ভিডিওটি সহায়ক হতে পারে। 




মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর গরম বা ঠান্ডা নির্ভর করে পৃথিবীর নতির ওপরই। দূরত্বের ওপর নয়। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তকার। ফলে কখনও সূর্য কাছে আসে, কখনও বা দূরে যায়। তার সাথে পৃথিবীর তাপমাত্রার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। জানুয়ারি মাসে পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে। অথচ এ সময়ই উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে শীত থাকে। 


পৃথিবীর তাপমাত্রা সূর্যের দূরত্বের ওপর নির্ভর করে না বললেই চলে। 

আরও পড়ুন


সূর্যের কাছে গেলে কি পৃথিবীর তাপমাত্রা বেশি হয়?


পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?


সূত্র

১। টাইম অ্যান্ড ডেইট ডট কম: https://www.timeanddate.com/astronomy/seasons-causes.html

Category: articles

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে উপবৃত্তাকার পথে। জানুয়ারি মাসে পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে। পৃথিবীর কক্ষপথের এ অবস্থানের নামে অনুসূর (perihelion)। এসময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হয় ১৪.৭ কোটি  কিলোমিটার৷ জুলাই মাসে দূরত্ব থাকে ১৫.২ কোটি কিলোমিটার। এ জায়গার নাম অপসূর (aphelion)। 


পৃথিবীর কক্ষপথে অনুসূর ও অপসূর


আরও পড়ুন 


সূর্যের নিকটতম অবস্থানে পৃথিবী


অনুসূর অবস্থানে সূর্য তুলনামূলক কাছে আসায় সূর্যের আলোও স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীতে বেশি পড়ে। অপসূর অবস্থানের তুলনায় এ সময় পৃথিবী ৭ ভাগ আলো বেশি পায়। কিন্তু আবার জানুয়ারি মাসে উত্তর গোলার্ধের বেশিরভাগ জায়গায় সবচেয়ে ঠান্ডা থাকে। কারণ আবহাওয়া প্রধানত নির্ভর করে পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে বিষুবরেখার নতির ওপর। পৃথিবীর বিষুব বা নিরক্ষরেখা কক্ষীয় তলের সাথে সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলে আছে। 


নিরক্ষরেখা কক্ষীয় তলের সাথে সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলে আছে

এখানেই একটা মজার ব্যাপার আছে। সূর্য অনুসূরে থাকার সময় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অপসূরে থাকার সময়ের তাপমাত্রার চেয়ে ২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। অথচ এসময় সূর্যের বেশি কাছে থাকে পৃথিবী। 


এর কারণ, মহাদেশ ও মহাসাগরগুলো পৃথিবীজুড়ে সমানভাবে বিন্যস্ত নয়। উত্তর গোলার্ধে ভূমির পরিমাণ বেশি। দক্ষিণে আবার মহাসাগর বেশি। জুন-জুলাই মাসে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। আর এতে করে উত্তর গোলার্ধের ভূমি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মাটি ও বালুর তাপধারণ ক্ষমতা কম। মরুভূমির কথা ভাবুন। দিনের সূর্যে বালু দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তাপমাত্রা হয়ে যায় প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতের বেলা সে তাপ হারিয়ে যায়। মরুভূমি হয়ে যায় শীতল। তাপমাত্রা নেমে হয়ে যায় দিনের অর্ধেকেরও কম (সেলসিয়াস স্কেলে)। 


পৃথিবীর ঋতুচক্র

অন্যদিকে পানির তাপধারণ ক্ষমতা বেশি। সূর্য ডোবার আগে-পরে তাপমাত্রার পার্থক্য খুব বেশি হয় না। কয়েক ডিগ্রি এদিক-সেদিক। 


এ কারণেই জুলাই মাসে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর জানুয়ারি সবচেয়ে শীতল মাস। সেসময় পৃথিবীর জলীয় অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। আমরা বেশি তাপ পাই। তবে সে বাড়তি তাপ সমুদ্রের পানিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এ কারণেই দক্ষিণ গোলার্ধের গরমকাল উত্তরে চেয়ে কম উষ্ণ হয়। অথচ দক্ষিণ গোলার্ধের গরমের সময় পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে (জানুয়ারি)। 


আরেকটা মজার ব্যাপার আছে। কেপলারের গ্রহের দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে, অপসূর অবস্থানের চেয়ে অনুসূর অবস্থান দিয়ে চলার পৃথিবী কক্ষপথে দ্রুত চলে। এ কারণে উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মকাল দক্ষিণের চেয়ে ২-৩ দিন লম্বা হয়। ফলে উত্তরের মহাদেশীয় অঞ্চল গরম হওয়ার জন্য একটু বেশি সময় পায়। 


সূত্র

স্পেস ওয়েদার

টাইম এন্ড ডেট ডট কম

Category: articles

শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪

সম্প্রতি নওতাপ নিয়ে একটি গুজব সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কিছু পত্রিকাও (যেমন দৈনিক ভোরের বার্তা) ফলাও করে তা প্রচার করেছে। নাসার নাম ব্যবহার করায় ব্যাপারটা অনেক মানুষ সহজেই বিশ্বাসও করে ফেলেছেন। 


অল্প কিছু কথার মধ্যে অনেকগুলো ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। 


প্রথমেই বলা হয়েছে, সূর্য রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করবে। কথাটা পুরোপুরি ভুল। একইসাথে বিভ্রান্তিকর। সূর্য নিজেও একটি নক্ষত্র। সাধারণত এক নক্ষত্র অন্য নক্ষত্রের কাছে-ধারেও যায় না। খুব দুর্লভ কিছু ক্ষেত্রে নক্ষত্ররা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে বা মিশে যায়। সাধারণত একই নক্ষত্রপুঞ্জের (Star cluster) নক্ষত্ররা কখনো কখনো একীভূত হতে পারে। নক্ষত্রপুঞ্জে কয়েক হাজার থেকে কয়েক কোটি নক্ষত্র মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গুচ্ছ আকারে থাকে। 


রোহিণী নক্ষত্র (Aldebaran)

আবার নক্ষত্রের জীবনের শেষ ভাগে জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নক্ষত্রের বাইরের অংশ বড় হয়ে যায়। সেক্ষেত্রেও অন্য নক্ষত্র সে স্ফীত অংশে ঢুকে যেতে (প্রবেশ করতে) পারে। 


 নক্ষত্রের জীবনচক্র 


তবে সূর্যের ক্ষেত্রে কোনোটাই সম্ভব না। সূর্য কোনো নক্ষত্রপুঞ্জের অংশ নয়। আশেপাশে সূর্যকে গিলে খাওয়ার মতোও কেউ নেই। তথাকথিত রোহিণী নক্ষত্র সূর্য থেকে ৬৫ আলোকবর্ষ দূরে৷ এটা বৃষমণ্ডলের (Taurus) নক্ষত্র। ইংরেজি নাম Aldebaran। রাতের আকাশের চতুর্দশ উজ্জ্বল নক্ষত্র এটি। উপযুক্ত সময়ে (জানুয়ারি মাস ও তার আগে-পরে) সহজেই খালি চোখে দেখা যায়। 


 আলোকবর্ষ কত বড়?



 উজ্জ্বল তারাদের গল্প


এটা ঠিক বর্তমানে সূর্য বৃষমণ্ডলে অবস্থান করছে। তার মানে এই নয় সূর্য রোহিণীর কাছে চলে গেছে। কথাটা একটু ব্যাখ্যা করতে হয়। আসলে ব্যাপারটা খুব সরল। পৃথিবীকে ঘিরে থাকা পুরো আকাশকে পৃথিবী থেকে দেখতে ৩৬০ ডিগ্রি গম্বুজের মতো লাগে। বাস্তবে তা না হলেও আকাশ পর্যবেক্ষণের সুবিদার্থে উপমাটা কাজে লাগে। পুরো আকাশকে ৮৮টা এলাকায় ভাগ করা আছে। এগুলোকে বলে একেকটি তারামণ্ডল (constellation)। নক্ষত্র, ছায়াপথ, কৃত্রিম উপগ্রহ বা দূর আকাশের বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান নির্দেশ করতে তারামণ্ডল ভাল ভূমিকা পালন করে। এই মুহূর্তে (২৫ মে) সূর্য গম্বুজের যেখানটায় আছে (বলে মনে হয়), সেটার নাম বৃষমণ্ডল। জ্যোতিষবিদরা বলবেন বৃষরাশি। আগেই বলেছি, রোহিণী এ মণ্ডলেরই তারা। 


আরও পড়ুন


তারামণ্ডলের পরিচয়


আবার মনে করিয়ে দেই, মণ্ডল একই হলেই মণ্ডলের বস্তুরা কাছাকাছি থাকে না। পৃথিবী থেকে আকাশের একই দিকে তাকালে দেখা গেলে একই মণ্ডলে থাকতে পারে। বাস্তবে কোনোটা সামনে আর কোনোটা অনেক পেছনে থাকতে পারে। অনেকসময় আমরা আকাশের চাঁদকে অন্য তারার পাশে দেখি। এটা আসলে পৃথিবীর আকাশে তাদের আপাত অবস্থান। একইদিকে অবস্থিত হওয়ায় পাশাপাশি দেখা যায়। বাস্তবে সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরিও (Proxima Centauri) ৪ আলোকবর্ষের বেশি দূরে। মানে সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৪ বছরের বেশি সময় লাগবে। অথচ চাঁদ থেকে আসতে সময় লাগে মাত্র ১.৩ সেকেন্ড। 


পুরো বছরে সূর্য এমন ১৩টা অঞ্চল বা তারামণ্ডল ঘুরে আসে। মানে, পৃথিবী থেকে দেখতে সূর্যকে আকাশের এসব অঞ্চল দিয়ে চলতে দেখা যায়। সূর্যের চলাচলের আপাত এ পথকে বলে সূর্যপথ (ecliptic)। তেরটি অঞ্চলের সমন্বিত নাম রাশিচক্র (zodiac)। প্রচলিত জ্যোতিষবিদ্যার (astrology) রাশিচক্রে ১২টি দেওয়া আছে। তাও তারিখগুলো আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার (astronomy) হিসাবের সাথে মেলে না। জ্যোতিষবিদ্যার প্রাচীন হিসাব বলে, সূর্য বৃষরাশিতে থাকে ২০ এপ্রিল থেকে ২০ মে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক হিসাবে সময়কালটা হলো ১৩ মে থেকে ২১ জুন। 


স্টেলারিয়াম সফটওয়্যার দিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে আপনি নিজেই সূর্যের গতিবিধি দেখতে পারবেন। 


আরও পড়ুন


 সূর্য কখন কোথায় থাকে?



রাশিচক্রের পরিচয় 


১৩ মে থেকে ২১ জুন সূর্য বৃষমণ্ডল পাড়ি দেওয়ার সময় পৃথিবী থেকে দেখতে রোহিণী নক্ষত্রের কাছ দিয়ে পার হবে। আগেই বলেছি, এ অবস্থান নিছক পৃথিবীর আকাশে সূর্য ও রোহিণীর আপাত অবস্থান। বাস্তবে কিন্তু রোহিণীর দূরত্ব সূর্য থেকে ৬৫ আলোকবর্ষই। 


বলা হয়েছে সূর্য ও পৃথিবীর উত্তাপের জন্য রোহিণী নক্ষত্র দায়ী। অথচ সূর্য ছাড়া অন্য নক্ষত্র পৃথিবীর উত্তাপে ভূমিকা রাখে না। হ্যাঁ, রাখে। তার পরিমাণ কতটুকু জানেন? ১০ কোটি-কোটি-কোটি ভাগের ($১০^{২২}$) এক ভাগ। আরও মজার ব্যাপার হলো রোহিণীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সূর্যের চেয়েও কম। সূর্যের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ৫,৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের চেয়ে বয়স্ক লোহিত দানব ধরনের তারা রোহিণীর তাপমাত্রা ৩,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। (সূর্যের বয়স ৪৬০ কোটি বছর আর রোহিণীর ৬৬০ কোটি।)


 সূর্যের তাপমাত্রা কত?



 সূর্যের বয়স কত? 


পৃথিবীর গরম বা ঠান্ডার সাথে সূর্যের নিজস্ব অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা নির্ভর করে  পৃথিবী সূর্যের সাথে কীভাবে হেলে আছে তার ওপর। পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ কক্ষীয় তলের সাথে ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে আছে। ফলে কখনো উত্তর ও কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের দিকে হেলে থাকে। ইদানিং ২০ জুনে হয় উত্তরায়ন (northern solstice)। এ সময় সূর্য পৃথিবীর সর্বউত্তরে আসে। ২৩.৫ ডিগ্রি অক্ষাংশে খাড়াভাবে আলো দেয়। এসময় ও তার আগে-পরে উত্তর গোলার্ধে তীব্র গরম আর দক্ষিণে শীত থাকে। আবার ২১ ডিসেম্বর সূর্য চলে যায় সর্বদক্ষিণে। তখন উত্তরে শীত আর দক্ষিণে গরম চলে। কারণ উত্তর গোলার্ধে তখন সূর্যের আলো পড়ে বাঁকাভাবে। খাড়াভাবে পড়লে তাপের তীব্রতা বেশি থাকে। বেঁকে আসায় তা কমে যায়। 





এখান থেকেই যাই পরের ভুল কথায়। ধারণা দেওয়া হয়েছে, পুরো পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠবে রোহিণীর কারণে। অথচ পুরো পৃথিবীতে কখনোই একইসাথে গরম ও ঠান্ডা থাকে না। বৃষ্টি বা আবহাওয়াহগত অন্য কারণ না থাকলে দুই গোলার্ধে তাপমাত্রা থাকবে বিপরীতধর্মী। 


তবে একটা ভাল পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। গরমে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। 


উল্লেখ্য, নাসা এমন কোনো কথা বলেনি।  কেউ দাবি করে থাকলে সূত্র দিতে বলুন।


Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...