Advertisement

সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬

গত দুই পর্বে আমরা ব্ল্যাকহোলের পরিচয় ও জন্ম-প্রক্রিয়া নিয়ে জেনেছিলাম। আমরা এবারে জানবো এদের আকার ও আয়তন নিয়ে। আলোর বেগকে আটকে ফেলে যে ব্ল্যাকহোল তার অবয়বও নিশ্চয় অনেক বড়। দেখা যাক, এই ধারণা কতটুকু সঠিক। সাধারণত কোন বস্তু কত বড় তা বিবেচনা করতে গেলে আমরা শুধু তার দৈর্ঘ্য বা দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক বস্তুর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ক্ষেত্রফল ও আয়তন দিয়ে হিসেব করি। বাস্তবে অবশ্য দ্বিমাত্রিক বস্তুর গুরুত্ব না থাকায় আমরা আয়তনকেই এ ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ধরি। সেই হিসেবে ব্ল্যাকহোলদের নিয়েও এভাবেই চিন্তা করা উচিত।

কিন্তু সমস্যা আছে দুটো। আমরা ইতোমধ্যেই জানি, মহাকর্ষের নিউটনীয় ধারণা ব্ল্যাকহোলের চিন্তা মিচেল-ল্যাপ্লাস সাহহেবদের মাথায় আনলেও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাই(General Relativity) ব্ল্যাকহোল তত্ত্বকে মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে। এ সত্ত্বেও আইনস্টাইন নিজেও বাস্তবে ব্ল্যাকহোল আছে বলে বিশ্বাস করতেন না (অবশ্য তাঁর সেই বিশ্বাসের কারণ এই যুগে এসে নড়বড়ে হয়ে গেছে)। 

সত্যি বলতে ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ভেতরে ঠিক কী ঘটে তা কেউ জানে না! আবার এর কেন্দ্রে (সিঙ্গুলারিটি, যেখানে সমগ্র ভর একটি বিন্দুতে সীমাবদ্ধ) ভেঙ্গে পড়ে পদার্থবিদ্যার সব সূত্র। এমনকি বিভিন্ন সূত্র যেমন কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও আপেক্ষিকতার মধ্যে চলে পারস্পরিক বৈরিতা। একটু আগে আমরা ব্ল্যাকহোলকে ত্রিমাত্রিক হিসেবে ধরে আকার বা আয়তন হিসেব করবো ভেবেছি। কিন্তু ব্ল্যাকহোল যে আসলে কত মাত্রার বস্তু তাও কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। এটা হতে পারে চার, পাঁচ, দশ বা অন্য যে কোন মাত্রার!

আরেকটি সমস্যা বলি। এটা ঠিক সমস্যা নয়, বলা যায় বিকল্প চিন্তা। মহাজাগতিক বস্তুগুলো কত বড় এটা বোঝার জন্যে দুটি প্যারামিটার ব্যাবহার করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে, বস্তুটির আসলেই আয়তন কত। অপরটি হচ্ছে তার ভর। মনে করা ঠিক হবে না, ভর ও আয়তন সব সময় একে অপরের সমানুপাতিক। অর্থ্যাত একটি বাড়লেই আরেকটিও বাড়বে- এমনটি নাও হতে পারে। প্রথম পর্বেই আমরা এটা জেনেছিলাম। তবে, এখানে আরেকটু বিস্তারিত দেখি।

আমরা ভর ও আয়তনের সম্পর্কটি জানি,
M = ρV
যেখানে,M = বস্তুর ভর, ρ = ঘনত্ব এবং V = আয়তন।

সাধারণ হিসাবে এ সূত্র অনুসারে, ভর আয়তনের সমানুপাতিক। অর্থ্যাৎ, আয়তন বাড়লে ভরও বাড়বে। তার মানে, ভর বাড়লে আয়তনও বাড়বে, তাই না? আসলে কিন্তু সব সময় তা হবে না। কেন? একটু ভাবুন, তারপরে আবার সামনে পড়ুন। প্রথমত, এখানে আমরা আলোচনা করছি বিশাল বিশাল মহাজাগতিক বস্তুদের নিয়ে। এদের ক্ষেত্রে ভর বাড়ার অর্থ হচ্ছে বস্তুর অভিকর্ষ লক্ষ্যনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়া, যার পরিণতি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অভিকর্ষ যা বস্তুটির নিজের উপরেই কার্যকর হয়ে একে গুটিয়ে ছোট্টতর করে ফেলবে। এমন ঘটনা নিউট্রন স্টার বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন নক্ষত্রদের বেলায়ও ঘটে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে বস্তুটির ঘনত্ব। উপরের সূত্রে আয়তন বাড়লে ভরকেও যদি বাড়তে হয় তবে সেক্ষেত্রে বস্তুর ঘনত্ব স্থির থাকতে হবে। অন্যথায় আয়তন বেশি থাকা বস্তুও যদি তারচেয়ে কম আয়তনের বস্তুর চেয়ে কম ঘনত্বের অধিকারী হয়, তবে প্রথম বস্তুর ভর কম হয়ে যেতে পারে।

এই দুই বিষয়ের যৌথ খপ্পরে পড়ে ভর বাড়ার সাথে সাথে আয়তনের বৃদ্ধি ও হ্রাস-দুটোই ঘটতে পারে। যেমন ধরুন আমাদের গত সংখ্যায় আলোচিত নিউট্রন স্টারদের কথা।

এদের ভর সূর্যের কয়েকগুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাসার্ধ হয় মাত্র ৭ মাইলের মতো! কল্পনা করা যায়! ফলে দেখা যায় এদের প্রতি ঘন মিটারে 3.7×1017 থেকে 5.9×1017 কেজি পর্যন্ত ভর জড় হয়ে থাকে। অথচ আমাদের সূর্যের প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে মাত্র ১ দশমিক ৪ গ্রামের কাছাকাছি ভর থাকে! ঘনত্বের কি বিশাল ফারাক!

অন্য দিকে উল্টো ঘটনাও ঘটে। যেমন সুপারম্যাসিভ (Supermassive) তথা অতি উচ্চ ভরবিশিষ্ট ব্ল্যাকহোলদের আয়তনও হতে পারে সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। যেমন এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া প্রস্তাবিত ব্ল্যাকহোলদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভরযুক্ত দানবের ভর সূর্যের ৪০ বিলিয়ন গুণ। তাই বলে আয়তন কিন্তু ছোট হয়ে যায়নি। এর ব্যাসও বিশাল- প্রায় ২৩৭ বিলিয়ন কিলোমিটার।

তবে এখানে একটু সাবধান হতে হবে। অন্যান্য বস্তুদের মত করে ব্ল্যাক হোলের আকার চিন্তা করলে ভুল হয়ে যেতে পারে। ব্ল্যাক হলের সমগ্র ভর একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে আবদ্ধ থাকে যার আয়তন প্রায় শুন্য। তাই আমরা যখন ব্ল্যাক হোলের আয়তন বা ব্যাসার্ধ বলব, বুঝতে হবে এটা আসলে ব্ল্যাক হলের ঘটনা দিগন্তের (যে দূরত্ব থেকে কিছুই, এমনকি আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না) পরিমাপ। তাই উপরের ভর-আয়তনের সূত্রের আলোচনা ঠিক সাধারণ অর্থে ব্ল্যাক হোলের জন্যে কাজ করবে না। অন্য অর্থে বলা যায় সবচেয়ে সুন্দরভাবে কাজ করবে। কারণ আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম ভর বাড়লে আয়তন কমতেও পারে। সেটার সবচেয়ে ভালো উদাহরণতো ব্ল্যাক হোলই।

ফলে, এ পর্যন্ত আমরা যা বুঝলাম, মহাজাগতিক বস্তুদের ক্ষেত্রে বড়ত্বের হিসাবে নিছক আয়তনকে নয়, ভরকেও বিবেচনা করতে হবে। তাহলে আমরা এবার দেখার চেষ্টা করি এই দুই দিক দিয়ে ব্ল্যাকহোলরা কত বড় হতে পারে।

প্রথমে ভরের কথা বলা যাক। সত্যি বলতে একটি ব্ল্যাকহোলে সর্বোচ্চ ঠিক কত ভর থাকতে পারে, তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। বেশি ভরের পাশাপাশি অল্প পরিমাণ ভর যুক্ত হয়েও ব্ল্যাকহোলের অন্ধকার রাজ্য গড়ে উঠতে পারে যদি এর ঘনত্ব হয় অতি উচ্চ। তবে, এখন পর্যন্ত জানা তথ্য মতে যেহেতু অধিকাংশ ব্ল্যাকহোলদেরই জন্ম বেশি ভরযুক্ত (Massive)  নক্ষত্রদের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে, তাই আমরা বলতে পারি, একটি ব্ল্যাকহোলের ভর একটি ভারী নক্ষত্রের ভরের কাছাকাছি।

আমরা গত পর্বেই দেখেছি, এই স্টেলার ব্ল্যাকহোলরা সূর্যের ১৫ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি ভর ধারণ করতে পারে। তাহলে তাদের ভর কত হবে? এটা বোঝার জন্যে আমাদেরকে নিছক সূর্যের ভর জানতে হবে যা আমরা জানি যে, ১০৩০ কেজি। তাহলে একটি সাধারণ ব্ল্যাকহোলের ভর হবে (যদি এর ২০ গুণ ধরি) ২৩৩ কেজি। চাইলে এবার তুমি নিজেই ২ এর পরে ৩২ খানা শুন্য বসালে যা হবে সেতাই এই ভর। উল্লেখ্য, এটা কিন্তু ব্ল্যাকহোলের ভরের নিম্ন সীমা। আগেই বলেছি, এর ভর সর্বোচ্চ কত হতে পারে তা বলার কোন উপায় নেই। তবে স্টেলার ব্ল্যাকহোলদের ক্ষেত্রে ভর খুব বেশি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এখন পর্যন্ত জানা তথ্য অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ভরের তারকার ভর ২৬৫ সৌর ভরের সমান। এর নাম R136a1।

একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল

এতো গেল শুধু স্টেলার ব্ল্যাকহোলের কথা। কিন্তু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলরা এতটা পিছিয়ে নেই। এদের ভর হতে পারে সূর্যের কয়েক লক্ষ গুণ থেকে শুরু করে কয়েকশো কোটি গুণ পর্যন্ত! ভাবা যায়! আমাদের মিল্কিওয়েসহ অধিকাংশ গ্যলাক্সির কেন্দ্রে এদের বসবাস। অন্য দিকে আরেক জাতের ব্ল্যাকহোল হচ্ছে মিনি বা মাইক্রো ব্ল্যাকহোল। আমরা জানি, কোন বস্তুকে ব্ল্যাক হোল হতে হলে এর মুক্তিবেগ হতে হবে আলোর বেগের চেয়ে বেশি। অর্থ্যাৎ, কাউকে একটি ব্ল্যাক হোল উৎপাদন করতে হলে বস্তুর ভর বা শক্তিকে এত বেশি সঙ্কুচিত করতে হবে যে এর পৃষ্ঠ থেকে কোন বস্তুকে বের করতে হলে আলোর চেয়ে বেশি বেগ দিতে হবে।

তাহলেতো যে কোন ভরকেই যথেষ্ট পরিমাণ চেপে গুটিয়ে ফেলে ব্ল্যাকহোল বানিয়ে ফেলা সম্ভব, তাই না? তাত্ত্বিকভাবে অবশ্য তাই। কিন্তু আরো জটিল কিছু কারণে একটি ব্ল্যাকহোলের সর্বনিম্ন ভর হতে পারে প্ল্যাঙ্ক ভরের সমান তথা মাত্র ২২ মাইক্রোগ্রামের সমান। উল্লেখ্য, একটিমাত্র মৌলিক আধান (Charge) ধারণে সক্ষম ভরকে প্ল্যাংক ভর (Planck Mass) বলা হয়।

এবার চলুন দেখি ব্ল্যাকহোলদের আকার কেমন হতে পারে। আমরা যেহেতু জানি, ব্ল্যাকহোলের মুক্তিবেগ অন্তত আলোর বেগের সমান হতে হবে, এই তথ্য কাজে লাগিয়ে আমরা এদের ন্যূনতম ব্যাসার্ধ বের করতে পারি।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ব্ল্যাকহোল নামক বস্তুটির ব্ল্যাকহোলসুলভ আচরণ শুধু তার ঘটনা দিগন্ত বা তার ভেতরের অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। কারণ, এই সীমার ভেতরের কোন ঘটনা আমরা দেখতে না পেলেও বাইরের ঘটনা দেখতে পাবো। আরেকভাবে বললে, আপনি যদি কখনো ব্ল্যাকহোল অভিযানে যান, তবে ঘটনা দিগন্ত পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে। কিন্তু যেই আপনি এই সীমা ভেদ করে আরো ভেতরে যাবেন, তখনই আপনার ফিরে আসার সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাবে। 

অবশ্য আশা যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে ব্ল্যাকহোল টাইম ট্র্যাভেল ঘটাতে পারে, তৈরি করতে এক ডাইমেনশন থেকে আরেক ডাইমেনশনে যাবার, এমনকি আরেকটি ইউনিভার্সে পাড়ি দেবার জন্যে ওয়ার্মহোল নামক টানেলও তৈরি করতে পারে। ভবিষ্যতের কোন পর্বে আমরা ওয়ার্মহোল ও টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে জানবো, ইনশা-আল্লাহ। যাই হোক, এখন তাহলে মূলত, ব্ল্যাকহোলের আকার বা ব্যাসার্ধ বলতে আসলে আমরা ঘটনা দিগন্তের (Event horizon) ব্যাসার্ধ জানতে চাচ্ছি।

এই ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ সর্বপ্রথম বের করেন জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জসাইল্ড। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়েই এই গাণিতিক হিসাবখানি প্রস্তুত করেন। তাঁর নামানুসারে এক বিশেষ ধরনের ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধকে সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius) বলা হয়। এই ব্যাসার্ধ্য ব্ল্যাকহোলের ভরের সাথে সমানুপাতিক। সূত্রটি হচ্ছে,


যেখানে, R = সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ, G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, M = ব্ল্যাকহোলের ভর এবং c = আলোর বেগ যা সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার বা ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬ মাইল থেকে শুরু করে সৌরজগতের সমানও ঘটনা দিগন্ত খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু এই সূত্র দিয়ে হিসাব করলে আমরা তাত্ত্বিকভাবে আরো ক্ষুদ্র বা বড় ব্ল্যাকহোলও পাব। যেমন, পৃথিবীর সমান ভরের কোন বস্তুকে যদি ব্ল্যাকহোল হতে হয়, তবে এর ভরকে গুটিয়ে এতটা সঙ্কুচিত করতে হবে যে তখন এর আকার দাঁড়াবে একটি ক্ষুদ্র মার্বেলের সমান। বিশ্বাস না হলে উপরের সূত্রে পৃথিবীর ভর (৬×১০২৪ কিলোগ্রাম) বসিয়ে দেখুনই না!

আসলে ব্ল্যাকহোল হবার জন্যে খুব বেশি ভরের দরকার নেই, দরকার শুধু উপস্থিত ভরটুকুর গুটিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষুদ্র জায়গায় অবস্থান করার। একইভাবে আমাদের সূর্য যদি ব্ল্যাকহোল হতে চায় তবে এর ব্যাসার্ধ কমিয়ে বানিয়ে দিতে হবে ৩ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এমনকি তাত্ত্বিকভাবে মাউন্ট এভারেস্টের সমান পাহাড়ও ব্ল্যাকহোল হতে পারবে যদি এর ভরকে গুটিয়ে এত ছোট বানাতে হবে এর সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ দাঁড়াবে এক ন্যানোমিটারের চেয়েও অনেকটা ক্ষুদ্র।  কিন্তু বাস্তবে মাউন্ট এভারেস্ট, পৃথিবী বা সূর্য কারো পক্ষেই ব্ল্যাকহোল হওয়া সম্ভব নয়। একটু ভাবুন কেন সম্ভব নয়। গত সংখ্যার লেখায় কিছু ক্লু পাবে। বিস্তারিত আমরা অন্য পর্বে দেখবো, ইনশাআল্লাহ।

অন্য দিকে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিজেই যদি একটি ব্ল্যাকহোল হবার আশা পোষণ করে তবে এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ২ কোয়াড্রিলিয়ন মিটার। ২ এর ১৫ শুন্য বসিয়ে দেখুন সংখ্যাটি কত বিশাল।  তবে এই দৈর্ঘ্য কিন্তু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নিজের ব্যাসার্ধ্যের চেয়ে ৫ লক্ষ গুণ ছোট।

আশা করি, শেষের দিকের এই আলোচনা সংক্ষেপে আমাদের গত পর্বের বিদায়ী প্রশ্নের জবাব সংক্ষেপে হলেও দিয়েছে। প্রশ্নটি ছিল অতি অল্প পরিমাণ ভর নিয়ে কিভাবে ব্ল্যাকহোল, সত্যি বলতে মাইক্রো ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে? এর জবাব আমরা আরো বিস্তারিত জানবো অন্য পর্বে। চলে যাচ্ছি আরেকটি বিদায়ী প্রশ্ন দিয়ে। গত পর্বে আমরা দেখেছিলাম, তারকাদের জীবনের শেষের দিকেই কেবল স্টেলার ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে। অথচ জীবনের শুরুতেই এর ভর ছিল আরো বেশি। কারণ, জীবনের শেষের দিকে পৌঁছতে গিয়ে এর জ্বালানি খরচ করে আলো, তাপ ইত্যাদি উৎপন্ন করতে হয়েছে। ফলে, শেষের দিকে এর ভরতো আইনস্টাইনের E=MC2 সূত্র মেনে শক্তি রূপে অনেকটাই কমে গেছে। প্রশ্ন হলো, জীবনের শুরুতেই এর ভর কেন একে ব্ল্যাকহোল বানায়নি? চিন্তা করুন। বুঝতে পারলে আমাকে জানাতে পারেন, এই নাম্বারে- 01722-(3500112)7। নাম্বারটি বুঝতে অসুবিধা হলে আপাতত কিছু করার নেই- এই লিঙ্কটি দেওয়া ছাড়া।

তথসূত্র
১। http://cfpa.berkeley.edu/Education/BHfaq.html#q2
2. https://en.wikipedia.org/wiki/Neutron_star
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_most_massive_stars_known
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Supermassive_black_hole
৫। http://csep10.phys.utk.edu/astr162/lect/active/smblack.html
৬। http://hubblesite.org/explore_astronomy/black_holes/encyc_mod3_q3.html
৭। https://en.wikipedia.org/wiki/Schwarzschild_radius
৮। https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_most_massive_black_holes

অন্যান্য পর্ব



Category: articles

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬

সৌরজগতের গ্রহদের মধ্যে একমাত্র শুক্র ও বুধের কোনো উপগ্রহ নেই।

সৌরজগতে সব মিলিয়ে ১৮১টি উপগ্রহ রয়েছে। এতে অবশ্য বামন গ্রহদের উপগ্রহদেরকে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি উপগ্রহ দেখতে গোলাকার। এর ফলে এরা যদি অন্য কোন গ্রহ বা বামন গ্রহের উপগ্রহ না হত, তবে সরাসরি গ্রহের খেতাব পেয়ে যেত। কিন্তু সৌরজগতের এত উপগ্রহ থাকতেও বুধ ও শুক্র গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই।

অন্য দিকে, পৃথিবীর একটিমাত্র উপগ্রহ আছে- চাঁদ। মঙ্গলের আছে ডেমোস ও ফোবোস নামে দুটি উপগ্রহ। বৃহস্পতির উপগ্রহ সবচেয়ে বেশি-  অন্তত ৬৭টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আয়ো , ইউরোপা, গ্যানিমিড ও ক্যালিস্টো। শনিও পিছিয়ে নেই। এর দখলে আছে ৬২ খানা চাঁদ (উপগ্রহকে অনেক সময় চাঁদও বলা হয়)। ইউরেনাস ও নেপচুনের যথাক্রমে ২৭ ও ১৪টি করে চাঁদ আছে।
প্লুটো এখন আর গ্রহ নয়, কিন্তু তারও উপগ্রহ আছে। তাও একটি দুটি নয়, পাঁচ-পাঁচটি। বামন গ্রহদের মধ্যে সেরেস ও মাকিমাকির কোন চাঁদ নেই। কিন্তু প্লুটো ছাড়াও অপর দুই বামন গ্রহ হোমিয়া ও ইরিসের যথাক্রমে ২টি ও ১টি করে চাঁদ আছে।
কিন্তু বুধ ও শুক্রের কোন উপগ্রহ বা চাঁদ নেই কেন?
এর প্রধান সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, এরা সূর্যের খুব নিকটে অবস্থান করছে। গ্রহদ্বয় থেকে বেশ দূরে অবস্থানকারী কোন উপগ্রহ স্থিতিশীল কক্ষপথের মালিক হতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে এটি গ্রহের আকর্ষণে থাকার পরিবর্তে সূর্যের টানে সাড়া দেয়। আর যদি গ্রহের খুব কাছে থাকে, তাহলে আবার গ্রহের শক্তিশালী আকর্ষণে গ্রহের সাথে একীভূত হয়ে যায়। এই গ্রহদের চারপাশের যে অঞ্চলে উপগ্রহদের জন্যে নিরাপদ কক্ষপথ হতে পারত সম্ভবত সে অঞ্চলটি খুব সংকীর্ণ যার ফলে কেউ তা হাসিল করতে পারেনি।
আরেকটি ব্যাখা এ রকম। সৌরজগতের অধিকাংশ উপগ্রহই তৈরি হয়েছে গ্রহদের দ্বারা বিভিন্ন গ্রহাণু ও বড় পাথরখণ্ড দখলের কারণে। কিন্তু বুধ সূর্যের খুব নিকটে থাকার কারণে কোন গ্রহাণু বা ধূমকেতু যখন এর কাছাকাছি আসে তখন এটি সূর্যের কবলে পড়ে যায়। এরা তখন হয় সূর্যে গিয়ে পতিত হয় অথবা ধূমকেতুতে পরিণত হয়। ধূমকেতুর কক্ষপথ ছিনতাই করে উপগ্রহ বানাবার মত শক্তি বুধের নেই বলেই এর কোন উপগ্রহ নেই।

সূত্রঃ
[১] উপগ্রহের তালিকা
[২] অ্যাস্ট্রোনমি ক্যাফে
[৩] টেক্সাস আরলিংটন ইউনিভার্সিটি
Category: articles

শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

একটি বস্তুতে মোট পদার্থের পরিমাণকে ভর বলে। একে আমরা সাধারণত ওজোন বলি। প্রকৃতপক্ষে ওজোন হচ্ছে বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের পরিমাপ। সৌরজগতে বর্তমানে গ্রহের সংখ্যা ৮টি। আগে ৯টি থাকলেও প্লুটোর পদবী এখন বামন গ্রহ হওয়াও সংখ্যা এক কম।
আমরা গ্রহদের ভরের প্রকৃত মান দেখার পাশাপাশি পৃথিবীর সাথে তুলনা করব। এখানে ভর উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সংখ্যা উল্লেখ করব। যেমন বুধ গ্রহের ভর 3.30×1023 kg। এর অর্থ হচ্ছে ৩.৩ এর পরে ২৩ টি শুন্য দিলে যা হবে। আগেই জেনে রাখা ভাল, পৃথিবীর ভর হচ্ছে 6×1024 kg। 
সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮৬ ভাগই সূর্যের একার দখলে। আবার বৃহস্পতির একার ভর অন্য ৭ গ্রহের আড়াই গুণ। 
সৌরজগতের গ্রহদের ভর নিয়ে পাই চার্ট

বুধঃ 
উপরে উল্লেখিত বুধের এই ভরটিই সৌরজগতের কোন গ্রহের সবচেয়ে ছোট ভর। বুধ গ্রহের ভর কম হওয়ায় এটি নিজে যেমন খুব হালকা তেমনি এতে গেলে আমাদের ওজোনও প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে যাবে। একটু আগেই বলেছি, ওজোন হচ্ছে প্রযুক্ত বলের পরিমাণ। ফলে, ভর কম হওয়ায় অভিকর্ষজ ত্বরণ কমে যাবে, এবং সেই সাথে ওজোনও। কারণ বস্তুর ওজোন নির্ভর করে এর অভিকর্ষজ ত্বরণের উপর। পৃথিবীতে আপনার ওজোন (ভর) ৬৮ কেজি হলে বুধে তা হবে ২৫.৭ কেজি। পৃথিবীর তুলনায় বুধের ভর ০.০৫৫ গুণ। উল্টোভাবে বললে ১৮টি বুধ একত্র করলে পৃথিবীর ভরের সমান হবে। 
শুক্রঃ
একে আমরা শুকতারাও বলি। অধিকাংশ গ্রহের তুলনায় এটিও খুব হালকা। এর ভর ভর ও আয়তনে অবশ্য পৃথিবীর কাছাকাছি, তবে অবস্থান একটু নিচে। ভর 4.87×1024 kg এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ পৃথিবীর ৯০ পারসেন্ট। এর মানে হল,  কেউ পৃথিবীতে ১০০ কেজি হলে শুক্র গ্রহে তার ভর হবে ৯০ কেজি। পৃথিবীর ভর ১০০ কেজি ধরে নিলে শুক্রের ভর হবে ৮১.৫ কেজি। শুক্রের অভিকর্ষ আমাদেরকে মেরে ফেলার মত প্রাণঘাতী না হলেও এর বিষাক্ত গ্যাস ও উচ্চ তাপমাত্রা সেই কাজ সম্পন্ন করবে।
মঙ্গলঃ
কম ভরের দিক দিয়ে সৌরজগতে মঙ্গলের অবস্থান ২য়। পৃথিবীর চেয়ে এর ভর ১০ গুণ কম। প্রকৃত ভর  6.42×1023 kg কেজি। এর ভর এত কম যে,এতে কোন বায়ুমণ্ডল তৈরি হতে পারেনি। বায়ুমণ্ডল না থাকার কারণেই আমরা এর লাল পৃষ্ট অবলীলায় দেখতে সক্ষম হই। 
আরো দেখুনঃ মঙ্গল গ্রহ লাল কেন? 
বৃহস্পতিঃ
হ্যাঁ, গ্রহরাজ বৃহস্পতির ভর সৌরজগতের গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর ভর 1.90×1027 kg। ৩১৮ টি পৃথিবীর ভর একত্র করলে তবেই তা বৃহস্পতির ভরের সমান হবে। বৃহস্পতির কোন কঠিন পৃষ্ঠ নেই বলে এতে দাঁড়ানো যাবে না। কিন্তু যদি যেতও এর শক্তিশালী অভিকর্ষ সাথে সাথে আমাদেরকে পিষে ফেলত। অভিকর্ষ বেশি হবার কারণে যে মানুষটির ভর পৃথিবীতে ৬৮ কেজি, এই গ্রহে তার ভর দেখা যাবে ১৬১ কেজি। প্রকৃতপক্ষে অবশ্য ভর বাড়বে না। পৃথিবীতে আমরা ভর মাপার জন্যে যে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করি, তা ওখানে নিয়ে গেলে অভিকর্ষজ ত্বরণের পার্থক্যের কারণে ভিন্ন ভর দেখাবে। আসলে এটা ভরের পার্থক্য বোঝাচ্ছে না, বোঝাচ্ছে ত্বরণের পার্থক্য। 
শনিঃ
শনির ভর 5.69×1026 kg। ভরের দিক দিয়ে এর অবস্থান ২য়। এর ভর ভর পৃথিবীর ৯৫ গুণ হলেও ঘনত্ব খুব কম হওয়ায় অভিকর্জষজ ত্বরণ পৃথিবীর চেয়েও কম- মাত্র ৯১%। অর্থ্যাৎ, শনিতে গেলে আমাদের ওজোন একটুখানি ক্মে যাবে।  
ইউরেনাসঃ 
সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ ইউরেনাসের ভর 8.68×1025 kg। শনির মতই এর ভর পৃথিবীর চেয়ে বেশি হলেও অভিকর্ষ পৃথিবীর চেয়ে কম। আপনার ভর পৃথিবীতে ৬৮ কেজি হলে, ইউরেনাস গ্রহে গিয়ে মাপলে তা দেখা যাবে ৬০.৫ কেজি। 
নেপচুনঃ
নেপচুন ভরের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে। এর ভর 1.02×1026 kg যা পৃথিবীর ১৭ গুণ। এর অভিকর্ষ ত্বরণও পৃথিবীর চেয়ে বেশি। আপনি পৃথিবীতে ৬৮ কেজি হলে নেপচুনে গিয়ে হবেন ৭৬.৫।  
সূত্রঃ
[১] http://www.universetoday.com/34024/mass-of-the-planets/
[২] http://astronomy.nmsu.edu/tharriso/ast110/planetdensities.gif
Category: articles

শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৬

মাইজার ও অ্যালকর আকাশের অন্যতম বিখ্যাত ডাবল স্টার। দুটোর মধ্যে মাইজারকে খুব সহজেই দেখা যায়, এমনকি শহর থেকেও। এর পাশেই অবস্থান অ্যালকরের। তবে একে খুঁজে পেতে চোখের একটু পরিশ্রম হবে।

মাইজার ও অ্যালকর 

এরা দুজনেই সপ্তর্ষীমণ্ডলীর সদস্য। তবে মাইজার  আবার সাতটি তারায় গঠিত চামচের মত দেখতে সপ্তর্ষী নামক তারাভুজের অংশ। প্রাচীন কাল থেকেই চোখ পরীক্ষার জন্যে অ্যালকর তারাটি ব্যবহৃত হত। অবশ্য স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য খারাপ চোখ দিয়ে অ্যালকরকে দেখা সম্ভব। তবু, আগেকার যুগে সেনাবাহিনীতে সৈন্য নিয়োগের সময় এই তারাটির মাধ্যমে চোখের পরীক্ষা নেওয়া হত। শহরের আলো বা ঝাপসা আকাশের কারণে খালি চোখে অনেক সময় একে দেখা না গেলেও দুরবিনে এটি ঠিকই দর্শনীয় হয়ে ওঠে।


মাইজার সম্ভবত সপ্তর্ষীর সবচেয়ে বিখ্যাত তারা। অ্যালকরকে বাদ দিলেও মাইজার নিজেও একটি ডাবল স্টার। এটা যে আসলে একটি ডাবল স্টার তা ১৬৫০ সালেই জানা গিয়েছিল। উপরন্তু টেলিস্কোপে দেখা ডাবল স্টারদের মধ্যে এটিই প্রথম।


আগে মনে করা হত নিজেরা অনেক দূরে অবস্থিত থেকেও শুধু আকাশের একই দিকে অবস্তিত হওয়াই শুধু ডাবল স্টার হবার কারণ হতে পারে। এদের নিজেদের মধ্যে সম্ভবত কোন আকর্ষণ কাজ করে না। কিন্তু ১৮৮৯ সালে এই ধারণা পাল্টে গেল। স্পেক্ট্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখা গেল, মাইজার দুটো নক্ষত্রের মধ্যে টেলিস্কোপে দেখা উজ্জ্বলতর সদস্যটি আসলে নিজেও আবার দুটো নক্ষত্রের সমন্বয়। মাইজার এই বাইনারি সিস্টেমও স্পেক্ট্রোস্কোপির মাধ্যমে আবিষ্কৃত প্রথম বাইনারি স্টার।


পরে দেখা গেল, অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল নক্ষত্রটিও আসলে বাইনারি স্টার। ফলে, সব মিলিয়ে শুধু মাইজারই দুইয়ে দুইয়ে চারটি নক্ষত্র হল। এরকম ক্ষেত্রে তারাদের বলা হয় কোয়াড্রুপল স্টার। এর আগে আমরা দেখেছিলাম আলম্যাকও একটি কোয়াড্রুপল স্টার।

মাইজার  ও অ্যালকর

এবার আসি অ্যালকরের কথায়। আগে মনে করা হত সাথে মাইজারের কোন মহাকর্ষীয় টান নেই। আরো মনে করা হত, অ্যালকর কোন বাইনারি জগতের সদস্য নয়। কিন্তু এ ধারণাও পাল্টে গেল ২০০৯ সালে। স্বতন্ত্রভাবে দুই দল জ্যোতির্বিদ দেখালেন যে অ্যালকর আসলে অ্যালকর  এ ও বি দুটো তারায় গঠিত। এখন মনে করা হয় অ্যালকরের এই বাইনারি জগৎ মাইজারের কোয়াড্রুপল জগতের সাথে মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ। ফলে সব মিলিয়ে ছয়টি তারকার সমাবেশ!


মাইজার ও অ্যালকর শুধু আমাদের চোখের পরীক্ষাই নিচ্ছে না, নিচ্ছে আমাদের প্রযুক্তির উন্নতির পরীক্ষাও!

আরবি  المئزر শব্দ থেকে মাইজার নামটি এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ কোমরবন্ধ বা বেল্ট।
Category: articles

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬

হারকিউলিস তারামণ্ডলী, সাথে তারাভুজ কি-স্টোন

এপ্রিল মাসের রাতের আকাশ নিয়ে এলো হারকিউলিস তারামণ্ডলী। রাতের আকাশের যথাক্রমে ৫ম ও ৪র্থ উজ্জ্বল তারকা অভিজিৎ (Vega) ও স্বাতীর (Arcturus) মাঝে এটির অবস্থান। ছবিটি এপ্রিলের
পূর্ব আকাশ দেখাচ্ছে।
হারকিউলিস তারামণ্ডলীতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ তারাভুজ রয়েছে। এর নাম কি-স্টোন। উপরের ছবিতে প্রায় বর্গাকার বা আয়তাকার যে অংশটি দেখা যাচ্ছে এটিই হচ্ছে কি-স্টোন তারাভুজ (Asterism)। এই তারাভুজ এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এর মাধ্যমেই হারকিউলিসকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
তারাভুজটির মাধ্যমে দারুণ একটি তারকাগুচ্ছও খুঁজে পাওয়া যাবে। এর নাম হারকিলিসের গ্রেট ক্লাস্টার বা সংক্ষেপে এম ১৩ (M13)। গুচ্ছটিকে খালি চোখে ভালোভাবে না দেখা গেলেও দুরবিনের চোখে এটি দর্শনীয় হয়ে ওঠে। প্রায় ১০ লক্ষের মত পুরাতন তারকায় ঠাঁসা গুচ্ছটি।

Category: articles

রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৬

শুধু এই সাতটি তারাকেই আমরা সাধারণত সপ্তর্ষীমণ্ডলী বললেও এরা আসলে পুরো মণ্ডলীর একাংশ মাত্র। এটি প্রকৃতপক্ষে তারানকশা। 

তারামণ্ডলী ও তারানকশা দুটোই আকাশের বিভিন্ন তারায় তৈরি নকশা। রাতের তারাখচিত আকাশের দিকে তাকালেই মনে হবে কিছু তারার সমন্বয়ে অর্থবোধক কোন আকৃতি তৈরি হয়েছে। মানুষের মনে চিত্রিত এই আকৃতিগুলো থেকেই রূপ পেয়েছে তারামণ্ডলী ও তারানকশা। ইংরেজিতে এদের নাম যথাক্রমে Constellation ও Asterism। এতে যেমন মানুষের প্রতিকৃতি আছে, তেমনি আছে রূপকথার প্রাণী, বিভিন্ন বস্তু। তবে তারামণ্ডলী বা তারানকশার তারারা একে অপরের সাথে সাধারণত সম্পর্কিত নয়। পৃথিবী থেকে দেখতে এদেরকে পাশাপাশি মনে হলেও বাস্তবে এরা পৃথিবী থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত।

উল্লেখযোগ্য কিছু তারামণ্ডলী হল কালপুরুষ বা আদম সুরত, বৃশ্চিক মণ্ডলী, বকমণ্ডলী ইত্যাদি।

আদম সুরত। অনেকের মতেই এটাই সেই মণ্ডলী যা সবচেয়ে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। 


কাঁকড়াবিছার মত দেখতে মণ্ডলীটির নাম বৃশ্চিক মণ্ডলী 

তারামণ্ডলীর সংখ্যা ৮৮ এবং এদের সবাইকে নিয়ে পুরো দৃশ্যমান আকাশ গঠিত। আকাশে কোন তারা বা অন্য কোন বস্তুর (দূরবর্তী গ্যালাক্সি, তারাস্তবক ইত্যাদি) অবস্থান নির্ণয় করতে তারামণ্ডলী কাজে আসে। দৃশ্যমান আকাশের যে কোন বস্তু কোন না কোন তারামণ্ডলীতে অবস্থিত থাকবেই।


তারামণ্ডলীর মতই তারানকশাও তারায় তৈরি নকশা। তবে তারামণ্ডলীর মত এরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভিন্ন তারামণ্ডলীর তারা নিয়ে এরা গঠিত হতে পারে, আবার একই তারামণ্ডলীর কয়েকটি তারা নিয়েও হতে পারে। বিখ্যাত তারানকশার মধ্যে অন্যতম সপ্তর্ষীমণ্ডলীর সাতটি তারা নিয়ে গঠিত চামচ যা থেকে ধ্রুব তারা চেনা যায়।

সামার ট্রায়াঙ্গেল। এটি তিনটি আলাদা মণ্ডলীর ভিন্ন তিনটি তারার সমাবেশ। 
Category: articles

শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৬

এই এপ্রিলের আকাশের সবেচেয়ে দর্শনীয় বস্তু গ্রহ রাজ বৃহস্পতি। ইদানিং এটি সন্ধ্যার পরপর এটি আকাশে হাজির হয়। অন্য গ্রহদের অবস্থাও এ মাসে বেশ ভালো। কিন্তু উজ্জ্বলতম গ্রহ শুক্রই এ মাসে দেখা যাবে না। তবু সামগ্রিক বিচারে গ্রহ দেখার জন্য এ মাসটি বছরের অন্যতম সেরা মাস। 
বৃহস্পতিঃ
এ মাসে উজ্জ্বলতায় সবার শীর্ষে বৃহস্পতি। সন্ধ্যার পরেই এটি আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র লুব্ধকের সাথে উজ্জ্বলতার টক্কর লাগায়। টক্করে বিজয়ী বৃহস্পতিই। পরাজয় মেনে নিয়ে লুব্ধক অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পরেই হারিয়ে যায় পশ্চিম দিগন্তে। কিন্তু বৃহস্পতি প্রায় সারা রাত রাতের আকাশে রাজত্ব করে পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেবে ভোরের দিকে। আগামী মাসগুলোতেও এটি নিজের পারফরম্যান্স অব্যাহত রাখবে।
লুব্ধক ও বৃহস্পতিকে কি করে চেনা যাবে? 
লুব্ধক বছরের এ সময় থাকে দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে। অন্য দিকে বৃহস্পতি সন্ধ্যার পরে পূর্ব দিকে ভেসে ওঠে। আদম সুরতের মাধ্যমে লুব্ধককে চিনে নেওয়া যেতে পারে।
আদম সুরতের মাঝের তিনটি তারা যোগ করে বাম দিকে বাড়িয়ে দিলেও পাওয়া যায় লুব্ধক
বর্তমানে বৃহস্পতির অবস্থান রাশিচক্রের সিংহ মণ্ডলীর কাছে
মঙ্গল গ্রহঃ
এ মাসে মঙ্গল বৃহস্পতির মত এতটা উজ্জ্বল নয়। তবে, আগামী দিনগুলোতে মঙ্গল ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকবে, আর বৃহস্পতি ধীরে ধীরে অনুজ্জ্বল হবে। এমনকি এ মাসেই মঙ্গল স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বল হবে। কেন? কারণ কোন গ্রহ যখন সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময় পূর্ব দিকে উদিত হয়, তখন এটি এর সেরা ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে। এ কারণেই বৃহস্পতি এখন উজ্জ্বল এবং সেই কারণেই মঙ্গল দ্রুত উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছে। 
মে মাসের শেষের দিকে এটি উজ্জ্বলতায় চারগুণ হয়ে যাবে। ঐ সময় সূর্য পশ্চিমে হারিয়ে গেলে এটি পূর্ব দিগন্তে দেখা দেবে। এ মাসে অবশ্য এটি দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে হাজির হয় ১১টার দিকে। মাসের শেষের দিকে উঠবে ৯ টার দিকে। এর পাশেই আছে আরেকটি গ্রহ শনি। 
দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে মঙ্গল ও শনি গ্রহ
শনি গ্রহঃ
এ মাসের আরেকটি উজ্জ্বল বস্তু। অবশ্য বৃহস্পতি ও মঙ্গলের চেয়ে এটি মৃদু। মঙ্গলের মতই বৃশ্চিক মণ্ডলীর কাছাকাছিতে এর অবস্থান। মাসের শুরুতে রাত ১টা এবং মাসের শেষে ১০ টার দিকে পূর্ব দিগন্তে হাজির হবে। 

বুধ গ্রহঃ
বুধ সব সময় সূর্যের আশেপাশে থাকে। এ মাসে সব তারিখেই এটি সূর্যের পরে অস্ত যাবে। অবশ্য দিগন্তের কাছাকাছি থাকায় বিশেষত শহর অনগচল থেকে একে চিনে নেওয়া একটু কষ্টকর। তবে মাসের ৮ তারিখে চাঁদ একে চিনতে সাহায্য করবে। 

শুক্র (শুকতারা):
আমাদের অনেকেরই আকাশের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু শুকতারা। কিন্তু দূর্ভাগ্যের কথা এটিও বুধের মত সূর্যের খুব কাছাকাছি থাকে। ফলে একে সন্ধ্যায় বা ভোরেই শুধু দেখা যায়। এই মাসে এটি সূর্যের এত কাছে যে একে দেখা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আফসোস! 
ভোরের আকাশ থেকে সন্ধ্যার আকাশে পাড়ি দেবার প্রাক্কালে জুনের ৬ তারিখে এটি একেবারে সূর্যের পেছনে থাকবে। 

সূত্রঃ Earth Sky
Category: articles

সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১৬

[মার্চের শেষ সপ্তাহ] 

কিছু দিন সূর্যের আড়ালে থেকে আবার আবির্ভূত হতে শুরু করেছে সামার ট্রায়াঙ্গেল। একে এখন ভোরের পূবাকাশে দেখা যায়। 


ছবিতে সামার ট্র্যায়াঙ্গেল বা গ্রীষ্মের ত্রিভুজ দেখা যাচ্ছে। এখানে আছে আকাশে অন্যতম উজ্জ্বল তিনটি নক্ষত্র। এরা হল যথাক্রমে বীণামণ্ডলীর নক্ষত্র অভিজিৎ (Vega), ঈগলমণ্ডলীর শ্রবণা (Altair) এবং বকমণ্ডলীর নক্ষত্র পুচ্ছ (Deneb)।


সামার ত্রিভুজ আকাশের তারাদের একটি নকশা হলেও এটি তারামণ্ডলী নয়, বরং  তারানকশা
গরমের দিনগুলোতে (মে-জুন মাসের দিকে) এটি মধ্য রাতে মোটামুটি মাথার উপর থাকে। বসন্ত কালে (যেমন এখন) এটি থাকে ভোরের আকাশে। আস্তে আস্তে পশ্চিমে হেলতে হেলতে নভেম্বর মাসের দিকে এটি থাকে সন্ধ্যার পশ্চিমাকাশে। আগস্টের শুরুতে রাত নয়টার দিকে থাকে প্রায় মাথার সোজা উপরে। 

Category: articles

রবিবার, ২৭ মার্চ, ২০১৬

গত পর্বে আমরা ব্ল্যাক হোলের সাথে প্রথমিক পরিচিতি সেরেছিলাম। এবার আমরা দেখবো, কিভাবে জন্ম নেয় এই দানবেরা। ব্ল্যাক হোল আবার আছে তিন রকমের- স্টেলার বা নাক্ষত্রিক (Steller), Supermassive বা অতি ভারী ও খুবই ছোট্ট আকারের মাইক্রো বা মিনিয়েচার ব্ল্যাক হোল (Miniature Black Hole)। আজকে আমরা মূলত প্রথম ধরনের তথা স্টেলার ব্ল্যাক হোল নিয়েই জানবো। এদের জন্ম হয় একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষের দিকে, যখন এর সবটুকু জ্বালানী নিঃশেষ হয়ে যায়।

এই ধরনের ব্ল্যাক হোল যেহেতু একটি নক্ষত্রের জীবনের অন্তিম দশা, তাই এর জন্মলাভের উপায় জানতে হলে নক্ষত্রের জীবনচক্র বুঝতে হবে। আমাদের তাহলে বুঝতে একটি নক্ষত্রের জন্ম হয় কিভাবে। জন্মের পরে এর মধ্যে কী ঘটতে থাকে? কিভাবে এটি আলো, তাপ ও বিকিরণের মাধ্যমে এর শক্তির বহিঃপ্রকাশ করে হুঙ্কার ছাড়ে, কিভাবে এটি আস্তে আস্তে বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং মারা যায়।

আচ্ছা, তারও আগে জেনে নিই, নক্ষত্র বা তারকা (Star) কাকে বলে? সাধারণত তারকা হচ্ছে সেইসব মহাজগতিক বস্তু যারা এদের অভ্যন্তরে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আলো, তাপ ও বিকিরণ উৎপন্ন করে। মহাবিশ্বের ৫০ ভাগ তারকারই বাইনারি স্টার বা জোড়া তারা (Binary Star)। এরা অন্য আরেকটি তারকার সাথে চুক্তি করে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। আর, প্রদক্ষিণকেন্দ্র হয় দু'জনের অভিকর্ষ কেন্দ্র (Center of Gravity) যেখানে থাকে সেখানে।

অবশিষ্ট  তারকারা আমাদের সূর্যের মত গড়ে তুলেছে গ্রহব্যবস্থা (Planetary System)। আমরা রাতের আকাশে যেসব উজ্জ্বল তারা দেখি, তার মধ্যে চাঁদের পরে যথাক্রমে ১ম, ২য় ও ৩য় উজ্জ্বল বস্তু শুক্র, বৃহস্পতি ও শনি- সবাই কিন্তু গ্রহ, তারকা নয়, তাই এদের নিজস্ব আলোও নেই। এরাও চাঁদের মতই সূর্যের আলোর প্রতিফলন ঘটায়।

এবার দেখা যাক, কীভাবে জন্ম নেয় নক্ষত্র। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিসহ সব গ্যালাক্সিতেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণ গ্যাসীয় মেঘ ও ধূলিকণা। প্রাথমিক অবস্থায় এদেরকে বলা হয় নীহারিকা বা নেবুলা (Nebula)। সাধারণত এক একটি নেবুলা আড়াআড়িভাবে বহু আলোকবর্ষ পরিমাণ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। একটি নেবুলাতে যে পরিমাণ গ্যাস থাকে তা দিয়েই আমাদের সূর্যের মতো কয়েক হাজার নক্ষত্রের জন্ম হতে পারে।  নেবুলার অধিকাংশ উপাদানই হচ্ছে বিভিন্ন হালকা গ্যাস- বিশেষ করে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অণু। এই সমস্ত গ্যাস ও ধূলিকণা যখন ঘনীভূত হয়ে যথেষ্ট পরিমাণ অভিকর্ষ উৎপন্ন করে, তখন নিজস্ব অভিকর্ষের চাপে সঙ্কুচিত হতে থাকে। কোন কোন জ্যোতির্বিদ আবার মনে করেন, এই অন্তর্মুখী সঙ্কোচনের জন্য শুধু অভিকর্ষই নয়, গ্যাস ও ধূলিকণায় সৃষ্ট চৌম্বকক্ষেত্রও দায়ী।

নক্ষত্র তৈরির কাঁচামাল নীহারিকা 

গ্যাসগুলো জড় হতে হতে বিভব শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং বাড়িয়ে ফেলে তাপমাত্রা। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে সঙ্কোচনশীল গ্যাস বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে এক একটি আলাদা নক্ষত্র তৈরি হয়।  এই তারকার অন্তর্বস্তুর সঙ্কোচনের হার হয় অনেক বেশি। এর গ্যাসীয় মেঘ অনেক দ্রুত আবর্তন করে করে এর কৌণিক ভরবেগ বজায় রাখে। এক সময় এই নক্ষত্রের তাপমাত্রা প্রায় ২ হাজার কেলভিনে পৌঁছায়। এই অবস্থায় হাইড্রোজেন অণু ভেঙ্গে গিয়ে মৌলটির পরমাণুতে পরিণত হয়। এর তাপমাত্রা এক সময় উঠে যায় ১০ হাজার কেলভিনে। সঙ্কুচিত হয়ে সূর্যের প্রায় ৩০ গুণ আয়তন লাভ করলে এই নব-সৃষ্ট তারকাকে বলে প্রোটো স্টার বা ভ্রুণ তারা (Protostar)। এবার এতে হাইড্রোজেন পরমাণু জোড়া লেগে লেগে হিলিয়ামে পরিণত হতে থাকে। এই নিউক্লিয় বিক্রিয়াটিকে বলে ফিউশন বা সংযোজন (Fusion) বিক্রিয়া।

ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেই তারকার অভ্যন্তরে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। কাদের মাঝে হয় এই ধাক্কাধাক্কি? একটি পক্ষ হচ্ছে তারকার ভেতরের দিকের নিজস্ব অভিকর্ষজ টান। এতক্ষণ সে একাই ছিল। কিন্তু ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সে পেল একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। এটি হচ্ছে উপরোক্ত নিউক্লিয় বিক্রিয়াজনিত বহির্মুখী চাপ। এই দুই চাপের চাপাচাপিতে পড়ে নক্ষত্রটি স্থিতিশীল অবস্থায় জীবন পার করতে থাকে। সরবরাহ করে যেতে থাকে আলো, তাপ ও বিভিন্ন উপকারী ও অপকারী রশ্মি ও বিকিরণ।

সূর্যের কাছাকাছি ভরের একটি তারকা এই দশায় অবস্থান করে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা এক শ কোটি বছর। আমাদের সূর্যে ৫ বিলিয়ন বছর আগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতে থাকবে আরো প্রায় একই পরিমাণ সময় ধরে। এই দশায় অবস্থান করার সময় একটি তারকাকে বলা হয় মেইন সিকুয়েন্স বা প্রধান ক্রমের তারকা (Main sequence star)। বর্তমানে মহাবিশ্বের ৯০ ভাগ তারকাই এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত।

একটা সময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে যায়। এবার তারকার অভ্যন্তরস্থ মূলবস্তু আরো সহজে ভেতরের দিকে চুপসে যায় কেননা চুপসে যাবার পক্ষে কার্যকরী বল অভিকর্ষের শত্রু যে দুর্বল হয়ে পড়েছে! কিন্তু তারকার বাইরের অংশ প্রসারিত হতেই থাকে। ফলে সামগ্রিকভাবে এর ব্যাসার্ধ্য বেড়ে যায়। এই অবস্থায় এদেরকে দানব নক্ষত্র (Giant Star) বা আরো বড় দানবদের সুপারজায়ান্ট বলে ডাকা হয়। এই ধাপেও ফিউশন ঘটে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌল যেমন কার্বন, অক্সিজেন প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। এখন থেকে আরো পাঁচশ বছর পরে আমাদের সূর্য মামা দানব নক্ষত্র হয়ে যাবে। এর পরিধি এসে পৌঁছাবে প্রায় পৃথিবী পর্যন্ত। তার আগেই কিয়ামত না ঘটে গেলে এটাই হবে পৃথিবী ও তাতে অবস্থিত প্রাণের কফিনে শেষ পেরেক।

নক্ষত্রের জীবনচক্র

বর্তমানেও রাতের আকাশে বেশ কিছু দানব বা মহাদানব নক্ষত্রের দেখা মেলে। যেমন আদমসুরত বা কালপুরুষ (Orion) তারামণ্ডলীর আর্দ্রা (Betelgeuse) একখানা সুপারজায়ান্ট বা মহাদানব নক্ষত্র। এছাড়াও বৃশ্চিক মণ্ডলীর জ্যেষ্ঠা (Antares) ও আদমসুরতের রিজেল ও ভূতেশ তারামণ্ডলীর স্বাতীও (Arcturus) সুপারজায়ান্ট গোত্ররে নক্ষত্র। অধিকাংশ দানব নক্ষত্রই লাল রং-এর অধিকারী হয়। উপরোক্ত তারকাগুলোও তাই। আর, এ জন্যেই রাতের আকাশে এদেরকে দেখতে লাল লাল মনে হয়।

এক সময় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ফিউশন বিক্রিয়া অব্যাহত রাখার মত কোন জ্বালানী অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় নক্ষত্রের ভরের উপর ভিত্তি করে নানান ঘটনা ঘটতে পারে।

যেসব তারকার ভর প্রায় দুই সৌর ভরের কাছাকাছি বা  তার কম তারা জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে বাহিরের দিকে প্রসারণশীল আবরণ ছুঁড়ে ফেলে ভেতরের অংশকে আরো বেশি গুটিয়ে ফেলে। এক সময় এর আকার হয়ে যায় প্রায় পৃথিবীর সমান যদিও ঘনত্ব থাকে অনেক বেশি। এদেরকে বলে শ্বেত বামন (White Dwarf)। এক সময় শেষ আলোক বিন্দুটিও হারিয়ে ফেলে এরা কালো বামন নাম ধারণ করে। সাবধান! এরা এক সময় কালো হয়ে গেলেও এদেরকে কিন্তু ব্ল্যাক হোল ভেবে বলা যাবে না! এরা হচ্ছে শুধুই অনুজ্জ্বল নক্ষত্র। আর, ব্ল্যাক হোল হচ্ছে তারা যারা আলোকেও বন্দী করে রাখে। সে নিজেই আলোক উৎস হতে পারে, কিন্তু সেই আলো ঘটনা দিগন্তের সীমা পার হতে দেবে না। অন্য দিকে কালো বামনদের আলো বিতরণ করার সামর্থ্যই কিন্তু লোপ পাবে। এই পার্থক্য না থাকলে তো আমরা কয়লাকেও বা যে কোনো কালো জিনিসকেই ব্ল্যাক হোল বলে বসবো!
তাহলে ব্ল্যাক হোল কারা হবে? আরেকটু কথা বলে নিই।

যেসব তারকার ভর দুই থেকে পাঁচ বা কারো মতে ১৫ সৌর ভরের মধ্যে থাকে তারাও বাইরের আবরণ ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এদের ক্ষেত্রে এই ঘটনাকে বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এ সময় অনেক বেশি ঔজ্জ্বল্যের সৃষ্টি যায় যার রেশ পৌঁছে যায় অনেক দূর পর্যন্ত। যেমন বিটলজুস যখন বিস্ফোরিত হবে, এর রেশ ৬৪৩ আলোকবর্ষ দূরে, আমাদের পৃথিবীতে বসেই দেখা যাবে। অবশ্য আলোর বেগ সামান্য (!) হবার কারণে পৃথিবীর মানুষ সেই ঘটনা দেখবে ঘটনার ৬৪৩ বছর পরে! সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষকে বলা হয় নিউট্রন স্টার। কারণ, এই সময় এর অভীকর্ষীয় চাপ এত প্রচণ্ড হয় যে এর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন ও প্রোটন অভিকর্ষের খপ্পরে পড়ে স্বাধীনতা হারিয়ে মিলিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়। এদের সাথে আবার অনেক সময় জড়িত থাকে অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র যা জন্ম দেয় নির্দিষ্ট সময় পর পর বেতার স্পন্দনের। এ সময় এদের বলে পালসার।

সুপারনোভা বিস্ফোরণ 

এই বার আমরা ব্ল্যাক হোলের কাছে যেতে পারি। সূর্যের চেয়ে অন্তত প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ ভারী তারকারাই জীবনের অন্তিম পর্যায়ে ব্ল্যাক হোল হবার সুযোগ পাবে। এরাও জায়ান্ট বা সুপারজায়ান্ট স্টারদের মতো সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বাইরের আবরণ ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ফলে, এবার বাকি অংশের ঘনত্ব বেশি হয়ে যাওয়ায় এবং ভর আগে থেকেই যথেষ্ট পরিমাণ থাকায় এদের অভিকর্ষ এতটা শক্তিশালী হবে যে আলোও এদের ঘটনা দিগন্ত থেকে বের হতে পারবে না। ঘটনা দিগন্ত কী এবং আলো এত বিপুল বেগ নিয়েও কিভাবে অভিকর্ষের খপ্পরে আটকা পড়ে, তা আমরা গত পর্বেই দেখেছি।

আজ শেষ করছি আরেকটি প্রশ্ন ও আগের পর্বে করা একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে। আমরা এখানে আলোচনা করেছি মূলত প্রধান ধরনের ব্ল্যাক হোলদের সম্পর্কে। বাকি দুই ধরনের ব্ল্যাক হোল কিভাবে জন্ম নেয়? ব্ল্যাক হোল আবার মাইক্রো তথা ক্ষুদ্র হয় কিভাবে? এমনকি একটি ব্ল্যাক হোলের ব্যাসার্ধ হতে পারে মাত্র ১৪৮ ফেমটো মিটার তথা  ১৪৮×১০−১৫ মিটার। কিন্তু কিভাবে? জানবো ভবিষ্যতে, ইনশা-আল্লাহ।

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তের কাছে একটি অবস্থান আছে যেখানে স্থান কালের বক্রতা ভেতরের দিকে অসীম না হয়ে বৃত্তপথের মতো তৈরি করবে। আসলে এই জায়গায় ব্ল্যাক হোলের বেপরোয়া মনোভাবের ইতি ঘটে। ফলে, এই জায়গার বস্তু আমরা দেখতে পাই। নামও আছে এর জন্যে। একে বলা হয় অ্যাক্রেশন ডিস্ক (Accretion Disk)। আশপাশের অঞ্চল থেকে পদার্থ ছিনতাই করে ব্ল্যাক হোল এর অন্ধকার কলেবরের চারপাশে এই দৃশ্যমান চাকতির প্রদর্শনী দেখায়। যাই হোক, পরের কোনো পর্বে আরো বিস্তারিত আলোচনার আশা রেখে আজকে বিদায়!



অন্যান্য পর্ব



Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬


সৌর ঝড়ের প্রভাবে বৃহস্পতি গ্রহেও সৃষ্টি হয় অরোরা। নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি প্রথম বারের মত গ্রহটির অরোরা প্রত্যক্ষ করেছে।
সূর্য প্রতিনিয়ত এর চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে কণিকাগুচ্ছ। পৃথিবীর মতই বৃহিস্পতিরও ম্যাগনেটোস্ফিয়ার এই কণিকাদের সাথে প্রতিক্রিয়া করে তৈরি করে অরোরা।  
Category: articles

শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৬


ছবিতে MACS J0717 গ্যালাক্সি ক্লাস্টার দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে ৫.৪ বিলিয়ন (৫৪০ কোটি) আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত স্থানটি চারটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষের হোস্ট হয়েছে।
এক একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে শত শত বা হাজার হাজার গ্যালাক্সি থাকে। এছাড়াও থাকে ডার্ক ম্যাটারের ঘন মেঘে সন্নিবেশিত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস।
এই ছবিটি নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি (নীল অংশ) ও হাবল স্পেইস টেলিস্কোপের (লাল, সবুজ ও নীল) সমন্বয়ে তৈরি।

সূত্রঃ
[১] Earth Sky
Category: articles

সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০১৬

রাতের আকাশের অন্যতম তিন উজ্জ্বল বস্তু- চাঁদ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহ 
একটি বস্তুকে পৃথিবী থেকে দেখতে যতটা উজ্জ্বল লাগে সেটাই হচ্ছে তার আপাত উজ্জ্বলতার (Apparent magnitude) পরিমাপ। এটা বস্তুর প্রকৃত উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি থেকে আলাদা জিনিস। কারণ, বাস্তবে বেশি দীপ্তিমান হলেও দূরত্বসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবী কোন তারকা বা বা অন্য কোন বস্তুকে অন্য তারকার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল মনে হতেই পারে। 

এই যেমন রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র লুব্ধক কিন্তু সবেচেয়ে বেশি দীপ্তিমান ৫০টি তারকার মধ্যেও নেই।আবার উজ্জ্বলতায় স্বাতী চতুর্থ আর বিটলজুস নবম। স্বাতী পৃথিবী থেকে মাত্র ৩৬ আলোকবর্ষ দূরে৷ অভ্যন্তরীণ উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি সূর্যের ১৭০ গুণ৷ ওদিকে লোহিত অতিদানব তারা বিটলজুসের দীপ্তি সূর্যের প্রায় এক লক্ষ গুণ (বিভিন্ন হিসাবে কম-বেশি আছে)। তবুও পৃথিবীর আকাশে বিটলজুস কম উজ্জ্বল। এর দূরত্ব যে ৫৪৮ আলোকবর্ষ!

তারকার উজ্জ্বলতা পরিমাপ করা হয় লগারিদম স্কেলে। উজ্জ্বলতার মান যত বেশি হয় তার আপাত উজ্জ্বলতা হয় তত কম। এটা অনেকটা এসিডের PH এর মানের মত। এসিডের পিএইচ যত বেশি হয় সেটি তত কম শক্তিশালী এসিড। পৃথিবীর আকাশের উজ্জ্বলতম বস্তু সূর্যের আপাত উজ্জ্বলতা -২৭ (মাইনাস ২৭)। চাঁদসহ সৌরজগতের খালি চোখে দৃশ্যমান পাঁচটি গ্রহের প্রত্যেকের আপাত উজ্জ্বলতার মান নেগেটিভ (০ এর নিচে) যা এদের উজ্জ্বলতার বড়ত্বের প্রমাণ বহন করে। চাঁদের ক্ষেত্রে এই মান -১২.৭, শুক্রের -৪.৮৯, বৃহস্পতির -২.৯৪, মঙ্গলের -২.৯১, বুধের -২.৪৫ এবং শনির ক্ষেত্রে এই মান -.৪৯। অন্য দিকে শুধু প্রথম চারটি উজ্জ্বল তারকারই আপাত উজ্জ্বলতা শূন্যের নিচে।

আপাত উজ্জ্বলতার বিচারে সবচেয়ে উজ্জ্বল পাঁচটি নক্ষত্র
১। লুব্ধক (-১.৪৪)
২। সুহাইল (০.৬২)
৩। আলফা সেন্টোরি (-.২৮)
৪। স্বাতী (-০.০৫)
৫। অভিজিৎ (+০.০৩)

সর্বচ্চ +৬.৫ উজ্জ্বলতার তারা খালি চোখে দেখা যায়। 

Category: articles

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

আজ মার্চের ৯ তারিখ। ১৯৩৪ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন। এখন বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ৮২। অবশ্য তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই ১৯৬৮ সালে পরলোক গমন করেন যান। ১৯৬১ সালের এপ্রিলের ১২ তারিখে তিনি প্রথম নভোচারী হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়েন। রাশিয়ার ভোস্টক ১ যানে করে তিনি ৮৯.১ মিনিট ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। তিনি সম্পূর্ণ পৃথিবী একবার ঘুরে আসেন এবং সর্বোচ্চ ২০০ মাইল (৩২৭ কিলোমিটার) পর্যন্ত উপরে উঠেন। ভ্রমণ শুরু থেকে অবতরণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অভিযান শেষ হতে সময় লাগে ১০৮ মিনিট।
প্রথম নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন

মস্কো শহরের পশ্চিমে একটি খামারে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন একইসাথে রাজমিস্রি, কাঠমিস্রি ও কৃষক। মা ছিলেন গোয়ালিনী। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার নাৎসি বাহিনীর হাতে নিপীড়নের শিকার হয়। তাঁর দুই বোনকে নির্বাসন দিয়ে পোল্যান্ড পাঠানো হয়। যুদ্ধের পরে অবশ্য তারা পরিবারের সাথে মিলিত হন। গ্যাগারিন পড়াশোনা চালিয়ে যান।
কিশোর বয়সেই গ্যাগারিন বৈমানিক হতে উৎসুক ছিলেন। একবার রাশিয়ার একটি ইওক ফাইটার প্লেন বাধ্য হয়ে গ্যাগারিনের বাড়ির কাছে অবতরণ করে। বিমানের বৈমানিকরা মানুষের কাছে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন তা তরুণ গ্যাগারিনের উপর গভীর ছাপ ফেলে। তিনিও তাদের মত হবার স্বপ্ন দেখতে থাকলেন।
১৬ বছর বয়সে তিনি ঢালাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। পাশাপাশি পড়তে থাকেন সান্ধ্য স্কুলে। ১ বছর পর, ১৯৫১ সালে তিনি ভোকেশনাল ও স্কুলের সেভেন্থ গ্রেড- দুটোই পাস করেন। এরপর ডাক আসে সারাতোভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল থেকে। এখানে থাকা অবস্থায়ই তিনি প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে স্থানীয় ফ্লায়িং ক্লাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন। এখানেই তিনি প্রথমে বাইপ্লেন ও পরে ইয়ক-১৮ ট্রেইনার প্লেন চালানো শিখে ফেলেন।
১৯৫৫ সালে তিনি সর্বপ্রথম নিজে নিজে বিমান চালান। একই বছর তিনি স্কুল থেকে পাস করে সোভিয়েট আর্মিতে যোগ দেন। পরে চলে আসেন বিমান বাহিনীতে। ভর্তি হন ওরেনবার্গ স্কুল অব এভিয়েশনে।
১৯৫৭ সালে তিনি এই স্কুল থেকে পাস করে স্কুলের মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট ভেলেন্টিনা ইভানোভা গরভাচেভার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে এ দম্পতি ইয়েলিনা ও গ্যালিনা নামে দুটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়।
১৯৫৯ সালে রাশিয়া লুনা ৩ যানের সাহাযে প্রথমবারের মত চাঁদের উল্টো পাশের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। গ্যাগারিন অনুভব করলেন, মানুষের মহাশুন্য ভ্রমণেরও আর বেশি দেরি নেই। ১৯৬০ সালে অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর নভোচারী হিসেবে প্রশিক্ষের জন্যে নির্বাচিত অল্প কিছু ব্যক্তির মধ্যে তিনিও স্থান করে নেন। এখানে শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেওয়া হল মন-মানসিকতার প্রশিক্ষণও। গ্যাগারিন তাঁর রসিক মনোভাব, অধ্যবসায় ও নম্রতা দিয়ে বিশেষ নজর কাড়লেন।
১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে মহাশূন্যে যাত্রা করল ভোস্টক ১ মহাকাশযান। যানের একমাত্র যাত্রী আর কেউ নন, ইতিহাসের প্রথম নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন।
রুশ ভাষায় ভোস্টক শব্দের অর্থ পূর্ব। পূর্বের তাৎপর্য সূর্যোদয়। অর্থ্যাৎ, মহাকাশ অভিযানের সূর্যোদয় ঘটল।
জাদুঘরে রক্ষিত ভোস্টক ১ মহাকাশযানের ক্যাপসুল

ফিরে এসে তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন সারা বিশ্বে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ খেতাব হিরো অব দা সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরস্কারও পেলেন। স্বপ্ন সত্যি হল। বিশ্বজুড়ে সফর করলেন। তবে, তাঁর খ্যাতি যেভাবে নিজের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারতেন তা তিনি করেননি।
১৯৬২ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম ডেপুটি হলেন। ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পদ দেওয়া হল। কিন্তু এটা তার খুশির কারণ হতে পারল না। তাঁর মনে হলে একবার মাত্র মহাকাশ সফরের জন্যে তিনি ট্রেনিং করেননি। কিন্তু জানা যায় অন্যরা সোভিয়েত হিরো হবার সুযোগ হারাবার ভয়ে তাঁকে থামানোর চেষ্টা করত।
১৯৬৩ সালে মস্কোর বাইরে গড়ে ওঠা কসমোনট ট্রেনিং সেন্টারের ডেপুটি ট্রেনিং ডিরেকটর মনোনীত হন। পরে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়।
১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চ তারিখে একজন সহকর্মীসহ (ভ্লাদিমির সেরিয়োগিন) বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন।

সূত্রঃ
[১] Earthsky
[২] উইকিপিডিয়াঃ Yuri Gagarin
Category: articles

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমরা কোন বস্তুকে উপরে ছুঁড়ে মারলে এটি একটু পর ভূমিতে ফিরে আসে। আরো জোরে ছুঁড়লে আরেকটু পরে ফিরে আসবে। আরো জোরে মারলে? আরেকটু পরে। এভাবেইকি চলতে থাকবে? না, সব কিছুর একটি শেষ আছে। এমন একটি বেগ আছে যে বেগে কোন কিছুকে খাড়া উপরের দিকে নিক্ষেপ করলে এটি আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। পৃথিবীর অভিকর্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই বেগটির নাম মুক্তি বেগ।

তাহলে কোন বড় ভরের বস্তু (যেমন গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি) থেকে যে বেগে কোন বস্তুকে নিক্ষেপ করলে সেটি নিচে ফিরে আসে না তাকে মুক্তি বেগ (Escape Velocity) বলে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে মুক্তি বেগের মান হচ্ছে সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। এর চেয়ে কম বেগ দিয়ে কোন রকেট বা নভোযানকে মহাশূন্যে পাঠানো সম্ভব হবে না।

বিভিন্ন বস্তুর মুক্তি বেগঃ 
[এখানে বেগের একক কিলোমিটার পার সেকেন্ড (km/s) ধরা হয়েছে।]
সূর্যঃ ৬১৭.৫
বুধঃ ৪.৩
শুক্রঃ ১০.৩
পৃথিবীঃ ১১.২
চাঁদঃ ২.৪
মঙ্গলঃ
বৃহস্পতিঃ ৫৯.৬
গ্যানিমিডঃ ২.৭ (বৃহস্পতির বৃহত্তম এই উপগ্রহটি সৌরজগতেরও উপগ্রহদের বড় ভাই)
শনিঃ ৩৫.৬
ইউরেনাসঃ ২১.৩
নেপচুনঃ ২৩.৮
প্লুটোঃ ১.৮
ঘটনা দিগন্তঃ আলোর বেগ

মুক্তি বেগের সূত্রঃ
এখানে ve = মুক্তিবেগ, G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, M = ভর, r = ব্যাসার্ধ 
সূত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে মুক্তি বেগের মান বস্তুর ভরের বর্গমূলের সমানুপাতিক এবং ব্যাসার্ধের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক। ফলে, বস্তুর ভর যত বেশি হবে মুক্তি বেগ তার বর্গমূলের হারে বাড়তে থাকবে এবং ব্যাসার্ধ যত বেশি হবে মুক্তি বেগ তত কম হয়ে যাবে। এবার উপরে দেখুন, প্লুটোর মুক্তি বেগ চাঁদের চেয়েও কম। প্লুটো গ্রহের খাতা থেকে বাদ পড়ার এটাও একটা কারণ।
মুক্তি বেগের সূত্রকে এভাবেও লেখা যায়-
ve = √(2gr) যেখানে = অভিকর্ষীয় ত্বরণ।
ব্ল্যাক হোলের ধারণা প্রথমে মুক্তি বেগ থেকেই এসেছে। কোন বস্তুর মুক্তি বেগ যদি আলোর বেগের চেয়েও বেশি হয়, তাহলে সেটি থেকে আলোও আসতে পারবে না। তাহলে সেটি আমরা দেখতেও পারবো না। এ জন্যেই তার নাম দেওয়া হয়েছে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর।
ব্ল্যাক হোল আলোকে কিভাবে আটকে রাখে যখন আলোর ভরই নেই? জানুন এখানে

সূত্রঃ
[১] Wikipedia: Escape Velocity
Category: articles

শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মেসিয়ার ৮২ 
মেসিয়ার ৮২ গ্যালাক্সিটির অপর নাম এনজিসি ৩০৩৪। একে সংক্ষেপে এম ৮২ (M82)  বা অনেক সময় সিগার গ্যালাক্সিও বলা হয়। এটি ১ কোটি ২০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আকাশের সপ্তর্ষীমণ্ডলী অঞ্চলে এর অবস্থান। এটি খুবই উর্বর (Starburst) গ্যালাক্সি। অর্থ্যাৎ, এতে নতুন নক্ষত্র জন্মের হার খুব বেশি। আমাদের সমগ্র মিল্কিওয়ের চেয়েও এই উর্বর গ্যালাক্সিটির দীপ্তি (Luminosity) ৪ গুণ
বেশি এবং মিল্কিওয়ে কেন্দ্রের চেয়ে বেশি ১০০ গুণ। উর্বর গ্যালাক্সিদের মধ্যে এটি আমাদের নিকটতম।

ফরাসী জ্যোতির্বিদ চার্লে মেসিয়ে ছিলেন ধূমকেতু শিকারী। অনেকগুলো বস্তুকে তিনি এক সময় ধূমকেতু মনে করলেও পরে জানা যায় এরা ধূমকেতু নয়। তিনি হতাশ হলেন। পরে এদের পেছনে সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচতে এদের একটি তালিকা করলেন। বর্তমানে এই তালিকায় ১১০ টি বস্তু আছে। তাঁর নামানুসারেই বস্তুগুলোকে বলা হয় মেসিয়ার অবজেক্ট।
ছবিটি হাবল টেলিস্কোপের তোলা।

আর্কাইভঃ  আজকের ছবি
সূত্রঃ 
[১] উইকিপিডিয়াঃ Messier 82
Category: articles

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ব্ল্যাক হোল কী জিনিস? ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয় কিভাবে? ব্ল্যাক হোলের সাথে অভিকর্ষের কী সম্পর্ক? আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে ব্ল্যাকহোলের কোন সম্পর্ক আছে কি? ব্ল্যাক হোলকি টাইম ট্র্যাভেল ঘটাতে পারে? ওয়ার্মহোলের সাথে ব্ল্যাক হোলের সম্পর্ক কোন দিক দিয়ে? আলোর মতো এমন গতিমান জিনিস কিভাবে ব্ল্যাক হোলের গর্তে আটকা পড়ে?

ব্ল্যাকহোল নিয়ে এমন আরো নানান কিছু জানতে নিয়মিত আয়োজন ব্ল্যাক হোলের গভীরে।

ব্ল্যাক হোল

শুরু করি মহাকাশের মহাদানব এই ব্ল্যাকহোল তথা কৃষ্ণগহ্বরদের পরিচতি দিয়ে।

আপনার নিশ্চয়ই ক্রিকেট খেলার বা দেখার অভ্যাস আছে, তাই না? নিশ্চয়ই আছে ছক্কা মারারও অভ্যাস। অনেক সময় দেখা যায় ব্যাটসম্যানের বেধড়ক পিটুনি খেয়ে বেচারা বল অনেক উপরে উঠে যায়। কিন্তু অভিকর্ষ সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় কথা প্রচলিত আছে- What goes up must come down। অর্থ্যাৎ, উপরে যে উঠবে, নিচেও তাকে নামতেই হবে। এই কথার প্রতিধ্বনি বাজাতেই যেন একটু পরেই বলটি আছড়ে পড়ে গ্যালারিতে, অথবা ভাগ্য খারাপ হলে ফিল্ডারের হাতে!

কেন উপরে ছুড়ে মারা বস্তু নিচে নেমে আসে? সহজ উত্তর- পৃথিবীর অভিকর্ষ। আচ্ছা, বলটিকে যদি আরেকটু জোরে মারা হতো, তাহলে কী হত? তখনও এটি নিচে নামত। তবে, একটু দেরিতে। আরেকটু জোরে মারলে? আরেকটু পরে। আরেকটু জোরে মারলে? আরেকটু পরে। এভাবেই কি চলতে থাকবে? না। সবকিছুরতো একটা সীমা আছে! (সব সময় অবশ্য না, গণিতবিদেরা আপত্তি করে বসবে!)

ধরুন, কোন ব্যাটসম্যানের গায়ে মিস্টার ইউনিভার্সের শক্তি ভর করেছে। সে বলটাকে এমন জোরে উপরে পাঠিয়ে দিল যে বলটি পৃথিবীর অভিকর্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহাশুন্যে হারিয়ে গেল। এটাকি সম্ভব যে কোন বস্তুকে নির্দিষ্ট কোন বেগে মারলে এটি আর ভূমিতে ফিরে আসবে না? হ্যাঁ সম্ভব। এটা করার জন্যে পৃথিবী থেকে খাড়া উপরে ছোড়া বস্তুর ক্ষেত্রে প্রাথমিক বেগ হতে হবে প্রতি সেকেন্ডে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার। এই বেগকে তাই বলা হয় মুক্তি বেগ (Escape Velocity)।

প্রকৃতপক্ষে মহাশুন্যে রকেট ও স্পেসশিপ পাঠানোর সময় এই মুক্তি বেগের কথা মাথায় রাখতে হয়। রকেটের প্রাথমিক বেগ দিতে হয় মুক্তি বেগের চেয়ে বেশি। নইলে কিন্তু “হোয়াট গোজ আপ, মাস্ট কাম ডাউন” কথাটি সত্য হয়ে যাবে।
 
এবার ধরুণ, কোনো গ্রহের ভর পৃথিবীর চেয়েও বেশি। তার ক্ষেত্রে এই মুক্তি বেগ হবে আরো বেশি [কেন?]। যেমন সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির কথাই ধরুণ। এর পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৫৯.৬ কি.মি.। অন্য দিকে সূর্যের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৬১৭.৫ কিলোমিটার। অর্থ্যাৎ সৌরপৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন বস্তুকে সূর্যের আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরে চলে যেতে হলে প্রাথমিক বেগ এই পরিমাণ হতে হবে। অবশ্য সমগ্র সৌরজগতের মুক্তি বেগ আরো খানিকটা বেশি।

আমরা এও জানি, সূর্য একটি সাধারণ ভরের তারকা। এর চেয়েও বিশাল ও বাঘা বাঘা তারকাদের উপস্থিতি রয়েছে খোদ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই।

কোন বস্তুর মুক্তিবেগ নির্ভর করে দুটো জিনিসের উপর- সংশ্লিষ্ট বস্তুর ভর ও ব্যাসার্ধ। ভর বেশি হলে পৃষ্ঠে মুক্তি বেগ বেশি হবে, কিন্তু ব্যাসার্ধ বাড়লে কমে যাবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ভর বাড়লেই যে ব্যাসার্ধও বাড়বে- এমনটি কিন্তু বলা যাবে না। কারণ, একেতো ঘনত্ব বেশি হলে কিন্তু ব্যাসার্ধ কমে যাবে। উপরন্তু ভর বেশি হবার অর্থ দাঁড়াবে অভিকর্ষ শক্তিশালী হয়ে যাওয়া। ফলে বস্তুটি নিজেরই অভিকর্ষের চাপে গুটিয়ে গিয়ে ছোট্টতর হয়ে যাবে। পর্যায় সারণির একই পর্যায়ে ডানে গেলে যেমন ঘটে অনেকটাই তেমন, তাই না?

এখন ধরুণ এমন একটি নক্ষত্র আছে যার ভর সূর্যের চেয়ে এত বেশি যে হিসেব করে এর পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ যা পাওয়া গেল তা আলোর বেগের চেয়েও বেশি। তার অর্থ দাঁড়াবে ঐ নক্ষত্রের পৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না। অবশ্য নক্ষত্রের জীবনের শুরুর দিকে এই অবস্থা ঘটে না, ঘটে যখন হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে যায়। কেন? সেটা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে বিস্তারিত জানবো, ইনশা-আল্লাহ।

এখন, আমরা কোন বস্তু দেখি তখনই যখন বস্তুটি থেকে নির্গত আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে। কিন্তু কোন বস্তু থেকে যদি আলো আসতে না পারে তাহলে তাকে আমরা দেখবো না। ফলে, যে নক্ষত্রের মুক্তি বেগ আলোর চেয়ে বেশি সেটি আমরা দেখতে পাবো না। তখন এর নাম হবে ব্ল্যাক হোল। ঠিক এ কারণেই ব্ল্যাক হোল আমরা দেখি না। আর এ এজন্যেই এর নাম ব্ল্যাক হোল (Black hole) বা ‘অন্ধকার গর্ত’ যাকে বাংলায় ডাকা হয় কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর বলে।

তাহলে, ভর অল্প হওয়াতে গ্রহরা কিন্তু কখোনই ব্ল্যাকহোল হবার সুযোগ পাবে না। সব তারকারাও পাবে না। সুযোগ শুধু তারাই পাবে যাদের ভর সূর্যের অন্তত ১৫-২০ গুণ। অর্থ্যাৎ আমাদের সূর্যও কখনো ব্ল্যাক হোল হতে পারবে না।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জোরালো অনুমান হচ্ছে প্রত্যেকটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে অনেক বিশাল বিশাল ভরের ব্ল্যাকহোল যাদের ভর হতে পারে সূর্যের কয়েকশো বিলিয়ন গুণ পর্যন্ত! যেমন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার (Sagittarius A*) নামক অবস্থানে একটি ব্ল্যাকহোল আছে বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস।
 
আমরা একটু আগে দেখলাম, ব্ল্যাকহোল থেকে কোন কিছু বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের রাজত্বতো নিশ্চয়ই পুরো মহাকাশজুড়ে বিস্তৃত নয়। এর কেন্দ্র থেকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্ছলের বাইরের কোন বস্তুকে এটি গ্রাস করতে পারবে না। সেই সীমানার নাম ইভেন্ট হরাইজন (Event Horizon) বা ঘটনা দিগন্ত। এটাই মূলত সেই পয়েন্ট যেখান পর্যন্ত বস্তুটির অভিকর্ষ এত বেশি শক্তিশালী যে এর মুক্তি বেগ আলোর বেগের চেয়েও বেশি। আর কোনো কিছুরই বেগ যেহেতু আলোর বেগকে অতিক্রম করতে পারে না, তাই ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের অভ্যন্তরস্থ কোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাবো না। এই সীমার বাইরের ঘটনা কিন্তু দেখবো।

কিন্তু মুক্তিবেগতো নির্ভর করে বস্তুর অভিকর্ষের উপর। আবার অভিকর্ষ কাজ করে ভরযুক্ত বস্তুর উপর। আলোরতো ভর নেই। তাহলে আলো কিভাবে ব্ল্যাক হোলের কবলে আটকা পড়ে? এটা জানতে হলে অভিকর্ষ ও আপেক্ষিকত তত্ত্বের একটু ইতিহাস জেনে আসতে হবে।

১৭৮৩ সালে বিজ্ঞানী জন মিচেল ‘ডার্ক স্টার’ (dark stars) শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ভাবলেন যে কোন বস্তুর ভর এত বেশি ঘনীভূতওতো হতে পারে যে আলোও এর ফাঁদে আটকা পড়ে যাবে। তাঁর সেই ডার্ক স্টারকেই এখন আমরা ব্ল্যাকহোল বলে ডাকি।
 
একই রকম ভাবনা আসে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী মারকুইস ডে লাপ্লাসের মাথায়ও। তবে মজার বিষয় হলো, তিনি তাঁর বই The System of the World এর ১ম এবং ২য় সংস্করণেই শুধু ভাবনাটি ছাপেন এবং তুলে দেন পরবর্তী সংস্করণগুলো থেকে। কারণ, তখনকার সমাজে এই ধরণের ভাবনাকে মানুষ পাগলের প্রলাপ মনে করত। আর বিজ্ঞানী হকিং এর ভাষায়, তিনি নিশ্চয় চাননি পাগলের খ্যাতি পেতে।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের পর কার্ল সোয়ার্জসাইল্ড এই ধরনের বস্তুর জন্যে একটি গাণিতিক সমাধান বের করেন। এর বেশ কিছু দিন পরে, ১৯৩০ এর দশকের দিকে ওপেনহাইমার, ভলকফ ও সিনডার মহাবিশ্বে এই ধরণের বস্তু থাকার সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন।

এই  তিন গবেষক প্রমাণ করে দেখালেন, একটি যথেষ্ট ভরযুক্ত নক্ষত্র যখন সব জ্বালানী হারিয়ে ফেলে তখন এতে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার বহির্মুখি চাপ থাকে না বলে এটি এর নিজস্ব অভিকর্ষের চাপে চুপসে যেতে থাকে।
এভাবেই আস্তে আস্তে বিকশিত হতে থাকে ব্ল্যাকহোলের ধারণা।
 
তবে, মিচেল এবং ল্যাপ্লাস- দু’জনেই আলোকে কণা বলে ধারণা করতেন যা অভিকর্ষ দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু ১৮৮৭ সালে দুই আমেরিকান বিজ্ঞানী মিচেলসন এবং মোরলের বিখ্যাত একটি পরীক্ষা থেকে জানা গেল, আলো সব সময় একটি নির্দিষ্ট বেগে চলে, এর উৎস কোথায় সেটা মোটেই বিবেচ্য নয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় অভিকর্ষ কিভাবে আলোকে প্রভাবিত করে? অভিকর্ষ বল বস্তুর ভরের সাথে সম্পৃক্ত। চার প্রকার মৌলিক বলের মধ্যে একটু ভিন্ন ‘বল’ অভিকর্ষ আকর্ষণ করে শুধু ভরযুক্ত বস্তুকে।

কিন্তু আলোরতো কোনো ভরই নেই। তাহলে তার কী দোষ? বেচারা ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাবে কেন?  
এই প্রশ্নের সমাধান নিয়ে এসেছিলেন আইনস্টাইন সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের (General theory of relativity) মাধ্যমে। এটা জেনেই আজকে বিদায় নিচ্ছি।
 
১৬৬৫ সালে সালে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন দিয়েছিলেন মহাকর্ষ-অভিকর্ষের ধারণা। বলা হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরকে নিজ দিকে আকর্ষণ করে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তার অভিকর্ষ ততোই শক্তিশালী হবে। নিউটনের এই সূত্র দিয়ে সূর্যের চারদিকে গ্রহদের গতিপথ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও কয়েকটি বিষয়ের নিখুঁত ব্যখ্যা পাওয়া সম্ভব হয়নি। এর অন্যতম উদাহরণ ছিল সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধের কক্ষপথের স্থানচ্যুতি।

এরকম আরো কিছু বিষয়ের নিখুঁত ব্যাখ্যা দিতে ব্যার্থ হয় নিউটোনিয়ান মহাকর্ষ।

এবার মহাকর্ষের হাল ধরেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে তিনি প্রদান করেন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (Special Theory of Relativity)। এর ১০ বছর পর ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব।
১ম তত্ত্ব মতে, আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলমান বস্তুর কাল দীর্ঘায়ন ও দৈর্ঘ্য সঙ্কোচন ঘটে। বেড়ে যায় ভরও।  আর ২য় তত্ত্বে তিনি মহাকর্ষকে তুলে ধরলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। মহাকর্ষ কোন ‘বল’ নয়। এটি হচ্ছে স্থান-কালের (Space-Time) বক্রতা। স্থান এবং কাল আলাদা আলাদা কিছু নয়। স্থানের তিনটি স্থানাঙ্কের সাথে চতুর্থ স্থানাঙ্ক  ‘সময়’ মিলিত হয়ে কোনো একটি ঘটনাকে পূর্ণাংগভাবে ব্যাখ্যা করে।

আপেক্ষিকতার এই নীতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি ভরযুক্ত বস্তুই তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়।

মহাকর্ষ (যেমন পৃথিবীর অভিকর্ষ) এভাবে স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়

নিউটোনিয়ান মহাকর্ষের মতই অবশ্য ক্ষুদ্র ভরবিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে এই বক্রতা হবে সামান্যই। অবশ্য এই নীতি আবার আমরা যখন পরমাণুর গহীণে অতি-পারমাণবিক কণিকার জগতে নিয়ে যাবো, তখন এটি একেবারেই খাটবে না। সেখানে আবার রাজত্ব করে বেড়ায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব। মহাবিশ্বের ম্যাক্রো (বৃহৎ) ও মাইক্রো (ক্ষুদ্র)- এই দুই জগতের শাসনভার যথাক্রমে তাই এই দুইটি আলাদা তত্ত্বের হাতে।

যাই হোক, বিশাল ভরের বস্তু কতৃক স্থান-কাল লক্ষ্যণীয়ভাবে বেঁকে যায় বলেই নক্ষত্রদের চারদিকে গ্রহদের আর গ্রহদের চারপাশে উপগ্রহের কক্ষপথ তৈরি হয়।

কিন্তু কোনো বস্তু স্থান এবং কালকে বাঁকিয়ে দেয়- এটা বললেই কি মানতে হবে? এর সপক্ষে প্রমাণওতো থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, প্রাচীন কালে প্রদত্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক (বা অবৈজ্ঞানিক) তত্ত্বের তুলনায় আপেক্ষিকতাকে অনেক বেশিই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।

সাধারণ আপেক্ষিকতার ভাষ্য মতে, ভর যেহেতু স্থান কালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেহেতু বড় বড় ভরের বস্তুদের লেন্সের মতো আচরণ করা উচিৎ।

অর্থ্যাৎ ধরুণ, আমরা কোনো নক্ষত্রের পেছনে অবস্থিত অন্য কোন বস্তু দেখতে চাই। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় সেই বস্তুকে দেখা না গেলেও মাঝখানের বস্তুটি যেহেতু স্থানকে বাঁকিয়ে দেবে, তাই অপরপাশের বস্তু থেকে আসা আলো সেই বক্রপথ অনুসরণ করে দর্শকের চোখে ধরা পড়বে। প্রমাণিত হবার পর এখন এই ঘটনাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং।
 
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর বদৌলতে আড়ালে লুকিয়ে থাকা বস্তু পর্যবেক্ষণ করা যায়

১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণের সময় সার্বিক আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়ে গেল। সূর্যের আলোর কারণে সাধারণ অবস্থায় দৃশ্যমান না হলেও সূর্যগ্রহণের সময়ের অন্ধকারে সূর্যের পেছনে অবস্থিত দেখা গেল হায়াডিজ তারাস্তবককে (Hyades Star Cluster)। প্রমাণিত হল আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। এই পরীক্ষণটি পরিচালনা করেছিলেন স্যার আর্থার এডিংটন।

 
উল্লেখ্য, সূর্যগ্রহণের সময়ের এই ঘটনা ও বুধের কক্ষপথের নিখুঁৎ বর্ণনাসহ আরো কিছু বিষয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতার পূর্বানুমানের সাথে বাস্তব ঘটনা মিলে গেল অবিকলভাবে যেখানে তা নিউটোনিয়ান তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ন ছিল না।
 
অতএব, বলা যাচ্ছে, অভিকর্ষ তার চারপাশের স্থানকে বাঁকিয়ে দিয়ে ঐ স্থানগামী যেকোনো কিছুকে সেই বক্রপথ অনুসরণ করতে বাধ্য করবে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে বক্রতার পরিমাণও হবে ততো বেশি।

এবার চিন্তা করা যাক ব্ল্যাকহোলদের মতো দানবদের কথা। এদের ভর এতই বেশি যে এরা এদের আশপাশের স্থানকালকে নির্দয়ভাবে এমনভাবে বাঁকাবে যে বক্রতা হবে শুধুই অন্তর্মুখী। অর্থ্যাৎ, এই বক্রতায় প্রবেশের দরজা থাকবে কিন্তু বেরুবার দরজা থাকবে না। গ্রামে বর্ষা মৌসুমে পুকুরে মাছ ঢোকানোর জন্যে দুটি বেড়া এমনভাবে মুখোমুখি লাগানো থাকে যে পুকুরে প্রবেশের সময় মাছ ঐ বেড়ার ফাঁক গলে চলে যেতে পারবে কিন্তু পুকুর থেকে বেরোতে পারবে না। ব্ল্যাকহোলের কাজও অনেকটাই এরকম।

ব্ল্যাক হোলে স্থান কালের বিকৃতি
এ কারণেই আলোর কোনো ভর না থাকলেও এটি ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে পড়ে যায়। দূর থেকে আসা আলো ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ভেতরে চলে গেলে আর বের হবার রাস্তা পাবে না। ফলে ঘটনা দিগন্তের ভেতরের কোন কিছু আমরা দেখতে পাবো না।

এ তো গেল ব্ল্যাকহোলের ভেতরের অবস্থা। ঘটনা দিগন্তের একটু বাইরে এমন একটি অঞল থাকা সম্ভব যেখানে বক্রতা ভেতরের দিকে অসীম না হয়ে একটি বৃত্তপথ তৈরি করবে। এই বৃত্তের বাইরের অঞ্চলগামী আলো অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এই বৃত্তাঞ্চলের আলোর কী হবে? এই আলোককণিকাটি ব্ল্যাকহোলের চারদিকে ঘুরে মরবে। অবিরত ব্ল্যাকহোলকে প্রদক্ষিণ করবে।

 
এই আলোকে কি তবে আমরা ব্ল্যাকহোলের উপগ্রহ বলতে পারি? নাহ! উপগ্রহ তো থাকে গ্রহদের। কী বলা যায় ভাবতে থাকুন। ততক্ষণে আমি আজকের মত বিদায়!!!
অন্যান্য পর্ব



Category: articles

শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৪৭৩। আজকের এই তারিখটি হচ্ছে নিকোলাস কোপার্নিকাসের জন্মদিন। তিনি একইসাথে গণিতজ্ঞ হলেও নজর কেড়েছেন কসমোলজিতে বিশেষ অবদান রেখে।
এমন এক সময়ে তাঁর জন্ম যখন মানুষ ভাবত মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীর অবস্থান। সূর্যসহ অন্যান্য গ্রহ এবং নক্ষত্ররা ঘুরছে এর চারদিকে।
পৃথিবী-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের চিত্র

এই মহা ভুল ধারণা দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করল তাঁর বই De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres) বা খ-গোলকের ঘূর্ণন যাতে প্রস্তাবনা আসল সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের। ১৫৪৩ সালে  প্রকাশিত বইখানা আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম ভিত্তি।
কয়েক বছর আগে Copernicus’ birthday লিখে গুগলে সার্চ দিলে সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের একটি ডুডল দেখা যেত। ছুটির দিন বা কারো জন্ম দিন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে গুগল ডুডল বানিয়ে থাকে।
নিকোলাস কোপার্নিকাস

তবে সৌরকেন্দ্রিক মডেল প্রথম প্রস্তাবক অবস্য কোপার্নিকাস নন। গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই ভাবতেন এই রকম চিন্তা। ইসলামিক জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতির সাথে সাথেও ধীরে ধীরে পৃথিবীর বেগ নিয়ে ধারণার বিকাশ ঘটে এবং পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরানো হয়। তবে গ্রিকদের ক্ষেত্রে অন্য অনেক কিছুর মতই বাগড়া দিয়ে বসেছিলেন এরিস্টটল। তিনি বললেন, ৫৫টি এককেন্দ্রিক এবং স্বচ্ছ গোলক নিয়ে আকাশ গঠিত যেখানে আকাশের বস্তুদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ঐ গোলকের কেন্দ্রে আছে পৃথিবী। পৃথিবী এতে স্থির এবং আবদ্ধ। পৃথিবীকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত করলেন কোপার্নিকাস।
এখন আমরা জানি সূর্যও কিন্তু মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। তাহলে কে আছে কেন্দ্রে? নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে। পড়ুনঃ মহাবিশ্বের কেন্দ্র কোথায়?
সূত্রঃ
[১] Earth Sky
[২] উইকিপিডিয়াঃ জিওসেন্ট্রিক মডেল
Category: articles
সর্বশেষ লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ (Leap year) ছিল ২০১২ সাল। পরেরটা? হ্যাঁ, এ বছরই- মানে ২০১৬! সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সত্যিকার সময়ের সাথে আমাদের ক্যালেন্ডারের হিসাবের মিল বজায় রাখার জন্যেই লিপ ইয়ারের আবির্ভাব। কিন্তু লিপ ইয়ারের সময় ফেব্রুয়ারি মাসকে এক দিন বাড়িয়ে ২৯ দি বানানো হয় কেন?

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসাকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে এক বছর ধরা হয়। এই হিসাবে আমরা ৩৬৫ দিনকে এক বছর ধরি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে পৃথিবী সূর্যকে ঘুরে আসতে সময় নেয় প্রায় ৩৬৫.২৫ দিন। এই বাড়তি .২৫ দিন চার বছরে ৪×.২৫ = ১ দিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই চার বছর পরপর বছর হয় এক দিন লম্বা- ৩৬৫ দিন। এ কারণেই সম্ভবত একে লিপ ইয়ার বা লাফ দেওয়া বর্ষ বলা হয়। বাংলা পরিভাষা অধিবর্ষ কথাটার অর্থও কাছাকাছি- অর্থ্যাৎ যে বছরে বাড়তি কিছু আছে।

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে ৩৬৫ দিনের চেয়ে বেশি সময় নেয় 

বছর গড়াবার সাথে সাথে যদি লিপ ইয়ারের এই সংশোধনী করা না হত তাহলে পঞ্জিকার বছর সৌর বছর থেকে দূরে সরতে থাকত। এক সময় তা হয়ে যেত খুব বেশি। চার বছরে পার্থক্য হত ১ দিন। ১০০ বছরে পার্থক্য হত ২৫ দিন। বোঝাই যাচ্ছে, বছর আরো বেশি হয়ে গেলে পার্থক্য ভয়াবহ রূপ লাভ করত। এক সময় দেখা যাবে উত্তর গোলার্ধের শীতকাল শুরু হচ্ছে জুন মাসে !

বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হচ্ছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের উন্নত রূপ। সর্বপ্রথম ৪৬ খৃস্টপূর্ব সালে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে অধি দিন (Leap day) যুক্ত করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিদ সসিজেনেসের পরামর্শে জুলিয়াস সিজার কাজটি করেন। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগোরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের উন্নতি সাধন করেন। সহায়তা করেন জার্মান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস।

জার্মান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে আরো নিয়ম করা হয়, যেসব বছরের শেষে '০০'থাকবে তাতে বাড়তি দিন যুক্ত করা হবে না। তবে '০০' যুক্ত বছরটি যদি ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য হয় তাহলে কিন্তু সেটি আবার লিপ ইয়ার হবে। কিন্তু এই নিয়ম আবার কেন দরকার হল?

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, উপরে আমরা বলেছি পৃথিবী সূর্যকে ঘুরে আসতে প্রায় ৩৬৫.২৫ দিন লাগে। এটাও প্রকৃত মান নয়। প্রকৃত মান হচ্ছে ৩৬৫.২৪২২ দিন বা বা ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। ফলে হাজার বছরের ব্যাবধানে সেটাও উল্লেখযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। যে বছরগুলোতে লিপ ইয়ার হয়েছে বা হবে তারা হচ্ছে-

1600 1604 1608 1612 1616 1620 1624 1628 1632 1636 1640 1644 1648 1652 1656 1660 1664 1668 1672 1676 1680 1684 1688 1692 1696 1704 1708 1712 1716 1720 1724 1728 1732 1736 1740 1744 1748 1752 1756 1760 1764 1768 1772 1776 1780 1784 1788 1792 1796 1804 1808 1812 1816 1820 1824 1828 1832 1836 1840 1844 1848 1852 1856 1860 1864 1868 1872 1876 1880 1884 1888 1892 1896 1904 1908 1912 1916 1920 1924 1928 1932 1936 1940 1944 1948 1952 1956 1960 1964 1968 1972 1976 1980 1984 1988 1992 1996 2000 2004 2008 2012 2016 2020 2024 2028 2032 2036 2040 2044 2048 2052 2056 2060 2064 2068 2072 2076 2080 2084 2088 2092 2096 2104 2108 2112 2116 2120 2124 2128 2132 2136 2140 2144 2148 2152।

খেয়াল করলে দেখা যাবে ২০০০ সাল অধিবর্ষ ছিল কারণ এটি ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য। কিন্তু এই শর্ত পূরণে অক্ষম ১৯০০ সাল অধিবর্ষ হতে পারেনি।

১৫৮২ সাল থেকে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

২০১৬ সালের লিপ ইয়ার আরেক দিক থেকে একটু বিশেষত্বের অধিকারী। এটি শুরু হয়েছে শুক্রবারে। এমনটি কিন্তু খুব বেশি ঘটে না কিন্তু। এর আগে এ রকম বছরগুলো ছিল ১৯৩২, ১৯৬০ এবং ১৯৮৮। আগামীতে এ রকম মজার অধিবর্ষ আবার পাওয়া যাবে ২০৪৪ ও ২০৭২ সালে। তার মানে ২৮ বছর পরপর এমন হয়।
বাংলায়ও কিন্তু অধিবর্ষ আছে। প্রতি চার বছর পরপর বাংলা ফাল্গুন মাসে এক দিন বেশি হয়ে ৩১ দিন হয়।

সূত্র
[১] উইকিপিডিয়াঃ জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার
[২] Earth Sky
[৩] শুক্রবারে শুরু হওয়া লিপ ইয়ার

Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...