Advertisement

মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটু গভীরে

এর আগে আমরা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রাথমিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তত্ত্বটি আসলে এতটা ব্যাপক যে অতটুকু জেনে জ্ঞানপিপাসু মন তৃপ্ত হয় না। সে জন্যেই এই লেখা।

ইয়াং- মিলস ফিল্ড হল এমন একটি ফিল্ড যার আলোকে দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বল এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বলের ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এই ফিল্ডের আলোকে এ পর্যন্ত জ্ঞাত সকল অতি-পারমাণবিক কণিকাদের আচরণও বর্ণনা করা যায়। শুধু কি তাই? ইয়াং- মিলস ফিল্ড তথা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিপূর্ণতার জন্য বিজ্ঞানীরা একের পর এক বিভিন্ন কণা কল্পনা করে যাচ্ছেন আর পরবর্তীতে তা পেয়েও যাচ্ছেন, যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে প্রতিনিয়তিই যোগ হয়ে যাচ্ছে। সদ্য যোগ হওয়া হিগস-বোসন (২০১২), টপ কোয়ার্ক(১৯৯৫), টাউ নিউট্রিনো(২০০০) ইত্যাদি কণিকাগুলো সবই একসময় হাইপোথেটিক্যাল বা অনুমিত কণিকা ছিল।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই কণিকাগুলোর অস্তিত্বের কথা ধারণা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কোলাইডারে এইসব কণিকা খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের হাইপোথেটিক্যাল জীবন শেষ হয়ে তারা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কণিকা হিসেবে মর্যাদা পায়। এখন পর্যন্ত হাইপোথেটিক্যাল অবস্থায় থাকা গ্র্যাভিটন কণা (মহাকর্ষের জন্যে প্রস্তাবিত কণা) যদি চিহ্নিত করা যায় বা পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে তা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পূর্ণতা পাবার দিকে বিশাল একটা পদক্ষেপ ফেলবে। কারণ গ্র্যাভিটন কণা অস্তিত্বশীল হলে ৪টি মৌলিক বলকে একীভূত করা হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।


স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মৌলিক কণিকাঃ

দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বল এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বল তিনটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াং- মিলস ফিল্ড থেকে কিছু কণার উদ্ভব হয়। মূলত এদের কণা না বলে কোয়ান্টাম ফিল্ডে একটি একক কোয়ান্টা বলাই অধিক ভাল। তারপরেও আমরা বলার সুবিধার্থে এগুলোকে কণা বলব।

ফার্মিয়নঃ 

আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবই কিছু মৌলিক কণিকা দ্বারা তৈরি। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে সকল পদার্থ ও শক্তি ব্যাখ্যার জন্য মোট ৬১ টি মৌলিক কণিকা এবং প্রতি-কণিকার কথা বলা হয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক কণিকার জন্য একবার কণা- পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মিতো বলেই ফেলেছিলেন যে,
স্ট্যান্ডার্ড মডেল যতগুলি কণিকার ভবিষ্যদ্বাণী করছে আর যতগুলি কণিকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তাদের সবার নাম মনে রাখতে পারলে তো আমি একজন উদ্ভিদিবিজ্ঞানী হয়ে যাব!!

এই মৌলিক কণিকাগুলোর মাঝে কিছু কিছু কণিকা আছে যারা পদার্থ তথা পরমাণু গঠন করে। আবার কিছু কিছু কণিকা আছে যারা নিজেরা পরস্পর অথবা অন্য কণিকার সাথে মিথষ্ক্রিয়া (interaction) করে বিভিন্ন বলের সৃষ্টি করে। মোটা দাগে যদি বিভাজন করা হয় তবে, গঠনগত মৌলিক কণিকাগুলোকে বলা হয় ফার্মিয়ন এবং বলবাহক কণিকাগুলোকে বলা হয় বোসন।  মৌলিক কণিকার প্রথম গ্রুপকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বলা হয় ফার্মিয়ন। এদের নামকরণ করা হয়েছে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামের সম্মানার্থে। বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং পল ডিরাক কণিকাদের কোয়ান্টাম অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য একটা সংখ্যায়ন দেন, যা ডিরাক-ফার্মি সংখ্যায়ন নামে পরিচিত। ফার্মিয়নরা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে। এরা পাউলির বর্জন নীতিও মেনে চলে। সাধারণভাবে ফার্মিয়ন সাধারণত দুইটি ভাগে বিভক্ত, যাদের বলা হয় কোয়ার্ক এবং লেপটন।

কোয়ার্কঃ

এদের প্রতিটা ভাগে আবার ৬ টি মৌলিক কণিকা আছে যারা জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হয়েছে, বা একই জেনারেশনে আবির্ভূত হয়েছে বলা হয়। এই "জেনারেশন"-এর সাথে কিন্তু বাংলা "প্রজন্ম"-এর তেমন কোনো মিল নেই। মূলত, সবচেয়ে হালকা এবং স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে প্রথম জেনারেশনে, যেখানে তার চেয়ে ভারী এবং কম স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় জেনারেশনে এবং সবচেয়ে ভারী এবং সর্বনিম্ন স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে তৃতীয় জেনারেশনে। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, কোয়ার্ক আর লেপটনকে তিনটি জেনারেশনে জোড়ায় জোড়ায় ভাগ করা হয়েছে।

তিন জেনারেশনে তাই মোট ৩ জোড়া কোয়ার্ক রয়েছে। প্রথম জেনারেশনে আছে 'আপ (u) কোয়ার্ক ও ডাউন (d) কোয়ার্ক, দ্বিতীয় জেনারেশনে আছে চার্ম (c) কোয়ার্ক ও স্ট্রেঞ্জ(s) কোয়ার্ক এবং তৃতীয় জেনারেশনে আছে টপ(t) কোয়ার্ক ও বটম(b) কোয়ার্ক। বটম কোয়ার্ককে অনেকে বিউটি কোয়ার্ক বলেও ডেকে থাকেন। আর টপ কোয়ার্ককে অনেকে ট্রুথ কোয়ার্ক বলেও ডেকে থাকেন। এই ৬টি কোয়ার্কের আবার ৩টি ভিন্ন ভিন কালার চার্জ আছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক কোয়ার্ক সংখ্যা হল ১৮ টি। প্রতিটি কোয়ার্কের প্রতি- কণিকা (anti- particle) বিদ্যমান বলে কোয়ার্ক ও প্রতি- কোয়ার্কের সংখ্যা সর্বমোট হল ৩৬।
নিউট্রনের অভ্যন্তরে চলা মিথষ্ক্রিয়া। গতিশীল বৃত্ত দ্বারা গ্লুওনকে বোঝানো হয়েছে। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকে কালার চার্জ, আর বাইরের দিকে থাকে অ্যান্টি- কালার চার্জ। চিত্রঃ উইকিপিডিয়া। 


কালার চার্জ হল চার্জের মতোই কণিকাদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম। কালারচার্জ ও চার্জ ছাড়াও কণিকাদের ফ্লেভার, স্ট্র্যাঞ্জনেস ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম আছে। কোয়ার্কের ধর্মই হল এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে বস্তু গঠন করা যাতে মোট কালার চার্জ শূণ্য হয়। কোয়ার্কের চার্জ বিদ্যমান বলে কোয়ার্ক তড়িচ্চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়।

লেপটনঃ 

লেপটনগুলোও কোয়ার্কের মতো ৩টি জেনারেশনে বিভক্ত। ইলেকট্রন (e) ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন (μ) ও মিউওন নিউট্রিনো এবং টাউ(τ) ও টাউ নিউট্রিনো । ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার প্রত্যেকের আধান, ভর এবং আকার আছে। অন্যদিকে নিউট্রিনোগুলোর কারোরই আধান নেই, কিন্তু অতি সূক্ষ্ম ভর রয়েছে। এক সময় মনে করা হত নিউট্রিনোগুলোর কারোরই ভর নেই, কিন্তু আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড ও তাকাকি কাজিতা নামের দুইজন বিজ্ঞানী নিউট্রিনোর স্পন্দনের মাধ্যমে দেখান যে নিউট্রিনোর অতি সূক্ষ্ম ভর আছে। এজন্য তারা ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

লেপটনগুলো কোয়ার্কের মতোই ফার্মিয়ন শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। তবে কোয়ার্কের কালার চার্জ থাকলেও কোনো লেপটনের কালার চার্জ নাই এবং মাত্র ৩টি লেপটনের বৈদ্যুতিক চার্জ রয়েছে। যেহেতু ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার চার্জ আছে, তাই এরা তড়িচ্চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়। কিন্তু, নিউট্রিনোর চার্জ নেই বলে এরা শুধুমাত্র দুর্বল নিউক্লীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়। ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার প্রতি- কণিকা থাকলেও বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর প্রতি- কণিকা আছে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান। ঠিক সন্দিহান বলা যাবে না, প্রতি- কণিকা যে আছে সেটা পল ডিরাক নিশ্চিত করে গেছেন। সমস্যা হল নিউট্রিনোর প্রতি-কণিকা নিউট্রিনো কি নিজেই? না অ্যান্টি- নিউট্রিনো বলে ভিন্নধর্মী কিছু একটা আছে? এখানেই বিজ্ঞানীদের সমস্যা। তাই কেউ কেউ বলেন মৌলিক কণিকার সংখ্যা ৫৮টি, আবার অনেকের মতে তা ৬১টি। যদি ৬১টি ধরা হয় তবে, লেপটনের সংখ্যা হয় ১২ টি। অর্থ্যাৎ, ৬ টি লেপটন, আর ৬টি প্রতি- লেপটন।

মোট ৩৬টি কোয়ার্ক এবং ১২টি লেপটন নিয়ে ফার্মিয়ন শ্রেণি গঠিত। ফার্মিয়ন শ্রেণির কণিকাগুলো সকল পদার্থের গঠনের জন্য দায়ী। পদার্থের গঠনগত একক পরমাণুর কেন্দ্রের প্রোটন, নিউট্রন কোয়ার্ক দ্বারাই গঠিত, যা ফার্মিয়ন শ্রেণিভুক্ত। পরমাণুর ইলেকট্রনও ফার্মিয়ন শ্রেণির কণিকা। পরমাণুতে অস্থায়ীভাবে উৎপন্ন বিভিন্ন কণিকাগুলোও কোয়ার্ক ও প্রতি-কোয়ার্কের সমন্বয়েই গঠিত।

আজ পদার্থের গঠনের মৌলিক এককগুলো আমরা দেখলাম, যা ব্যাখ্যা করা গেছে একমাত্র স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কল্যাণেই। স্ট্যান্ডার্ড মডেল শুধু পদার্থ কী দিয়ে তৈরি সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি, সাথে সাথে কীভাবে তারা একত্রে আছে, মিথষ্ক্রিয়া গুলো কীভাবে ও কেন করে, এই প্রশ্নগুলির উত্তরও দিয়েছে। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে থিওরি অব এভরিথিং না বললে কী হল! থিওরি অব অলমোস্ট এভরিথিং বলাই চলে!!

সূত্র:
১. http://wikiquote.org/wiki/Enrico_Fermi/
২. http://­Wikipedia.org/wiki/Standard_Model/
৪. http://­profmattstrassler.com­/articles-and-posts/largehadroncolliderfaq/
৫. http://home.cern/about/physics/standard-model


Advertisement 02

Unknown

লেখকের পরিচয়

আব্দুল মুহাইমিন মঈন। পড়াশোনা নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি দিচ্ছেন ২০১৭ সালে।
কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ভক্ত।
লেখকের সব লেখা এখানে। ফেসবুকে লেখকঃ Abdul Muhaymin Moin

2 comments

Write comments
Unknown
AUTHOR
১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ এ ১০:২৭ PM delete

Moin, I expect your response to my knock in a social media(Facebook), we can have some conversation regarding quantum physics.
Thank you, see u there.

Reply
avatar

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...