আমরা এতদিন জানতাম, মহাবিশ্বের নিপুণ কাঠামো টিকে আছে চারটি মৌলিক বলের কল্যাণে। এরা হল মহাকর্ষ, তড়িচ্চুম্বকীয় এবং সবল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল।
কিন্তু গত এপ্রিলে হাঙ্গেরির এক দল পদার্থবিদ সর্বপ্রথম সম্ভাব্য নতুন আরেকটি (পঞ্চম) মৌলিক বলের প্রমাণ পান। এই বলটির মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা মহাবিশ্বের অনেকগুলো রহস্যের সমাধান হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ডার্ক ম্যাটার রহস্যের সমাধানেরও ইঙ্গিত। ব্যপারটি ইদানিং আবারও আলোচনায় এল।
গত ১৪ আগস্ট ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইরভাইন) একটি দল একই মতের পক্ষ নিয়ে একটি গবেষণা- পত্র প্রকাশ করেন। তাঁরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সেই ফলাফলগুলো বিচার করে দেখলেন যে সত্যিই নতুন একটি বলের সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে। প্রধান গবেষক জোনাথন ফেং বলেন,
সত্য হয়ে থাকলে এটা হবে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার। আরো পরীক্ষার মাধ্যমে যদি এর সত্যতা পাওয়া যায় তবে পঞ্চম বলের এই আবিষ্কার মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল পাল্টে দেবে। মৌলিক বলদের একীভবন ও ডার্ক ম্যাটার গবেষণার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা থাকবে।
বিষয়টি প্রথম হাঙ্গেরিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এর এক দল গবেষকের নজরে আসে। তাঁরা উচ্চ-শক্তির প্রোটন রশ্মিকে লিথিয়াম- ৭ এর দিকে নিক্ষেপ করে ধ্বংসাবশেষের সাথে খুবই হালকা একটি অতিপারমাণবিক কণিকার দেখতে পান। তাঁরা এটাকে তখন একটি নতুন ধরনের বোসন কণিকা মনে করেছিলেন। এটা ছিল ইলেকট্রনের চেয়ে মাত্র ৩০ গুণ ভারী। কণাপদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এর কোনো পূর্বাভাস ছিল না। মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে এখন পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড মডেলের এক গুচ্ছ সমীকরণই সবচেয়ে মোক্ষম ভূমিকা পালন করছে।
আরো পড়ুনঃ
স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিচয়
আরো পড়ুনঃ
স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিচয়
স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, প্রত্যেকটি মৌলিক বলেরই নিজ নিজ বোসন কণিকা রয়েছে। সবল বলের বাহক হচ্ছে গ্লুওন, তড়িচ্চুম্বকীয় বলকে বহন করে আলোক কণা বা ফোটন এবং W ও Z বোসন করে দুর্বল নিউক্লিয় বল বহনের কাজ। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দুর্বলতা হল, আমরা এখনো মহাকর্ষের জন্যে কোনো বোসন কণিকা খুঁজে পাইনি। তবে অনুমান করা হচ্ছে মহাকর্ষের ক্ষেত্রে বল বহনের কাজটি করবে গ্র্যাভিটন নামক কণাটি। একে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও ডার্ক ম্যাটারের ব্যাখ্যা দিতেও ব্যর্থ স্ট্যান্ডার্ড মডেল।
হাঙ্গেরির দলটি প্রথমে মনে করেছিলেন, এই কণিকাটি হয়ত কোনো ধরনের ডার্ক ফোটন হবে। ডার্ক ম্যাটারের ক্রিয়া বহনকারী কল্পিত কণিকাকে বলা হয় ডার্ক ফোটন। তাঁদের গবেষণা প্রকাশের পর থেকেই বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ফেং বলেন,
উনারা দাবি করতে পারেননি যে এটা নতুন একটি মৌলিক বলের ফলে হয়েছে। তাঁদের মতে এই বাড়তি জিনিসটি ছিল একটি নতুন কণিকার প্রতিক্রিয়া, কিন্তু তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে এটা কি বস্তুকণা (matter particle) ছিল নাকি বলবাহী (force-carrying) কণা ছিল।
বিষয়টি আরো বিস্তারিত জানতে ফেং তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে প্রাথমিক উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করেন। পরীক্ষা করে দেখেন এই সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরীক্ষাগুলোও। এরপরই শক্তিশালী তাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেল যে এই নতুন প্রতিক্রিয়ার পেছনে বস্তুকণা বা ডার্ক ফোটন- কারোরই হাত নেই। বরং তাঁদের হিসাব- নিকাশ থেকে দেখা গেল যে এটা প্রকৃতির পঞ্চম বলের নিজস্ব বোসন হতে পারে। ডার্ক ম্যাটারসহ মহাবিশ্বের রহস্যময় নানান কিছুর ব্যাখ্যা এর মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।
কাল্পনিক নতুন এই বোসনকে আপাতত বলা হচ্ছে প্রোটোফোবিক এক্স। এর বিস্ময়কর দিক হল, এটি শুধু ইলেকট্রন এবং নিউট্রনের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে, তাও খুবই স্বল্প পাল্লায়, যার ফলে একে শনাক্ত করা খুবই কঠিন ছিল।
আরেক গবেষক টিমোথি টেইট বলেন,
এর আগে এই একই বৈশিষ্ট্যধারী কোনো বোসন কণিকা পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েনি। একে আমরা কখনো কখনো এক্স বোসন বলে থাকি, যেখানে এক্স অর্থ হল ‘অজানা’।‘
এই গবেষণাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মে মাসে। তখন এটি প্রকাশিত হয় প্রি-প্রিন্ট সাইট arXiv.org এ। কিন্তু এখন এর পিয়ার রিভিউ সম্পন্ন হবার পর এটি ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস এর মতো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
তাহলে এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত তা হল, আমরা একটি বিস্ময়কর কণা পেলাম, যাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তাত্ত্বিক হিসবা- নিকাশ বলছে এটি প্রকৃতির পঞ্চম মৌলিক বলের বাহক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এ বিষয়ে পরীক্ষামূলক প্রমাণ এখনো যথেষ্ট হয়নি। তবে সারা বিশ্বের গবেষকরা এর পেছনে লেগেছেন, যার ফলে আশা করা হচ্ছে এক বছরের মধ্যেই রেজাল্ট পাওয়া যাবে।
ফেং বলেন,
কণিকাটি ভারী না হলেও প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবত এমন হালকা কণিকা তৈরি করার মতো প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের হাতে আছে।
কণিকাটি খুব হালকা হবার কারণে এর প্রতিক্রিয়াও খুব দুর্বল। তবে সারা বিশ্বে গবেষকদের অনেকগুলো দল ছোট ছোট পরীক্ষাগারে কাজ করছেন। প্রাথমিক সেই ইঙ্গিতের কারণে সবাই এখন অন্তত এটুকু জানেন যে কোথায় খুঁজতে হবে।
কণিকাটি ভারী না হলেও প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবত এমন হালকা কণিকা তৈরি করার মতো প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের হাতে আছে।
কী হবে যদি সত্যিই পাওয়া যায় এই পঞ্চম বল? আমরা এখনো সেটা থেকে বেশ দূরে আছি। তবে ফেং বলছেন যে বলটি তড়িচ্চুম্বকীয় এবং দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বলের সাথে যুক্ত হয়ে একটি সুপার ফান্ডামেন্টাল বল গঠন করতে পারে- যে বলটি এর নিজস্ব কণা ও বলের মাধ্যমে ডার্ক সেক্টরে প্রতিক্রিয়া করতে পারে।
তিনি আরো বলেন,
হাঙ্গেরির এই পরীক্ষার ফলে হয়ত আমরা এই ডার্ক সেক্টরের বলকেই প্রোটোফোবিক বল হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। অন্য দিকে আবার ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি বোঝার জন্যে পরিচালিত গবেষণার সাথেও এই ফলাফলের মিল রয়েছে। স্টার ওয়ারস মুভি সিরিজের দি ফোর্স এর অন্ধকার (ডার্ক) ও আলোকীয় অংশের সাথেও মিল আছে এর।
হতে পারে এই দুটি সেকটর অজানা কোনো উপায়ে একে অপরের সাথে সম্পর্ক রেখে চলছে।
হাঙ্গেরির এই পরীক্ষার ফলে হয়ত আমরা এই ডার্ক সেক্টরের বলকেই প্রোটোফোবিক বল হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। অন্য দিকে আবার ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি বোঝার জন্যে পরিচালিত গবেষণার সাথেও এই ফলাফলের মিল রয়েছে। স্টার ওয়ারস মুভি সিরিজের দি ফোর্স এর অন্ধকার (ডার্ক) ও আলোকীয় অংশের সাথেও মিল আছে এর।
পুনশ্চ-১: এখন পর্যন্ত জানা মৌলিক বলসমূহ
প্রথম হল মহাকর্ষ। নিউটনের পর আইনস্টাইন তাঁর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষের উন্নত রুপ প্রদান করেন ১৯১৫ সালে। তত্ত্বটি প্রযোজ্য মহাবিশ্বের বড়ো স্কেলের কাঠামোর ক্ষেত্রে। এখানে মহাকর্ষকে তুলে ধরা হয়েছে স্থান- কালের বক্রতা হিসেবে।
দ্বিতীয় প্রকার মৌলিক বল হল তড়িচ্চুম্বকীয় বল। বৈদ্যুতিক চার্জধারী কণারা এই বলের মাধ্যমে কাজ করে। অণু ও পরমাণুর জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে এই বল।
তৃতীয় মৌলিক বল সবল নিউক্লিয় বলের (সংক্ষেপে শুধু সবল বল) কাজ হল পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠনকারী কণাগুলোকে একত্রে ধরে রাখা। আর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্যে দায়ী হল চতুর্থ মৌলিক বল দুর্বল নিউক্লিয় বল।
ম্যাক্সওয়েল, ফ্যারাডে ও ওয়েরেস্টেডদের হাত ধরে ১৮৩০ এর দশকে তড়িৎ ও চুম্বক বলকে একীভূত করা সম্ভব হয়। ১৮৬৪ সালে ম্যাক্সওয়েল বল দুটির সমন্বিত ক্ষেত্র তত্ত্ব (ফিল্ড থিওরি) প্রকাশ করেন। ম্যাক্সওয়েল দেখেছিলেন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ সব সময় একটি নির্দিষ্ট বেগে চলে। সেই বেগটি হয়ে দাঁড়াল আলোর বেগে সমান। আলোর বেগ ধ্রুব কেন তা তখন মাথায় না ঢুকলেও সেই ধ্রুবতা কাজে লাগিয়েই ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন স্থান- কালকে একত্র করে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব তৈরি করেন। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব সন্ধি করলেও সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব এখনো অন্য বলদের সাথে একমত হয়নি। ভাইল, কালুজা এবং স্বয়ং আইনস্টাইন নিজেও এর পেছনে সময় দিয়ে গেছেন, কিন্তু সফলতার মুখ মেলেনি এখনো।
অন্য দিকে ১৯৬০ এর দশকে শেলডন গ্যাশো, আব্দুস সালাম ও স্টিভেন উইনবার্গের হাত ধরে তড়িচ্চুম্বকীয় এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলকে একত্র করার থিওরি পাওয়া যায়। ১৯৭৩ সালে আসে তাঁদের মতের পক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ। সমন্বিত তত্ত্বটিকে এখন ইলেকট্রৈউইক থিওরি বলা হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে তাঁরা এ জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম সার্নের গবেষণাগারে ডাব্লিও এবং জেড বোসন তৈরি করা সম্ভব হয়।
ইলেকট্রোউইক থিওরিকে সবল বলের সাথে একই সাথে ব্যাখ্যা করার জন্যে গ্ল্যাশো ও জর্জি প্রথম একটি গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি দেন। পরে সালাম ও জোগেশ পাটিও একই রকম মডেল দাঁড় করান। তৈরি হয় এরকম আরও নানান মডেল। তবে এসব মডেলের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পেতে খুব উচ্চ শক্তির পরীক্ষার প্রয়োজন বলে তা এখনো সম্ভব হয়নি।
কিন্তু মহাকর্ষ এখনো অন্যদের সাথে সন্ধি করার কোনো রকম মানসিকতা দেখাচ্ছে না। এ অবস্থায় আরেকটি বল পাওয়া গেলে থিওরি অব এবরিথিং প্রস্তুত করতে খাটুনি একটু বাড়বে বৈকি। অবশ্য আগেই আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি যে একে অন্যদের সাথে মিলিয়ে নেওয়া মহাকর্ষের মতো কঠিন হবে না।
পুনশ্চ-২: নতুন মৌলিক বলটি সম্পর্কে এখনই শতভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। অনেক সময়ই এমন হয় যে তথ্য-উপাত্তকে ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে না পারার অভাবে ভুল জিনিসকে প্রমাণিত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। যেমন কিছু দিন আগেই গুঞ্জন উঠেছিল যে নতুন একটি মৌলিক কণিকা খুঁজে পাওয়া গেছে। আগস্টের শুরুতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্ন অফিসিয়ালি জানিয়ে দিয়েছে, তথ্যটা সঠিক নয়। আপাতত কোনো মৌলিক বল পাওয়া যায়নি।
২০১১ সালে সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে সার্নের গবেষণাগারে দুই দুইবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়, আলোর চেয়ে বেশি বেগ পাওয়া গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সন্দেহ যায়নি। পরে ২০১২ সালের মার্চে এসে দেখা যায়, পরীক্ষায় ভুল ছিল।
তবে মৌলিক বল খুঁজে পাবার এ ব্যাপারটি সেরকম নয় বলেই মনে হয়। অন্তত এর ভাবসাব দেখে তাই মনে হচ্ছে। কারণ এটি প্রতিষ্ঠিত কোনো কিছুর সরাসরি বিরুদ্ধে যাচ্ছে না। তাই আমরা চেয়ে থাকি নতুন কিছুর আশায়।
লেখাটি ইতোপূর্বে জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সংখ্যায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসেবে ছাপা হয়েছিল।
সূত্রঃ
১। http://earthsky.org/space/physicists-confirm-a-possible-5th-force
২। http://www.sciencealert.com/new-study-confirms-physicists-might-have-spotted-a-fifth-force-of-nature
৩। http://www.sciencealert.com/physicists-think-they-might-have-just-detected-a-fifth-force-of-nature
৪। http://arxiv.org/abs/1608.03591
৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Unified_field_theory#History