Advertisement

রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭

পরমাণুর মাঝে যে নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব আছে, তা আমরা জানতে পারি বিশ শতকের শুরুর দিকে। এই নিউক্লিয়াস কী দিয়ে গঠিত? কোন কোন কণা আছে এর মাঝে? কণাগুলো কীভাবে এর মাঝে আছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বিশ শতকের প্রায় অর্ধেকটাই পার হয়ে যায়। অবশেষে যা জানা যায় তা হলো, নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন নামক দুই ধরণের কণা একত্রে আবদ্ধ থাকে। একটি নিউক্লিয়াসে যত সংখ্যক প্রোটনই থাকুক না কেন, তারা যদি একত্রে থাকে তবে সেটা অবশ্যই কোনো না কোনো বলের কারণেই একত্রে আছে।

এই কণাগুলো যে বলের সাহায্যে আবদ্ধ থাকে, সেই বলকে বলা হয় সবল নিউক্লীয় বল। এই বল স্বল্প পাল্লার, অত্যাধিক শক্তিশালী ও আকর্ষণধর্মী। কেননা কুলম্ব সাহেবের স্থির বৈদ্যুতিক সমধর্মী চার্জের পরস্পর বিকর্ষণ করার সূত্র হতে আমরা জানি দুটো প্রোটন খুব নিকটে থাকলে প্রচণ্ড বিকর্ষণ করার কথা। কিন্তু তারা সেটা না করে বরং প্রচণ্ড আকর্ষণের সহিত নিউক্লিয়াসের মাঝে থাকে। আর এই আকর্ষণধর্মী বলটির নামই হলো সবল নিউক্লীয় বল।

সবল নিউক্লীয় বলের সাথে সাথে আরও আছে দুর্বল নিউক্লীয় বল। এই বল আবার কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণে জড়িত থাকে না। এর কাজ হল নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় ভাঙন ঘটানো তথা নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি ক্ষয় করা। দূর্বল নিউক্লীয় বলকে তাই বল না বলে দুর্বল নিউক্লীয় মিথষ্ক্রিয়া বলাটা বেশি উত্তম। এই দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া পদার্থবিদ্যার CP-প্রতিসাম্য লঙ্ঘন করে। প্রতিসাম্য হলো পদার্থবিদ্যার একটা কারসাজি। CP-প্রতিসাম্য হলো চার্জ ও প্যারিটি নামক দুই প্রতিসাম্যর মিশ্র প্রতিসাম্য। এর বক্তব্য হলো, একটি কণাকে এর প্রতিকণার সাথে অদল-বদল করলেও পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর কোনো নড়চড় হবে না। এ অংশের নাম সি প্রতিসাম্য (C symmetry)। আর পি প্রতিসাম্যে মানে, কণাকে এর দর্পণ রূপের সাথে অদল-বদল করলেও সূত্র একই রকম থাকবে।

প্রতিসাম্য বিশ্লেষণ করে কণিকা-প্রতিকণিকা সম্পর্ক, প্রকৃতির নিয়ম ইত্যাদি স্পষ্ট হওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো দুর্বল নিউক্লীয় বল CP-প্রতিসাম্যকে লঙ্ঘন করলেও সবল নিউক্লিয় বল CP-প্রতিসাম্যকে তেমন একটা লঙ্ঘন করে না। তত্ত্বীয়ভাবে এটা খুবই ব্যতিক্রমী ও ব্যাখ্যাহীন একটা ঘটনা। কণা-পদার্থবিদ্যার ভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় সবল CP সমস্যা।

এই সবল CP সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেছেন, অ্যাক্সিয়ন নামক একটি ক্ষেত্র আছে। সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে CP-প্রতিসাম্য লঙ্ঘনের জন্য দায়ী প্রভাবকগুলোকে এই অ্যাক্সিয়ন ক্ষেত্র নিস্ক্রিয় করে ফেলে। ফলে সবল নিউক্লিয় বল CP-প্রতিসাম্যকে লঙ্ঘন করতে পারে না। ১৯৭৭ সালে বিজ্ঞানী রবার্তো দানিয়েল ও হেলেন কুইন গাণিতিকভাবে দেখান, এই অ্যাক্সিয়ন ক্ষেত্র কীভাবে সবল CP সমস্যা সমাধান করতে পারে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী ওয়াইনবার্গ দেখান যে, এই কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের অস্তিত্ব থাকলে একটি কোয়ান্টা তথা ক্ষেত্রকণাও থাকবে, যার নাম তিনি দেন অ্যাক্সিয়ন কণা। ভবিষ্যদ্বাণীর পর থেকেই গত ৪০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নিভাবে এই কণার অনুসন্ধান করছেন। তবুও এখন পর্যন্ত এই কণার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এই কণার একটি ধর্ম হলো - তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাঝে অ্যাক্সিয়ন কণা মুহূর্তের মাঝে ভেঙে গিয়ে ফোটন কণার জন্ম দিবে। এই কণাটির ভর অনেক অনেক কম। দশমিকের পর ৪০ টি শূন্য দিয়ে একটি ১ বসালে যত কেজি হয়, একটি কণার ভর প্রায় তত। কণাটির কোনো চার্জ নেই। তাই একে শনাক্ত করাও দুরূহ কাজ বটে।

তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে (নীচের যুগ্ম পুরু রেখা) অ্যাক্সিয়ন কণা থেকে (উপরের বামপাশের ভাঙা ভাঙা রেখা) ফোটন কণা উৎপত্তির (উপরের ডানপাশের বক্ররেখা) ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম।

জ্যোতিপদার্থবিদ্যার অন্যতম রহস্য ডার্ক ম্যাটারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবেও অ্যাক্সিয়নকে দায়ী করা হয়। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে ডার্ক ম্যাটারের কারণ হবে WIMP (Weakly Interacting Massive Particle বা দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ভারী কণা) জাতীয় কোনো কণা, অ্যাক্সিয়ন নয়।

অ্যাক্সিয়ন শণাক্তকরণ অনেক কঠিন হলেও শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে নিয়ে এসে ফোটন কণায় পরিণত করে এই কণার খোঁজ করার জন্য কাজ চলছে। ইউরোপের নিউক্লীয় গবেষণা সংস্থা সার্নও ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের প্রস্তাবিত রূপ।


অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ল্যাবে এই কণাকে নিয়ে গবেষণা হলেও গত বছরের শুরুতে এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) একদল গবেষক শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা নতুন এক পদ্ধতিতে অ্যাক্সিয়ন কণার অনুসন্ধান শুরু করছেন। বেশ কয়েকটি গবেষণা দাবী করেছে ইতোমধ্যেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে এই কণা। যদিও এখনও তা সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

যদি অ্যাক্সিয়ন কণা পাওয়া সম্ভব হয়, তবে কণা-পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির একটি তথা সবল CP সমস্যা অতি দ্রুতই সমাধান করা যাবে। তাই যতদিন অ্যাক্সিয়ন কণা ধরা না দেয়, ততদিন কণা-পদার্থবিদরা না হয় আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষনকেন্দ্র ও এমআইটি-র সেই গবেষক দলের দিকেই তাকিয়ে থাকুক।

১। সি,পি ও টি প্রতিসাম্য - ম্যাট স্ট্রসলার।
২। আন্তর্জাতিক অ্যাক্সিয়ন পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ওয়েবসাইট
১। উইকিপিডিয়াঃ Axion,  CP violation এবং Weakly interacting massive particles
Category: articles

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (Special theory of relativity) থেকে আমরা জানি, শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি (c) হল মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিবেগ। আলোর দ্রুতি (speed) বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের হয়। তবে শূন্যস্থানে আলোর সর্বোচ্চ যে দ্রুতি (সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ ৮ হাজার মাইল), একে কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় দ্রুতির সার্বজনীন সীমা। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, এর চেয়ে বেশি দ্রুতি অর্জন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কারণ, তার জন্য প্রয়োজন পড়ে অসীম পরিমাণ শক্তির। 

বিজ্ঞানীরা এই সার্বজনীন দ্রুতি সীমা c এর ভিত্তিতে মহাবিশ্বের সকল কণাকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন।

১. ব্র‍্যাডিয়ন (Bradyon):

এই ধরণের কণারা বাস্তব ভরযুক্ত ও সর্বদা দ্রুতি সীমার চেয়ে নিম্ন গতিতে চলাচল করে। এদের অপর নাম ট্যারডিয়ন (tardyons) বা ইটিয়ন (ittyons)। ইলেকট্রন, W বোসন, Z বোসন, আপ কোয়ার্ক ইত্যাদি সবই ব্র‍্যাডিয়ন শ্রেণির অন্তর্গত কণা। 

২. লুক্সন (Luxon):

এই ধরণের কণাদের নিশ্চল ভর (rest mass) শূন্য। তবে চলাচলের সময় এদের ভরবেগ সৃষ্টি হয়। এরা সর্বদা দ্রুতি সীমায় চলাচল করে। অর্থাৎ এদের বেগ আলোর বেগের সমান। গ্লুওন, ফোটন ইত্যাদি কণা হল লুক্সন কণা।


৩. ট্যাকিয়ন (tachyon): 

এই কণারা একটু অন্যরকম কণা। এরা শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির চেয়েও বেশি দ্রুতিতে চলাচল করে।  লঙ্ঘন করে আপেক্ষিক তত্ত্ব। এদের ভর হল কাল্পনিক। এখন পর্যন্ত এমন কণাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

ট্যাকিয়ন একক কোনো কণা নয়। এটা আসলে কণাদের একটা শ্রেণি। ১৯৬২ সালে কিছু বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিকভাবে দ্রুতি সীমার চেয়ে বেশি দ্রুতির কণাদের অস্তিত্বের কথা বলেন। এর নাম দেয়া হয় 'মেটা-পার্টিকেল'। তারপর জেরাল্ড ফাইনবার্গ প্রথম দেখান যে, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব দিয়ে দেখানো যায়, ট্যাকিয়নিক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আছে। এইসব ট্যাকিয়নিক ক্ষেত্রের সকল কণাই c এর চেয়ে বেশি দ্রুতিসম্পন্ন। এরপর থেকে এই জাতীয় কণা নিয়ে গবেষণা শুরু হয় এবং বেরিয়ে পড়তে থাকে এই ধরণের কণার মজার মজার বৈশিষ্ট্যগুলি। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে কোনো কণার দ্রুতি যত বাড়ে তার ভরও তত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুতি বাড়তে বাড়তে যখন দ্রুতি সীমায় চলে যায় তখন কণার ভর অসীম হয়ে যায়। তাই, দ্রুতি সীমা অতিক্রম করা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু, ট্যাকিয়ন শ্রেণির কণারা এইসব নিয়মের তোয়াক্কা করেনা। ট্যাকিয়ন কণার দ্রুতি বাড়লে ভর কমে আসে, আবার দ্রুতি কমলে ভর বাড়ে। ট্যাকিয়নের দ্রুতি সর্বদাই দ্রুতি সীমার উপরে থাকবে। ইচ্ছা করলেও ট্যাকিয়ন কণারা c এর চেয়ে কম দ্রুতিতে চলাচল করতে পারে না। কারণ, তাহলে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে। ট্যাকিয়ন কণাদের আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হল এদের দেখতে পাওয়া-না পাওয়া। কেননা আমরা যেহেতু আলোর সাহায্যে দেখি, আবার ট্যাকিয়ন কণারা আলোর চেয়েও বেশি দ্রুতিতে চলে, তাই আমরা ট্যাকিয়ন কণা দেখতে পাব না। সর্বদা কণাটি চলে যাবার পর শুধুমাত্র কণাটির পদচিহ্ন হিসেবে দুইটি তরঙ্গ দেখতে পাব। এই তরঙ্গের নাম হল চেরেনকভ তরঙ্গ।

পারমাণবিক চুল্লীতে দ্রুতবেগে গতিশীল নিউট্রনের কারণে সৃষ্ট চেরেনকভ নীল বিকিরণ

ট্যাকিয়ন কণারা কি তাহলে শুধুই কাল্পনিক? না, এরা পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। হিগস-বোসন কণা যেমন ২০১২ সাল পর্যন্ত কাল্পনিক ছিল, তারপর পর্যবেক্ষণ করা গেছে। তেমনি  বিজ্ঞানীদের দাবি করেন, এক্সোপ্ল্যানেট তথা বাইরের গ্রহগুলোতে ট্যাকিয়ন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা অনেক। পৃথিবীতে চেরেনকভ বিকিরণ দেখা গেলেও ট্যাকিয়নিক কোনো কণার সাথে এর সম্পর্ক নেই। এটা তৈরি করা খুবই সহজ। কোনো চার্জিত কণাকে ত্বরক যন্ত্রে নিয়ে আলোর অনেক কাছাকাছি দ্রুতি দেয়া সম্ভব হয়। আবার, মাধ্যম পরিবর্তন করে তথা পানি বা কাঁচ মাধ্যমে আলোর দ্রুতিও কমে যায়। ফলে ওই মাধ্যমে চার্জিত কণা মাধ্যমের আলোর দ্রুতির থেকেও বেশি দ্রুতিতে চলাচল করতে পারে। তখন কণাটির রেখে যাওয়া পদচিহ্ন হিসেবে নীল তরঙ্গ দেখা যায়। এই ঘটনাকে বলে চেরেনকভ বিকিরণ।

ট্যাকিয়ন কণা চলে যাবার পর গতিপথে দেখতে পাওয়া দুইটি তরঙ্গ

একসময় মনে করা হত নিউট্রিনো ও টাউ কণা বোধহয় ট্যাকিয়ন শ্রেণির কণা। পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এই ধরণের কণা আবিস্কার করা সম্ভব হলে পৃথিবীর জীবনমানের গতি একদিনেই শতভাগ বেড়ে যাবে বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে যেহেতু কণাটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বর মত প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত একটি তত্ত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তাই অনেক বিজ্ঞানীই এই কণাকে নিছক উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়। তবে ট্যাকিয়ন কণিকা নিছকই কল্পনা নাকি অত্যাধিক উন্নতমানের বিজ্ঞান, তা জানার জন্য আমাদের আরো অনেক বছরই অপেক্ষা করা লাগবে।

** তথ্যের অসঙ্গতি দূর করে পোস্টটি সংশোধন করতে সাহায্য করার জন্য Deepayan Turja ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা। 
Category: articles

শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৬


একটা সময় পৃথিবীর অবস্থা এমন ছিল যে, সবাই মনে করত কোনো পদার্থকে চিরকাল ধরে টুকরা করা যাবে। টুকরা করতে করতে এমন কোনো ক্ষুদ্রতম টুকরা পাওয়া যাবে না, যাকে আরও বেশি ভাঙা অসম্ভব হবে। কিন্তু, ডেমোক্রিটাস বললেন বিপরীত কথা। পরমাণু বলে এমন কিছু আছে যা অবিভাজ্য। তারপর ডালটন সাহেবও তার সাথে সুর মেলালেন। কিন্তু বিজ্ঞানী থমসন, বোর, রাদারফোর্ড প্রমুখরা দেখালেন যে, পরমাণু মাঝে নিউক্লিয়াস আছে। তাতে আবার প্রোটন, নিউট্রন আছে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে সদা সর্বদা ইলেকট্রনও ঘুর্ণায়মান আছে। এই প্রোটন, নিউট্রনের ভর নির্ণয় করতেও বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন। কিন্তু, অনেকে প্রশ্ন করল যে, প্রোটন আর নিউট্রন ভরই বা পেল কোথায়? চার্জই বা কীভাবে পেল?

এই রকম আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন বিজ্ঞানী মারি গেল ম্যান। তিনি বললেন, প্রোটন আর নিউট্রনের মাঝে আছে কোয়ার্ক, যা ফার্মিয়ন শ্রেণির কণা। হরেক রকমের কোয়ার্ক কণা দ্বারা এই সকল পারমাণবিক কণারা গঠিত। তার মানে কোয়ার্করা হল অতি-পারমাণবিক (subatomic particle) কণা। তিনি বললেন, কোয়ার্করা প্রচন্ড বেগে প্রোটনের মাঝে চলাচল করছে। তাদের গতির কারণে আপেক্ষিক ভরের সৃষ্টি হয়। এভাবে প্রোটন, নিউট্রনের ভরের সৃষ্টি হয়। তিনি দেখালেন, একটা প্রোটন দুইটা আপ ও একটা ডাউন কোয়ার্ক- মোট ৩টা কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। তেমনি একটা নিউট্রন দুইটা ডাউন ও একটা আপ কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি।

প্রোটন ও নিউট্রন তৈরি আপ ও ডাউন কোয়ার্কের মিশ্রণে।

তাহলে মনে আবার প্রশ্ন জাগতে পারে, কোয়ার্ক কি তাহলে দুই প্রকার? আপ এবং ডাউন? না, কোয়ার্ক হল ৬ প্রকার। আপ ও ডাউন কোয়ার্ক ছাড়াও আছে চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ ও বটম কোয়ার্ক। তবে প্রোটন ও নিউট্রনে শুধু আপ ও ডাউন কোয়ার্কই থাকে। এই আপ কোয়ার্কের চার্জ হল +$\frac{২}{৩}$ এবং ডাউন কোয়ার্কের চার্জ হল -$\frac{১}{৩}$. একটু হিসাব নিকাশ করলে দেখা যায় প্রোটনে যেহেতু ২টা আপ ও ১টা ডাউন কোয়ার্ক আছে, তাই এর চার্জ +১ আবার নিউট্রনে যেহেতু ২টা ডাউন ও ১টা আপ কোয়ার্ক আছে, তাই এর চার্জ শূন্য। কত সুন্দর করে চার্জের হিসাব মিলে গেল। তাই না!! তবে চার্জের হিসাব মিললেও ভরজনিত কিছু সমস্যা থেকেই গেল।

প্রোটন ও  নিউট্রনের চার্জের হিসাব 

সেই সমস্যায় একটু পরে আসছি। আপাতত পারমাণবিক কণারা যে কোয়ার্ক থেকে ভর পেয়ে আসছে সেটা জানা গেল। সাধারণত, এই তথ্য পেয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মনে করে নেয় যে, ভরের সবটুকুই কোয়ার্ক থেকে আসছে। আসলে কিন্তু তা নয়। কোয়ার্ক শুধুমাত্র স্থিতিভর(নিশ্চল ভর) প্রদান করে। কণা-পদার্থবিদ্যায় ভর বলতে স্থিতিভরকেই বুঝানো হয়। যেমন: মানবদেহের স্থিতিভর প্রায় এক কেজির মত। অবশিষ্ট যে ভর পাওয়া যায় তা হল কোয়ার্কের গতিজনিত ভর বা আপেক্ষিক ভর। কোয়ার্কসহ সকল ফার্মিয়নরা কোয়ান্টাম জগতে আলোর কাছাকাছি বেগে মিথস্ক্রিয়া দেখায়। তাই এক্ষেত্রে ভরবৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং, ভরের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখা প্রয়োজন, তা নাহলে কণা-পদার্থবিদ্যার সমীকরণে গরমিল হয়ে যেতে পারে।

সমস্যাটিতে ফিরে আসি। প্রোটন, নিউট্রন তো ভর পেল। কিন্তু, প্রশ্নকারীরা বলল, কোয়ার্কের ভরই বা কীভাবে এল? এবার বিজ্ঞানীরা খুব ভাল একটা উত্তর দিলেন। তারা বললেন, হিগস নামের একটা ক্ষেত্র আছে, যেই ক্ষেত্রে কোনো কোয়ার্ক কণা প্রবেশ করলেই তার ভর তৈরি হয়ে যায়। বলা যায়, হিগস ক্ষেত্রে চলাচলকারী কণাদের ভর হিগস ক্ষেত্র প্রদান করে। এই হিগস ক্ষেত্র ও কণাদের অস্তিত্বও বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন। ২০১২ সালে। সুতরাং ভর নিয়ে আর কোনো সমস্যা রইলনা। অনেকে হয়ত প্রশ্ন করবে, হিগস ক্ষেত্র ভর কীভাবে দেয়? হিগস ক্ষেত্রের ভরই কোথা থেকে এল? এটা অন্য একটা আলোচনার বিষয় হলেও সংক্ষেপে বলছি।

হিগস ক্ষেত্রের একটি কোয়ান্টা আছে। যার নাম হিগস কণা। এই বোসন কণা অন্য কণাদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে বাঁধা প্রদান করে। হিগস ক্ষেত্রে চলাচলকারী কণাদের এই বাঁধাকেই আমরা ভর হিসেবে দেখি। পুরো মহাবিশ্ব হিগস কণা দিয়ে পূর্ণ। সৃষ্টিলগ্নের পর মহাবিশ্ব যখন স্থিতাবস্থায় আসতে থাকে, তখন হিগস কণা জমতে(condensed) থাকে। এই জমার প্রক্রিয়াতেই হিগস কণা নিজে ভর পায়। মজার বিষয় হল হিগস ক্ষেত্রের উৎপত্তি যে ক্ষেত্র থেকে তা কাল্পনিক ক্ষেত্র। এই কাল্পনিক ক্ষেত্র কীভাবে বাস্তব ভর দেয়, তাও সমাধান করতে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত লিখব শীঘ্রই। 

উল্লেখ্য যে, ইলেকট্রন কিন্তু কোনো আপ বা ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত নয়। ইলেকট্রন একেবারেই মৌলিক কণা। একে আর টুকরা করা যায় না। কোয়ার্ক থাকে প্রোটন আর নিউট্রনের মাঝে। এর ভিতর অনেক কথা আছে। যেমন, আপ ও ডাউন কোয়ার্ক কীভাবে প্রোটন অথবা নিউট্রনের ভিতরে একত্রে আছে? এরা মূলত গ্লুয়ন নামক (আঠা বা গ্লু থেকে নাম করা হয়েছে) এক প্রকার কণা দ্বারা একত্রে যুক্ত থাকে। গ্লুয়নের গল্পের রাজ্য কোয়ার্কের চেয়েও বিশাল। সেই গল্প আপাতত তোলা থাক।

এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ

সূত্রঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Murray_Gell-Mann
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Higgs_boson
Category: articles

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

আগের পর্বের লিঙ্কঃ ১ম পর্ব, ২য় পর্ব

আমাদের মহাবিশ্বে মোট ৪টি মৌলিক বল ক্রিয়াশীল রয়েছে। সবল নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তড়িচ্চুম্বকীয় বল ও মহাকর্ষীয় বল। এসব বলের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পাল্লা ও ভিন্ন ভিন্ন শক্তি। এই বলগুলোর মাঝে মহাকর্ষীয় বলের পাল্লা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও এটি সবচেয়ে দুর্বল বল। তড়িচ্চুম্বকীয় বলের পাল্লাও অসীমতক, কিন্তু এটি মহাকর্ষের তুলনায় কয়েকগুণ শক্তিশালী বল। সবল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলের পাল্লা অতি ক্ষুদ্র, এরা অতি-পারমাণবিক জগতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

নামে উলটা হলেও দুর্বল নিওক্লিয় বল মহাকর্ষের চেয়ে অনেকগুণ শক্তিশালী। অবশ্য বাকী দুই বলের চেয়ে সে ঠিকই দুর্বল। সবল নিউক্লিয় বল ৪টি বলের মাঝে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী বল। সমস্যা হল  এই বল কার্যকর থাকে নিউক্লিয়াসের ভেতরেই। এর চেয়ে বেশি পাল্লায় এই বল কার্যকর থাকে না।

বলবাহক কণিকাঃ

বিভিন্ন ধরনের বোসন কণা

৪টি মৌলিক বলের মাঝে ৩টি মৌলিক বলেরই উৎপত্তি হয় বলবাহক কণিকাদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বলবাহক কণিকাদের গ্রুপকে বলা হয় 'বোসন' গ্রুপ। বোসন নামটি উপমহাদেশীয় বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এর নামানুসারেই এসেছে। ফার্মিয়ন কণিকাগুলি শক্তির বিচ্ছিন্ন পরিবহন ঘটায় নিজেদের মাঝে বোসন কণিকাদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। 

প্রতিটা মৌলিক বলের সাথেই একটা সম্পর্কযুক্ত বোসন কণিকা রয়েছে। যেমন, সবল নিউক্লিয় বলের বাহক হল গ্লুওন (g) ও মেসন শ্রেণির বোসন কণিকা, তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক হল ফোটন এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য দায়ী হল ডব্লিউ বোসন ((W+, W-) ও জেড বোসন ((Z)। মহাকর্ষীয় বলের জন্য দায়ী কোনো কণিকা তথা মহাকর্ষ বলের বাহক এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মহাকর্ষ বলের বাহক হল গ্র‍্যাভিটন (G) নামক অনুকল্পিত কণিকা। 
চিত্রঃ মৌলিক বল

স্ট্যান্ডার্ড মডেল তড়িচ্চুম্বকীয় বল, দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বল এবং এই বল তিনটির বাহক কণিকাগুলোকে একই নিয়মের অধীনে আবদ্ধ করেছে। সাথে সাথে এটাও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে যে, কেমন করে এই বলগুলি ফার্মিয়নদের উপর প্রতিক্রিয়া করে। যাই হোক, আসল কথা হল আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবচেয়ে বেশি পরিচিত বল মহাকর্ষীয় বল, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভূক্ত নয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দ্বারা মহাকর্ষীয় বল ব্যাখ্যা করা এবং এই মডেলের মাঝে মহাকর্ষীয় বলের বাহকের স্থান করে দেয়াটা বিজ্ঞানীদের নিকট একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আণবিক জগতের পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য  উৎপত্তি হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের। আবার, বৃহৎ বস্তুর পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, এই দুইটি তত্ত্ব একইসাথে ব্যবহারযোগ্য নয়। এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আলোকে এই দুই তত্ত্বকে গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখাতে পারেননি। কিন্তু কণা পদার্থবিদ্যার জন্য এটা তেমন বড় কোনো সমস্যা নয়। কেননা, যখন মহাকর্ষকে কণিকাদের ক্ষুদ্র জগতে বিবেচনা করা হয়, তখন মহাকর্ষীয় প্রভাব এত ক্ষুদ্র হয় যে তা বর্জনযোগ্য। অনেক ফার্মিয়ন মিলে যখন চেয়ার- টেবিল বা মানবদেহ কিংবা গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বড় বড় বস্তু তৈরি করে তখনই মহাকর্ষ অনুভূত হয়। তাই, মহাকর্ষীয় বলের মতো একটা মৌলিক বলকে হিসেবের বাইরে রেখেও বাকি সব ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড মডেল দারুণভাবে কাজ করে।

বলবাহক কণিকা কীভাবে বল বহন করেঃ

কল্পনা করুন, একটা মাঠে দুই বন্ধু বল ছোড়াছুড়ি খেলছে। তারা খুব একটা জোরে বল ছুড়তে পারে না, আবার বলকে মাটিতে পড়তেও দিতে চায় না। তাহলে নিশ্চয় তাদেরকে অতি কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে এবং বল ছোড়াছুড়ি নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে। তারা এই শর্ত মেনে ইচ্ছা করলেই দূরে যেতে পারবে না। কারণ, তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়ে গেলে তারা বলটা আর ধরতে পারবে না। তাই তাদেরকে কাছাকাছিই থাকতে হবে।

ফার্মিয়ন কণিকারাও এইরকম কিছু বোসন কণিকার বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি করে বলে নিজেরা আলাদা হতে পারে না, একত্রে থাকে। আলাদা ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ফার্মিয়নের জন্য আলাদা আলাদা বোসন কণিকা রয়েছে। যেমন, পরমাণুর প্রোটন ও নিউট্রনের কোয়ার্কেরা পরস্পরের মাঝে পাই মেসন বা পাইওন নামের একজাতীয় বোসন কণিকা ছোড়াছুড়ি করে অর্থাৎ এইক্ষেত্রে সবল নিউক্লিউ বলের জন্য এই পাই মেসন দায়ী। এইরকম প্রোটনের মাঝে কোয়ার্কেরা পরস্পর গ্লুওন নামক বোসন কণিকা আদান প্রদান করতেই থাকে বলে তারা একত্রে থাকে।

কোন কণিকার সাথে কোন কণিকা মিথস্ক্রিয়া করে তা জানতে নিচের ছবিটি সহায়ক হবে।
চিত্রঃ বিভিন্ন বল ও কণার সম্পর্ক 


বোসনঃ

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বোসন শ্রেণির কণিকারা পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে না। অর্থাৎ একই কোয়ান্টাম অবস্থায় এদের অসীম সংখ্যক কণিকা অবস্থান করতে পারে, যেখানে ফার্মিয়নরা একই কোয়ান্টাম অবস্থায় মাত্র একটা কণিকাই অবস্থান করতে পারে। বোসন কণিকাদের এই বৈশিষ্ট্য বলা হয় বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই কণিকাদের স্পিন সংখ্যা অবশ্যই পূর্ণ সংখ্যা হবে, ফার্মিয়নদের মত অপূর্ণ নয়। তবে দুইটি অর্ধপূর্ণ স্পিনবিশিষ্ট ফার্মিয়ন মিলে একটা পূর্ণ স্পিনবিশিষ্ট বোসন হতে পারে। যেমন: মেসন একপ্রকার বোসন। অতি-পরিবাহীতা, অতি-প্রবাহীতা ইত্যাদি বোসন কণিকার বৈশিষ্ট্য।

বোসন কণিকার গুরত্ব অনেক। কেননা, বোসন কণিকা না থাকলে ফার্মিয়নরা একত্র হতে পারত না। আবার আলোর জন্য দায়ী কণিকা ফোটনও একপ্রকার বোসন। যদি ফোটন না থাকত, তবে প্রাণিজগতকে দৃষ্টিশক্তির জন্য অন্য কোনো বোসন সংবেদী চোখ ব্যবহার করতে হত, যেটা তুলনামূলক জটিল হত। কসমোলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই কণিকা শ্রেণিরই অন্তর্ভূক্ত কণিকা হল কল্পিত গ্র‍্যাভিটন কণিকা। মহাকর্ষকে অন্য সব বলের সাথে একীভূত করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল থিওরি অব এভরিথিং এর দাবিদার হতে চাইলে ২ স্পিন বিশিষ্ট, চার্জহীন এই বোসন খুঁজে পাওয়া এখন সময়ের দাবি। তাই, বোসন কণিকাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্যতম একটা সৌন্দর্য বলে আখ্যায়িত করাই যায়।
Category: articles

মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬

এর আগে আমরা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রাথমিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তত্ত্বটি আসলে এতটা ব্যাপক যে অতটুকু জেনে জ্ঞানপিপাসু মন তৃপ্ত হয় না। সে জন্যেই এই লেখা।

ইয়াং- মিলস ফিল্ড হল এমন একটি ফিল্ড যার আলোকে দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বল এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বলের ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এই ফিল্ডের আলোকে এ পর্যন্ত জ্ঞাত সকল অতি-পারমাণবিক কণিকাদের আচরণও বর্ণনা করা যায়। শুধু কি তাই? ইয়াং- মিলস ফিল্ড তথা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিপূর্ণতার জন্য বিজ্ঞানীরা একের পর এক বিভিন্ন কণা কল্পনা করে যাচ্ছেন আর পরবর্তীতে তা পেয়েও যাচ্ছেন, যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে প্রতিনিয়তিই যোগ হয়ে যাচ্ছে। সদ্য যোগ হওয়া হিগস-বোসন (২০১২), টপ কোয়ার্ক(১৯৯৫), টাউ নিউট্রিনো(২০০০) ইত্যাদি কণিকাগুলো সবই একসময় হাইপোথেটিক্যাল বা অনুমিত কণিকা ছিল।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই কণিকাগুলোর অস্তিত্বের কথা ধারণা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কোলাইডারে এইসব কণিকা খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের হাইপোথেটিক্যাল জীবন শেষ হয়ে তারা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কণিকা হিসেবে মর্যাদা পায়। এখন পর্যন্ত হাইপোথেটিক্যাল অবস্থায় থাকা গ্র্যাভিটন কণা (মহাকর্ষের জন্যে প্রস্তাবিত কণা) যদি চিহ্নিত করা যায় বা পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে তা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পূর্ণতা পাবার দিকে বিশাল একটা পদক্ষেপ ফেলবে। কারণ গ্র্যাভিটন কণা অস্তিত্বশীল হলে ৪টি মৌলিক বলকে একীভূত করা হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।


স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মৌলিক কণিকাঃ

দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বল এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বল তিনটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াং- মিলস ফিল্ড থেকে কিছু কণার উদ্ভব হয়। মূলত এদের কণা না বলে কোয়ান্টাম ফিল্ডে একটি একক কোয়ান্টা বলাই অধিক ভাল। তারপরেও আমরা বলার সুবিধার্থে এগুলোকে কণা বলব।

ফার্মিয়নঃ 

আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবই কিছু মৌলিক কণিকা দ্বারা তৈরি। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে সকল পদার্থ ও শক্তি ব্যাখ্যার জন্য মোট ৬১ টি মৌলিক কণিকা এবং প্রতি-কণিকার কথা বলা হয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক কণিকার জন্য একবার কণা- পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মিতো বলেই ফেলেছিলেন যে,
স্ট্যান্ডার্ড মডেল যতগুলি কণিকার ভবিষ্যদ্বাণী করছে আর যতগুলি কণিকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তাদের সবার নাম মনে রাখতে পারলে তো আমি একজন উদ্ভিদিবিজ্ঞানী হয়ে যাব!!

এই মৌলিক কণিকাগুলোর মাঝে কিছু কিছু কণিকা আছে যারা পদার্থ তথা পরমাণু গঠন করে। আবার কিছু কিছু কণিকা আছে যারা নিজেরা পরস্পর অথবা অন্য কণিকার সাথে মিথষ্ক্রিয়া (interaction) করে বিভিন্ন বলের সৃষ্টি করে। মোটা দাগে যদি বিভাজন করা হয় তবে, গঠনগত মৌলিক কণিকাগুলোকে বলা হয় ফার্মিয়ন এবং বলবাহক কণিকাগুলোকে বলা হয় বোসন।  মৌলিক কণিকার প্রথম গ্রুপকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বলা হয় ফার্মিয়ন। এদের নামকরণ করা হয়েছে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামের সম্মানার্থে। বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং পল ডিরাক কণিকাদের কোয়ান্টাম অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য একটা সংখ্যায়ন দেন, যা ডিরাক-ফার্মি সংখ্যায়ন নামে পরিচিত। ফার্মিয়নরা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে। এরা পাউলির বর্জন নীতিও মেনে চলে। সাধারণভাবে ফার্মিয়ন সাধারণত দুইটি ভাগে বিভক্ত, যাদের বলা হয় কোয়ার্ক এবং লেপটন।

কোয়ার্কঃ

এদের প্রতিটা ভাগে আবার ৬ টি মৌলিক কণিকা আছে যারা জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হয়েছে, বা একই জেনারেশনে আবির্ভূত হয়েছে বলা হয়। এই "জেনারেশন"-এর সাথে কিন্তু বাংলা "প্রজন্ম"-এর তেমন কোনো মিল নেই। মূলত, সবচেয়ে হালকা এবং স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে প্রথম জেনারেশনে, যেখানে তার চেয়ে ভারী এবং কম স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় জেনারেশনে এবং সবচেয়ে ভারী এবং সর্বনিম্ন স্থায়ী কণিকাকে রাখা হয়েছে তৃতীয় জেনারেশনে। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, কোয়ার্ক আর লেপটনকে তিনটি জেনারেশনে জোড়ায় জোড়ায় ভাগ করা হয়েছে।

তিন জেনারেশনে তাই মোট ৩ জোড়া কোয়ার্ক রয়েছে। প্রথম জেনারেশনে আছে 'আপ (u) কোয়ার্ক ও ডাউন (d) কোয়ার্ক, দ্বিতীয় জেনারেশনে আছে চার্ম (c) কোয়ার্ক ও স্ট্রেঞ্জ(s) কোয়ার্ক এবং তৃতীয় জেনারেশনে আছে টপ(t) কোয়ার্ক ও বটম(b) কোয়ার্ক। বটম কোয়ার্ককে অনেকে বিউটি কোয়ার্ক বলেও ডেকে থাকেন। আর টপ কোয়ার্ককে অনেকে ট্রুথ কোয়ার্ক বলেও ডেকে থাকেন। এই ৬টি কোয়ার্কের আবার ৩টি ভিন্ন ভিন কালার চার্জ আছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক কোয়ার্ক সংখ্যা হল ১৮ টি। প্রতিটি কোয়ার্কের প্রতি- কণিকা (anti- particle) বিদ্যমান বলে কোয়ার্ক ও প্রতি- কোয়ার্কের সংখ্যা সর্বমোট হল ৩৬।
নিউট্রনের অভ্যন্তরে চলা মিথষ্ক্রিয়া। গতিশীল বৃত্ত দ্বারা গ্লুওনকে বোঝানো হয়েছে। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকে কালার চার্জ, আর বাইরের দিকে থাকে অ্যান্টি- কালার চার্জ। চিত্রঃ উইকিপিডিয়া। 


কালার চার্জ হল চার্জের মতোই কণিকাদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম। কালারচার্জ ও চার্জ ছাড়াও কণিকাদের ফ্লেভার, স্ট্র্যাঞ্জনেস ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম আছে। কোয়ার্কের ধর্মই হল এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে বস্তু গঠন করা যাতে মোট কালার চার্জ শূণ্য হয়। কোয়ার্কের চার্জ বিদ্যমান বলে কোয়ার্ক তড়িচ্চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়।

লেপটনঃ 

লেপটনগুলোও কোয়ার্কের মতো ৩টি জেনারেশনে বিভক্ত। ইলেকট্রন (e) ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন (μ) ও মিউওন নিউট্রিনো এবং টাউ(τ) ও টাউ নিউট্রিনো । ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার প্রত্যেকের আধান, ভর এবং আকার আছে। অন্যদিকে নিউট্রিনোগুলোর কারোরই আধান নেই, কিন্তু অতি সূক্ষ্ম ভর রয়েছে। এক সময় মনে করা হত নিউট্রিনোগুলোর কারোরই ভর নেই, কিন্তু আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড ও তাকাকি কাজিতা নামের দুইজন বিজ্ঞানী নিউট্রিনোর স্পন্দনের মাধ্যমে দেখান যে নিউট্রিনোর অতি সূক্ষ্ম ভর আছে। এজন্য তারা ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

লেপটনগুলো কোয়ার্কের মতোই ফার্মিয়ন শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। তবে কোয়ার্কের কালার চার্জ থাকলেও কোনো লেপটনের কালার চার্জ নাই এবং মাত্র ৩টি লেপটনের বৈদ্যুতিক চার্জ রয়েছে। যেহেতু ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার চার্জ আছে, তাই এরা তড়িচ্চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়। কিন্তু, নিউট্রিনোর চার্জ নেই বলে এরা শুধুমাত্র দুর্বল নিউক্লীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায়। ইলেকট্রন, মিউওন ও টাউ কণিকার প্রতি- কণিকা থাকলেও বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর প্রতি- কণিকা আছে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান। ঠিক সন্দিহান বলা যাবে না, প্রতি- কণিকা যে আছে সেটা পল ডিরাক নিশ্চিত করে গেছেন। সমস্যা হল নিউট্রিনোর প্রতি-কণিকা নিউট্রিনো কি নিজেই? না অ্যান্টি- নিউট্রিনো বলে ভিন্নধর্মী কিছু একটা আছে? এখানেই বিজ্ঞানীদের সমস্যা। তাই কেউ কেউ বলেন মৌলিক কণিকার সংখ্যা ৫৮টি, আবার অনেকের মতে তা ৬১টি। যদি ৬১টি ধরা হয় তবে, লেপটনের সংখ্যা হয় ১২ টি। অর্থ্যাৎ, ৬ টি লেপটন, আর ৬টি প্রতি- লেপটন।

মোট ৩৬টি কোয়ার্ক এবং ১২টি লেপটন নিয়ে ফার্মিয়ন শ্রেণি গঠিত। ফার্মিয়ন শ্রেণির কণিকাগুলো সকল পদার্থের গঠনের জন্য দায়ী। পদার্থের গঠনগত একক পরমাণুর কেন্দ্রের প্রোটন, নিউট্রন কোয়ার্ক দ্বারাই গঠিত, যা ফার্মিয়ন শ্রেণিভুক্ত। পরমাণুর ইলেকট্রনও ফার্মিয়ন শ্রেণির কণিকা। পরমাণুতে অস্থায়ীভাবে উৎপন্ন বিভিন্ন কণিকাগুলোও কোয়ার্ক ও প্রতি-কোয়ার্কের সমন্বয়েই গঠিত।

আজ পদার্থের গঠনের মৌলিক এককগুলো আমরা দেখলাম, যা ব্যাখ্যা করা গেছে একমাত্র স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কল্যাণেই। স্ট্যান্ডার্ড মডেল শুধু পদার্থ কী দিয়ে তৈরি সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি, সাথে সাথে কীভাবে তারা একত্রে আছে, মিথষ্ক্রিয়া গুলো কীভাবে ও কেন করে, এই প্রশ্নগুলির উত্তরও দিয়েছে। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে থিওরি অব এভরিথিং না বললে কী হল! থিওরি অব অলমোস্ট এভরিথিং বলাই চলে!!

সূত্র:
১. http://wikiquote.org/wiki/Enrico_Fermi/
২. http://­Wikipedia.org/wiki/Standard_Model/
৪. http://­profmattstrassler.com­/articles-and-posts/largehadroncolliderfaq/
৫. http://home.cern/about/physics/standard-model
Category: articles

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬

আজ ৭ অক্টোবর। ১৮৮৫ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ নিলস বোর। ড্যানিশ এই পদার্থবিজ্ঞানীর কল্যাণেই পরমাণুর মৌলিক গঠন উদঘাটিত হয় এবং ভিত্তি স্থাপিত হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর

বিশেষ করে তিনি পরমাণুর জন্যে বোর মডেল প্রস্তুত করেন। পরে আবার তৈরি করেন লিকুইড ড্রপ মডেল। কোপেনহেগেন থাকার সময় অসংখ্য পদার্থবিদ তাঁর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেতেন। একত্রে কাজও করেছেন অনেকের সাথে। এখানে থাকা অবস্থায়ই হাইজেনবার্গের সাথে মিলে তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen interpretation) তৈরি করেন। বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এই বিজ্ঞানী ১৯২২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, পরমাণুর গঠন ও তা থেকে নির্গত বিকিরণ নিয়ে গবেষণার জন্যে।

নিলস বোর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৮৮৫ সালের ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। বোরের বাবা একজন অধ্যাপক ছিলেন এবং কোপেনহেগেনের সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোর মাঝে বোরের পরিবার ছিল অন্যতম। বোরের পরিবারের সবাই ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁর ছোট ভাই হ্যারাল্ড বোরও পরবর্তীতে একজন দক্ষ গণিতবিদ হয়েছিলেন। বোরের বাবার কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর করাতে বাল্যকালে বোর কিছুটা সুবিধা পেয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে তিনি বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও দর্শনে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯০৫ সালে বোর তরলের পৃষ্ঠটানের উপর একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, যা সবার মনোযোগ কাড়ে। তিনি পুরস্কৃতও হন এর জন্যে। এর পরেই বোর গণিত ও দর্শন ছেড়ে ঢুকে পড়েন পদার্থবিদ্যার জগতে। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯১১ সালে বোর তাঁর ডক্টরেট থিসিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তী গবেষণার জন্য ডেনমার্ক ছেড়ে বোর ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকেই তাঁর চমক দেখানোর শুরু।

চাপা স্বভাবের বোর ছোটবেলায় ভাষা শিখতে অনেক দেরী করে ফেলেছিল বলে ড্যানিশ ভাষা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেননি। আবার পড়ালেখার জন্য ইংরেজী শিখলেও ইংরেজী ভাষার শব্দ জ্ঞান তাঁর ছিল খুব সীমিত। ইংল্যান্ডে আসার পর ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্যার জে.জে. থমসনের অধীনে গবেষণা শুরু করলেও তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। থমসনের উদাসীনতা বোরকে ভীষণভাবে হতাশ করলেও ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের সঙ্গ বোরকে অনেক উৎসাহ- অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে মহান শিক্ষক রাদারফোর্ডের অধীনে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে বোর গবেষণা শুরু করেন।

ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে থাকাকালীন আইসোটোপ, তেজস্ক্রিয়তার ভাঙন সুত্র এবং পর্যায় সারণী নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেন। ১৯১১ সালে আলফা- কণা বিক্ষেপণের ফলাফলের উপর নির্ভর করে রাদারফোর্ড তার পরমাণু মডেল প্রকাশ করলে এতে অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। বোর সেগুলোর কয়েকটি সমাধান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, তিনি রাদারফোর্ডকে তা বোঝাতে অক্ষম হন। ১৯১২ সালে বোর কোপেনহেগেনে ফিরে আসেন এবং জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি মার্গ্রেথকে বিয়ে করেন। বোর- মার্গ্রেথ দম্পতির পরবর্তীতে ৬টি সন্তান- সন্তুতি হয়েছিল, যাদের মাঝে ২ জন নাবালক অবস্থায় মারা গেলেও বাকি ৪ জন পিতার মতোই বিভিন্ন শাখায় দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তন্মধ্যে, বোরের সন্তান অউ নিলস বোর ১৯৭৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

১৯১২ সালের গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটানোর সময় বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল থেকে চিরায়ত বলবিদ্যাকে বিদেয় করে তাতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করেন। তার স্ত্রী মার্গেথ এই সময় বোরকে তার গবেষণাপত্র (scientific paper) তৈরিতে খুব সহায়তা করেন। বোরের গবেষণাপত্রগুলো মূলত তার স্ত্রী মার্গেথেরই লেখা। মার্গেথ তার স্বামীর কথা বোঝার চেষ্টা করতেন এবং তা লিখে রাখতেন। ১৯১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বোর পরমাণু সম্পর্কে এমন ৩টি অনুমান করেন, যা দ্বারা রাদারফোর্ডের অস্থায়ী পরমাণু, পরমাণুর ভৌতিক(?) বর্ণালীসহ নানা সমস্যা সমাধান করা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বোরের সেই অমর কর্ম- ‘পরমাণুতে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধে ঘুরতে পারে না, শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট অনুমোদিত(কোয়ান্টায়িত) কক্ষপথেই ঘুরে’ এই সময়েই প্রকাশ পায়। বোরের দেওয়া পরমাণুর এই চিত্র বোরের কোয়ান্টাম পরমাণু মডেল নামে পরিচিত।

১৯২১ সালে বোর কোপেনহেগেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের বাকি সময় তিনি এর পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৬- ২৭ সালে এই সমিতিতেই হাইজেনবার্গ বোরের অধীনে কাজ করেন এবং প্রদান করেন তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূতিকাগার ছিল মূলত তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সমিতিটিই। আলোর দ্বৈত ধর্ম, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বোরের এই সমিতির অবদান অনস্বীকার্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানি ডেনমার্ক আক্রমণ করলে বোর এর প্রতিবাদ করেন এবং নাৎসিবিরোধি মনোভাবের কারণে জার্মানদের রোষানলে পড়েন। ১৯৪৩ সালে বোর দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং সুইডেন হয়ে ইংল্যান্ড গমন করেন। এইসময় বোর নিউক্লিয়ার ফিশান এবং ইউরেনিয়াম- ২৩৫ নিয়ে কাজ করেন। তিনি সারাজীবনই পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে আমেরিকায় ম্যানহাটন প্রজেক্টে ধীরে ধীরে তিনি জড়িয়ে পড়েন এবং আণবিক বোমা তৈরির এই প্রকল্পে একজন সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে পদোন্নতি পান। এইসময় বোর ছদ্মনাম হিসেবে নিকোলাস বেকার নাম গ্রহণ করেন। তবে বোর আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েতের সাথে প্রকাশ্যে আলাপ চালাতে শুরু করেন পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহার রোধের জন্য। এই কারণে বোরকে নিরাপত্তার ঝুঁকি মনে করে আমেরিকা থেকেও বের করে দেয়া হয়।

বোর ১৯৪৭ সালে বীরের বেশে দেশে ফিরে আসেন। তাকে ডেনমার্কের সর্বোচ্চ পদক অর্ডার অব দি এলিফ্যান্ট প্রদান করা হয়। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি রয়্যাল ড্যানিশ একাডেমির সভাপতি ছিলেন। শেষ বছরগুলোতে বোর তার গবেষণা বন্ধ করে দিলেও নিউক্লিয়ার শক্তির অপব্যবহার রোধে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। ১৯৫০ সালে জাতিসংঘে শান্তির পক্ষে তার খোলা চিঠিটি তার শান্তি আন্দোলনে স্মরণীয় একটি পদক্ষেপ।

বোর কোপেনহেগেনেই ১৯৬২ সালের ১৮ নভেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। নিলস বোরের স্ত্রী মার্গ্রেথ আরো প্রায় ২০ বছর জীবিত ছিলেন।

নিলস বোরের পরমাণু ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর কাজ বিজ্ঞানের সকল শাখায় যে কত বড় অবদান রেখেছে তা কল্পনাতীত। আইনস্টাইনের একটা উক্তির অংশবিশেষ দিয়েই শেষ করছি।
'বোর  না থাকলে পরমাণু সম্পর্কে যে আমরা কতটুকু জানতে পারতাম তা কেউই জানে না।' 
তাঁর ছাত্র থাকাকালীন সময়ের একটি মজার কাহিনী পড়ুন এখানে।

সূত্রঃ
১। http://www.famousscientists.org/niels-bohr/
২। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_bohr.html
Category: articles

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬

স্ট্যান্ডার্ড মডেল হল বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল তত্ত্বগুলোর মাঝে একটি। অনেকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে মৌলিক কণাদের বা বলবাহক কণাদের তালিকা মনে করলেও এটি আসলে এটি নিছকই তালিকা নয়, বরং একটি গাণিতিক সূত্র বা তত্ত্ব। চলুন জেনে নিই, অতি-পারমাণবিক কণাদের আচরণ ও মৌলিক বলগুলোর একীভূত কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠনে সফল এই তত্ত্বের জন্ম কীভাবে হল।

বর্তমান বিজ্ঞানীদের নিকট অন্যতম বড় একটা চ্যালেঞ্জ হল প্রকৃতির মৌলিক ৪ টি বলকে একীভূত করা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করা গেলে কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব, কণা-পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদির হাজারো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সেই আদিকাল থেকেই সকল বলকে একই বলের বিভিন্ন রূপ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, তখনও সকল মৌলিক বল আবিষ্কৃত না হওয়ায় বিজ্ঞানীরা মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করতে পারেননি। পরবর্তীতে যখন সবল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল আবিস্কৃত হয় তখন মৌলিক বলগুলোর একীভবনের জন্য অনেকগুলো তত্ত্ব গঠিত হয়। সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব, লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, ইয়াং-মিলস ফিল্ড এই তত্ত্বগুলোর মাঝে অন্যতম।

কোনো একটি বলকে ব্যাখ্যা করতে গেলে দরকার হয় ফিল্ড থিওরি বা ক্ষেত্র তত্ত্বের। যেমন মহাকর্ষ বলের জন্য যেমন মহাকর্ষ ক্ষেত্র রয়েছে। আইনস্টাইনের সফলতা ও নিউটনের ব্যর্থতার মূল কারণ হল আইনস্টাইন একটি মহাকর্ষ ক্ষেত্র তত্ত্ব গঠন করতে পেরেছিলেন, যা নিউটন পারেননি। দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বলের জন্য কোনো ক্ষেত্র তত্ত্ব যখন আবিষ্কৃত হয়নি, তখন ১৯৫৪ সালে এন. সি. ইয়াং ও তার ছাত্র আর. এল. মিলস একটি নতুন ক্ষেত্র তত্ত্ব দেন। এটি দুর্বল ও সবল নিউক্লীয় বলকে কোয়ান্টা বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়। ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রতত্ত্বের আলোকে সবল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং তাড়িচ্চুম্বকীয় বলকে একীভূত করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়, তাই অবশেষে স্ট্যান্ডার্ড মডেল অব পার্টিকেল রূপে পরিচিতি পায়। স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যাখ্যা করে যে পদার্থের মৌলিকতম কণাগুলো কীভাবে নিজেদের মাঝে মিথষ্ক্রিয়া বা পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করছে এবং বলবাহক কণাগুলোর সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে মৌলিক ৩টি বলের ক্ষেত্র কীভাবে সৃষ্টি করছে।

এই মডেল অনুসারে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সকল বলের জন্যই এক বা একাধিক কোয়ান্টা রয়েছে। বল তৈরি হয় এই কোয়ান্টাদের পারস্পারিক আদান- প্রদানের মাধ্যমে। দৃশ্যমান সকল পদার্থের গঠনগত মৌলিক কণাদের আচরণ এই তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমি এখানে দৃশ্যমান বলেছি, কেননা ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি এবং অ্যান্টিম্যাটারের সৃষ্টিকে এই তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। বেরিয়নসূচক পদ্ধতি, হায়ারার্কি সমস্যা, নিউট্রিনো স্পন্দন, সবল সিপি প্রতিসাম্য সমস্যাসহ আরো অনেক কিছুই আছে, যেখানে স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যর্থ হয়ে পড়ে।


তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কথা পরে বলব, আগে তত্ত্বটির ভালো দিকগুলির কথায় জানা যাক! প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌলিক বল ৪টি। বিজ্ঞানীরা নতুন আরেকটি মৌলিক বলের দাবি করলেও সেটা এখনও চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি। ৪টি মৌলিক বলের মাঝে ৩টি মৌলিক বলেরই কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করতে পারে এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল। মহাকর্ষ বল বাদে অন্য সব বলগুলোকে একীভূত করার কৃতিত্বও তাই এই মডেলের।

কণিকার স্ট্যান্ডার্ড মডেল 


সবল নিউক্লীয় বলঃ

আমরা জানি সবল নিউক্লীয় বলের কারণেই নিউক্লিয়াসের স্থায়ীত্ব রয়েছে। নিউক্লিয়াসের মাঝে প্রোটন ও নিউট্রনের একত্রে থাকার মূল রহস্য সবল নিউক্লীয় আকর্ষণ বল। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে সবল নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী কণা হল গ্লুওন নামক একটি বলবাহক কণা। এই গ্লুওন মূলত গ্লুওন ক্ষেত্র নামক একটি ক্ষেত্র তৈরি করে, যে ক্ষেত্রে কোয়ার্ক নামক একপ্রকার কণা গ্লুওন কণাকে বিনিময়ের মাধ্যমে একত্রে থেকে প্রোটন ও নিউট্রনের সৃষ্টি করে। এই প্রোটন ও নিউট্রন আবার বিভিন্ন মেসন কণা দ্বারা আবদ্ধ থাকে। গ্লুওনের কাজ হল মেসনসহ সকল নিউক্লিওনকে বেঁধে রাখা। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মোট ১৮ রকমের কোয়ার্ক ও ৮ রকমের গ্লুওন কণা আছে, যাদের কালার নামক একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের যে অংশে সবল নিউক্লীয় বলকে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইন্যামিক্স বলে। এই "ক্রোমো" শব্দটি "Color" শব্দ থেকে এসেছে। এটি সংক্ষেপে QCD (Quantum ChromoDynamics) নামেও পরিচিত।


দুর্বল নিউক্লীয় বলঃ

স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে লেপটন নামক বিশেষ এক শ্রেণির কণা রয়েছে। এই লেপটনদের স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা সবসময় ভগ্নাংশ হয়, আর এরা পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে। দুর্বল নিউক্লীয় বল এই লেপটন কণাদের আচরণ থেকেই বের হয়ে আসে। তবে দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী কণা বা বলবাহক কণা হল W এবং Z কণা। ২ প্রকারের W কণা (W+ ও W-) ও ১ প্রকারের Z কণা রয়েছে। গ্লুওনের মত এরাও বোসন শ্রেণির কণা। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের এই অংশকে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্লেভারোডাইন্যামিক্স, যা সংক্ষেপে QFD (Quantum FlavourDynamics) নামেও পরিচিত।


তড়িচ্চুম্বকীয় বলঃ 

ম্যাক্সওয়েল সাহেবের তড়িচ্চুম্বকীয় বলকেও এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই বলের জন্য দায়ী কোয়ান্টা হল ফোটন নামক এক প্রকার কণা। এটিও বলবাহক কণা। এই তত্ত্ব সবচেয়ে বেশিবার পরীক্ষিত তত্ত্ব ও সবচেয়ে সফল তত্ত্ব। চিরায়ত বলবিদ্যার (classical mechanics) এই তত্ত্বকে কোয়ান্টায়িত করার কৃতিত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলরই। এই অংশকে বলা হয় কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইন্যামিক্স বা QED (Quantum ElectroDynamics)

এভাবেই তিনটি বলকে একীভূত করেছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেল যদিও মহাকর্ষ বলকে একীভূত করতে পারেনি, তবুও গ্র্যাভিটন নামক একটি কল্পিত কণা ধরে নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মাধ্যমেই মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলছে। গ্র্যাভিটন কণাকে এই মডেলের আওতায় নিয়ে আসা যায়, যা এখনও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য প্রায় সকল কণা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে গ্র্যাভিটনের মতো স্ট্যান্ডার্ড মডেল কর্তৃক কল্পিত কণার সংখ্যাও কম নয়। তারপরেও এই মডেলকে এতটা সফল বলা যায় কারণ,  ১৯৬০ থেকে '৭০ এর দশকে বিজ্ঞানীরা এই মডেল নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন তাই মিলে যেত। শক্তিশালী কোলাইডার বা এ্যাটম স্ম্যাশারগুলো এবং ক্লাউড চেম্বারে কণার গতিপথ থেকে এই মডেলের সত্যতা প্রমাণ করা যায়।

মূল কথা হল, এই মডেল প্রায় সকল প্রকার পদার্থেরই গঠন ও বলগত মিথষ্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। ম্যাক্সওয়েল ও ইয়াং মিলস ফিল্ডের সাহায্যে এই মডেল কাজ করে থাকে। তবে বিজ্ঞানী ক্লেইন ও কালুজা তাদের তত্ত্বে উচ্চ মাত্রা ব্যবহার করে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব ও মহাকর্ষকে একীভূত করার একটি উপায় দিয়েছিলেন। যেহেতু স্ট্যান্ডার্ড মডেল ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে, তাই আমরা আশা রাখতেই পারি যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল অদূর ভবিষ্যতে মহাকর্ষ বলকেও ব্যাখ্যা করতে পারবে।

শুধু এটুকু পড়ে তৃপ্তি না পেলে ঢুঁ মেরে আসুনঃ
☛ স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটু গভীরে

সূত্র:
১. সার্ন
২। উইকিপিডিয়া 
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আজ ২২ সেপ্টেম্বর। ১৭৯১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান শিক্ষা বা বিজ্ঞান চর্চা শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকত। নিম্নবিত্ত- দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা বিজ্ঞানচর্চায় অংশ নিতে পারত না। মাইকেল ফ্যারাডে সেই সময়ের একজন বিজ্ঞানী। তিনিও উঠে এসেছিলেন খুব দরিদ্র একটি পরিবার থেকে। তবুও তিনি সকল প্রতিকূলতা জয় করে হয়েছিলেন একাধারে জগদ্বিখ্যাত ব্যবহারিক পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং প্রকৃতি বিষয়ক দার্শনিক। তাঁর নামানুসারেই বৈদ্যুতিক ধারকত্বের এককের নাম রাখা হয়েছে ফ্যারাডে, যা F প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়।


১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মাইকেল ফ্যারাডে বর্তমান যুক্তরাজ্যর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেমস- মার্গারেট দম্পতির তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কামার এবং মা ছিলেন গৃহকর্মী। মোটকথা, মাইকেল ফ্যারাডের পরিবার নিম্নবিত্ত দরিদ্র জীবন-যাপন করত।

মাইকেল ফ্যারাডে তার গ্রামেরই একটি স্কুলে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এই স্কুল থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের দারিদ্যের কারণে তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে একটি বইয়ের দোকানে বই পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করেন। এই কাজে ফ্যারাডের কঠোর পরিশ্রম আর মনোযোগ দেখে বই এর দোকানের মালিক ফ্যারাডের উপর অনেক খুশি হন। এর ফলে তিনি ডেলিভারি বয় এর কাজ থেকে বাদ দিয়ে ফ্যারাডেকে বই বাঁধাই এর কাজ শেখার সুযোগ দেন। ফ্যারাডের বাল্যকাল শিক্ষানবীশ বই বাঁধাইকারী হিসেবেই শেষ হয়।


বিজ্ঞানের ছোঁয়াঃ

মাইকেল ফ্যারাডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা বন্ধ করে দিলেও পৃথিবী ও প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতুহল ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। দিনের পুরোটা সময় শুধু বই বাঁধাই করেই কাটাতেন না তিনি, সাথে সাথে যে বইগুলো বাঁধাই করতেন তা পড়েও ফেলতেন। ফ্যারাডে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, অন্য বইগুলোর চাইতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলো পড়তে বেশি ভালো লাগছে। কথিত আছে, ফ্যারাডের বই এর দোকানে এমন দু'টি বই আসে যা ফ্যারাডের অনেক ভালো লেগেছিল। বই দু'টি হল-

১। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ (The Encyclopedia Britannica)- ফ্যারাডের তড়িৎ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান এই বই থেকেই আসে।
২। Conversations on Chemistry (রসায়নের সহজ পাঠ)- সবার বোধগম্য করে জেন মাসেঁ কর্তৃক লিখিত রসায়নের একটি বই।

মাইকেল ফ্যারাডে এসব বই পড়ে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বই এর দোকানে কাজ করে যা সামান্য মাইনে পেতেন, তার অধিকাংশই তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির পেছনে খরচ করে ফেলতেন। এসব দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি কিনে মাইকেল ফ্যারাডে তার অবসর সময়ে পরীক্ষা করে দেখতেন যে, তিনি বই পড়ে যা শিখছেন তা কি আসলেই কাজ করে না কি না। এইজন্য মুখস্থ শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রায়োগিক শিক্ষার আন্দোলনে মাইকেল ফ্যারাডে একটা ভাল উদাহরণের নাম হতে পারে।

তিনি একদিন জানতে পারলেন যে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জন ট্যাটাম প্রাকৃতিক দর্শনের (মূলত পদার্থবিজ্ঞানের) উপর জনসম্মুখে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তব্য প্রদান করবেন। এই বক্তব্য শুনতে হলে প্রবেশ ফি দিতে হবে ১ শিলিং, যা দরিদ্র ফ্যারাডের জন্য অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। ফ্যারাডের বড় ভাই, যিনিও বাবার মত একজন কামার ছিলেন, তিনি ফ্যারাডের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে ঐ ১ শিলিং মুদ্রা দিয়েছিলেন। এর ফলে ফ্যারাডে ট্যাটামের সেই বক্তব্য শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে এভাবেই ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করে ফেললেন।

স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়: ফ্যারাডের নতুন জীবনঃ

উইলিয়াম ড্যান্স নামে ফ্যারাডের দোকানের এক খদ্দের ফ্যারাডের বিজ্ঞানভক্তির কথা জানতেন। তিনি একদিন ফ্যারাডেকে রয়েল ইন্সটিটিউশানে অনুষ্ঠিতব্য স্যার হামফ্রে ডেভির বক্তব্যর একটা টিকেট অফার করেন। স্যার হামফ্রে ডেভি ছিলেন তৎকালীন সময়ের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের একজন। ফ্যারাডে তাই এই অফার লুফে নিয়েছিলেন। স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়ের পর ফ্যারাডের বিজ্ঞানচর্চা আরো একধাপ উপরে উঠেছিল।

ফ্যারাডে এই সুযোগে হামফ্রে ডেভির ৪ টি সেমিনারে অংশ নেন। এগুলোর বিষয় ছিল রসায়নবিদ্যার একটা নতুন সমস্যা। সমস্যাটি হল এসিডের সংজ্ঞায়ন নিয়ে। ফ্যারাডে পরীক্ষণ ভিত্তিক বিজ্ঞানের উপর প্রচন্ড দূর্বল ছিলেন। এ কারণেই পরবর্তীতে তাঁর নাম অন্যতম একজন সফল ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের নামের তালিকায় উঠে এসেছিল। মাইকেল ফ্যারাডে সেমিনারে যে নোটটি করেছিলেন তার সাথে অনেক তথ্য যোগ করে তিনি তার হাতে লেখা নোটটি বাঁধাই করেন। তিনি দেখেছিলেন যে ডেভি সেমিনারের মাঝে বিভিন্ন পরীক্ষণ সম্পন্ন করছিলেন। এই জন্য তিনি সেমিনারের শেষে উৎসাহিত হয়ে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বাঁধাই করা নোটটি বই এর মতো করে হামফ্রে ডেভিকে উপহারস্বরুপ পাঠিয়ে দেন।

ফ্যারাডে এই সময়ে পেশাদার পরীক্ষণগুলোও সম্পন্ন করতে শুরু করে দেন। তার দোকানের পেছনেই একটি স্থানে তিনি একটি ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন, যাতে দস্তার পাত ও তামার মুদ্রা পরস্পর হতে আদ্র লবণাক্ত কাগজ দ্বারা পৃথক করা ছিল। ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের তড়িৎ বিশ্লেষণে তিনি তার এই ব্যাটারি ব্যবহার করতেন। ১৮১২ সাল পর্যন্ত ফ্যারাডে শিক্ষানবীশ হিসেবে সেই দোকানে কাজ করেন। তারপরেই ফ্যারাডের জীবনে আকস্মিক কিছু ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে তাঁর নতুন জীবনে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

স্যার হামফ্রে ডেভি ফ্যারাডের পাঠানো সেই বাঁধাই করা বইটা দেখে খুশি হয়েছিলেন। তিনি তখন থেকেই ফ্যারাডেকে চিনতেন। একদিন ডেভির ল্যাবরেটরিতে একটি পরীক্ষণ চলার সময় দুর্ভাগ্যবশত (ফ্যারাডের জন্য সৌভাগ্যবশত) একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে ডেভি গুরুতর আঘাত পান। এর ফলে তিনি সাময়িকভাবে লেখালেখি করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তাই তিনি ফ্যারাডেকে তার নোট করার জন্য কিছুদিনের জন্য ল্যাবরেটরিতে কাজ দেন। এই কাজের ফলে ডেভি ফ্যারাডের মেধা সম্পর্কে আরো ঘনিষ্টভাবে জানার সুযোগ পান। কিন্তু ডেভি সুস্থ হয়ে উঠলে ফ্যারাডেকে এই কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে দেয়া হয়।

কাজ শেষ করে ফ্যারাডে ডেভির ল্যাবরেটরিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করার আবেদন করেছি্লেন। এই ঘটনার কিছু আগে বা পরে ডেভির ল্যাবরেটরির একজন সহযোগীকে অসদাচারণের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তাই ডেভি ফ্যারাডেকে জানিয়েছিল যে ফ্যারাডে চাইলে তিনি ডেভির ল্যাবরেটরিতে কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারেন।

ফ্যারাডেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কাজটা নিতে চান কি না। রয়েল ইন্সটিটিউশানে পৃথিবীবিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর সাথে কি তিনি কাজ করতে চান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর 'হ্যাঁ' ছাড়া আর কিইবা হতে পারে! এই 'হ্যাঁ' এর মাধ্যমেই শুরু হল মাইকেল ফ্যারাডের নতুন জীবন।


রয়েল ইন্সটিটিউশানে ক্যারিয়ারঃ 

মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১ মার্চ ফ্যারাডে রয়্যাল ইন্সটিটিউশানে কাজ শুরু করেন। এখানে ফ্যরাডে পূর্বাপেক্ষা ভালোই বেতন পেতেন। রয়েল ইন্সটিটিউশান সংলগ্ন একটা চিলেকোঠায় তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফ্যারাডেকে নেয়া হয়েছিল ৫৪ বছরের চুক্তিতে। চুক্তি অনুসারে মেয়াদ শেষে ফ্যারাডে রসায়নের একজন অধ্যাপক হিসেবে বের হবার কথা।

যাই হোক, কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে ফ্যারাডে সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি তৈরি করতেন, যা রয়েল ইন্সটিটিউশানের বিভিন্ন প্রকার সেমিনার এবং পরীক্ষণে কাজে লাগত। সেখানে কাজ করার মাত্র ৭ মাসের মাথায় ডেভি ফ্যারাডেকে তার সেক্রেটারি হিসেবে দেড় বছরের লম্বা ভ্রমণে ইউরোপ নিয়ে যান। এই ভ্রমণে ফ্যারাডের সাথে পরিচয় ঘটে আন্দ্রে ম্যারি অ্যাম্পিয়ার এবং আলসান্দ্রো ভোল্টার সাথে। এদের নিকট হতে ফ্যারাডে তড়িৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন।

এত কিছুর পরেও মাইকেল ফ্যারাডে ব্যক্তিগতভাবে সুখী ছিলেন না। স্যার হামফ্রে ডেভির স্ত্রী তাঁর সাথে ব্যক্তিগত চাকরের মত ব্যবহার করতেন এবং ফ্যারাডেকে ডেভির সমতুল্য ভাবতে অস্বীকার করতেন। এর কারণ হল, ফ্যারাডের নিম্নবর্গের এবং নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ইউরোপের ভ্রমণ শেষে লন্ডনে ফিরে এলে রয়েল ইন্সটিটিউশান কর্তৃপক্ষ মাইকেল ফ্যারাডের বেতন বৃদ্ধি করে দেয় এবং চুক্তি নবায়ন করে। স্যার হামফ্রে ডেভিও ফ্যারাডের মেধা ও যোগ্যতার সম্মান করতেন এবং তার অনেক রিসার্চ পেপারেই তিনি মাইকেল ফ্যারাডের ঋণ ও কৃতজ্ঞতা অকপটে স্বীকার গেছেন।


উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহঃ 

১৮১৬ সালে ২৪ বছর বয়সে মাইকেল ফ্যারাডে তাঁর প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যর বিষয় ছিল পদার্থের বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম। এই বছরেই তিনি ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড নিয়ে তার একটি গবেষণাপত্র বের করেন, যা সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮২১ সালে যখন মাইকেল ফ্যারাডের বয়স মাত্র ২৯ বছর, সেই সময়েই তিনি রয়েল ইন্সটিটিউশানের আবাসিক ও ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি সারাহ বার্নাড নাম্নী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ফ্যারাডে আর রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের সেই চিলেকোঠায় ছিলেন না, তিনি পার্শ্বস্থ একটি পাকা দালানবাড়িতে জীবনের বাকি সময়ের অধিকাংশই কাটিয়ে দেন।

১৮২৪ সালে ৩২ বছর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির জন্য তিনি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এই সময়ই তিনি বিজ্ঞানীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন। পরের বছরই তিনি রয়্যাল ইন্সটিটিউশান ল্যাবরেটরির পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৮৩৩ সালে তিনি ব্রিটেন রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। যদিও '৪৮ ও '৫৮ সালে দুইবার তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব অফার করা হয়, তিনি সেই দায়িত্ব প্রত্যাখান করে রসায়নের অধ্যাপকের পদেই ফিরে যান। তাই মাইকেল ফ্যারাডে আমৃত্যু রয়েল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপকের পদে আসীন ছিলেন।


আবিস্কার ও উদ্ভাবনসমূহঃ 
১৮২১ সাল- তাড়িতচৌম্বকের যান্ত্রিক ক্রিয়া (মোটর)
১৮২৩ সাল- গ্যাস শীতলীকারক ও তরলীকারকের ধারণা দেন যার মূলনীতি ছিল মূলত ১৭৫৬ সালে উইলিয়াম কুলেনের দেয়া। ১৮৬২ সালে ফার্দিন্যান্ড ক্যাঁ ফ্যরাডের এই শীতলীকারক প্রদর্শন করেন।
১৮২৫ সাল- গ্যাসের তৈলাক্ত অবশেষ থেকে বেনজিন আবিস্কার
১৮৩১ সাল- তাড়িতচৌম্বকীয় আবেশ উদ্ভাবন (জেনারেটর)
১৮৩৪ সাল- তড়িৎ বিশ্লেষণ সম্পর্কিত ফ্যারাডের সুত্র।
১৮৪৫ সাল- ফ্যারাডে ইফেক্ট আবিস্কার (আলোক-চৌম্বক ক্রিয়া)
১৮৪৫ সাল- সকল পদার্থেরই মৌলিক ধর্ম হিসেবে ডায়াচৌম্বকত্ব আবিস্কার।

জীবনাবসানঃ
৭৫ বছর বয়সে ১৮৬৭ সালের ২৫ আগস্ট মাইকেল ফ্যারাডে মৃত্যুবরণ করেন। ফ্যারাডে- সারাহ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে জীবদ্দশায় একজন ধর্মপ্রাণ স্যান্ডাম্যানিয়ান খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বেই মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে তাকে সমাহিত করার। ব্রিটেনের রাজা- রাণী, আইজ্যাক নিউটন বা রাদারফোর্ডের মতো বিজ্ঞানীদের পাশে সমাহিত হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফ্যারাডে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত হবাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ড গেলে লন্ডনের হাইগেট সিমেট্রির নিকটে মাইকেল ফ্যারাডে ও সারাহ বার্ণাডের কবর দেখতে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ
১। শ্রেষ্ঠ আবিস্কার ও আবিস্কারকের গল্প by ইব্রাহীম খলিল।
২। http://famousscientists.org/michael-faraday
৩। http://en.wikipedia.org/wiki/Michael_Faraday
Category: articles

মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

আজ ৩০ আগস্ট।
১৮৭১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কিউই পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

রসায়ন থেকে পদার্থবিদ বনে যাওয়া বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড

নিউজিল্যান্ডের এই বিজ্ঞানী মূলত ছিলেন রসায়নবিদ। কিন্তু পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেন 'নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের জনক' হিসেবে । তিনিই সবার আগে ১৯১১ সালে আবিষ্কার করেন যে প্রতিটি পরমাণুর একটি চার্জিত ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস থাকে, যার চারপাশে থাকে বিশাল শূন্যস্থান। আর এই নিক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনরা সর্বদা বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই মতবাদ পরে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল (বা সৌর-মডেল) বলে পরিচিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে প্রোটন আবিষ্কার করার কৃতিত্বও তার। নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের অস্তিত্বের কথাও তিনিই প্রথম কল্পনা করেন। মৌলের ভাঙন ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের রসায়ন নিয়ে তার সফল গবেষণার জন্য তিনি ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

নিউজিল্যান্ডের নেলসন শহরের কাছে তৎকালীন স্প্রিং গ্রুভ (বর্তমান ব্রাইটওয়াটার) নামক স্থানে ক্ষুদ্র একটি কাঠের তৈরি বাড়িতে ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে রাদারফোর্ডের জন্ম। বাবা-মায়ের বারো সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তার মা মার্থা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং বাবা জেমস ছিলেন কৃষক। রাদারফোর্ড পরিবার প্রবল আর্থিক সংকটের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে কখনো দমে যাননি। বাল্যকালে হেভলক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর ১৬ বছর বয়সে নেলসন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৯ সালে বৃত্তিলাভ করে ওয়েলিংটনে ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ড এর ক্যান্টারবারি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৯৩ সালে গণিত এবং ভৌতবিজ্ঞানে দুইটি প্রথম শ্রেণিসহ এমএ পাশ করেন।

তিনি ক্যান্টারবারি কলেজে খুব অল্পকিছুদিনের জন্য গবেষণা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৮৯৪ সালে লাভ করেন স্নাতক ডিগ্রি। প্রতিটি পরীক্ষাতেই বৃত্তি নিয়ে ১৮৯৫ সালে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে এসে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। কাজ শুরু করেন জে জে থমসনের অধীনে, যিনি তার কিছুদিনের মাথায়ই ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন।

ক্যামব্রিজে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে রাদারফোর্ডের গবেষণা চালানোর সময় রাদারফোর্ড অনেক উন্নতমানের রেডিও ওয়েভ ডিটেক্টর তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন। অবশ্য পরবর্তীতে গবেষণা ছেড়ে অর্থ উপার্জনের এই পথে যেতে তাঁর মন সায় না দেওয়ায় তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। রাদারফোর্ড থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়াম এর তেজস্ক্রিয়তা থেকে দুটি ভিন্ন তেজস্ক্রিয়তার বর্ণনা দেন এবং তাদের যথাক্রমে আলফা ও বিটা নাম দেন। ১৮৯৭ সালে তাঁকে বিএ রিসার্চ ডিগ্রি এবং ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের কৌট-ট্রটার স্টুডেন্টশিপ প্রদান করা হয়।

১৮৯৮ সালের এপ্রিলে রাদারফোর্ড জানতে পারলেন যে কানাডার মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের চেয়ারটি খালি আছে। তিনি সেখানে আবেদন করে নিয়োগ পেয়ে গেলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে সেপ্টেম্বরে শেষদিকে তিনি মনট্রিলে এলেন এবং পরবর্তী ৯ বছর এখানেই থেকে গেলেন। ১৯০০ সালে তিনি ম্যারি জর্জিয়ানা নিউটনকে বিয়ে করেন। পরবর্তী বছর রাদারফোর্ড-ম্যারি দম্পতির ইলিন ম্যারি নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে রাদারফোর্ড মনট্রিলে তরুণ রসায়নবিদ ফ্রেডারিখ সোদির (যিনি ১৯২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন) সাথে একত্রে থোরিয়াম বিকিরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং প্রথাবিরোধী সিদ্ধান্ত নেন যে বিকিরণের মাধ্যমে এক পদার্থ অন্য পদার্থে পরিণত হয়। তার তেজস্ক্রিয়তার বিভেদ তত্ত্ব থেকে তিনি দেখান যে, তেজস্ক্রিয়তা কোনো আণবিক ঘটনা নয়, এটি একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়ার ঘটনা। তিনি আরো বললেন যে, তেজস্ক্রিয় মৌলের হ্রাসের হার সূচকীয় এবং যে সময় পরপর তেজস্ক্রিয় তীব্রতা আদি তীব্রতার অর্ধেক হয় তাকে অর্ধায়ু বলে।

এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি পৃথিবীর বয়স নির্নয় করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত পৃথিবীর বয়স ছিল সেই সময়ের বিজ্ঞানীদের অনুমিত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি। তেজস্ক্রিয়তার উপর তাঁর এই অসাধারণ কাজ তাকে নোবেল পুরস্কার (১৯০৮ সালে রসায়নে) এবং ম্যানচেস্টারে অধ্যাপক পদ দুটোই এনে দেয়। পারমাণবিক বোমার জনক বলে পরিচিত অটো হান রাদারফোর্ডের অধীনেই মনট্রিলের ল্যাবে ১৯০৫-০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন, যিনি পরবর্তীতে নিউক্লিয়ার ফিশান আবিস্কার করেন।

১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ড পদার্থবিদ্যার প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৮ সালের গ্রীষ্মে রাদারফোর্ড জার্মান বিজ্ঞানী গাইগারকে সাথে নিয়ে নিশ্চিত করলেন যে আলফা কণা হল দুটি ইলেকট্রন হারানো হিলিয়াম পরমাণু বা হিলিয়াম আয়ন। ১৯০৯ সালে তার অধীনেই হ্যানস গাইগার ও আর্নেস্ট মার্সডেন বিখ্যাত আলফা কণা বিক্ষেপণ (যা স্বর্ণপাত পরীক্ষণ নামেও পরিচিত) পরীক্ষণটি সম্পন্ন করেন। এই পরীক্ষা হতেই সর্বপ্রথম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ত্ব সম্বন্ধে অনুমান করা যায়।

আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা

এই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে পরমাণুর নতুন একটি মডেলের প্রস্তাব করেন। মডেলের বর্ণনামতে পরমাণুর কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র ধনাত্বক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস রয়েছে যাকে সার্বক্ষণিক প্রদক্ষিণ করছে ক্ষুদ্রতর ঋনাত্বক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। জে জে থমসনের দেয়া পরমাণুর কল্পিত চিত্রকে এই মডেল বাতিল করে দেয়। রাদারফোর্ফ তার মডেল নিয়ে এতটাই উচ্ছাসিত ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন,
Now I know what the atoms look like! It was nothing like Thomson.

১৯১২ সালে নিলস বোর রাদারফোর্ডের সাথে ম্যানচেস্টারে যোগ দেন। গুরু রাদারফোর্ডের দেয়া নিউক্লিয়াসের গঠনকে কোয়ান্টানাইজড করে বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম জগৎ উন্মোচন করেন যা আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত একটি তত্ত্ব। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বোর পরমাণুর কোয়ান্টায়ন করে সমাধান করেছিলেন। ১৯১৩ সালে রাদারফোর্ড এবং মোসলে ক্যাথোড রশ্মি দ্বারা বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর মাঝে সংঘর্ষ ঘটান এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্ণালী রেখা পান। এই পরীক্ষার পর থেকে মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা আসে যা দ্বারা প্রতিটি মৌলকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

১৯১৯ সালে রাদারফোর্ডকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদের অফার দেওয়া হলে তিনি ম্যানচেস্টার থেকে ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন এবং পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন। তাঁকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির সর্বকালের সেরা যোগ্য পরিচালক বিবেচনা করা হয়। একটা ছোট পরিসংখ্যান থেকে পরিচালক হিসেবে রাদারফোর্ডের দক্ষতা সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। তাঁর ল্যাবরেটরির ছাত্রদের মাঝে পরবর্তীতে ১১ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। নিলস বোর, জর্জ হ্যাভেস, চ্যাডউইক, পাওয়েল, ব্ল্যাকেট, সিজে ডারউইন সহ অনেক জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর ছাত্র এবং সহকর্মী ছিলেন।

১৯১৯ সালে তিনি তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াই কৃত্রিমভাবে এক মৌলকে অন্য মৌলতে পরিণত করে দেখাতে সক্ষম হন। তিনি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নাইট্রোজেন গ্যাসের মাঝে আলফা কণা চালনা করে অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করেন। গোল্ডস্টাইন ১৮৮৬ সালে একক ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট কণার স্রোত খুঁজে পেলেও পারমানবিক কণা হিসেবে রাদারফোর্ডই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রোটন আবিস্কার করেন। ১৯২১ সালে বোরের সাথে কাজ করার সময় রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াসের স্থায়ীত্ব ও ভর ঘাটতির ব্যাখ্যা দেবার সময় আধানহীন, একক ভরবিশিষ্ট একটি নিউক্লিয়নের কথা কল্পনা করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে বিজ্ঞানী বুথ ও বেকার খুঁজে পান এবং চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে একে নিউট্রন হিসেবে শনাক্ত করেন।

১৯১৪ সালে রাদারফোর্ডকে 'নাইট' উপাধি দেয়া হয়। ১৯২৫ সালে তিনি 'অর্ডার অব মেরিট' খেতাবও লাভ করেন। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি পদ লাভ করেন। এগুলোর মাঝে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য গবেষণা বিভাগের উপদেষ্টা মন্ডলীর চেয়ারম্যান, লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ক্যামব্রিজের রয়্যাল সোসাইটি মন্ড ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ অন্যতম। ১৯০৩ সালেই তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর বর্ণিল জীবনে অজস্র সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। তন্মধ্যে রামফোর্ড মেডেল, ফ্যারাডে মেডেল, কপলি মেডেল, ব্রেসা পুরস্কার, আলবার্ট মেডেলসহ অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রি এবং ডক্টরেট ডিগ্রি উল্লেখযোগ্য।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯৩৭ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে ক্যামব্রিজে নাড়ির অন্ত্রের অপারেশনের পরে খুব আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এর মাধ্যমে জীবনাবসান হয় একজন মহান ভৌত ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানীর। যুক্তরাজ্যর লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিনের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর অদূরেই সমাহিত আছেন মহাবিজ্ঞানী সার আইজাক নিউটন।

তথ্যসুত্রঃ
১। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_rutherford.html
২। http://www.famousscientists.org/ernest-rutherford/
Category: articles

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

আজ ১৫ আগস্ট।
১৮৯২ সালের এই তারিখে জন্মগ্রহণ করেন ফরাসী পদার্থবিদ লুই ডি ব্রগলি।

কোয়ান্টামতত্ত্ব নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজই সারা বিশ্বের নিকট তাকে পরিচিত করে তুলেছে। ১৯২৪ সালে তিনি তাঁর এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মের আবিস্কার করেছেন এবং প্রস্তাব করেন যে সকল পদার্থেরই তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে। এই কাজের জন্য ১৯২৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

পদার্থবিজ্ঞানী লুই ডি ব্রগলি

ব্রগলির বাবা-মায়ের বেঁচে যাওয়া ৪ সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন ৪র্থ। ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের দিপ্পে (Dieppe) শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার সামাজিক দিক থেকে অনেক উচ্চবংশীয় ছিল। তার বাল্যকালের পড়াশোনা বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের নিকট শুরু হয়। ১৯০৬ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই মরিস ডি ব্রগলির পরামর্শে ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম স্কুলে যান। স্কুল পাশ করার পর ইতিহাস নিয়ে লুই ডি ব্রগলির পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান, ফ্রেঞ্চ, দর্শন, ইতিহাস, রসায়ন ও গণিতে তার মত ভাল ছাত্র আর কেউ ছিল না। ১৯০৯ সালে ব্রগলি মাত্র ১৭ বছর বয়সেই দর্শন ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বড় ভাই মরিসের উৎসাহেই বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন লুই ডি ব্রগলি। ১৯১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানের উপর একটি ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তিনি ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাকে আইফেল টাওয়ারে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি এই স্থান হতেই বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং তরঙ্গ নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বড় ভাই মরিসের ল্যাবে তার সাথেই কাজ শুরু করেন ডি ব্রগলি।

মরিসের ল্যাবে ডি ব্রগলি যতগুলি কাজ করেছেন তার বেশিরভাগই ছিল এক্স-রশ্মি ও আলোর তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত। এইসব পরীক্ষণ হতেই ডি ব্রগলি আলোর কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave-partiucle dulaity) নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন। আরো ভালোভাবে বললে, 'যে কোনো কিছুর' কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। শীঘ্রই ১৯২৪ সালে ডি ব্রগলি পদার্থের কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে তত্ত্বটিকে তার পিএইচডি থিসিস পেপারে প্রস্তাব করলেন। সৌভাগ্যক্রমে এই থিসিস পেপার বিজ্ঞানী ল্যাংজেভিনের হাত হয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাতে এসে পড়ে। তিনি ডি ব্রগলির এই ধারণার অনেক বেশি প্রশংসা করেন। তরঙ্গ-বলবিদ্যার উত্থানে আইনস্টাইন এর এই প্রশংসা অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছিল।

কণা- তরঙ্গ দ্বৈততা

লুই ডি ব্রগলির এই তত্ত্ব পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের গতির হিসাব-নিকাশ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার সমাধান এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয়। কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে পৃথকভাবে জিপি থমসন, ক্লিনটন ডেভিসন এবং লেস্টার জারমারের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়। এ থেকে সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হয় যে পদার্থও তরঙ্গ ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। এই অসাধারণ কাজের জন্য ১৯২৯ সালে লুই ডি ব্রগলি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লুই ডি ব্রগলি তার ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর সরবোনেই অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত হেনরি পয়েনকেয়ার ইন্সটিটিউশনে ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি অবসরের যাবার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৫ সালে ডি ব্রগলি ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ইউনেস্কো প্রদত্ত কলিঙ্গ পুরস্কার লাভ করেন এবং ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির বৈদেশিক সদস্যপদ সাথে সাথে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমীর সদস্যপদ লাভ করেন। উনবিংশ শতকের শুরুতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিকাশে কণা-তরঙ্গের মিল প্ল্যাংক এবং আইনস্টাইনের হাত ধরে পরর বোর হয়ে লুই ডি ব্রগলির হাতে এসে পূর্ণতা পায়।

এই পূর্ণতাদানকারী বিজ্ঞানী ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ ফ্রান্সের ল্যুভেসিয়েনেসে (Louveciennes) মৃত্যুবরণ করেন। ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাও  লুই ডি ব্রগলির মত বিজ্ঞানীর জন্য খুব অল্প সময় হয়ত।

নোটঃ লুই ডি ব্রগলির নামের ফরাসি উচ্চারণ হল লুই দ্য ব্রোয়ি

তথ্যসূত্র:
১। http://www.famousscientists.org/louis-de-broglie/
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Louis_de_Broglie
৩। কণা তরঙ্গ, রেজা এলিয়েন, বর্ণায়ন, ঢাকা, ২০০৯
Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...