Advertisement

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আরেকটু গভীরে

আগের পর্বের লিঙ্কঃ ১ম পর্ব, ২য় পর্ব

আমাদের মহাবিশ্বে মোট ৪টি মৌলিক বল ক্রিয়াশীল রয়েছে। সবল নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তড়িচ্চুম্বকীয় বল ও মহাকর্ষীয় বল। এসব বলের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পাল্লা ও ভিন্ন ভিন্ন শক্তি। এই বলগুলোর মাঝে মহাকর্ষীয় বলের পাল্লা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও এটি সবচেয়ে দুর্বল বল। তড়িচ্চুম্বকীয় বলের পাল্লাও অসীমতক, কিন্তু এটি মহাকর্ষের তুলনায় কয়েকগুণ শক্তিশালী বল। সবল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলের পাল্লা অতি ক্ষুদ্র, এরা অতি-পারমাণবিক জগতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

নামে উলটা হলেও দুর্বল নিওক্লিয় বল মহাকর্ষের চেয়ে অনেকগুণ শক্তিশালী। অবশ্য বাকী দুই বলের চেয়ে সে ঠিকই দুর্বল। সবল নিউক্লিয় বল ৪টি বলের মাঝে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী বল। সমস্যা হল  এই বল কার্যকর থাকে নিউক্লিয়াসের ভেতরেই। এর চেয়ে বেশি পাল্লায় এই বল কার্যকর থাকে না।

বলবাহক কণিকাঃ

বিভিন্ন ধরনের বোসন কণা

৪টি মৌলিক বলের মাঝে ৩টি মৌলিক বলেরই উৎপত্তি হয় বলবাহক কণিকাদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বলবাহক কণিকাদের গ্রুপকে বলা হয় 'বোসন' গ্রুপ। বোসন নামটি উপমহাদেশীয় বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এর নামানুসারেই এসেছে। ফার্মিয়ন কণিকাগুলি শক্তির বিচ্ছিন্ন পরিবহন ঘটায় নিজেদের মাঝে বোসন কণিকাদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। 

প্রতিটা মৌলিক বলের সাথেই একটা সম্পর্কযুক্ত বোসন কণিকা রয়েছে। যেমন, সবল নিউক্লিয় বলের বাহক হল গ্লুওন (g) ও মেসন শ্রেণির বোসন কণিকা, তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক হল ফোটন এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য দায়ী হল ডব্লিউ বোসন ((W+, W-) ও জেড বোসন ((Z)। মহাকর্ষীয় বলের জন্য দায়ী কোনো কণিকা তথা মহাকর্ষ বলের বাহক এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মহাকর্ষ বলের বাহক হল গ্র‍্যাভিটন (G) নামক অনুকল্পিত কণিকা। 
চিত্রঃ মৌলিক বল

স্ট্যান্ডার্ড মডেল তড়িচ্চুম্বকীয় বল, দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বল এবং এই বল তিনটির বাহক কণিকাগুলোকে একই নিয়মের অধীনে আবদ্ধ করেছে। সাথে সাথে এটাও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে যে, কেমন করে এই বলগুলি ফার্মিয়নদের উপর প্রতিক্রিয়া করে। যাই হোক, আসল কথা হল আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবচেয়ে বেশি পরিচিত বল মহাকর্ষীয় বল, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভূক্ত নয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দ্বারা মহাকর্ষীয় বল ব্যাখ্যা করা এবং এই মডেলের মাঝে মহাকর্ষীয় বলের বাহকের স্থান করে দেয়াটা বিজ্ঞানীদের নিকট একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আণবিক জগতের পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য  উৎপত্তি হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের। আবার, বৃহৎ বস্তুর পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, এই দুইটি তত্ত্ব একইসাথে ব্যবহারযোগ্য নয়। এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আলোকে এই দুই তত্ত্বকে গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখাতে পারেননি। কিন্তু কণা পদার্থবিদ্যার জন্য এটা তেমন বড় কোনো সমস্যা নয়। কেননা, যখন মহাকর্ষকে কণিকাদের ক্ষুদ্র জগতে বিবেচনা করা হয়, তখন মহাকর্ষীয় প্রভাব এত ক্ষুদ্র হয় যে তা বর্জনযোগ্য। অনেক ফার্মিয়ন মিলে যখন চেয়ার- টেবিল বা মানবদেহ কিংবা গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বড় বড় বস্তু তৈরি করে তখনই মহাকর্ষ অনুভূত হয়। তাই, মহাকর্ষীয় বলের মতো একটা মৌলিক বলকে হিসেবের বাইরে রেখেও বাকি সব ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড মডেল দারুণভাবে কাজ করে।

বলবাহক কণিকা কীভাবে বল বহন করেঃ

কল্পনা করুন, একটা মাঠে দুই বন্ধু বল ছোড়াছুড়ি খেলছে। তারা খুব একটা জোরে বল ছুড়তে পারে না, আবার বলকে মাটিতে পড়তেও দিতে চায় না। তাহলে নিশ্চয় তাদেরকে অতি কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে এবং বল ছোড়াছুড়ি নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে। তারা এই শর্ত মেনে ইচ্ছা করলেই দূরে যেতে পারবে না। কারণ, তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়ে গেলে তারা বলটা আর ধরতে পারবে না। তাই তাদেরকে কাছাকাছিই থাকতে হবে।

ফার্মিয়ন কণিকারাও এইরকম কিছু বোসন কণিকার বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি করে বলে নিজেরা আলাদা হতে পারে না, একত্রে থাকে। আলাদা ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ফার্মিয়নের জন্য আলাদা আলাদা বোসন কণিকা রয়েছে। যেমন, পরমাণুর প্রোটন ও নিউট্রনের কোয়ার্কেরা পরস্পরের মাঝে পাই মেসন বা পাইওন নামের একজাতীয় বোসন কণিকা ছোড়াছুড়ি করে অর্থাৎ এইক্ষেত্রে সবল নিউক্লিউ বলের জন্য এই পাই মেসন দায়ী। এইরকম প্রোটনের মাঝে কোয়ার্কেরা পরস্পর গ্লুওন নামক বোসন কণিকা আদান প্রদান করতেই থাকে বলে তারা একত্রে থাকে।

কোন কণিকার সাথে কোন কণিকা মিথস্ক্রিয়া করে তা জানতে নিচের ছবিটি সহায়ক হবে।
চিত্রঃ বিভিন্ন বল ও কণার সম্পর্ক 


বোসনঃ

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বোসন শ্রেণির কণিকারা পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে না। অর্থাৎ একই কোয়ান্টাম অবস্থায় এদের অসীম সংখ্যক কণিকা অবস্থান করতে পারে, যেখানে ফার্মিয়নরা একই কোয়ান্টাম অবস্থায় মাত্র একটা কণিকাই অবস্থান করতে পারে। বোসন কণিকাদের এই বৈশিষ্ট্য বলা হয় বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই কণিকাদের স্পিন সংখ্যা অবশ্যই পূর্ণ সংখ্যা হবে, ফার্মিয়নদের মত অপূর্ণ নয়। তবে দুইটি অর্ধপূর্ণ স্পিনবিশিষ্ট ফার্মিয়ন মিলে একটা পূর্ণ স্পিনবিশিষ্ট বোসন হতে পারে। যেমন: মেসন একপ্রকার বোসন। অতি-পরিবাহীতা, অতি-প্রবাহীতা ইত্যাদি বোসন কণিকার বৈশিষ্ট্য।

বোসন কণিকার গুরত্ব অনেক। কেননা, বোসন কণিকা না থাকলে ফার্মিয়নরা একত্র হতে পারত না। আবার আলোর জন্য দায়ী কণিকা ফোটনও একপ্রকার বোসন। যদি ফোটন না থাকত, তবে প্রাণিজগতকে দৃষ্টিশক্তির জন্য অন্য কোনো বোসন সংবেদী চোখ ব্যবহার করতে হত, যেটা তুলনামূলক জটিল হত। কসমোলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই কণিকা শ্রেণিরই অন্তর্ভূক্ত কণিকা হল কল্পিত গ্র‍্যাভিটন কণিকা। মহাকর্ষকে অন্য সব বলের সাথে একীভূত করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল থিওরি অব এভরিথিং এর দাবিদার হতে চাইলে ২ স্পিন বিশিষ্ট, চার্জহীন এই বোসন খুঁজে পাওয়া এখন সময়ের দাবি। তাই, বোসন কণিকাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্যতম একটা সৌন্দর্য বলে আখ্যায়িত করাই যায়।


Advertisement 02

Unknown

লেখকের পরিচয়

আব্দুল মুহাইমিন মঈন। পড়াশোনা নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি দিচ্ছেন ২০১৭ সালে।
কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ভক্ত।
লেখকের সব লেখা এখানে। ফেসবুকে লেখকঃ Abdul Muhaymin Moin

1 comments:

Write comments
Unknown
AUTHOR
১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ এ ১০:২৬ PM delete

Moin, I expect your response to my knock in a social media(Facebook), we can have some conversation regarding quantum physics.
Thank you, see u there.

Reply
avatar

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...