Advertisement

বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

আজ ৮ নভেম্বর। 
১৬৫৬ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ এডমান্ড হ্যালি। 

হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ হিসাব করার জন্যে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত। বলাই বাহুল্য ধূমকেতুটির নামকরণ তাঁর নামেই হয়েছে। একই সাথে তিনি ছিলেন গণিত, ভূ-পদার্থ, আবহাওয়া ও পদার্থবিদ। 

এডমান্ড হ্যালি

জন্ম ৩৬১ বছর আগে। ইংল্যান্ডের লন্ডনের কাছের একটি গ্রামে। বাবা সাবানের ব্যবসা করে ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হ্যালির ঝোঁক ছিল গণিতের দিকে। শুরুতে অধ্যয়ন করেন সেন্ট পলস স্কুলে। ১৬৭৩ সালে চলে আসেন অক্সফোর্ডের কুইনস কলেজে। ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি সৌরজগত ও সৌরদাগ (sunspot) নিয়ে পেপার প্রকাশ করেন। 

সপ্তদশ শতকটি উদীয়মান বিজ্ঞানীদের জন্যে ইংল্যান্ড ছিল খুব অনুকূল জায়গা। লন্ডনের রয়েল সোসাইটি এ শতকেই (১৬৬০) প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যালি তখন ছোট্ট এক শিশু। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এখানে মিলিত হতেন প্রতি হপ্তায়। জন ফ্ল্যামস্টিড ছিলেন প্রথম অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল। 

১৬৭৩ সালে কুইনস কলেজে এসে ফ্ল্যামস্টিডের সাথে সাক্ষাৎ হয় হ্যালির। বিভিন্ন সময়ে ফ্ল্যামস্টিডের সাথে দেখা করে তিনি জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। 

এ সময় ফ্ল্যামস্টিড একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন। উত্তর আকাশের তারাগুলোর একটি তালিকা চাই। তবে খালি চোখে নয়। এত দিনে টেলিস্কোপ চলে এসেছে। হ্যালি ভাবলেন, আমিও একই কাজ করব। তবে উত্তরের বদলে দক্ষিণের আকাশ নিয়ে। 

১৬৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি দক্ষিণে যাত্রা করলেন। চুকিয়ে আসলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠটিও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজে চেপে চলে এলেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। সবচেয়ে কাছের ভূখণ্ড রিও ডি জেনিরো থেকে আড়াই হাজার মাইল পুবে। বাবার অঢেল টাকা থাকায় ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হল না। 

খারাপ আবহাওয়ার কারোণে কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু তবুও তিনি কিন্তু খালি হাতে ঘরে ফেরেননি। ১৬৭৮ সালে ফিরে আসার সময় তাঁর কাছে ছিল ৩৪১ টি তারার তথ্য। পর্যবেক্ষণ করেন বুধ গ্রহের দুর্লভ একটি অতিক্রমণও (transit)। 

তাঁর প্রকাশিত নক্ষত্রের এই ক্যটালগ ছিল একটি বড় সাফল্য। এই ধরনের কাজ এটাই প্রথম। দক্ষিণের নক্ষত্রগুলোকে এর আগে কেউ টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি। জানতে চেষ্টা করেনি তাদের অবস্থান। জ্যোতির্বিদ হিসেবে এটাই হ্যালির প্রথম সাফল্য। একই বছর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। নির্বাচিত হন রয়েল সোসাইটির ফেলো। 

১৬৮৪ সালে আসেন কেমব্রিজে। দেখা হয় নিউটনের সাথে। নিউটন ও রবার্ট হুকসহ রয়েল সোসাইটির কয়েকজন বিজ্ঞানী তখন গ্রহদের গতির ব্যাখ্যা খুঁজছিলেন। হ্যালিও যোগ দিলেন এই দলে। মজার ব্যাপার হল, অন্য সবার চেয়ে তাঁর বয়স কম। জানার চেষ্টা চলছে কীভাবে ও কেন গ্রহরা সূর্যের চারদিকে ঘোরে। সবাই চাচ্ছিলেন অন্যদের আগে কীভাবে সমাধান বের করে ফেলা যায়। দরকার এমন একটি মডেল যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাবে যে কেন গ্রহরা সূর্য থেকে দূরে ছিটকে যায় না, বা সোজা সূর্যের দিকে চলে যায় না। 

হ্যালি ও হুক এর একটি সমাধান পেলেন। তাঁরা একটি বলের প্রস্তাব করলেন, যেটি একটি গ্রহকে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ধরে রাখবে। এই বল দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে কমবে। এই নিয়মকেই এখন আমরা বিপরীত বর্গীয় সূত্র (inverse-square law) হিসেবে জানি। 

হ্যালি ও হুক ঠিক পথেই ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এর একটি তত্ত্বীয় রূপ তত্ত্ব দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলেন, যা দিয়ে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা যাবে। হ্যালি গেলেন নিউটনের কাছে। তাঁর মতামত তুলে ধরলেন। এও বললেন, যে তিনি বিষয়টি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিউটন হ্যালির কাছ থেকে অনুপ্রেরণ নিলেন। এর জের ধরেই প্রকাশিত হল তাঁর ম্যাথমেটিক্যাল প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল ফিলোসফি, সংক্ষেপে যার নাম প্রিন্সিপিয়া। 

রয়েল সোসাইটি এই প্রবন্ধের সম্পাদনার ভার দিলেন হ্যালিকেই। এর কৃতিত্ব নিয়ে নিউটন ও হুকের দ্বন্দ হ্যালি খুব কৌশলে সমাধান করেন। তিনি এর প্রুফ দেখেন ও লাতিন ভাষায় এর ভূমিকা লিখে দেন। 

হ্যালি আবহাওয়া বিদ্যায়ও অবদান রাখনে। ১৬৮৬ সালে তিনি একটি বিশ্ব মানচিত্র তৈরি করেন। এতে ছিল বিপুল পরিমাণ তথ্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বায়ুগুলো সম্পর্কে এই মানচিত্রে তথ্য ছিল। মনে করা হয়, এটাই আবহাওয়াবিদ্যার প্রথম প্রকাশিত মানচিত্র। 

দুই একটি বিষয়ে অবদান রেখে হ্যালির যেন মন ভরছিল না।  তিনি কাজ করতে লাগলেন বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে। মৃত্যুর হারের সাথে বয়সের সম্পর্ক নিয়েও তিনি কাজ করেন। তাঁর এই অবদান পরে জীবন বিমার জন্যে কাজে লাগে। 

১৭০৪ সালে অক্সফোর্ডে জ্যামিতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর প্রকাশ করেন ধূমকেতু নিয়ে গ্রন্থ- আ সিনোপসিস ইন অ্যাস্ট্রোনমি অফ কমেটস। এতে তিনি ২৪ টি ধূমকেতুর কক্ষপথের বিবুরণ লেখেন। ১৩৩৭ থেকে ১৬৯৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছিল এই ধূমকেতুগুলো। 

এদের মধ্যে তিনটি ধূমকেতু তাঁর খুব নজর কাড়ে। এগুলো দেখা গিয়েছিল যথাক্রমে ১৫৩১, ১৬০৭ ও ১৬৮২ সালে। তিনি বললেন, এগুলোর মধ্যে এত বেশি মিল দেখা যাচ্ছে যে এরা আসলে একই ধূমকেতু না হয়েই যায় না। আর ফিরে আসে ৭৬ বছর পর পর। এটা ছিল যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত। তিনি পূর্বাভাস দিলেন, ধূমকেতুটি আবার ফিরে আসবে। সালটি হল ১৭৫৮। তিনি বললেন, 
১৪৫৬ সালে... পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে একটি ধূমকেতুকে দেখা গিয়েছিল। অতএব, আমার সিদ্ধান্ত হল, ১৭৫৮ সালে এটি আবারও ফিরে আসবে। 
হ্যালির ধূমকেতু 
১৭২০ সালে হ্যালি ফ্ল্যামস্টিডের স্থলাভিষিক্ত হন। নিয়োগ পান দ্বিতীয় অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল হিসেবে।

তিনি ৮৫ বছর বেঁচে ছিলেন। মারা যান ১৭৪২ সালে। তাঁর পূর্বাভাসকৃত ধূমকেতু ঠিকই পরে দেখা যায়। তবে ১৭৫৮'র বদলে ১৭৫৯। কারণ, ওটা ঠিক ৭৬ বছর ফেরে না। একটু এদিক-ওদিক হয়। সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৬ সালে, আবার ২০৬১ সালে দেখা যাবার কথা রয়েছে। তত দিনে বেঁচে থাকলেও আপনি বুড়ো হয়ে যাবেন। 

হ্যালির ধূমকেতু একবার দেখার পর ভাগ্যক্রমে আবারও দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে যাবেন। 


আরো পড়ুনঃ

সূত্রঃ
১। http://earthsky.org/space/today-in-science-edmond-halley-nov-8-1656
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Edmond_Halley
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Royal_Society
৪। 
Category: articles

সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭

আমরা দেখি, গ্রহ, উপগ্রহ ও নক্ষত্রদের আকৃতি হয় গোলাকার (spherical)। অবশ্য মেরু অঞ্চলের দিকে কিছুটা চাপা। দুটো বিষয়ই আমরা আলোচনায় রাখবো। 

আপনাকে এক খণ্ড পাথর দেওয়া হলে একে আপনি ইচ্ছে মতো কেটে যে কোন আকৃতি দিতে পারবেন- ঘনক, পিরামিড বা গোলক ইত্যাদি। নিজের মতো রেখে দিলে এটি আগের মতই থাকবে। গোলকাকার হয়ে যাবে না। কিন্তু ধরুন, ঐ পাথরটির বদলে আপনাকে পৃথিবীর সমান একটা বস্তু দেওয়া হল। একে কেটে কুটে কি আপনি পিরামিড বানাতে পারবেন?

পারবেন না। কারণ, এখন বস্তুটা যথেষ্ট ভারী। এর অভিকর্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী। বস্তুর আকার যত বড় হবে, এর অভিকর্ষও তত বড় হবে। পূর্বোক্ত পাথরখণ্ডটিরও অভিকর্ষ (Gravity) আছে। কিন্তু অতি নগণ্য, অকার্যকর।
বিভিন্ন গ্রহ 
মনে করুন, আপনি পৃথিবীর বুকে খুব উঁচু একটা ভবন নির্মাণ করবেন। তাহলে, এর ভিত্তি হতে হবে যথেষ্ট মজবুত। তা না হলে এটা নিজের ভারে তথা পৃথিবীর অভিকর্ষের চাপে ধসে পড়বে। কোনো গ্রহ, উপগ্রহ বা নক্ষত্রে যদি অনেক উঁচু কোন স্থাপনা থাকতো, তবে তা অভিকর্ষের টানে গুঁড়িয়ে যেত। ভাবছেন, তাহলে বুর্জ খলিফার মত সুউচ্চ স্থাপনা টিকে আছে কিভাবে? হ্যাঁ, এর ফাউন্ডেশান বা ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত এবং উচ্চতা তত বেশি নয় যত হলে ধসে পড়ত।  পাহাড়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

একটু খেয়াল করুনঃ 
গ্রহ যদি হতো ঘনকের মতো, তার অর্থ হতো এর কোণাগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচু। যেহেতু গ্রহ, নক্ষত্রদের অভিকর্ষ খুব বেশি শক্তিশালী সে কারণে এ কোণাগুলো টিকে থাকতে পারে না, ধসে পড়ে। যে কোনো কিছুই মাথা চাড়া দিতে যাবে, অভিকর্ষ তাকে এক হাত দেখে নিবে। ফলে বস্তুটি চার পাশ থেকেই সমান হতে শুরু করবে।

এখন, সবকিছুই টান-প্রাপ্ত হয় কেন্দ্রের দিকে। ফলে, কেন্দ্রের চারপাশে ভর জড় হয়ে গোলকের (sphere) আকৃতি তৈরি হবে। যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি না থাকলে সব উঁচু নিচু স্থাপনা সমতল হয়ে যাবে। এ জন্যেই গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররা গোলকাকার। যেসব গ্রহাণুর অভিকর্ষ অপেক্ষাকৃত কম, তারা গোল হতে পারে না। হয় এবড়ো থেবড়ো। যেমন, ছবিতে দেখন ৪ ভেস্টা নামক গ্রহাণুর ছবি।


মহাকাশযান ডন থেকে ৪ ভেস্টার ছবি।
গোলকাকার হবার জন্য সর্বনিম্ন ভর কত হতে হবে?
ব্যাপারটা আসলে শুধু ভরের উপরই নির্ভরশীল নয়। বস্তুটা কী দিয়ে তৈরি তাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোন কোন বস্তুকে অন্য বস্তুর চেয়ে সহজে নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ভর (mass) কম হলেও চলবে। পাথুরে কোন বস্তুর ক্ষেত্রে গোলাকাকৃতি পাবার জন্য ব্যাস প্রয়োজন ৬০০ কিলোমিটার। কিন্তু বরফ নির্মিত বস্তু হলে ব্যাস ৪০০ কিলোমিটার হলেও যথেষ্ট।

যেমন উপরোক্ত গ্রহাণু  ৪ ভেস্টা হল সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহাণু। এর আকার হল দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে যথাক্রমে ৫৭৮ ও ৪৫৮ কিলোমিটার। ১৮০৭ সালে হেনরিখ উইলহেম ওলবার্স।

মেরু অঞ্চলে চেপে যায় কেন?
আমরা জানি গ্রহ, উপগ্রহরা যেমন আমাদের পৃথিবীও মেরু অঞ্চলে একটু চাপা তথা কম ব্যাসার্ধ্য বিশিষ্ট। এর কারণ হল পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করেআবর্তন বেগ দুই মেরু মাঝখান তথা বিষুব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আর মেরুতে কম। ফলে,  ঘূর্ণনের কারণে বিষুব অঞ্চলের দিকে বস্তুটা একটু লম্বা হয়ে যায়।

সূত্রঃ
[1] curious.astro.cornell.edu
[২] spaceanswers
[৩] www.universetoday.com
Category: articles

রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭

পরমাণুর মাঝে যে নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব আছে, তা আমরা জানতে পারি বিশ শতকের শুরুর দিকে। এই নিউক্লিয়াস কী দিয়ে গঠিত? কোন কোন কণা আছে এর মাঝে? কণাগুলো কীভাবে এর মাঝে আছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বিশ শতকের প্রায় অর্ধেকটাই পার হয়ে যায়। অবশেষে যা জানা যায় তা হলো, নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন নামক দুই ধরণের কণা একত্রে আবদ্ধ থাকে। একটি নিউক্লিয়াসে যত সংখ্যক প্রোটনই থাকুক না কেন, তারা যদি একত্রে থাকে তবে সেটা অবশ্যই কোনো না কোনো বলের কারণেই একত্রে আছে।

এই কণাগুলো যে বলের সাহায্যে আবদ্ধ থাকে, সেই বলকে বলা হয় সবল নিউক্লীয় বল। এই বল স্বল্প পাল্লার, অত্যাধিক শক্তিশালী ও আকর্ষণধর্মী। কেননা কুলম্ব সাহেবের স্থির বৈদ্যুতিক সমধর্মী চার্জের পরস্পর বিকর্ষণ করার সূত্র হতে আমরা জানি দুটো প্রোটন খুব নিকটে থাকলে প্রচণ্ড বিকর্ষণ করার কথা। কিন্তু তারা সেটা না করে বরং প্রচণ্ড আকর্ষণের সহিত নিউক্লিয়াসের মাঝে থাকে। আর এই আকর্ষণধর্মী বলটির নামই হলো সবল নিউক্লীয় বল।

সবল নিউক্লীয় বলের সাথে সাথে আরও আছে দুর্বল নিউক্লীয় বল। এই বল আবার কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণে জড়িত থাকে না। এর কাজ হল নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় ভাঙন ঘটানো তথা নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি ক্ষয় করা। দূর্বল নিউক্লীয় বলকে তাই বল না বলে দুর্বল নিউক্লীয় মিথষ্ক্রিয়া বলাটা বেশি উত্তম। এই দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া পদার্থবিদ্যার CP-প্রতিসাম্য লঙ্ঘন করে। প্রতিসাম্য হলো পদার্থবিদ্যার একটা কারসাজি। CP-প্রতিসাম্য হলো চার্জ ও প্যারিটি নামক দুই প্রতিসাম্যর মিশ্র প্রতিসাম্য। এর বক্তব্য হলো, একটি কণাকে এর প্রতিকণার সাথে অদল-বদল করলেও পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর কোনো নড়চড় হবে না। এ অংশের নাম সি প্রতিসাম্য (C symmetry)। আর পি প্রতিসাম্যে মানে, কণাকে এর দর্পণ রূপের সাথে অদল-বদল করলেও সূত্র একই রকম থাকবে।

প্রতিসাম্য বিশ্লেষণ করে কণিকা-প্রতিকণিকা সম্পর্ক, প্রকৃতির নিয়ম ইত্যাদি স্পষ্ট হওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো দুর্বল নিউক্লীয় বল CP-প্রতিসাম্যকে লঙ্ঘন করলেও সবল নিউক্লিয় বল CP-প্রতিসাম্যকে তেমন একটা লঙ্ঘন করে না। তত্ত্বীয়ভাবে এটা খুবই ব্যতিক্রমী ও ব্যাখ্যাহীন একটা ঘটনা। কণা-পদার্থবিদ্যার ভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় সবল CP সমস্যা।

এই সবল CP সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেছেন, অ্যাক্সিয়ন নামক একটি ক্ষেত্র আছে। সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে CP-প্রতিসাম্য লঙ্ঘনের জন্য দায়ী প্রভাবকগুলোকে এই অ্যাক্সিয়ন ক্ষেত্র নিস্ক্রিয় করে ফেলে। ফলে সবল নিউক্লিয় বল CP-প্রতিসাম্যকে লঙ্ঘন করতে পারে না। ১৯৭৭ সালে বিজ্ঞানী রবার্তো দানিয়েল ও হেলেন কুইন গাণিতিকভাবে দেখান, এই অ্যাক্সিয়ন ক্ষেত্র কীভাবে সবল CP সমস্যা সমাধান করতে পারে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী ওয়াইনবার্গ দেখান যে, এই কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের অস্তিত্ব থাকলে একটি কোয়ান্টা তথা ক্ষেত্রকণাও থাকবে, যার নাম তিনি দেন অ্যাক্সিয়ন কণা। ভবিষ্যদ্বাণীর পর থেকেই গত ৪০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নিভাবে এই কণার অনুসন্ধান করছেন। তবুও এখন পর্যন্ত এই কণার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এই কণার একটি ধর্ম হলো - তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাঝে অ্যাক্সিয়ন কণা মুহূর্তের মাঝে ভেঙে গিয়ে ফোটন কণার জন্ম দিবে। এই কণাটির ভর অনেক অনেক কম। দশমিকের পর ৪০ টি শূন্য দিয়ে একটি ১ বসালে যত কেজি হয়, একটি কণার ভর প্রায় তত। কণাটির কোনো চার্জ নেই। তাই একে শনাক্ত করাও দুরূহ কাজ বটে।

তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে (নীচের যুগ্ম পুরু রেখা) অ্যাক্সিয়ন কণা থেকে (উপরের বামপাশের ভাঙা ভাঙা রেখা) ফোটন কণা উৎপত্তির (উপরের ডানপাশের বক্ররেখা) ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম।

জ্যোতিপদার্থবিদ্যার অন্যতম রহস্য ডার্ক ম্যাটারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবেও অ্যাক্সিয়নকে দায়ী করা হয়। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে ডার্ক ম্যাটারের কারণ হবে WIMP (Weakly Interacting Massive Particle বা দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ভারী কণা) জাতীয় কোনো কণা, অ্যাক্সিয়ন নয়।

অ্যাক্সিয়ন শণাক্তকরণ অনেক কঠিন হলেও শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে নিয়ে এসে ফোটন কণায় পরিণত করে এই কণার খোঁজ করার জন্য কাজ চলছে। ইউরোপের নিউক্লীয় গবেষণা সংস্থা সার্নও ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের প্রস্তাবিত রূপ।


অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ল্যাবে এই কণাকে নিয়ে গবেষণা হলেও গত বছরের শুরুতে এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) একদল গবেষক শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা নতুন এক পদ্ধতিতে অ্যাক্সিয়ন কণার অনুসন্ধান শুরু করছেন। বেশ কয়েকটি গবেষণা দাবী করেছে ইতোমধ্যেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে এই কণা। যদিও এখনও তা সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

যদি অ্যাক্সিয়ন কণা পাওয়া সম্ভব হয়, তবে কণা-পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির একটি তথা সবল CP সমস্যা অতি দ্রুতই সমাধান করা যাবে। তাই যতদিন অ্যাক্সিয়ন কণা ধরা না দেয়, ততদিন কণা-পদার্থবিদরা না হয় আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষনকেন্দ্র ও এমআইটি-র সেই গবেষক দলের দিকেই তাকিয়ে থাকুক।

১। সি,পি ও টি প্রতিসাম্য - ম্যাট স্ট্রসলার।
২। আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ওয়েবসাইট
১। উইকিপিডিয়াঃ Axion,  CP violation এবং Weakly interacting massive particles
Category: articles

বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭

পৃথিবীর মহাকর্ষের কারণে আমরা এর বুক আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারছি। কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যে যাবার পথে এই মহাকর্ষই আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

মহাকর্ষের আকর্ষণ এড়িয়ে পৃথিবীকে অব্যাহতভাবে  প্রদক্ষিণ করার জন্যে কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর তীব্র বেগের প্রয়োজন হয়। যেমন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ঘণ্টায় ১৭,৫০০ মাইল (২৮,২০০ কিমি.) বেগে ঘুরছে পৃথিবীর কক্ষপথে। কিন্তু পৃথিবী থেকে বাইরে যেতে হলে আরও বেশি বেগ লাগবে। সেই বেগের নাম মুক্তি বেগ (Escape velocity)।

আরও পড়ুনঃ
মুক্তি বেগের পরিচয়

এ বেগ অর্জনের জন্যে বিপুল জ্বালানি প্রয়োজন। এ কারণেই অ্যাপোলোর মতো আগের রকেটগুলো উৎক্ষেপেণে ব্যবহৃত স্যাটার্ন ভি রকেট খুব ভারী হতো। চাঁদে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট জ্বালানি দিতে হত এতে। ইলোন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের আধুনিক রকেট সে তুলনায় ছোট। কিন্তু এদেরকে যেতে হবে আরও অনেক দূর পথ। সুদূর মঙ্গল।

মাস্ক খুশি হতে পারেন যে তাঁকে অন্তত বৃহস্পতি গ্রিহ থেকে রকেট নিক্ষেপ করতে হচ্ছে না। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহে মুক্তি বেগের মান আলাদা। তবে বৃহস্পতির ক্ষেত্রে সেটা তুলনামূলক অনেক বেশি। রকেট নিক্ষেপ করতে হলে মুক্তি বেগ লাগবে ঘণ্টায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মাইল (২ লক্ষ ১৭ হাজার কিমি.)। কারণ, গ্রহটির একারই ভর অন্য সব গ্রহের মিলিত ভরের দ্বিগুণ।

নিচের দারূণ অ্যানিমেশনটি থেকে বিভিন্ন গ্রহের মুক্তি বেগের ধারণা পাওয়া যাবে। 

যথাক্রমে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহ থেকে রকেট নিক্ষেপে জন্যে প্রয়োজনীয় বেগ। 

খেয়াল করলে দেখবেন, বৃহস্পতির মুক্তিবেগ অন্য গ্রহদের চেয়ে অনেক বেশি। আগেই বলেছি, কেন এটা হচ্ছে। এর ভর বেশি হবার কারণে। 
Category: articles

শনিবার, ৪ মার্চ, ২০১৭

এর আগে একটি নিবন্ধে আমরা দেখেছিলাম, মহাকর্ষ কীভাবে কাল দীর্ঘায়ন ঘটায়। আজ এর গাণিতিক হিসাব দেখব আমরা।

মহাকর্ষীয় কাল দীর্ঘায়ন (Gravitational time dilation) অনুসারে, মহাকর্ষীয় বিভবের মান যেখানে বেশি, সে অঞ্চলের সময় তুলনামূলক আস্তে চলবে। অর্থ্যাৎ, মহাকর্ষের উৎসের তুলনামূলক কাছে সময় ধীরে চলে। যেমন, আপনি ভূপৃষ্ঠের যত কাছে থাকবেন,  পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা যে কারও চেয়ে আপনার সময় তত ধীরে অতিবাহিত হবে।


এ ফলাফলগুলো পাওয়া যায় আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব (General theory of relativity) থেকে। এ তত্ত্বের সমীকরণগুলো অতিমাত্রায় জটিল ও সাধারণের জন্যে দূর্বোধ্য। তবে, কাল দীর্ঘায়নের সমীকরণ সে তুলনায় অনেক সরল। বেগ জনিত কাল দীর্ঘায়নের সূত্রের সাথেও এর বেশ মিল আছে।

মহাকর্ষীয় কাল দীর্ঘায়ন এর সূত্র

এখানে to হচ্ছে কোনো ঘটনার প্রকৃত সময় (Proper time)। দর্শক এবং ঘটনা একই মহাকর্ষীয় বিভবে অবস্থান করলে পরিমাপে এ সময় দেখা যাবে। আর tহচ্ছে যে-কোনো ভর থেকে অসীম দূরত্বে অবস্থান করে মাপা সময়। অর্থ্যাৎ, আমরা ধরে নিচ্ছি tf পরিমাপের জায়গায় আলোচ্য ভরের মহাকর্ষীয় প্রভাব নগণ্য।

G হলো নিউটনের সার্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। c হলো শূন্যস্থানে আলোর বেগ।  M হচ্ছে আলোচ্য বস্তুর ভর। আর r হলো বস্তুটা থেকে (মানে এর মহাকর্ষীয় কেন্দ্র থেকে) ঘটনার দূরত্ব।

সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের একটি সূত্র বের হয় সোয়ার্জসাইল্ড সমাধান থেকে। এটাই ব্ল্যাক হোলের সমীকরণ। সূত্র থেকে আপনি পাবেন সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধের মান।  M ভরের একটি বস্তুর সবটুকু ভর এ ব্যাসার্ধের ভেতরে অবস্থান করলে বস্তুটির মহাকর্ষ এত শক্তিশালী হবে যে, এর থেকে কোনো কিছুই বেরিয়ে আসতে পারবে না। এমনকি আলোও না।

আরও পড়ুনঃ 
☛ আলো কীভাবে ব্ল্যাক হোলে আটকা পড়ে?

সূত্রটি হলোঃ
সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধের সমীকরণ


এখানে rs-ই হলো সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ।
ব্ল্যাক হোলের সীমানায় পৌঁছে সূত্রটি প্রয়োগ করলে আমরা পাই r = rs। ফলে to এর মান হয়ে যাবে শূন্য। তার মানে, বাইরের কোনো দর্শকের কাছে মনে হবে এখানে সময় থেমে আছে। ফলে ব্ল্যাক হোলের সীমানা পেরিয়ে কোনো কিছুকে কখনোই ভেতরে যেতে দেখা যাবে না।

তবে ব্ল্যাক হোলে পড়েই গেলে ব্যাপারটা হয়ে পড়ে আরও উদ্ভট। অবশ্য বাইরে থেকে এ পতন দেখা সম্ভব হবে না। যাই হোক, এক্ষেত্রে বর্গমূলের ভেতরের রাশিটা হবে ঋণাত্মক। মানে, ফল হিসেবে পাওয়া যাবে কাল্পনিক সময়, যার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত জানা নেই।

সূত্রঃ
১। সাসেক্স ওয়েবসাইট 
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি।

১৯৫৬ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন বিখ্যাত ভারতীয় ও বাঙালি জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি বিজ্ঞানজগতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তাকে সাহা আয়নীকরণ সমীকরণ –এর জনক বলা হয়। তাঁর আবিষ্কৃত এই সমীকরণ নক্ষত্রের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি ব্যাখ্যায় ব্যাবহৃত হয়।

জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা 

মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার কাছে শ্যাওড়াতলী গ্রামে। তখন ঢাকা শহর ব্রিটিশদের শাসনাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গরীব ঘরে জন্ম তার। বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদি দোকানদার। ছেলেবেলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঝুটা কাজের বিনিময়ে থেকে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। অর্থাভাবে বহু প্রতিকূলতার মাঝে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং পরে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন।  কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও জে এন মুখার্জির সহপাঠী ছিলেন।  আর আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন তাঁর শিক্ষক।

তিনি পদার্থের তাপীয় আয়নীকরণ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। এই গবেষণার ফলস্বরূপ তিনি একটি সমীকরণ প্রদান করেন। এটিই সাহা সমীকরণ নামে পরিচিত। তারকাসমূহের বর্ণালি সম্পর্কিত গবেষণার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোনো তারার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিমাপ করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করে কোনো তারকা বা নক্ষত্র গঠনকারী বিভিন্ন উপাদানসমূহের আয়নিত অবস্থা সম্পর্কে তারা অবগত হন।  সৌররশ্মির ওজন ও চাপ নির্ণয়ে সাহা একটি যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম।

এক পরমানুক গ্যাসীয় পদার্থের জন্য সাহা সমীকরণ

শিক্ষাঙ্গনেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে মনোনীত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯২৭ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন। সাহা ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ২১ তম অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার প্রসারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ গড়ে তোলেন। এছাড়াও ১৯৪৯ সালে কলকাতায় ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠাতেও তার অসামান্য অবদান ছিল। পরবর্তীতে তার সম্মানার্থে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় “সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স”।

সাহা Science and Culture নামে  একটি পত্রিকাও চালু করেন ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও তার নেতৃত্বে বেশ কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক সংগঠন গড়ে ওঠে।  এগুলোর মাঝে ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স (১৯৩০), দ্যা ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি (১৯৩৪) ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কালটিভেশন অব সায়েন্স (১৯৪৪ ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতের নদী পরিকল্পনার প্রধান স্থপতি ও দামোদর উপত্যকা প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

এত সাফল্যের পরেও মেঘনাদ সাহার জীবনে কিছুটা অতৃপ্তি ছিল। তিনি যে কখনও নোবেল পুরষ্কার লাভ করতে পারেননি! তবে তিনি বেশ কয়েকবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি ডি এম বোস এবং শিশির কুমার মিত্র কর্তৃক পদার্থবিদ্যায় ১৯৩০ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। নোবেল কমিটি সাহার কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানায়।  তারা তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফলকে “গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটাকে “আবিষ্কার” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। ফলে সেবার তিনি নোবেল পুরষ্কার অর্জনে ব্যার্থ হন। এরপর ১৯৩৭ এবং ১৯৪০ সালে কম্পটন ও ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৩ সালে শিশির কুমার মিত্র পুনরায় নোবেলের জন্য মেঘনাদ সাহাকে মনোনীত করেন। তবে নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় প্রতিবারই তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল।

বিজ্ঞানজগতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি অধরা থাকলেও সমস্ত বাঙ্গালির গর্ব মেঘনাদ সাহা তৎকালীন খ্যাতনামা সকল বিজ্ঞানীর প্রশংসা পেয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন,
Dr. M.N. Saha has won an honored name in the whole scientific world     

সূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়াঃ Meghnad Saha
২। উইকিপিডিয়াঃ মেঘনাদ সাহা 

Category: articles

বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বই মেলায় পাওয়া যাচ্ছে আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ এর অনূদিত বই অ্যা ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম।
বইটি স্টিফেন হকিং এর লেখা 'কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' বইটির আপডেট। এ বইটিতে হকিংকে সহায়তা করেছেন লিওনার্ড ম্লোডিনো।

বইটির প্রচ্ছদের অংশ বিশেষ 

আলোচিত হয়েছে মহাবিশ্বের অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে। পাশাপাশি রয়েছে আপেক্ষিক তত্ত্ব, ব্ল্যাক হোল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে আলোচনা। শেষের দিকে রয়েছে বর্তমান সময়ের আলোচিত স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কিছু আলোচনা।

এর আগে লেখা অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের সাথে এর পার্থক্য নিয়ে শোনা যাক মূল লেখকদের মুখেঃ

এ বইটির নাম অ্যা ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম (A Briefer History of Time), যার অর্থ আগের বইটির সাথে এর পার্থক্য মাত্র দুটো অক্ষরের। A Brief History of Time (কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) বইটি ২৩৭ সপ্তাহ ধরে সানডে টাইমস বেস্ট-সেলার বইয়ের তালিকায় ছিল। ...

বইটিতে আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম জটিল কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
A Brief History of Time প্রকাশিত হবার পর বহু মতামত আসে।। বইটির একটি নতুন সংস্করণ বের করার অনুরোধ আসত খুব নিয়মিত। পাঠকদের প্রত্যাশা ছিল- এতে আগের বইটির বিষয়গুলোই থাকবে, তবে তা হবে আরো স্পষ্ট ও সহজবোধ্যভাবে। কিন্তু অনেকের মতামত ছিল আবার আরেকটু বেশি জানার পক্ষে, যা কলেজ পর্যায়ের, কসমোলজির কোর্সের সমান মানের হবে। এ বইটি লেখার পেছনে এই উদ্দেশ্যগুলোই কাজ করেছে।
...
বইটিতে আমরা আগের বইয়ের বিষয়গুলো অক্ষুণ্ণ রেখে প্রয়োজন অনুসারে কিছু কথা যোগ করেছি। কিন্তু আবার এর পরিসর ও সহজবোধ্যতার দিকেও চোখ রেখেছি। আমরা আগের বইয়ের কিছু বিষয় বাদ দিয়েছি বলে আসলেই একে আগের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা চলে । আসলে তা করতে গিয়ে
বইটির প্রধান ও মূল বিষয়কেই আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এই সুযোগে আমরা বইটিকে আপডেটও করেছি এবং এতে নতুন তাত্ত্বিক ও পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল যুক্ত করেছি। যেমন পদার্থবিদ্যার সকল বলের একটি পূর্ণাংগ তত্ত্ব অনুসন্ধানের পথে সাম্প্রতিক অগ্রগতি এতে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে এতে স্ট্রিং থিওরির অগ্রগতি আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনা করা হয়েছে ডুয়ালিটি বা দ্বৈততা তথা আপাত দৃষ্টিতে দেখতে আলাদা মনে হওয়া বিভিন্ন তত্ত্বের সাদৃশ্য নিয়ে।

এতে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার (COBE) এবং হাবল স্পেইস টেলিস্কোপের মাধ্যমে পাওয়া ফলাফল যুক্ত করা হয়েছে।
(বইয়ের ভূমিকা থেকে)

বইটি পাওয়া যাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকা ১২ নং প্যাভিলিয়নে অন্বেষা প্রকাশন এর স্টলে। দাম রাখা হয়েছে ২০০ টাকা।

বইয়ের পুরো আবরণ

ইতোমধ্যেই অন্বেষার বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বইটি।

বিজ্ঞান পত্রিকার সৌজন্যে অনলাইনেও পড়তে পারেন।

হার্ড কপির পাঠকরা কিনতে পারবেন রকমারি ডট কম থেকেও। অর্ডার করুন এখান থেকে

লেখক পরিচিতি 
Category: articles

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি।

১৮৯৮ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিটজ জুইকি।  তাত্ত্বিক ও পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে তিনি বিখ্যাত। বিশেষ করে সুপারনোভার  নামকরণ ও এদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি অবদান রাখেন, যার ফলে পরবর্তীতে মহাবিশ্বের বয়স ও সাইজ পরিমাপ করা সহজ হয়ে যায়।


ফ্রিট্‌জ জুইকি

জুইকির জন্ম বুলগেরিয়ার ভারনা শহরে। বুলগেরিয়াতে জন্মালেও তার বাবা মা দুজনই ছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরক। ৩ ভাই বোনের মাঝে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ১৯০৪ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে তাকে তার পৈত্রিক নিবাস সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যারাসে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি  দাদা দাদির কাছে বড় হতে থাকেন।  প্রথমে পড়াশোনা শুরু করেনবাণিজ্য বিভাগ নিয়ে। পরবর্তীতে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর ফলশ্রুতিতে তিনি সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউটে গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

১৯২৫ সালে সুইজারল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। রকিফেলার ফাউন্ডেশন থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অর্জনের ফলে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকনের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মহাজাগতিক তত্ত্ব নিয়ে  গবেষণা করতে থাকেন। জুইকি সাধারণত একাকী থাকতেই পছন্দ করতেন। এমনকি গবেষণার সময় সমস্ত গাণিতিক হিসাব নিকাশ করতেন নিজে নিজেই।

১৯৪২ সালে তিনি ক্যালটেকের জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত অ্যারোজেট ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের গবেষক দলের পরিচালক বা পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরি ও পালোমার অবজারভেটরি নামক জ্যোতির্বিদ্যার দুইটি বিখ্যাত গবেষণাগারেও কাজ করেন। তিনি বেশ কিছু জেট ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। এদের মধ্যে আন্ডারওয়াটার জেট, ইনভার্টেড হাইড্রো পালস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সনাতন পদ্ধতির এই জেটইঞ্জিনগুলোর আবিষ্কারের ফলে তিনি ৫০টি পেটেন্ট লাভ করেছিলেন।

বিজ্ঞানী হিসেবে জুইকি প্রথমে আয়নিক ক্রিস্টাল ও তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তবে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে করা অনুসন্ধানই তাকে বিখ্যাত করে তোলে।
১৯৩৪ সালে তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষক ওয়াল্টার বাডে সর্বপ্রথম সুপারনোভা শব্দটি ব্যাবহার করেছিলেন। একটি সাধারণ তারকা নিউট্রন তারকাতে রূপান্তরিত হবার মধ্যবর্তী অবস্থাকে তাঁরা সুপারনোভা বলে অভিহিত করেন। তাঁরা সুপারনোভাকে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এই ধারণাটিই মহাবিশ্বের আকার এবং বয়সের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।

আরও পড়ুন
 নিউট্রন তারকা কাকে বলে?

এই স্বীকার্য প্রমানের জন্য জুইকি  সুপারনোভার খোঁজ চালাতে থাকেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সর্বমোট ১২০টি সুপারনোভার সন্ধান পেয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৩৫ সালে তিনি ও বাডে মিলিতভাবে মাউন্টেন টপ অবজারভেটরিতে প্রথম স্মিট (Schmidt) টেলিস্কোপ ব্যাবহার করেছিলেন।

১৯৩৭ সালে জুইকি পূর্বে আবিষ্কৃত আইনস্টাইন ইফেক্টের মাধ্যমে অনুমান করেন, গ্যালাক্সিগুলো মহাকর্ষীয় লেন্স হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। তবে আইনস্টাইন ইফেক্ট আবিষ্কার করা হলেও বিজ্ঞানীরা এটি সম্পর্কে তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলেন না। পরবর্তীতে “টুইন কোয়াসার” পর্যবেক্ষণের দ্বারা তারা আইনস্টাইন ইফেক্টের সত্যতা খুঁজে পান।

১৯৩৩ সালে কোমা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার নিয়ে গবেষণা কালে তিনিই সর্বপ্রথম অদৃশ্যমান বস্তুর অস্তিত্ব নিরূপণে ভিরিয়াল উপপাদ্য (বলবিদ্যার একটি বিশেষ সূত্র) প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি সেই অদৃশ্য বস্তুর নাম দিয়েছিলেন Dunkle Materie। একেই বর্তমানে আমরা ডার্ক ম্যাটার বলে চিনি। তিনি ক্লাস্টারের মাঝে থাকা গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষীয় ভর পরিমাপ করেন এবং দেখেন এই ভরের মান গ্যালাক্সিগুলোর ঔজ্জ্বল্য অনুসারে অনুমিত ভরের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। এর অর্থ দাঁড়ায়, মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থানই ডার্কম্যাটার দ্বারা পূর্ণ। বর্তমানে দৃশ্যমান ও আলোকিত পদার্থসমূহের ভরের মান বৃহৎ বিবেচনা করে হিসাব করার ফলে এই ফলাফলের কিছুটা এদিক-ওদিক হয়েছে। তবে তার এই ধারণাটি এখন পর্যন্ত সঠিক বলেই গৃহীত হয়।

জুইকির আবিষ্কৃত গ্যালাক্সি আইজুইকি১৮এ। ছবিটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা। 


নিউট্রন স্টার আবিষ্কারের পর জুইকি নিউক্লিয়ার গব্লিনের  ধারণা প্রদান করেছিলেন। তার প্রস্তাবনা অনুসারে, গব্লিন একটি তারার মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে চলাচল করতে পারে। তবে তারাটির অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের অঞ্চলে পৌঁছানো মাত্রই এটি বিস্ফোরিত হয়। নক্ষত্রের বিস্তারন সহ উদ্গীরনজাত বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যায় তাঁর এই অনুমান যথেষ্ট কাজে লেগেছিল। এছাড়াও তিনি কৃত্রিম উল্কাপিণ্ড তৈরি করতে সমর্থ হন।

মহাকাশ গবেষণায় অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতিসরূপ তার নামে একটি গ্রহাণু (১৮০৩ জুইকি) ও চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি বড় গর্তের (জুইকি) নামকরণ করা হয়। এছাড়াও ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় রকেট পরিচালনায় অসামান্য অবদান রাখায় তাকে ১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে তাকে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির এমিরেটাস অধ্যাপক বানানো হয়। ১৯৭২ সালে তাকে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিদদের জন্য এটিকেই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞানী হিসেবে জুইকি সকলক্ষেত্রে সফলতার স্বাদ পেলেও পারিবারিক জীবন ততটা মসৃণ ছিল না।  ১৯৩২ সালের এপ্রিলে তিনি এগবার্ট গেটস নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী সিনেটরের কন্যা ডোরোথি ভারনান গেটসকে বিয়ে করেন। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের চাচাতো ভাই নিকোলাস রুজভেল্ট এগবার্টের আরেক মেয়ে তিরজাহ গেটসকে বিয়ে করেছিলেন। ফলে বিবাহসূত্রে জুইকি আর নিকোলাসের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। অপরদিকে ডোরোথিকে বিয়ে করায় তিনি বেশ ভালো অর্থ উপঢৌকন হিসেবে লাভ করেন। ১৯৩০ সালের দিকে আর্থিক মন্দার সময় পালোমার অবজারভেটরির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তিনি এই অর্থ ব্যয় করেন।

তবে ১৯৪১ সালে ডোরোথি ও জুইকি তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টানেন এবং আপোষের মাধ্যমে পরস্পর আলাদা হয়ে যান। ১৯৪৭ সালে সুইজারল্যান্ডে অবস্থানকালে জুইকি অ্যানা মারগারিটা যার্চার নামক এক মহিলাকে পুনরায় বিবাহ করেন। পরবর্তীতে জুইকি ৩ কন্যা সন্তানের বাবা হন। তার সন্তানদের নাম ছিল মারগারিট, ফ্রাঞ্জিস্কা ও বারবারিনা।

সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যারাসে জুইকির নামে একটি জাদুঘর (জুইকি মিউজিয়াম) স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে তার বিভিন্ন গবেষনাপত্র ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর এই প্রথিতযশা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনা শহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সুইজারল্যান্ডের মলিসে তাকে সমাহিত করা হয়।

সূত্র
১।  উইকিপিডিয়া
২।  ফেমাস অ্যাস্ট্রোনোমারস ডট অরগ
Category: articles

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭


স্বছ পদার্থ হচ্ছে সেই বস্তু, যার মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করতে পারে। যেমন কাঁচ। এর মধ্য দিয়ে তাকালে বিপরীত পাশের বস্তু দেখা যায় (অবশ্যই যদি না অপর পাশে প্রলেপ দেওয়া থাকে)। চলুন দেখি কেন আমরা কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকালে অপর পাশের বস্তু দেখি অথচ কাঠের মধ্য দিয়ে তাকালে দেখি না।

নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন, বেশিরভাগ তরল ও গ্যাসীয় পদার্থই স্বচ্ছ। পানি, রান্না-বান্নার তেল, বায়ূ, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি।

কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের মৌলিক ভিন্নতাই এর কারণ।

কোনো বস্তু যখন কঠিন অবস্থায় থাকে, তখন এর অণুগুলো (Molecule) পরস্পরের সাথে খুব সু-সংগঠিত থাকে, এবং এর ফলে তাদের মধ্যকার বন্ধন খুব শক্তিশালী হয় আর বস্তুটি পায় দৃঢ়তা। বস্তুটি যখন তরল হয়ে যায়, তখন বন্ধন-শক্তি কমে যায় এবং অণুগুলোর সজ্জা বা বিন্যাস কিছুটা বিশৃংখল হয়ে যায়। আর গ্যাসীয় অবস্থায় এ বিন্যাস হয়ে যায় একেবারেই এলোমেলো।

বিন্যস্ত অবস্থা থেকে ক্রমে তরল ও গ্যাসে সজ্জাহীনতাই এদের মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করতে পারার মূল কারণ। একটার উপর একটা ইট খাড়া করে যেমন দূর্ভেদ্য দেয়াল নির্মাণ করা যায় তেমনি আলোক তরঙ্গ চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অণুর সুবিন্যস্ততা।

বস্তু সাপেক্ষে আলোক তরঙ্গ প্রতিফলিত বা শোষিত হবে অথবা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তরল বা গ্যাসের ক্ষেত্রে অণুগুলো নিজেদের সাথে গাদাগাদি করে লেগে থাকবে না। ফলে তাদের মাঝে ফাঁকা স্থান রয়ে যাবে, যে পথে আলোক তরঙ্গ বের নিজের পথ করে নেবে।

অণুগুলোর অবিন্যস্ততা ( randomness) যত বেশি হবে , আলো তত সহজে বস্তূটিকে পাড়ি দেবে।
যখন একটি ফোটন (Photon) কোন পদার্থের পরমাণুর ইলেক্ট্রনের সংস্পর্শে আসে তখন নিম্ন-ঘটনা ঘটতে পারে-
      ক. ইলেক্ট্রন ফোটনের শক্তি শোষণ করে একে রূপান্তরিত করবে (সাধারণত তাপ শক্তিতে)
      খ. ইলেক্ট্রন ফোটনের শক্তি শোষণ ও সঞ্চয় করে ঔজ্জ্বল্য (Luminescence)  প্রদর্শন করবে।
      গ. ফোটনের শক্তি শোষণ করে পরে প্রতিফলিত করবে
      ঘ. ইলেক্ট্রন ফোটন কে শোষিত করতে পারবে না, ফলে ফোটন বস্তুটি ভেদ করে চলে যাবে।

অবশ্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরের সব অপশনের সমন্বয় (Combination) ঘটে।

এবার চলুন দেখি কাঁচ কীভাবে স্বচ্ছ হয়?
সিলিকা বা বালি কাঁচ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত হয়। এটাকে গলনাঙ্কে পৌঁছানো পর্যন্ত উত্তপ্ত করে তরল বানিয়ে এরপর  ঠণ্ডা করা হয়। ফল দাঁড়ায় এর অণুগুলো তরলের মতই অ-বিন্যস্ত থাকে কিন্তু কঠিন পদার্থের মত শক্ত বন্ধন ও দৃঢ়তা ধরে রাখে।
প্লাস্টিককেও একইভাবে শীতলীকরণের মাধ্যমে স্বচ্ছ বানানো হয়।
Category: articles

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

প্রাচীনকালের মানুষজন পৃথিবীকে সমতল মনে করত। এ বিশ্বাস শুরু হয়েছিল সুমেরীয়দের দিয়ে। তারাই ছিল প্রথম সভ্যতা, যারা লিখতে পারত। তারা ধরে নিয়েছিল, পৃথিবী একটি বিশাল সমতল মাঠ। তাদের ধারণার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও ছিল। কারণ সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে, পৃথিবীর উঁচু ও নিচু স্থানগুলোকে মিলিয়ে সমতল করে ফেলা সম্ভব। তাছাড়া শান্ত পুকুর বা হ্রদের পানির দিকে তাকালে তা সমতল দেখায়। ভিন্নভাবে দেখলে, পৃথিবীর বক্রতা মেপেও বোঝা যায় তা আসলে সমতল নাকি গোলাকার। পরিমাপ করলে দেখা যাবে পৃথিবীর প্রতি মাইলে বক্রতার ব্যাসার্ধ শুন্য! যেখানে ১ মিটার ব্যাসার্ধের কোনো গোলকের বক্রতা প্রতি মিটারে ১ একক।

 বক্র পৃথিবী 

কিন্তু আজ আমরা সবাই জানি, পৃথিবী সমতল নয়। বরং প্রায় কমলালেবুর মতো গোলাকার। তবে প্রাচীনকালের যন্ত্রপাতি দ্বারা প্রাপ্ত পৃথিবীর সমতল তত্ত্ব প্রায় সঠিক ছিল। এ কারণে অনেক দিন ধরেই মানুষ পৃথিবীকে সমতল ভাবত।

তবে পৃথিবী সমতল হলে কিছু সমস্যা থেকেই যায়, যা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। যেমনঃ ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল দেখলেন, পৃথিবীকে সমতল ধরলে তিনটি প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায় না। প্রথমটি হল, যদি কেউ উত্তর দিকে ভ্রমণ করতে থাকে, তবে তার কাছে রাতের আকাশের কিছু তারা দিগন্তে মিলে যাচ্ছে বলে মনে হবে। আবার দক্ষিণ দিকে ভ্রমণ করলেও অন্য কিছু তারা দিগন্তে মিলে যায়। দ্বিতীয়টি হল, চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া সব সময় গোলাকার দেখায়। তৃতীয় ঘটনা, সমুদ্রে কোনো জাহাজ যেদিকেই ভ্রমণ করুক না কেন জাহাজের কোল সবার আগে অদৃশ্য হয়ে যায়। এছাড়াও তিনি মনে করতেন সব বস্তুই গোলকে রুপান্তরিত হতে চায়।

অ্যারিস্টটল  
অ্যারিস্টটলের প্রায় ১০০ বছর পরে ইরাটোস্থেনিস নামে আরেকজন বিজ্ঞানী খেয়াল করেন, একই বস্তুর ছায়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যদি একই সময়ে পরিমাপ করা যায়, তবে ছায়ার দৈর্ঘ্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হয়।
 
ছায়ার এই দৈর্ঘ্যের পার্থক্য থেকে তিনি পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেন ২৮ হাজার ৬৫০ মাইল। যার বক্রতার ব্যাসার্ধ দাঁড়ায় প্রতি মাইলে ০.০০০১২৬। এই মানটি শূন্যের খুব কাছাকাছি। প্রাচীনকালের যন্ত্রপাতি দিয়ে তা পরিমাপ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই সেই সময় পৃথিবীর সমতলতত্ত্ব নিয়ে কেউ তেমন দ্বিমত পোষণ করেনি।

ইরাটোস্থেনিস 

তারপরেও পৃথিবী কি সম্পূর্ণ গোলক? টেলিস্কোপ দিয়ে শনি ও বৃহস্পতি গ্রহ পর্যবেক্ষণ করা হলে দেখা গেল, তারা পুরোপুরি গোলক নয়। বরং উপবৃত্তাকার। ১৭ শতকের শেষের দিকে আইজ্যাক নিউটন দেখিয়েছিলেন, যদি বিশালাকার কোনো বস্তু ঘূর্ণায়মান থাকে, তবে একটা কেন্দ্রবিমুখী বল তৈরি হবে, যার মান বিষুবীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি হবে। এই বলের কারণে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ বস্তুসমুহ অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে পৃথিবী ছেড়ে বাইরে চলে যেতে চাইবে। যেহেতু বিষুবীয় অঞ্চলে এই বল সর্বাধিক, তাই এই অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সর্বোচ্চ হবে। অষ্টাদশ শতকে পরিমাপ করে দেখা গেল নিউটন ঠিকই বলেছিলেন। পৃথিবী আকৃতি আসলে কমলালেবুর মত। তখন প্রতি মাইলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধের পার্থক্য পাওয়া যায় ০.০০৩৪।

নিউটন 

তাহলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল?
পৃথিবীর বক্রতা প্রাথমিকভাবে প্রতি মাইলে শূন্য। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে ০.০০০১২৬ ,যা প্রতি মাইলে ৭.৯৭৩ থেকে ৮.০২৭ ইঞ্চি পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে। তাই সমতল পৃথিবীর ধারণা যেমন ভুল ছিল, গোলাকার পৃথিবীর ধারণাটিও তেমনি ভুল। কিন্তু সেই ভুলের পরিমাণ সমতল পৃথিবীর ধারনার চেয়ে অনেক অনেক কম।

ঠিক এরকমভাবেই আজ আমরা যা জানি, তা আমাদের কাছে এখন  সঠিক ও নির্ভুল মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জ্ঞান আরেকটু সমৃদ্ধ হলে নিজের জানা সঠিক বিষয়টাই হয়ত এক সময় ভুল বলে মনে হতেই পারে। এই মহাবিশ্বের অসীম জ্ঞান সমুদ্রের তুলনায় আমরা যে নিতান্তই মূর্খ!

আরও পড়ুনঃ
পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ মেরু থাকলেও পূর্ব পশ্চিম মেরু নেই কেন?

তথ্যসূত্রঃ 
১। ইউটিউব
২। উইকিপিডিয়া
Category: articles

বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৭


পৃথিবীর পৃষ্ঠে বসিয়ে রাখা একটি রকেট নিয়ে চিন্তা করতে করতেই কাল দীর্ঘায়নে মহাকর্ষের প্রভাব বুঝে ফেলা যায়। আমরা একটু পরেই তা করব। তবে তার আগে কিছু কথা বলে রাখা জরুরী।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, স্থান ও কাল দুটোই পরম। কোনো ঘটনা কোথায় এবং কখন ঘটেছে সে সম্পর্কে সকল পর্যবেক্ষক একমত হবেন। নিউটন এসে পরম স্থানের ধারণাকে বিদায় জানিয়ে দেন। আইনস্টাইন বিদায় দেন পরম সময়কেও। তবে পরম সময়ের কফিনে মাত্র একটি পেরেক ঠুকে তাঁর মন ভরেনি। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, আলোর কাছাকাছি বেগে গতিশীল অভিযাত্রীর সময় চলবে তুলনামূলক অনেক ধীরে। ১৯১৫ সালের প্রকাশ করেন আরো যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব। এটাই হল মহাকর্ষের সর্বাধুনিক তত্ত্ব। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব (General theory of relativity)। দেখালেন, কাল দীর্ঘায়ন ঘটায় মহাকর্ষও।

অবশ্য উচ্চ গতির মতো মহাকর্ষও যে কাল দীর্ঘায়ন ঘটাতে সিদ্ধহস্ত সেটা তিনি ১৯০৭ সালে লেখা ও ১৯০৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধেই অনুমান করেন।

দুই আপেক্ষিক তত্ত্বেই একটি করে মৌলিক নীতি মেনে চলা হয়। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে সেটি হল আপেক্ষিকতার মৌলিক স্বীকার্য। এর বক্তব্য হল,
মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের কাছে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকবে, বেগ যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। 
এখানে ত্বরণ সম্পর্কে কিছু বলা হয় না। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক নীতিটি হল,  সমতুল্যতার নীতি (Principle of equivalence)। এই নীতির বক্তব্য হল,
যথেষ্ট ক্ষুদ্র স্থানের অঞ্চলে অবস্থান করে এটা বলা সম্ভব নয় যে আপনি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থিরাবস্থায় আছেন, নাকি শূন্য স্থানে সুষম হারের ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) নিয়ে চলছেন।
এই গুরুগম্ভীর কথা বুঝতে অসুবিধা হলে সমস্যা নেই। বরং চলুন একটি উদাহরণ দেখি।

মনে করুন, আপনি মহাশূন্যের মধ্যে এমন একটি লিফটে আছেন, যেখান মহাকর্ষ অনুপস্থিত। ফলে এখানে উপর বা বা নিচ বলতে কিছু নেই। আপনি মুক্তভাবে ভেসে আছেন। একটু পর লিফটখানা সমত্বরণে চলা শুরু করল। এখন কিন্তু হঠাৎ করে আপনি ওজোন অনুভব করবেন। আপনি লিফটের এক প্রান্তের দিকে একটি টান অনুভব করবেন। এখন এ দিকটিকেই আপনার কাছে মেঝে মনে হবে! আপনি এখন হাত থেকে একটি আপেল ছেড়ে দিলে এটি মেঝের দিকে চলে যাবে। আসলে এখন আপনার মতোই লিফটের ভেতরের সব কিছুর ত্বরণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আসলে লিফটটা মোটেই গতিশীল নয়, বরং এটি একটি সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থির অবস্থায় আছে।

আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, ট্রেনের ভেতরে বসে যেমন আপনি বলতে পারেন না যে আপনি সম বেগে চলছেন কি না, তেমনি লিফটের ভেতরে বসেও আপনি বুঝতে পারবেন না, আসলে আপনি সুষম ত্বরণে চলছেন, নাকি কোনো সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আছেন। আইনস্টাইনের এই চিন্তার ফলাফলই হল সমতুল্যতার নীতি।

সমতুল্যতার নীতি এবং এর ওপরের উদাহরণটি সত্য হলে বস্তুর জড় ভর (Inertial mass) ও মহাকর্ষীয় ভরকে (Gravitational mass) অবশ্যই একই জিনিস হতে হবে। বল প্রয়োগের ফলে কতটুকু ত্বরণ হবে তা নির্ভর করে জড় ভরের ওপর। এই ভর নিয়েই কথাই বলা হয়েছে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রে। আর অন্য দিকে মহাকর্ষীয় ভরের কথা আছে নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রে। আপনি কতটুকু মহাকর্ষীয় বল অনুভব করবেন তা নির্ভর করে এই ভরের ওপর।

আমরা সমতুল্যতার নীতি জানলাম। আইনস্টাইনের যুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবার একটি থট এক্সপেরিমেন্ট (যে পরীক্ষা বাস্তবে করা যায় না, চিন্তা করে করে বুঝতে হয়) করতে হবে। এটা আমাদেরকে দেখাবে মহাকর্ষ সময়কে কীভাবে প্রভাবিত করে।

মহাশূন্যে অবস্থিত একটি রকেটের কথা চিন্তা করুন। চিন্তার সুবিধার জন্যে মনে করুন রকেটটি এত বড় যে এর শীর্ষ থেকে তলায় আলো পৌঁছতে এক সেকেন্ড লাগে। অর্থ্যাৎ এর দৈর্ঘ্য ১, ৮৬,০০০ মাইল। আরও মনে করুন, রকেটের সিলিং ও মেঝেতে একজন করে দর্শক আছেন। দুজনের কাছেই অবিকল একই রকম একটি করে ঘড়ি আছে যা প্রতি সেকন্ডে একটি করে টিক দেয়।

মনে করুন সিলিং এর দর্শক ঘড়ির টিকের অপেক্ষায় আছেন। টিক পেয়েই তিনি মেঝের দর্শকের দিকে একটি আলোক সঙ্কেত পাঠালেন। পরে ঘড়িটি আবারও টিক (সেকেন্ডের কাঁটায়) দিলে তিনি আরেকটি সঙ্কেত পাঠালেন। এ অবস্থায় প্রতিটি সঙ্কেত এক সেকেন্ড পর মেঝের দর্শকের কাছে পৌঁছায়। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত দুটি পাবেন।

মহাশূন্যে মুক্তভাবে ভেসে না চলে রকেটখানা যদি পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানের মধ্যে থাকত তাহলে কী ঘটত? নিউটনীয় থিওরি অনুসারে এই ঘটনায় মহাকর্ষের কোনো হাত নেই। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকেন্ডের মধ্যেই তা পাবেন। কিন্তু সমতুল্যতার নীতি ভিন্ন কথা বলে। চলুন দেখা যাক, নীতিটি কাজে লাগিয়ে আমরা মহাকর্ষের বদলে সুষম ত্বরণ নিয়ে চিন্তা করে কী পাই। নিজের মহাকর্ষ থিওরি তৈরি করতে আইনস্টাইন সমতুল্যতা নীতিকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন এটা হল তার একটি উদাহরণ।

তো, এখন তাহলে মনে করুন রকেটটি ত্বরণ নিয়ে চলছে (অর্থ্যাৎ, প্রতি মুহূর্তে এর বেগ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা আপাতত ধরে নিচ্ছি এর ত্বরণের মান ক্ষুদ্র, না হলে আবার এটি আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে!)। রকেটটি উপরের দিকে গতিশীল বলে প্রথম সঙ্কেতটিকে আগের চেয়ে (যখন রকেট স্থির ছিল) কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। কাজেই সঙ্কেতটি এখন এক সেকেন্ড পার হবার আগেই পৌঁছে যাবে তলায়।

রকেটটি যদি নির্দিষ্ট বেগে (ত্বরণহীন) চলত, তাহলে আগে-পরের সব সঙ্কেত এক সেকেন্ড পরপরই পৌঁছত। কিন্তু এখানে ত্বরণ আছে বলে প্রথমে যখন সঙ্কেত পাঠানো হয়েছিল, রকেট এখন তার চেয়ে দ্রুত চলছে। কাজেই দ্বিতীয় সঙ্কেতকে আরও কম দূরত্ব পার হতে হবে। ফলে এটি পৌঁছতেও আরও কম সময় লাগবে। কাজেই মেঝের দর্শক দুই সঙ্কেতের মাঝে সময় ব্যবধান পাবেন এক সেকেন্ডের চেয়ে কম। অথচ সিলিং এর দর্শক তা পাঠিয়েছেন ঠিক এক সেকেন্ড পরে। হয়ে গেল সময়ের গরমিল।

ত্বরণপ্রাপ্ত রকেটের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটা নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, সমতুল্যতার নীতি বলছে, রকেটটি যদি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রেও স্থির থাকে তবু একই ঘটনা ঘটবে। অর্থ্যাৎ, রকেটটি যদি ত্বরণপ্রাপ্ত নাও হয় (যেমন ধরুন এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে উৎক্ষেপণের জন্যে বসিয়ে রাখা আছে) তাহলেও সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ড পর দুটো সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শক তা পাবেন এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই। এবার অদ্ভুৎ লাগছে, তাই না!

হয়ত মাথায় প্রশ্ন আসবে, এর অর্থ তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে- মহাকর্ষ কি সময়কে বিকৃত করছে, নাকি ঘড়িকে অচল করে দিচ্ছে? ধরুন, মেঝের দর্শক উপরে উঠে সিলিং এর দর্শকের সাথে ঘড়ি মিলিয়ে নিলেন। দেখা গেল, দুটো ঘড়ি অবিকল একই রকম। তারা এও নিশ্চিত যে দুজনে এক সেকেন্ড বলতে সমান পরিমাণ সময়কেই বোঝেন। মেঝের দর্শকের ঘড়িতে কোনো ঝামেলা নেই। এটি যেখানেই থাকুক, তা তার স্থানীয় সময়ের প্রবাহ-ই মাপবে।

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের বলছে, ভিন্ন বেগে চলা দর্শকের জন্যে সময় ভিন্ন গতিতে চলে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে, একই মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের গতি আলাদা। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মেঝের দর্শক এক সেকেন্ডের চেয়ে কম সময় পেয়েছেন, কারণ পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছে সময় অপেক্ষাকৃত ধীরে চলে। মহাকর্ষ ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে এই প্রভাবও হবে বেশি। নিউটনের গতি সূত্রের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছিল পরম স্থানের ধারণা। এবার আপেক্ষিক তত্ত্ব পরম সময়কেও বিদায় জানিয়ে দিল।

কাল দীর্ঘায়ন। পাহাড়ের ঘড়ি দ্রুত চলে। 

১৯৬২ সালে এই অনুমান পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। একটি ওয়াটার টাওয়ারের উপরে ও নিচে দুটি অতি সূক্ষ্ম ঘড়ি বসানো হয়। দেখা গেল নিচের ঘড়িটিতে (যেটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের বেশি কাছে আছে) সময় ধীরে চলছে, ঠিক সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব যেমনটি অনুমান করেছিল তেমনই। এই প্রভাব খুব ক্ষুদ্র। সূর্যের পৃষ্ঠে রাখা কোনো ঘড়িও পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় মাত্র এক মিনিট পার্থক্য দেখাবে। কিন্তু পৃথিবীর ওপরের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের এই ক্ষুদ্র পার্থক্যই বর্তমানে বাস্তব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্যাটেলাইট থেকে আসা সঙ্কেতের মাধ্যমে আমাদের ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে ঠিক রাখার জন্যে এর প্রয়োজন হয়। এই প্রভাব উপেক্ষা করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অবস্থান বের করলে ভুল হয়ে যাবে কয়েক মাইল!

সময়ের প্রবাহের পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের শরীরেও। এমন এক জোড়া যমজের কথা চিন্তা করুন, যাদের একজন বাস করছে পাহাড়ের চূড়ায় এবং আরেকজন সমুদ্র সমতলে। প্রথম জনের বয়স অপরজনের চেয়ে দ্রুত বাড়বে। দুজনে আবার দেখা করলে দেখা যাবে একজনের বয়স আরেকজনের চেয়ে বেশি। এই ক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য খুব ক্ষুদ্র হবে হবে। তবে এদের একজন যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে মহাকাশযানে করে দীর্ঘ ভ্রমণ করে ফিরে আসে তাহলে দেখা যাবে যমজের চেয়ে তার বয়স অনেক বেশি পরিমাণে কম হচ্ছে।

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে পৃথিবী থেকে দূরে গিয়ে অনেক বেশি বেগে ভ্রমণ করে এলে আপনার বয়স অপেক্ষাকৃত কম হবে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দূরে অবস্থান করলে বয়স দ্রুত বাড়বে। একটি প্রভাব আপাত দৃষ্টিতে আরেকটি থেকে উল্টোভাবে কাজ করে। অবশ্য বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব কার্যকর হবার জন্যে আপনাকে রকেটে চড়ে মহাশূন্যেই যেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনি যদি পৃথিবীতেই একটি (অ)সম্ভব দ্রুতগামী ট্রেনে চড়েও ভ্রমণ করেন তবু ট্রেনের বাইরে থাকা আপনার বন্ধুর চেয়ে আপনার বয়স কম হবে।
কাল দীর্ঘায়ন। পাহাড়ের তুলনায় ভূমির সময় চলে ধীরে। 

 একে বলা হয় টুইন প্যারাডক্স। তবে মাথার মধ্যে পরম সময়ের ধারণাকে স্থান দিলে তবেই একে প্যারাডক্স (পরস্পর বিরোধী বা আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা) মনে হবে। আপেক্ষিক তত্ত্বে একক পরম সময় বলতে কিছু নেই। বরং প্রত্যেক দর্শক তার নিজের মতো করে সময় মাপেন। এটা মেনে নিলেই আর কোনো প্যারাডক্স থাকে না।

সূত্রঃ
স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লোদিনোর লেখা ও লেখকের অনূদিত প্রকাশিতব্য বই অ্যা ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম অবলম্বনে। বইটি এ বই মেলায় প্রকাশিত হচ্ছে। পড়তে পারছেন অনলাইনেও। 
Category: articles

সোমবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৭

পৃথিবীর বুক থেকে থেকে ওপরের দিকে লাফ দিয়ে আমরা গড়ে দেড় ফুটের কিছু বেশি উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে পারি। বাতাসে ভেসে থাকতে পারি প্রায় এক সেকেন্ড। কিন্তু সৌরজগতের অন্য গ্রহ বা উপগ্রহে গেলে কেমন লাফাতে পারব আমরা?


এ হিসাব মুহূর্তের মধ্যে করে ফেলতে স্টুয়ার্ট লোয়ে ও ক্রসি নর্থ নামের দুজন জ্যোতির্বিদ দারুণ একটি অনলাইন অ্যাপ বানিয়েছেন। এর নাম দিয়েছেন হাই জাম্প। এখান থেকে বের করা যাবে, এক লাফে কত উচ্চতায় ওঠা যাবে, আর কতক্ষণই বা ভেসে থাকা যাবে। চলুন ঘুরে আসি কিছুক্ষণ।

প্রথমেই পৃথিবী। আহেই বলেছি, সোজা ওপরের দিকে লাফ দিয়ে আমরা গড়ে দেড় ফুট উঠতে পারি। আমি অবশ্য দুই ফুটের কাছাকাছি পারি, চিকন হবার সুবাদে।

পৃথিবীর এক লাফ 
চাঁদে যাওয়া যাক। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র চাঁদেই এ পর্যন্ত মানুষ লাফানোর সুযোগ পেয়েছে। চাঁদের মহাকর্ষ পৃথিবীর মাত্র প্রায় সতের শতাংশ বা ছয় ভাগের এক ভাগ। ফলে এক লাফে আপনি আরও বেশি উঠতে পারবেন। দশ ফুট! হ্যাঁ, সত্যিই নিজেকে কিছুটা অতিমানব মনে হবে। আর শুন্যে ভেসে থাকতে পারবেন চার সেকেন্ড। বাহ!

মঙ্গলে যাই চলুন। চাঁদের চেয়ে বড় হলেও পৃথিবীর চেয়ে কিন্তু ছোট। মহাকর্ষ পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। উঠতে পারবেন তিন ফুট, আর ভেসে থাকবেন দুই সেকেন্ড। খুব বেশি না, তাই না? চলুন তাহলে একটু শিহরিত হই।

চলে আসুন বামন গ্রহ প্লুটোয়। এর পৃষ্ঠের অভিকর্ষের মান পৃথিবীর এক শ ভাগের ছয় ভাগ। এক লাফে এক্কেবারে ২৫ ফুট। শুন্যে থাকবেন ঝাড়া ৯ থেকে ১০ সেকেন্ড! চাঁদের চেয়েও বেশি। মনে রাখতে হবে, প্লুটো কিন্তু চাঁদের চেয়েও ছোট। এটাও এর গ্রহ থেকে বামন গ্রহ হয়ে যাবার একটা কারণ।

ভাবছেন হয়ত, বৃহস্পতি বা শনি থেকে লাফালে কেমন হয়? আফসোস! সেটা পারবেনই না। এদের কোনো কঠিন পৃষ্ঠ নেই, যেখান থেকে আপনি লাফ দেবেন। আর দিতে পারলেও পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম উঠতে পারতেন। তার চেয়ে চলুন, সত্যি সত্যি সুপারম্যান হয়ে যাই।

আসুন শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস-এ। এক লাফে শুন্যে ভেসে থাকবেন ঝাড়া এক মিনিট। পৌঁছবেন ১৪০ ফুট (প্রায় ৪৩ মিটার) ওপরে। বাহ!

এনসেলাডাস উপগ্রহে জাম্প 

একটি ধূমকেতু সফর করে এলে কেমন হয়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বেছে নিলাম ধূমকেতু ৬৭পি। এর অভিকর্ষ এতই তুচ্ছ যে, নাসার পাঠানো ফিলি ল্যান্ডার এর বুক আঁকড়ে থাকার জন্যে হারপুনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এখান থেকে লাফ দিলে আপনি আর এর বুকে ফিরেই আসবেন না। ছিটকে চলে যাবেন মহাশূন্যে! তার মানে নিছক একটি লাফের বেগ এর বুকের মুক্তিবেগের চেয়েও বেশি।

আরও পড়ুনঃ 
মুক্তি বেগ কাকে বলে? 

আরও জানতে চাইলে নিজেই ঘুরে আসুন এই লিঙ্ক থেকে

সূত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার, কসমস বুক 
Category: articles

বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৭

আলডেবারান রাতের আকাশের ১৪তম উজ্জ্বল নক্ষত্র।
একে চেনার ভালো একটি মাস জানুয়ারি। সন্ধ্যা নামলেই পূর্ব দিগন্তের বেশ ওপরে দেখা যাবে একে। তাকাতে হবে প্রায় সোজা পূর্ব দিকে। পরের মাসগুলোতে আস্তে আস্তে ওঠে আসবে মাথার ওপরের দিকে। এপ্রিল মাসের দিকে সন্ধ্যার  পশ্চিম আকাশে চলে আসবে। পরের কয়েক মাস দেখা কঠিন হবে।

আলডেবারানকে নিশ্চিত করে চেনার জন্যে কাজে লাগবে আদম সুরতের (কালপুরুষ) এর তিন তারা। আদম সুরতের মাঝখানের কোমরের তিনটি তারাকে যোগ করে ডান দিকে বাড়িয়ে দিলেই পেয়ে যাবেন নক্ষত্রটি।

আর তিন তারা থেকে যদি বাম দিকে যান, তাহলে পাবেন লুব্ধক। রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র।

আদম সুরত থেকে আলডেবারান
আরও পড়ুনঃ
Category: articles

শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬

লিখেছেনঃ বাংলাদেশ সায়েন্স ক্লাব 

এতদিন যা জেনেছেন মাথা থেকে এক্ষুণি ঝেড়ে ফেলুন। বৃহস্পতি গ্রহ যেই বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সেটা মহাকাশের একটা শুন্যস্থান! শুনে হয়ত অবিশ্বাসে চোখ কপালে ওঠে গেছে। তবে এটাই সত্য।
NASA থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক তথ্য এটাই বলছে ।


আমি আজ এর বিস্তারিত আলোচনা করব।

শুরুতেই আমাদের যেটা জেনে নিতে হবে সেটা হচ্ছে  বেরিকেন্দ্র (The barycenter)।
বলবিদ্যায় " Two body problem " এ আমরা এই Barycenter এর ধারণা পেয়ে থাকি। বলবিদ্যা বলছে,
যখন দুইটা বস্তু একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে চায় বা ঘুরে থাকে, তখন কম ভরের বস্তুটি বেশি ভরের বস্তুর চারপাশে ঘুরে না বরং দুটি বস্তুই একটা নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরে। 

যে বস্তুর ভর তুলনামূলক ভাবে বেশি হবে, বেরিকেন্দ্র ঠিক তার কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থান করবে।
একটু পরিষ্কার করে বললে, পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ ঘুরছে, তার মানে এই নয় যে চাঁদ পৃথিবীর কেন্দ্র বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বরং চাঁদ এবং পৃথিবী উভয়েই একটা নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। চাঁদের ভর যদি পৃথিবীর তুলনায় অত্যন্ত নগন্য বা নেগলিজিবল হতো তাহলে এই বেরিসেন্টার এর অবস্থান হতো পৃথিবীর কেন্দ্রে বা কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি ।

কিন্তু চাঁদ খানিকটা ভারি হবার দরুন এই বেরিকেন্দ্র পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে খানিকটা উপরে ( কেন্দ্র থেকে ৪৬৭১ কিমি উপরে ) । তবুও পৃথিবীর ব্যাসার্ধ যেহেতু ৬৩৭৮ কিমি, সেহেতু এই বেরিকেন্দ্র পৃথিবীর ভেতরেই অবস্থান করছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এই বেরিসেন্টারকে কেন্দ্রকরে পৃথিবীও তার নিজের কক্ষ পথে ঘুরছে ।

এবার ভেবে দেখুন...
যদি চাঁদের ভর দ্বিগুণ হতো তাহলে এই বেরিসেন্টার পৃথিবীর বুকে অবস্থান করতো ?
মোটেও না !

তখন এই বেরিসেন্টার থাকতো পৃথিবীর বাইরে খোলা আকাশের কোনো একটা স্থানে।
ঠিক অনুরূপ ঘটনাই ঘটছে সূর্য এবং বৃহস্পতির ক্ষেত্রে।

এদের বেরিসেন্টার এর অবস্থান সূর্যের পরিধির বাইরে খোলা আকাশের কোনো একটা বিন্দুতে !

বৃহস্পতি ও সূর্য

এটা আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলির মাঝে ব্যতিক্রম এক ঘটনা। অন্যান্য গ্রহদের জন্য আলাদা আলাদা বেরিসেন্টার গুলির অবস্থান সূর্য্যের কেন্দ্রের খানিকটা কাছাকাছি থাকলেও গ্রহরাজা বৃহস্পতির বেলায় সেটা খাটে না, অর্থাৎ এই বেরিকেন্দ্র অনেক দূরে চলে যায় এমনকি সূর্য্যের পরিধিরও বাইরে মহাশুন্যের কোনো একটা স্থানে গিয়ে অবস্থান করে।

তাই এখন থেকে মনে রাখতে হবে বৃহস্পতি গ্রহটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না, বরং একটা খোলা বা শুন্য স্থানকে কেন্দ্র করে ঘুরছে মহাকাশে!
ব্যপারটা সত্যিই বড় অবাক করার মতোন।

আরও পড়ুনঃ
বৃহস্পতি কী দিয়ে তৈরি 
এক নজরে বৃহস্পতি 
দেখা হইল চক্ষু মেলিয়া 

লেখাটি বাংলাদেশ সায়েন্স ক্লাব এর ফেসবুক পেইজে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হল। 

সূত্রঃ
১। বিজনেস ইনসাইডার
Category: articles

শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬

মহাকর্ষ তরঙ্গ বইয়ের প্রচ্ছদ

অনলাইনে উইকিপিডিয়া জাতীয় সাইটগুলোর কল্যাণে বই পড়ার অভ্যাস কম। বাংলা বই তো আরও কম পড়া হয়। কিন্তু আব্দুল গাফফার রনি ভাইয়ের লেখা মহাকর্ষ তরঙ্গ বইটি দুই নিঃশ্বাসে (মানে এক বিরতিতে) শেষ করে বুঝলাম, না পড়লে বিশাল মিস হয়ে যেত।

শুরুর দিকে আলোচনা করেছেন, কীভাবে গ্যালিলিও এবং নিউটনদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হল প্রাথমিক মহাকর্ষ তত্ত্ব। এরপর বললেন, ম্যাক্সওয়েল সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর পরিশ্রমের ফসল তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্বের আবির্ভাবের ব্যাপারে। অতঃপর কীভাবে আইনস্টাইন আগের তত্ত্বগুলো ও নতুন পর্যবেক্ষণের মিশেলে তৈরি করে ফেললেন আপেক্ষিক তত্ত্ব। 

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে এল মহাকর্ষ তরঙ্গের ইঙ্গিত। 

কিন্তু আইনস্টাইনই সেটা বাতিল করতে চাচ্ছিলেন। পরে বুঝতে পারেন নিজের ভুল।  ১৯৭৪ সালে এই তরঙ্গের পরোক্ষ প্রমাণ হাতে এল। এ জন্যে হালস ও টেলর নোবেল পেলেন ১৯৯৩ সালে। 
কিন্তু প্রত্যক্ষ্য প্রমাণ? তাতে সফল হবার জন্যে অসদুপায় অবলম্বন করলেন জোসেফ ওয়েবার। কিন্তু কিপ থর্ন, ওয়েইস ও ড্রেভার এর প্রতিষ্ঠিত লাইগো ঠিকই ধরে ফেলল এই রহস্যময় তরঙ্গ। 

কিন্তু এত সূক্ষ্ম এই তরঙ্গ কীভাবে ধরা গেল? এটি পেয়েই বা লাভ কী? এ তরঙ্গের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবার বিগ ব্যাঙ ও মহাবিশ্বের গান শুনতে চাচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে? 
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে অবদান আছে সাত বাঙালি বিজ্ঞানীরও। এঁদের দুজন আবার বাংলাদেশি। কারা সেই মহান ব্যক্তি? জানতে হলে পড়ে ফেলুন মহাকর্ষ তরঙ্গ বইটি। 

আস্থা রাখুন, টাকা ও সময় কোনোটিই নষ্ট হবে না। 

লেখক 

বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সতেরোর বই মেলায়। তবে ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।
রকমারি ডট কম থেকেও কিনতে পারেন। 
Category: articles

বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

আমরা পৃথিবীতে বসে সূর্যের যে আলো ও উত্তাপ পাই, তা সূর্যের কেন্দ্রে পরিচালিত ফিউশন বিক্রিয়ার ফলাফল। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে ঘটে এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া।

সূর্য প্রচন্ড গরম। সত্যি অনেক অনেক গরম। এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সে তুলনায় কম। ৫৫০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের কোরের গভীর অভ্যন্তরে ফিউশন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতেই এই প্রচণ্ড তাপ ও আলো উৎপন্ন হয়। সূর্যের কোর এর কেন্দ্র থেকে ২০-২৫ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। কোরের ভেতরের চাপ পৃথিবী পৃষ্টের চাপের প্রায় ১০ লক্ষ গুণেরও বেশি। অন্য দিকে তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি কেলভিনের ওপরে। এরকম একটি পরিবেশেই ফিউশন বিক্রিয়াটি ঘটে।

আরো পড়ুনঃ
সূর্যের তাপমাত্রা কত?

এখানে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে। সেই সাথে তৈরী হচ্ছে বিপুল পরিমাণ তাপ ও শক্তি। সূর্যের ফিউশন বিক্রিয়া প্রোটন-প্রোটন (P-P) চেইন নামে পরিচিত। এই বিক্রিয়া প্রোটনের ($H^+$) মাধ্যেমে শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়ার মাধ্যেমে হিলিয়ামে পরিণত হয়।

ফিউশন বিক্রিয়ার পর্যায় তিনটি ::১. দুই জোড়া প্রোটন একীভূত হয়ে একজোড়া ডিউটেরন তৈরী করে।
২. প্রত্যেক ডিউটেরন অপর একটি প্রোটনের সাথে একীভূত হয়ে হিলিয়াম-৩ তৈরী করে।
৩. দুটি হিলিয়াম-৩ এর নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অস্থায়ী মৌল বেরিলিয়াম-৬ তৈরী করে, যা পরবর্তিতে ভেঙে গিয়ে দুটি প্রোটন ও একটি হিলিয়াম-৪ তৈরী করে।
৪. এই বিক্রিয়ায় একই সাথে দুটি নিউট্রিনো, দুটি পজিট্রন এবং গামা রশ্মি নির্গত হয়।

সূর্যের কেন্দ্রে ফিউশন প্রক্রিয়া 
উপরিউক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যেমে ফিউশন বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ ও আলোর প্রবাহ উৎপন্ন হয়।

আরও পড়ুনঃ
ল্যাপটপ চলে সূর্যের আলোয়!

সূত্রঃ
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

আপনারা আকাশে কখনও কি আলোর নৃত্য দেখেছেন? অনেকেই হয়তো ভাবছেন আতোশবাজি বা অন্যান্য জিনিসের কথা। কিন্তু প্রকৃতি যে নিজেই আলোর নৃত্য দেখায়। এরই নাম অরোরা (Aurora)। আলোর এই নাচন চোখে পড়ে সাধারণত পৃথিবীর দুটি মেরু অঞ্চলে। সুমেরু (Arctic) ও কুমেরুর (Antarctic) আকাশে। 

মেরু অঞ্চলে সৃষ্ট অরোরা 

অরোরা শব্দতি এসেছে ল্যাটিন থেকে। অর্থ Sunrise বা সূর্যোদয়। এই মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা (Polar aurora) পৃথিবীর দুই মেরুর  আকাশে ঘটে যাওয়া এক নৈসাদৃশ্য ঘটনা। উত্তরে মেরুতে ঘটলে নাম হয় সুমেরু প্রভা (Northern Lights বা Auorora Borealis),আর দক্ষিণ মেরুতে এরই নাম কুমেরু প্রভা (Southern Lights বা Aurora Australis)। 

এই অরোরা দেখতে আপ্রাকিতিক দৃশ্য বলে একে এক রহস্যময় শক্তি বলে বিবেচনা করা হত। অধিকাংশ মানুষই একে স্বর্গীয় আলো মনে করত। অনেকে আবার একে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ হতে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা মনে করত। সবুজ রঙের প্রভাকে তারা ভাবতো তাদের ভবিষ্যতের সুখের আভাস। আর এর রঙ লাল হলেই তাদের মনে হত ভবিষ্যৎ হবে দুর্যোগময়। লোহিত মেরুপ্রভাকে যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবেও দেখা হত।

অরোরা দেখতে অনেকটা অনেকগুলো সমান্তরাল আলোক রশ্মির মতো, যা একটির পর একটি করে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে তৈরি করে আলোক পর্দার মতো। প্রতি মুহূর্তে হতে থাকে স্থানান্তরিত। রাতের বেলা মনে হয় অনেকগুলো সমান্তরাল আলোক রশ্মি পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে। মূলত এই আলোক পর্দাই প্রতিনিয়ত স্তানন্তরিত হতে থাকে। আর এটা মনে হয় যেন পৃথিবীর বুকে সমুদ্রের ঢেউ খেলছে। এই অরোরা বিভিন্ন রঙের হতে পারে।


অরোরা তৈরির কারণঃ

সূর্য প্রতিনিয়তই পৃথিবীর চারদিকে বিভিন্ন চার্জিত কণা নিক্ষেপ করছে, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। সূর্যের এই চার্জিত কণার প্রবাহকেই বলে সৌরবায়ু (solar wind)। কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার হল, আমাদের পৃথিবীতে রয়েছে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র (Magnetic field) । এটি দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরুতে প্রবেশ করছে। সূর্য থেকে যখন এসব আয়নিত কণা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, তখন এরা পৃথিবীর আয়োনিত চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই তা ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু মেরু অঞ্চল যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্র একদম কম সেখানে এই আয়নিত কণাগুল প্রবেশের সুযোগ পায় এবং এ অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনকে আঘাত করে। তখন এদের পরমাণু উত্তেজিত হয় এবং কিছুক্ষণ পরেই শক্তি বিকিরন করে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আর এই বিকিরণই আমরা দৃশ্যমান আলোতে দেখতে পাই। আর এটাই হল অরোরা। 

অরোরায় আলোর নাচন 

বায়ুমণ্ডল আছে এমন কোনো গ্রহে যদি দ্রুতগতির চার্জিত কণা প্রবেশ করে তবেই মেরুপ্রভা সৃষ্টি হবে। সৌরবায়ু যেহেতু সকল গ্রহেই পৌঁছে, তাই সব গ্রহেই অরোরা বা মেরুপ্রভা সৃষ্টি হয়। তবে গ্রহভেদে এদের রুপ ভিন্ন। শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র বিশিষ্ট শনি ও বৃহস্পতি গ্রহে পৃথিবীর ন্যায়
মেরু অঞ্চলে অরোরা উৎপন্ন হয়। শুক্রের মতো গ্রহের ক্ষেত্রে যেখানে উল্লেখযোগ্য চৌম্বকক্ষেত্র নেই, সেখানে অনিয়মিত প্রভা উৎপন্ন হয়। যে সকল গ্রহের চৌম্বক অক্ষ এবং ঘূর্ণন অক্ষ এক নয়
(যেমন ইউরেনাস ও নেপচুন), সেখানে বিকৃত (Distorted) মেরুপ্রভ অঞ্চল সৃষ্টি হয়। 

আজকের ছবিঃ বৃহস্পতির অরোরা
বৃহস্পতি গ্রহে সৃষ্ট অরোরা 
Category: articles

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (Special theory of relativity) থেকে আমরা জানি, শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি (c) হল মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিবেগ। আলোর দ্রুতি (speed) বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের হয়। তবে শূন্যস্থানে আলোর সর্বোচ্চ যে দ্রুতি (সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ ৮ হাজার মাইল), একে কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় দ্রুতির সার্বজনীন সীমা। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, এর চেয়ে বেশি দ্রুতি অর্জন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কারণ, তার জন্য প্রয়োজন পড়ে অসীম পরিমাণ শক্তির। 

বিজ্ঞানীরা এই সার্বজনীন দ্রুতি সীমা c এর ভিত্তিতে মহাবিশ্বের সকল কণাকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন।

১. ব্র‍্যাডিয়ন (Bradyon):

এই ধরণের কণারা বাস্তব ভরযুক্ত ও সর্বদা দ্রুতি সীমার চেয়ে নিম্ন গতিতে চলাচল করে। এদের অপর নাম ট্যারডিয়ন (tardyons) বা ইটিয়ন (ittyons)। ইলেকট্রন, W বোসন, Z বোসন, আপ কোয়ার্ক ইত্যাদি সবই ব্র‍্যাডিয়ন শ্রেণির অন্তর্গত কণা। 

২. লুক্সন (Luxon):

এই ধরণের কণাদের নিশ্চল ভর (rest mass) শূন্য। তবে চলাচলের সময় এদের ভরবেগ সৃষ্টি হয়। এরা সর্বদা দ্রুতি সীমায় চলাচল করে। অর্থাৎ এদের বেগ আলোর বেগের সমান। গ্লুওন, ফোটন ইত্যাদি কণা হল লুক্সন কণা।


৩. ট্যাকিয়ন (tachyon): 

এই কণারা একটু অন্যরকম কণা। এরা শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির চেয়েও বেশি দ্রুতিতে চলাচল করে।  লঙ্ঘন করে আপেক্ষিক তত্ত্ব। এদের ভর হল কাল্পনিক। এখন পর্যন্ত এমন কণাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

ট্যাকিয়ন একক কোনো কণা নয়। এটা আসলে কণাদের একটা শ্রেণি। ১৯৬২ সালে কিছু বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিকভাবে দ্রুতি সীমার চেয়ে বেশি দ্রুতির কণাদের অস্তিত্বের কথা বলেন। এর নাম দেয়া হয় 'মেটা-পার্টিকেল'। তারপর জেরাল্ড ফাইনবার্গ প্রথম দেখান যে, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব দিয়ে দেখানো যায়, ট্যাকিয়নিক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আছে। এইসব ট্যাকিয়নিক ক্ষেত্রের সকল কণাই c এর চেয়ে বেশি দ্রুতিসম্পন্ন। এরপর থেকে এই জাতীয় কণা নিয়ে গবেষণা শুরু হয় এবং বেরিয়ে পড়তে থাকে এই ধরণের কণার মজার মজার বৈশিষ্ট্যগুলি। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে কোনো কণার দ্রুতি যত বাড়ে তার ভরও তত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুতি বাড়তে বাড়তে যখন দ্রুতি সীমায় চলে যায় তখন কণার ভর অসীম হয়ে যায়। তাই, দ্রুতি সীমা অতিক্রম করা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু, ট্যাকিয়ন শ্রেণির কণারা এইসব নিয়মের তোয়াক্কা করেনা। ট্যাকিয়ন কণার দ্রুতি বাড়লে ভর কমে আসে, আবার দ্রুতি কমলে ভর বাড়ে। ট্যাকিয়নের দ্রুতি সর্বদাই দ্রুতি সীমার উপরে থাকবে। ইচ্ছা করলেও ট্যাকিয়ন কণারা c এর চেয়ে কম দ্রুতিতে চলাচল করতে পারে না। কারণ, তাহলে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে। ট্যাকিয়ন কণাদের আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হল এদের দেখতে পাওয়া-না পাওয়া। কেননা আমরা যেহেতু আলোর সাহায্যে দেখি, আবার ট্যাকিয়ন কণারা আলোর চেয়েও বেশি দ্রুতিতে চলে, তাই আমরা ট্যাকিয়ন কণা দেখতে পাব না। সর্বদা কণাটি চলে যাবার পর শুধুমাত্র কণাটির পদচিহ্ন হিসেবে দুইটি তরঙ্গ দেখতে পাব। এই তরঙ্গের নাম হল চেরেনকভ তরঙ্গ।

পারমাণবিক চুল্লীতে দ্রুতবেগে গতিশীল নিউট্রনের কারণে সৃষ্ট চেরেনকভ নীল বিকিরণ

ট্যাকিয়ন কণারা কি তাহলে শুধুই কাল্পনিক? না, এরা পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। হিগস-বোসন কণা যেমন ২০১২ সাল পর্যন্ত কাল্পনিক ছিল, তারপর পর্যবেক্ষণ করা গেছে। তেমনি  বিজ্ঞানীদের দাবি করেন, এক্সোপ্ল্যানেট তথা বাইরের গ্রহগুলোতে ট্যাকিয়ন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা অনেক। পৃথিবীতে চেরেনকভ বিকিরণ দেখা গেলেও ট্যাকিয়নিক কোনো কণার সাথে এর সম্পর্ক নেই। এটা তৈরি করা খুবই সহজ। কোনো চার্জিত কণাকে ত্বরক যন্ত্রে নিয়ে আলোর অনেক কাছাকাছি দ্রুতি দেয়া সম্ভব হয়। আবার, মাধ্যম পরিবর্তন করে তথা পানি বা কাঁচ মাধ্যমে আলোর দ্রুতিও কমে যায়। ফলে ওই মাধ্যমে চার্জিত কণা মাধ্যমের আলোর দ্রুতির থেকেও বেশি দ্রুতিতে চলাচল করতে পারে। তখন কণাটির রেখে যাওয়া পদচিহ্ন হিসেবে নীল তরঙ্গ দেখা যায়। এই ঘটনাকে বলে চেরেনকভ বিকিরণ।

ট্যাকিয়ন কণা চলে যাবার পর গতিপথে দেখতে পাওয়া দুইটি তরঙ্গ

একসময় মনে করা হত নিউট্রিনো ও টাউ কণা বোধহয় ট্যাকিয়ন শ্রেণির কণা। পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এই ধরণের কণা আবিস্কার করা সম্ভব হলে পৃথিবীর জীবনমানের গতি একদিনেই শতভাগ বেড়ে যাবে বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে যেহেতু কণাটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বর মত প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত একটি তত্ত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তাই অনেক বিজ্ঞানীই এই কণাকে নিছক উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়। তবে ট্যাকিয়ন কণিকা নিছকই কল্পনা নাকি অত্যাধিক উন্নতমানের বিজ্ঞান, তা জানার জন্য আমাদের আরো অনেক বছরই অপেক্ষা করা লাগবে।

** তথ্যের অসঙ্গতি দূর করে পোস্টটি সংশোধন করতে সাহায্য করার জন্য Deepayan Turja ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা। 
Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...