Advertisement

বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৭

কাল দীর্ঘায়নে মহাকর্ষের কারসাজি


পৃথিবীর পৃষ্ঠে বসিয়ে রাখা একটি রকেট নিয়ে চিন্তা করতে করতেই কাল দীর্ঘায়নে মহাকর্ষের প্রভাব বুঝে ফেলা যায়। আমরা একটু পরেই তা করব। তবে তার আগে কিছু কথা বলে রাখা জরুরী।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, স্থান ও কাল দুটোই পরম। কোনো ঘটনা কোথায় এবং কখন ঘটেছে সে সম্পর্কে সকল পর্যবেক্ষক একমত হবেন। নিউটন এসে পরম স্থানের ধারণাকে বিদায় জানিয়ে দেন। আইনস্টাইন বিদায় দেন পরম সময়কেও। তবে পরম সময়ের কফিনে মাত্র একটি পেরেক ঠুকে তাঁর মন ভরেনি। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, আলোর কাছাকাছি বেগে গতিশীল অভিযাত্রীর সময় চলবে তুলনামূলক অনেক ধীরে। ১৯১৫ সালের প্রকাশ করেন আরো যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব। এটাই হল মহাকর্ষের সর্বাধুনিক তত্ত্ব। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব (General theory of relativity)। দেখালেন, কাল দীর্ঘায়ন ঘটায় মহাকর্ষও।

অবশ্য উচ্চ গতির মতো মহাকর্ষও যে কাল দীর্ঘায়ন ঘটাতে সিদ্ধহস্ত সেটা তিনি ১৯০৭ সালে লেখা ও ১৯০৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধেই অনুমান করেন।

দুই আপেক্ষিক তত্ত্বেই একটি করে মৌলিক নীতি মেনে চলা হয়। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে সেটি হল আপেক্ষিকতার মৌলিক স্বীকার্য। এর বক্তব্য হল,
মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের কাছে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকবে, বেগ যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। 
এখানে ত্বরণ সম্পর্কে কিছু বলা হয় না। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক নীতিটি হল,  সমতুল্যতার নীতি (Principle of equivalence)। এই নীতির বক্তব্য হল,
যথেষ্ট ক্ষুদ্র স্থানের অঞ্চলে অবস্থান করে এটা বলা সম্ভব নয় যে আপনি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থিরাবস্থায় আছেন, নাকি শূন্য স্থানে সুষম হারের ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) নিয়ে চলছেন।
এই গুরুগম্ভীর কথা বুঝতে অসুবিধা হলে সমস্যা নেই। বরং চলুন একটি উদাহরণ দেখি।

মনে করুন, আপনি মহাশূন্যের মধ্যে এমন একটি লিফটে আছেন, যেখান মহাকর্ষ অনুপস্থিত। ফলে এখানে উপর বা বা নিচ বলতে কিছু নেই। আপনি মুক্তভাবে ভেসে আছেন। একটু পর লিফটখানা সমত্বরণে চলা শুরু করল। এখন কিন্তু হঠাৎ করে আপনি ওজোন অনুভব করবেন। আপনি লিফটের এক প্রান্তের দিকে একটি টান অনুভব করবেন। এখন এ দিকটিকেই আপনার কাছে মেঝে মনে হবে! আপনি এখন হাত থেকে একটি আপেল ছেড়ে দিলে এটি মেঝের দিকে চলে যাবে। আসলে এখন আপনার মতোই লিফটের ভেতরের সব কিছুর ত্বরণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আসলে লিফটটা মোটেই গতিশীল নয়, বরং এটি একটি সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থির অবস্থায় আছে।

আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, ট্রেনের ভেতরে বসে যেমন আপনি বলতে পারেন না যে আপনি সম বেগে চলছেন কি না, তেমনি লিফটের ভেতরে বসেও আপনি বুঝতে পারবেন না, আসলে আপনি সুষম ত্বরণে চলছেন, নাকি কোনো সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আছেন। আইনস্টাইনের এই চিন্তার ফলাফলই হল সমতুল্যতার নীতি।

সমতুল্যতার নীতি এবং এর ওপরের উদাহরণটি সত্য হলে বস্তুর জড় ভর (Inertial mass) ও মহাকর্ষীয় ভরকে (Gravitational mass) অবশ্যই একই জিনিস হতে হবে। বল প্রয়োগের ফলে কতটুকু ত্বরণ হবে তা নির্ভর করে জড় ভরের ওপর। এই ভর নিয়েই কথাই বলা হয়েছে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রে। আর অন্য দিকে মহাকর্ষীয় ভরের কথা আছে নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রে। আপনি কতটুকু মহাকর্ষীয় বল অনুভব করবেন তা নির্ভর করে এই ভরের ওপর।

আমরা সমতুল্যতার নীতি জানলাম। আইনস্টাইনের যুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবার একটি থট এক্সপেরিমেন্ট (যে পরীক্ষা বাস্তবে করা যায় না, চিন্তা করে করে বুঝতে হয়) করতে হবে। এটা আমাদেরকে দেখাবে মহাকর্ষ সময়কে কীভাবে প্রভাবিত করে।

মহাশূন্যে অবস্থিত একটি রকেটের কথা চিন্তা করুন। চিন্তার সুবিধার জন্যে মনে করুন রকেটটি এত বড় যে এর শীর্ষ থেকে তলায় আলো পৌঁছতে এক সেকেন্ড লাগে। অর্থ্যাৎ এর দৈর্ঘ্য ১, ৮৬,০০০ মাইল। আরও মনে করুন, রকেটের সিলিং ও মেঝেতে একজন করে দর্শক আছেন। দুজনের কাছেই অবিকল একই রকম একটি করে ঘড়ি আছে যা প্রতি সেকন্ডে একটি করে টিক দেয়।

মনে করুন সিলিং এর দর্শক ঘড়ির টিকের অপেক্ষায় আছেন। টিক পেয়েই তিনি মেঝের দর্শকের দিকে একটি আলোক সঙ্কেত পাঠালেন। পরে ঘড়িটি আবারও টিক (সেকেন্ডের কাঁটায়) দিলে তিনি আরেকটি সঙ্কেত পাঠালেন। এ অবস্থায় প্রতিটি সঙ্কেত এক সেকেন্ড পর মেঝের দর্শকের কাছে পৌঁছায়। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত দুটি পাবেন।

মহাশূন্যে মুক্তভাবে ভেসে না চলে রকেটখানা যদি পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানের মধ্যে থাকত তাহলে কী ঘটত? নিউটনীয় থিওরি অনুসারে এই ঘটনায় মহাকর্ষের কোনো হাত নেই। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকেন্ডের মধ্যেই তা পাবেন। কিন্তু সমতুল্যতার নীতি ভিন্ন কথা বলে। চলুন দেখা যাক, নীতিটি কাজে লাগিয়ে আমরা মহাকর্ষের বদলে সুষম ত্বরণ নিয়ে চিন্তা করে কী পাই। নিজের মহাকর্ষ থিওরি তৈরি করতে আইনস্টাইন সমতুল্যতা নীতিকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন এটা হল তার একটি উদাহরণ।

তো, এখন তাহলে মনে করুন রকেটটি ত্বরণ নিয়ে চলছে (অর্থ্যাৎ, প্রতি মুহূর্তে এর বেগ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা আপাতত ধরে নিচ্ছি এর ত্বরণের মান ক্ষুদ্র, না হলে আবার এটি আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে!)। রকেটটি উপরের দিকে গতিশীল বলে প্রথম সঙ্কেতটিকে আগের চেয়ে (যখন রকেট স্থির ছিল) কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। কাজেই সঙ্কেতটি এখন এক সেকেন্ড পার হবার আগেই পৌঁছে যাবে তলায়।

রকেটটি যদি নির্দিষ্ট বেগে (ত্বরণহীন) চলত, তাহলে আগে-পরের সব সঙ্কেত এক সেকেন্ড পরপরই পৌঁছত। কিন্তু এখানে ত্বরণ আছে বলে প্রথমে যখন সঙ্কেত পাঠানো হয়েছিল, রকেট এখন তার চেয়ে দ্রুত চলছে। কাজেই দ্বিতীয় সঙ্কেতকে আরও কম দূরত্ব পার হতে হবে। ফলে এটি পৌঁছতেও আরও কম সময় লাগবে। কাজেই মেঝের দর্শক দুই সঙ্কেতের মাঝে সময় ব্যবধান পাবেন এক সেকেন্ডের চেয়ে কম। অথচ সিলিং এর দর্শক তা পাঠিয়েছেন ঠিক এক সেকেন্ড পরে। হয়ে গেল সময়ের গরমিল।

ত্বরণপ্রাপ্ত রকেটের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটা নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, সমতুল্যতার নীতি বলছে, রকেটটি যদি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রেও স্থির থাকে তবু একই ঘটনা ঘটবে। অর্থ্যাৎ, রকেটটি যদি ত্বরণপ্রাপ্ত নাও হয় (যেমন ধরুন এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে উৎক্ষেপণের জন্যে বসিয়ে রাখা আছে) তাহলেও সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ড পর দুটো সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শক তা পাবেন এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই। এবার অদ্ভুৎ লাগছে, তাই না!

হয়ত মাথায় প্রশ্ন আসবে, এর অর্থ তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে- মহাকর্ষ কি সময়কে বিকৃত করছে, নাকি ঘড়িকে অচল করে দিচ্ছে? ধরুন, মেঝের দর্শক উপরে উঠে সিলিং এর দর্শকের সাথে ঘড়ি মিলিয়ে নিলেন। দেখা গেল, দুটো ঘড়ি অবিকল একই রকম। তারা এও নিশ্চিত যে দুজনে এক সেকেন্ড বলতে সমান পরিমাণ সময়কেই বোঝেন। মেঝের দর্শকের ঘড়িতে কোনো ঝামেলা নেই। এটি যেখানেই থাকুক, তা তার স্থানীয় সময়ের প্রবাহ-ই মাপবে।

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের বলছে, ভিন্ন বেগে চলা দর্শকের জন্যে সময় ভিন্ন গতিতে চলে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে, একই মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের গতি আলাদা। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মেঝের দর্শক এক সেকেন্ডের চেয়ে কম সময় পেয়েছেন, কারণ পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছে সময় অপেক্ষাকৃত ধীরে চলে। মহাকর্ষ ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে এই প্রভাবও হবে বেশি। নিউটনের গতি সূত্রের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছিল পরম স্থানের ধারণা। এবার আপেক্ষিক তত্ত্ব পরম সময়কেও বিদায় জানিয়ে দিল।

কাল দীর্ঘায়ন। পাহাড়ের ঘড়ি দ্রুত চলে। 

১৯৬২ সালে এই অনুমান পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। একটি ওয়াটার টাওয়ারের উপরে ও নিচে দুটি অতি সূক্ষ্ম ঘড়ি বসানো হয়। দেখা গেল নিচের ঘড়িটিতে (যেটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের বেশি কাছে আছে) সময় ধীরে চলছে, ঠিক সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব যেমনটি অনুমান করেছিল তেমনই। এই প্রভাব খুব ক্ষুদ্র। সূর্যের পৃষ্ঠে রাখা কোনো ঘড়িও পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় মাত্র এক মিনিট পার্থক্য দেখাবে। কিন্তু পৃথিবীর ওপরের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের এই ক্ষুদ্র পার্থক্যই বর্তমানে বাস্তব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্যাটেলাইট থেকে আসা সঙ্কেতের মাধ্যমে আমাদের ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে ঠিক রাখার জন্যে এর প্রয়োজন হয়। এই প্রভাব উপেক্ষা করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অবস্থান বের করলে ভুল হয়ে যাবে কয়েক মাইল!

সময়ের প্রবাহের পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের শরীরেও। এমন এক জোড়া যমজের কথা চিন্তা করুন, যাদের একজন বাস করছে পাহাড়ের চূড়ায় এবং আরেকজন সমুদ্র সমতলে। প্রথম জনের বয়স অপরজনের চেয়ে দ্রুত বাড়বে। দুজনে আবার দেখা করলে দেখা যাবে একজনের বয়স আরেকজনের চেয়ে বেশি। এই ক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য খুব ক্ষুদ্র হবে হবে। তবে এদের একজন যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে মহাকাশযানে করে দীর্ঘ ভ্রমণ করে ফিরে আসে তাহলে দেখা যাবে যমজের চেয়ে তার বয়স অনেক বেশি পরিমাণে কম হচ্ছে।

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে পৃথিবী থেকে দূরে গিয়ে অনেক বেশি বেগে ভ্রমণ করে এলে আপনার বয়স অপেক্ষাকৃত কম হবে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দূরে অবস্থান করলে বয়স দ্রুত বাড়বে। একটি প্রভাব আপাত দৃষ্টিতে আরেকটি থেকে উল্টোভাবে কাজ করে। অবশ্য বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব কার্যকর হবার জন্যে আপনাকে রকেটে চড়ে মহাশূন্যেই যেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনি যদি পৃথিবীতেই একটি (অ)সম্ভব দ্রুতগামী ট্রেনে চড়েও ভ্রমণ করেন তবু ট্রেনের বাইরে থাকা আপনার বন্ধুর চেয়ে আপনার বয়স কম হবে।
কাল দীর্ঘায়ন। পাহাড়ের তুলনায় ভূমির সময় চলে ধীরে। 

 একে বলা হয় টুইন প্যারাডক্স। তবে মাথার মধ্যে পরম সময়ের ধারণাকে স্থান দিলে তবেই একে প্যারাডক্স (পরস্পর বিরোধী বা আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা) মনে হবে। আপেক্ষিক তত্ত্বে একক পরম সময় বলতে কিছু নেই। বরং প্রত্যেক দর্শক তার নিজের মতো করে সময় মাপেন। এটা মেনে নিলেই আর কোনো প্যারাডক্স থাকে না।

সূত্রঃ
স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লোদিনোর লেখা ও লেখকের অনূদিত প্রকাশিতব্য বই অ্যা ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম অবলম্বনে। বইটি এ বই মেলায় প্রকাশিত হচ্ছে। পড়তে পারছেন অনলাইনেও। 


Advertisement 02

আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ

লেখকের পরিচয়

আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ। প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, সিলেট ক্যাডেট কলেজ। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত বই পাঁচটি | সব লেখা | ফেসবুক | পারসোনাল ওয়েবসাইট

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...