Advertisement

শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রাতের আকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তারাহল ধ্রুবতারা। এটি সব সময় উত্তর দিক বরাবর অবস্থান করে। যে অঞ্চলের অক্ষাংশ যত ডিগ্রি, এটি উত্তর দিগন্ত থেকে ঠিক ততটা উপরে অবস্থান করে। অন্য তারাদের মতো পশ্চিম দিকে যেতে থাকে না। বরং, অন্য তারাদের দেখে মনে হয়, ওরা সবাই একে কেন্দ্র করে ঘুরছে। 

ধ্রুবতারা খুঁজে পাবার উপায়ঃ
উত্তর আকাশের খুবই পরিচত তারামণ্ডলী হল সপ্তর্ষীমণ্ডলী। এর প্রধান উজ্জ্বল সাতটি তারার বাইরের দিকের দুটি নির্দেশক তারাকে যুক্ত করে প্রাপ্ত রেখাকে সামনের দিকে ছয়গুণ বাড়িয়ে দিলেই পাওয়া যাবে ধ্রুবতারা। 
এর বিষুব লম্ব +৮৯ ডিগ্র ১৬ সেকেন্ড, যার অর্থ এটি প্রায় উত্তর মেরুর বরাবর উপরে অবস্থান করছে। 
আরো পড়ুনঃ 



যেহেতু এটি সব সময় উত্তর দিকেই থাকে, তাই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ন্যাভিগেশনাল তারা। 
আরো পড়ুনঃ


এটি স্থির থাকে কেন? এটা বিস্তারিত বুঝতে হলে পড়ুনঃ

অনেকে একে শুকতারার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। শুকতারা কিন্তু বাস্তবে কোনো তারা নয়। এটি হল শুক্র গ্রহ।ঋতুভেদে এটি থাকে পূর্ব বা পশ্চিমের যথাক্রমে ভোরের বা সন্ধ্যার আকাশে। 
আরো পড়ুনঃ 

Category: articles
আজ ২৩ সেপ্টেম্বর। ১৮৪৬ সালের এই দিনে আবিষ্কৃত হয় সৌরজগতের অষ্টম ও সর্বশেষ গ্রহ নেপচুন। এই গ্রহটিকে আবিষ্কার করা হয় গাণিতিক হিসাবের ভিত্তিতে। অন্য গ্রহদের তুলনায় এর আবিষ্কার হয়েছে দেরিতে। এর কারণ কী জানেন?

রাতের আকাশের ৫টি গ্রহ সহজেই খালি চোখে ধরা দেয়। এগুলোর সাথে মানুষের প্রাচীন কাল থেকেই পরিচয় ছিল। সপ্তম গ্রহ ইউরেনাসও খালি চোখে দেখা সম্ভব যদি আপনি জানেন আকাশের কোন অংশে তাকাতে হবে, আর আকাশ যদি হয় পরিষ্কার এবং জায়গাটা (যেখানে দাঁড়িয়ে দেখবেন) হয় আলোক দূষণ থেকে মুক্ত এবং বেশ অন্ধকার। কিন্তু নেপচুনকে শুধু টেলিস্কোপ দিয়েই দেখা সম্ভব। আর টেলিস্কোপ যেহেতু মাত্র কয়েকশো বছর আগে জন্ম নিয়েছে তাই নেপচুনের আবিষ্কারও হয়েছে তুলনামূলক দেরিতে। 
নেপচুন গ্রহের ছবি
ফরাসী গণিতবিদ অ্যালেক্সি বুভার (Alexis Bouvard) ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে অনেকগুলো বিস্তারিত নথি প্রকাশ করেন। এক সময় সবাই বুঝতে পারল, আমাদের সৌরজগতের আরো গভীরে কোনো একটি গ্রহ থাকা উচিত যা ইউরেনাসের কক্ষপথে নাক গলাচ্ছে। শুরু হলো হিসাব নিকাশ। কোথায় থাকতে পারে গ্রহটি?

দুজন জ্যোতির্বিদ স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তাবিত ৮ম গ্রহটির গাণিতিক অবস্থান নির্ণয় করলেন। একজন ব্রিটেনের জন কাউচ অ্যাডামস। অপরজন ফরাসী জ্যোতির্বিদ উরবেই লা ভেরিয়ে। দুজনকেই সহকর্মীরা হতাশ করলেন। তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হল যে গাণিতিক হিসাব থেকে সত্যিই গ্রহ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

নেপচুন আবিষ্কারে ভূমিকা রাখা বিজ্ঞানীরা 

জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহান গ্যালের কাছে লা ভেরিয়ের হিসাব খুব মনঃপুত হল। তিনি খুঁজে বের করে ফেললেন সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ। নেপচুনকে পাওয়া গেল লা ভেরিয়ের প্রস্তাবিত অবস্থানের ১ ডিগ্রির মধ্যে। জন অ্যাডামসের প্রস্তাবিত অবস্থান থেকে গ্রহটির বিচ্যুতি ছিল ১২ ডিগ্রি। এবার দুজনেই দাবী করলেন, তিনিই প্রথম একে আবিষ্কার করেছেন। এটা নিয়ে সমগ্র বিজ্ঞান বিশ্বে তুমুল বিতর্ক হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কের প্রধান দুই পক্ষ ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। কাকে দেওয়া উচিত নেপচুন আবিষ্কারকের খেতাব- অ্যাডামস নাকি ভেরিয়ে? আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মহল দুজনকেই খেতাব দেয়ার পক্ষ দিলেন। ফলে, এখন তাই করা হয়। নেপচুনের আবিষ্কারক তাই দুজন- জন অ্যাডামস ও লা ভেরিয়ে। আবিষ্কারের সাল ১৮৪৬।

এখন পর্যন্ত নেপচুন গ্রহের কাছে পৌঁছতে পারা একমাত্র মহাকাশযান ভয়েজার ২, যা ১৯৮৯ সালে এর পাশ দিয়ে চলে যায়।  
বিভিন্ন গ্রহের তুলনামূলক সাইজ

সূত্রঃ
২। ইংরেজি উইকিপিডিয়াঃ ফরাসী উচ্চারণ
৩। http://earthsky.org/human-world/today-in-science-discovery-of-neptune
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আজ ২২ সেপ্টেম্বর। ১৭৯১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান শিক্ষা বা বিজ্ঞান চর্চা শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকত। নিম্নবিত্ত- দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা বিজ্ঞানচর্চায় অংশ নিতে পারত না। মাইকেল ফ্যারাডে সেই সময়ের একজন বিজ্ঞানী। তিনিও উঠে এসেছিলেন খুব দরিদ্র একটি পরিবার থেকে। তবুও তিনি সকল প্রতিকূলতা জয় করে হয়েছিলেন একাধারে জগদ্বিখ্যাত ব্যবহারিক পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং প্রকৃতি বিষয়ক দার্শনিক। তাঁর নামানুসারেই বৈদ্যুতিক ধারকত্বের এককের নাম রাখা হয়েছে ফ্যারাডে, যা F প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়।


১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মাইকেল ফ্যারাডে বর্তমান যুক্তরাজ্যর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেমস- মার্গারেট দম্পতির তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কামার এবং মা ছিলেন গৃহকর্মী। মোটকথা, মাইকেল ফ্যারাডের পরিবার নিম্নবিত্ত দরিদ্র জীবন-যাপন করত।

মাইকেল ফ্যারাডে তার গ্রামেরই একটি স্কুলে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এই স্কুল থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের দারিদ্যের কারণে তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে একটি বইয়ের দোকানে বই পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করেন। এই কাজে ফ্যারাডের কঠোর পরিশ্রম আর মনোযোগ দেখে বই এর দোকানের মালিক ফ্যারাডের উপর অনেক খুশি হন। এর ফলে তিনি ডেলিভারি বয় এর কাজ থেকে বাদ দিয়ে ফ্যারাডেকে বই বাঁধাই এর কাজ শেখার সুযোগ দেন। ফ্যারাডের বাল্যকাল শিক্ষানবীশ বই বাঁধাইকারী হিসেবেই শেষ হয়।


বিজ্ঞানের ছোঁয়াঃ

মাইকেল ফ্যারাডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা বন্ধ করে দিলেও পৃথিবী ও প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতুহল ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। দিনের পুরোটা সময় শুধু বই বাঁধাই করেই কাটাতেন না তিনি, সাথে সাথে যে বইগুলো বাঁধাই করতেন তা পড়েও ফেলতেন। ফ্যারাডে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, অন্য বইগুলোর চাইতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলো পড়তে বেশি ভালো লাগছে। কথিত আছে, ফ্যারাডের বই এর দোকানে এমন দু'টি বই আসে যা ফ্যারাডের অনেক ভালো লেগেছিল। বই দু'টি হল-

১। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ (The Encyclopedia Britannica)- ফ্যারাডের তড়িৎ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান এই বই থেকেই আসে।
২। Conversations on Chemistry (রসায়নের সহজ পাঠ)- সবার বোধগম্য করে জেন মাসেঁ কর্তৃক লিখিত রসায়নের একটি বই।

মাইকেল ফ্যারাডে এসব বই পড়ে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বই এর দোকানে কাজ করে যা সামান্য মাইনে পেতেন, তার অধিকাংশই তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির পেছনে খরচ করে ফেলতেন। এসব দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি কিনে মাইকেল ফ্যারাডে তার অবসর সময়ে পরীক্ষা করে দেখতেন যে, তিনি বই পড়ে যা শিখছেন তা কি আসলেই কাজ করে না কি না। এইজন্য মুখস্থ শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রায়োগিক শিক্ষার আন্দোলনে মাইকেল ফ্যারাডে একটা ভাল উদাহরণের নাম হতে পারে।

তিনি একদিন জানতে পারলেন যে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জন ট্যাটাম প্রাকৃতিক দর্শনের (মূলত পদার্থবিজ্ঞানের) উপর জনসম্মুখে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তব্য প্রদান করবেন। এই বক্তব্য শুনতে হলে প্রবেশ ফি দিতে হবে ১ শিলিং, যা দরিদ্র ফ্যারাডের জন্য অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। ফ্যারাডের বড় ভাই, যিনিও বাবার মত একজন কামার ছিলেন, তিনি ফ্যারাডের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে ঐ ১ শিলিং মুদ্রা দিয়েছিলেন। এর ফলে ফ্যারাডে ট্যাটামের সেই বক্তব্য শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে এভাবেই ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করে ফেললেন।

স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়: ফ্যারাডের নতুন জীবনঃ

উইলিয়াম ড্যান্স নামে ফ্যারাডের দোকানের এক খদ্দের ফ্যারাডের বিজ্ঞানভক্তির কথা জানতেন। তিনি একদিন ফ্যারাডেকে রয়েল ইন্সটিটিউশানে অনুষ্ঠিতব্য স্যার হামফ্রে ডেভির বক্তব্যর একটা টিকেট অফার করেন। স্যার হামফ্রে ডেভি ছিলেন তৎকালীন সময়ের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের একজন। ফ্যারাডে তাই এই অফার লুফে নিয়েছিলেন। স্যার হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়ের পর ফ্যারাডের বিজ্ঞানচর্চা আরো একধাপ উপরে উঠেছিল।

ফ্যারাডে এই সুযোগে হামফ্রে ডেভির ৪ টি সেমিনারে অংশ নেন। এগুলোর বিষয় ছিল রসায়নবিদ্যার একটা নতুন সমস্যা। সমস্যাটি হল এসিডের সংজ্ঞায়ন নিয়ে। ফ্যারাডে পরীক্ষণ ভিত্তিক বিজ্ঞানের উপর প্রচন্ড দূর্বল ছিলেন। এ কারণেই পরবর্তীতে তাঁর নাম অন্যতম একজন সফল ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের নামের তালিকায় উঠে এসেছিল। মাইকেল ফ্যারাডে সেমিনারে যে নোটটি করেছিলেন তার সাথে অনেক তথ্য যোগ করে তিনি তার হাতে লেখা নোটটি বাঁধাই করেন। তিনি দেখেছিলেন যে ডেভি সেমিনারের মাঝে বিভিন্ন পরীক্ষণ সম্পন্ন করছিলেন। এই জন্য তিনি সেমিনারের শেষে উৎসাহিত হয়ে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বাঁধাই করা নোটটি বই এর মতো করে হামফ্রে ডেভিকে উপহারস্বরুপ পাঠিয়ে দেন।

ফ্যারাডে এই সময়ে পেশাদার পরীক্ষণগুলোও সম্পন্ন করতে শুরু করে দেন। তার দোকানের পেছনেই একটি স্থানে তিনি একটি ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন, যাতে দস্তার পাত ও তামার মুদ্রা পরস্পর হতে আদ্র লবণাক্ত কাগজ দ্বারা পৃথক করা ছিল। ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের তড়িৎ বিশ্লেষণে তিনি তার এই ব্যাটারি ব্যবহার করতেন। ১৮১২ সাল পর্যন্ত ফ্যারাডে শিক্ষানবীশ হিসেবে সেই দোকানে কাজ করেন। তারপরেই ফ্যারাডের জীবনে আকস্মিক কিছু ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে তাঁর নতুন জীবনে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

স্যার হামফ্রে ডেভি ফ্যারাডের পাঠানো সেই বাঁধাই করা বইটা দেখে খুশি হয়েছিলেন। তিনি তখন থেকেই ফ্যারাডেকে চিনতেন। একদিন ডেভির ল্যাবরেটরিতে একটি পরীক্ষণ চলার সময় দুর্ভাগ্যবশত (ফ্যারাডের জন্য সৌভাগ্যবশত) একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে ডেভি গুরুতর আঘাত পান। এর ফলে তিনি সাময়িকভাবে লেখালেখি করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তাই তিনি ফ্যারাডেকে তার নোট করার জন্য কিছুদিনের জন্য ল্যাবরেটরিতে কাজ দেন। এই কাজের ফলে ডেভি ফ্যারাডের মেধা সম্পর্কে আরো ঘনিষ্টভাবে জানার সুযোগ পান। কিন্তু ডেভি সুস্থ হয়ে উঠলে ফ্যারাডেকে এই কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে দেয়া হয়।

কাজ শেষ করে ফ্যারাডে ডেভির ল্যাবরেটরিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করার আবেদন করেছি্লেন। এই ঘটনার কিছু আগে বা পরে ডেভির ল্যাবরেটরির একজন সহযোগীকে অসদাচারণের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তাই ডেভি ফ্যারাডেকে জানিয়েছিল যে ফ্যারাডে চাইলে তিনি ডেভির ল্যাবরেটরিতে কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারেন।

ফ্যারাডেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কাজটা নিতে চান কি না। রয়েল ইন্সটিটিউশানে পৃথিবীবিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর সাথে কি তিনি কাজ করতে চান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর 'হ্যাঁ' ছাড়া আর কিইবা হতে পারে! এই 'হ্যাঁ' এর মাধ্যমেই শুরু হল মাইকেল ফ্যারাডের নতুন জীবন।


রয়েল ইন্সটিটিউশানে ক্যারিয়ারঃ 

মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১ মার্চ ফ্যারাডে রয়্যাল ইন্সটিটিউশানে কাজ শুরু করেন। এখানে ফ্যরাডে পূর্বাপেক্ষা ভালোই বেতন পেতেন। রয়েল ইন্সটিটিউশান সংলগ্ন একটা চিলেকোঠায় তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফ্যারাডেকে নেয়া হয়েছিল ৫৪ বছরের চুক্তিতে। চুক্তি অনুসারে মেয়াদ শেষে ফ্যারাডে রসায়নের একজন অধ্যাপক হিসেবে বের হবার কথা।

যাই হোক, কেমিক্যাল সহযোগী হিসেবে ফ্যারাডে সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি তৈরি করতেন, যা রয়েল ইন্সটিটিউশানের বিভিন্ন প্রকার সেমিনার এবং পরীক্ষণে কাজে লাগত। সেখানে কাজ করার মাত্র ৭ মাসের মাথায় ডেভি ফ্যারাডেকে তার সেক্রেটারি হিসেবে দেড় বছরের লম্বা ভ্রমণে ইউরোপ নিয়ে যান। এই ভ্রমণে ফ্যারাডের সাথে পরিচয় ঘটে আন্দ্রে ম্যারি অ্যাম্পিয়ার এবং আলসান্দ্রো ভোল্টার সাথে। এদের নিকট হতে ফ্যারাডে তড়িৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন।

এত কিছুর পরেও মাইকেল ফ্যারাডে ব্যক্তিগতভাবে সুখী ছিলেন না। স্যার হামফ্রে ডেভির স্ত্রী তাঁর সাথে ব্যক্তিগত চাকরের মত ব্যবহার করতেন এবং ফ্যারাডেকে ডেভির সমতুল্য ভাবতে অস্বীকার করতেন। এর কারণ হল, ফ্যারাডের নিম্নবর্গের এবং নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ইউরোপের ভ্রমণ শেষে লন্ডনে ফিরে এলে রয়েল ইন্সটিটিউশান কর্তৃপক্ষ মাইকেল ফ্যারাডের বেতন বৃদ্ধি করে দেয় এবং চুক্তি নবায়ন করে। স্যার হামফ্রে ডেভিও ফ্যারাডের মেধা ও যোগ্যতার সম্মান করতেন এবং তার অনেক রিসার্চ পেপারেই তিনি মাইকেল ফ্যারাডের ঋণ ও কৃতজ্ঞতা অকপটে স্বীকার গেছেন।


উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহঃ 

১৮১৬ সালে ২৪ বছর বয়সে মাইকেল ফ্যারাডে তাঁর প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যর বিষয় ছিল পদার্থের বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম। এই বছরেই তিনি ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড নিয়ে তার একটি গবেষণাপত্র বের করেন, যা সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৮২১ সালে যখন মাইকেল ফ্যারাডের বয়স মাত্র ২৯ বছর, সেই সময়েই তিনি রয়েল ইন্সটিটিউশানের আবাসিক ও ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি সারাহ বার্নাড নাম্নী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ফ্যারাডে আর রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের সেই চিলেকোঠায় ছিলেন না, তিনি পার্শ্বস্থ একটি পাকা দালানবাড়িতে জীবনের বাকি সময়ের অধিকাংশই কাটিয়ে দেন।

১৮২৪ সালে ৩২ বছর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির জন্য তিনি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এই সময়ই তিনি বিজ্ঞানীদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন। পরের বছরই তিনি রয়্যাল ইন্সটিটিউশান ল্যাবরেটরির পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৮৩৩ সালে তিনি ব্রিটেন রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। যদিও '৪৮ ও '৫৮ সালে দুইবার তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব অফার করা হয়, তিনি সেই দায়িত্ব প্রত্যাখান করে রসায়নের অধ্যাপকের পদেই ফিরে যান। তাই মাইকেল ফ্যারাডে আমৃত্যু রয়েল ইন্সটিটিউশানের রসায়ন অধ্যাপকের পদে আসীন ছিলেন।


আবিস্কার ও উদ্ভাবনসমূহঃ 
১৮২১ সাল- তাড়িতচৌম্বকের যান্ত্রিক ক্রিয়া (মোটর)
১৮২৩ সাল- গ্যাস শীতলীকারক ও তরলীকারকের ধারণা দেন যার মূলনীতি ছিল মূলত ১৭৫৬ সালে উইলিয়াম কুলেনের দেয়া। ১৮৬২ সালে ফার্দিন্যান্ড ক্যাঁ ফ্যরাডের এই শীতলীকারক প্রদর্শন করেন।
১৮২৫ সাল- গ্যাসের তৈলাক্ত অবশেষ থেকে বেনজিন আবিস্কার
১৮৩১ সাল- তাড়িতচৌম্বকীয় আবেশ উদ্ভাবন (জেনারেটর)
১৮৩৪ সাল- তড়িৎ বিশ্লেষণ সম্পর্কিত ফ্যারাডের সুত্র।
১৮৪৫ সাল- ফ্যারাডে ইফেক্ট আবিস্কার (আলোক-চৌম্বক ক্রিয়া)
১৮৪৫ সাল- সকল পদার্থেরই মৌলিক ধর্ম হিসেবে ডায়াচৌম্বকত্ব আবিস্কার।

জীবনাবসানঃ
৭৫ বছর বয়সে ১৮৬৭ সালের ২৫ আগস্ট মাইকেল ফ্যারাডে মৃত্যুবরণ করেন। ফ্যারাডে- সারাহ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। মাইকেল ফ্যারাডে জীবদ্দশায় একজন ধর্মপ্রাণ স্যান্ডাম্যানিয়ান খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বেই মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে তাকে সমাহিত করার। ব্রিটেনের রাজা- রাণী, আইজ্যাক নিউটন বা রাদারফোর্ডের মতো বিজ্ঞানীদের পাশে সমাহিত হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফ্যারাডে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত হবাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ড গেলে লন্ডনের হাইগেট সিমেট্রির নিকটে মাইকেল ফ্যারাডে ও সারাহ বার্ণাডের কবর দেখতে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ
১। শ্রেষ্ঠ আবিস্কার ও আবিস্কারকের গল্প by ইব্রাহীম খলিল।
২। http://famousscientists.org/michael-faraday
৩। http://en.wikipedia.org/wiki/Michael_Faraday
Category: articles

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এ পর্যন্ত ১২ জন মানুষ চাঁদের বুকে হেঁটেছেন। আপনিও যদি তাদের মতো চাঁদে যেতে চান, তবে শীতের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা রাতে চাঁদের তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাংকের ১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। কিন্তু শুধু শীত থেকে বাঁচলেই চলবে না, গরম থেকে বাঁচারও প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা দিনের বেলায় চাঁদের তাপমাত্রা উঠে যেতে পারে ১০৭ ডিগ্রি (আরেকটি তথ্য মতে ১২৩ ডিগ্রি) পর্যন্ত।

চাঁদের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা 

চাঁদের তাপমাত্রা এত বেশি উঠা- নামা করে কেন? এর কারণ হল, চাঁদে পৃথিবীর মতো কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল কম্বলের মতো আচরণ করে। ধরে রাখে ভেতরে প্রবেশ করা উত্তাপ। সূর্যের আলো বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভেতরে এসে ভূমিকে উত্তপ্ত করে। পৃথিবী সেই তাপ শক্তিকে অবলোহিত বিকিরণ (infrared radiation) আকারে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এই বিকিরণ সহজে বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত থাকে।

অবলোহিত বিকিরণ বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যেতে পারে না কেন? এর কারণ হল আমরা খালি চোখে যেসব আলো দেখি তার মধ্যে লাল রঙ এর আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। আর অবলোহিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর চেয়ে একটু বেশি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হবার কারণে এর পক্ষে বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

চাঁদের সমস্যা আছে আরেকটিও। চাঁদ নিজের অক্ষের সাপেক্ষে একবার ঘুরতে ২৭ দিন সময় নেয়। ফলে চাঁদের কোনো জায়গা ১৩ দিনের কাছাকাছি সময় সূর্যের আলো পায়, বাকি সময়টা থাকে অন্ধকারে। সূর্যের আলো থাকার সময় চাঁদে যে তাপমাত্রা থাকে, তাতে সহজেই পানি বাষ্প হয়ে যাবে। আর সূর্য দিগন্তের নিচে তলিয়ে যাবার পর সাঁই করে তাপমাত্রা কমে যাবে ২৫০ ডিগ্রি।

আরো পড়ুনঃ
আবর্তন বনাম প্রদক্ষিণ
☛ চাঁদ কি আসলে আবর্তন করে?

ফলে চাঁদে যেতে হলে এমন পোশাক দরকার যাতে একই সাথে উত্তাপ তৈরির এবং শীতলীকরণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চাঁদের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কাছে কিছু খাদ আছে যারা অবিরাম ছায়ার মধ্যে থাকে, কখনো সূর্যের
মুখ দেখে না। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা সব সময় মাইনাস ১৫৩ ডিগ্রিই থাকে। আবার এর আশেপাশেই এমন কিছু পাহাড় চূড়া আছে যারা অবিরাম সূর্যের আলো পেতেই থাকে।

রাতের আকাশে চাঁদকে কত নিরীহ দেখায়, অথচ এর তাপমাত্রা যে এত ভয়ানক হতে পারে তা কে ভেবছিল। 

আরো পড়ুনঃ
চাঁদ কীভাবে আলো দেয়?
☛ পূর্ণিমা হয় কীভাবে?

সূত্রঃ
1. http://www.space.com/18175-moon-temperature.html
2. http://www.universetoday.com/19623/temperature-of-the-moon/
3. http://www.livescience.com/50260-infrared-radiation.html
Category: articles

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আলডেরামিন নক্ষত্রটি সিফিয়াস তারামণ্ডলীতে অবস্থিত। এই তারামণ্ডলীটি খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। তারামণ্ডলীটির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল একমাত্র নক্ষত্র হল আলডেরামিন। এর অপর নাম হল আলফা সিফিয়াই। নক্ষত্রটি অনেক দ্রুত বেগে আবর্তন করে।

জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদরা অপটিক্যাল ইনটারফেরোমিটার ব্যবহার করে নক্ষত্রটির নতি, মেরু ও বিষুব ব্যাসার্ধ এবং তাপমাত্রা বের করেন। 

সিফিয়াস তারামণ্ডলির দেখতে ঘরের মতো, আমরা ছোটবেলায় দোচালা ঘরের যেরকম চিত্র আঁকতাম ঠিক তেমন।  আকাশের এক কোণে এর অনেকগুলো ম্লান তারকার মধ্যে আলডেরামিন একমাত্র ব্যতিক্রম। ফলে এই তারাটিকে চিনে নেওয়া খুব সহজ কাজ। এর তীব্র আবর্তন বেগের কারণেও এটি খুব পরিচিত।

আরো পড়ুনঃ 
নক্ষত্র কাকে বলে?
তারামণ্ডলীর পরিচয়
আবর্তন ও প্রদক্ষিণের পার্থক্য

আলডেরামিনকে খুঁজে পাবার উপায়ঃ
তারাটির অবস্থান উত্তর আকাশে। একে খুঁজে পেতে কাজে আসবে ইংরেজি W বা M অক্ষরের মতো (অবস্থানের উপর ভিত্তি করে দুই রকমের যে কোনো রকম হতে পারে) দেখতে আরেকটি তারামণ্ডলী ক্যাসিওপিয়া।

ঋতুভেদে ক্যাসিওপিয়াকে কখনো উত্তর-পূর্ব দিকে, কখনো বা উত্তর- পশ্চিম দিকে, আবার কখনো মাথার উপর থেকে একটু উত্তরের অবস্থানে সোজা উত্তর দিকে থাকবে।  নভেম্বর মাসের রাত নয়টার দিকে ক্যাসিওপিয়াকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। এ সময় এটি থাকে উত্তর দিগন্ত থেকে সোজা উপরের দিকে। তারামণ্ডলীটির প্রধান অংশ (ডাব্লিউ বা এম আকৃতি) (+৬৫) থেকে (+৫৫) ডিগ্রি  বিষুব লম্ব জুড়ে অবস্থিত।  সব মিলিয়ে বছরের শেষ অর্ধেকের দিনগুলো একে খুঁজে পেতে বেশি সহায়ক। আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসেও সন্ধ্যা নামার পরেই এটি উত্তর- পূর্ব দিগন্ত দিয়ে উঁকি দিতে শুরু করে। 

ইংরেজি এম বা ডাব্লিউ আকৃতির ক্যাসিওপিয়া ও সিফিয়াস মণ্ডলী ।
সহজে বোঝার জন্যে ছবিটিকে রোটেট করা হয়েছে। 

ক্যাসিওপিয়াকে আমরা সহজেই পেয়ে যাব। এবার কাজ হল একে কাজে লাগিয়ে সিফিয়াস ও আলডেরামিনকে বের করা। দেখুন, ক্যাসিওপিয়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল উপরের তিনটি তারাকে দেখতে ইংরেজি ভি (V) অক্ষরের মত মনে হয়। এদের মধ্যে উপরের দুটি কাফ ও শেডার। শেডারকে কাফের সাথে যোগ করে সামনে চলে গেলেই পাওয়া যাবে আলডেরামিন। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পুরো সিফিয়াসকেও খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে।


আলডেরামিনের বৈশিষ্ট্যঃ 
এটি একটি সাদা নক্ষত্র। একে এ শ্রেণীর (Class A) তারা মনে করা হয়। বর্তমানে এটি প্রধান ধারা থেকে সাবজায়ান্ট ধাপে রূপ নিচ্ছে। প্রধান ধারার (main sequence) নক্ষত্ররা হাইড্রোজেনের ফিউসান ঘটিয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন করতে থাকে। আমাদের সূর্য একটি প্রধান ধারার নক্ষত্র। মনে করা হচ্ছে, আলডেরামিনের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে এটি রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানবে পরিণত হবে।

নক্ষত্র বিশেষজ্ঞ জিম কেলারের মতে আলডেরামিনের দীপ্তি সূর্যের ১৮ গুণ। অন্য দিকে এটি আবার খুব জোরে ঘুরছে। এটি ১২ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে একবার নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণন সম্পন্ন করে ফেলে, যেখানে কাজটি করতে আমাদের সূর্যের সময় লাগে প্রায় এক মাস।

আরো পড়ুনঃ 
☛ আবর্তন ও প্রদক্ষিণের পার্থক্য

জিম কেলার বলেন,
নক্ষত্রটির কাজের সাথে এই ঘূর্ণনের সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাদের সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র খুব সক্রিয়। তবে 'এ শ্রেণী'র নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে চৌম্বকক্ষেত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু আলডেরামিন সূর্যের প্রায় সমপরিমাণ এক্সরে বিকিরণ নির্গত করছে। এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকেও বোঝা যাচ্ছে এতে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র উপস্থিত। এর কারণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। 

তবে সিফিয়াসের আরো দুটি দানব নক্ষত্রের তুলনায় আলডেরামিন কিছুই নয়। এরা হল মিউ সিফিয়াই এবং ভিভি সিফিয়াই। এরা দুজনেই সুপারজায়ান্ট- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বৃহত্তম এবং উজ্জ্বলতম গ্যালাক্সিদের দলের সদস্য। হাজার হাজার সূর্যকে মিলিত করলেও এদের উজ্জ্বলতার কাছে তা ম্লান হয়ে যাবে। অবশ্যই এখানে আমরা নক্ষত্রের প্রকৃত উজ্জ্বলতা দা দীপ্তির কথা বলছি। দূরে অবস্থিত বলেই এরা পৃথিবীর আকাশে সূর্যের কাছে হেরে যাচ্ছে।


এদের কোনো একটিকে যদি সূর্যের জায়গায় বসানো হয়, তবে এরা বৃহস্পতির কক্ষপথ পর্যন্ত জায়গা দখল করে ফেলবে। এরা এত দীপ্তিমান হয়েও রাতের আকাশে তুলনামূলক অনুজ্জ্বল হবার কারণ হচ্ছে এরা পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। তবে তুলনামূলকভাবে আলডেরামিন খুব কাছে অবস্থিত- মাত্র ৪৯ আলোকবর্ষ।

আরো পড়ুনঃ
☛ আপাত উজ্জ্বলতা কাকে বলে? 


ইতিহাসে আলডেরামিনঃ
অতীতে এক সময় এটি ধ্রুব তারা ছিল। অর্থ্যাৎ, তখন এর অবস্থান ছিল আমাদের বর্তমান ধ্রুবতারা পোলারিসের জায়গায়, প্রায় উত্তর দিক বরাবর। সর্বশেষ এ অবস্থা ছিল ১৮, ০০০ খৃষ্টপূর্ব সালে। আরো ৫,৫০০ বছর পরে এটি আবার ধ্রুবতারার স্থান দখল করবে। ৭৫০০ সালের দিকে এটি প্রকৃত উত্তর দিক থেকে তিন ডিগ্রি দূরে থাকবে। এর অর্থ, আমাদের পোলারিস এর চেয়ে ভালো ধ্রুবতারা।  পোলারিস প্রায় বরাবর উত্তর দিকেই থাকে। এর বিষুব লম্ব (+৮৯) ডিগ্রির বেশি দেখেই সেটা অনুমান করা যায়।  ২১০০ সালে পোলারিস প্রকৃত উত্তর থেকে মাত্র ০.৪৫ ডিগ্রি দূরে থাকবে।

নামকরণঃ
আলডেরামিন শব্দটি এসেছে আরবি আযযিরা আল ইয়ামিন (الذ راع اليمين) থেকে। এর অর্থ হল 'ডান বাহু'। সিফিয়াস মণ্ডলীর নাম রূপকথার একজন রাজার নামে দেওয়া। ডান বাহু বলতে সেই রাজার ডান বাহু বোঝানো হচ্ছে।


সংক্ষিপ্ত প্রোফাইলঃ 
আপাত উজ্জ্বলতাঃ + ২.৫
দূরত্বঃ ৪৯ আলোকবর্ষ
বিষুব লম্বঃ +৬২.৫ ডিগ্রি
নামঃ আলফা সিফিয়াই


সূত্রঃ
১। http://earthsky.org/brightest-stars/alderamin-the-kings-brightest-star
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Alpha_Cephei
Category: articles

বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এ মাসে শুক্র, মঙ্গল ও শনি আছে সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে। মাসের শেষের দিকে ভোরের পূর্ব আকাশে বুধ উপস্থিত হবে। একে উত্তর গোলার্ধের আকাশপ্রেমীরা বেশি সহজে দেখবেন।

☛ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে দৃশ্যমান সবগুলো গ্রহই সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে ছিল। এদের মধ্যে দুটোকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এরা হল বুধ ও বৃহস্পতি।

☛ বুধ ও বৃহস্পতি মাসের শেষের দিকে চলে যাবে ভোরের পূর্ব আকাশে। কারণ, এরা দিন দিন সূর্যের আগেই উদিত হচ্ছে এবং অস্ত যাচ্ছে। এ কারণেই সন্ধ্যার আকাশ থেকে ভোরের আকাশে চলে যাচ্ছে।

☛ বাকি তিনটি গ্রহ- মঙ্গল, শুক্র এবং শনি পুরো মাসজুড়েই থাকছে সন্ধ্যার আকাশে।

☛ অনেক দিন পর শুক্র গত মাস থেকে পশ্চিম আকাশে হাজির হয়েছে। তবে এখনো দিগন্তের খুব কাছে। ফলে সন্ধ্যার কিছু পরেই ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্ত থেকে।

সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে শুক্র 

☛ তবে আগামী অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে একে আর বেশ সময় ধরে পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে।

☛ বৃহস্পতি মাসের শুরুতে পশ্চিম আকাশ থেকে হারিয়ে যাবার পর ভোরের পূর্ব আকাশে হাজির হবে অক্টোবরের কোনো এক সময়।

☛ মঙ্গল এখনো যথেষ্ট উজ্জ্বল, যদিও মে মাসের তুলনায় উজ্জ্বলতা কমেছে অনেকখানি।

☛ এর কাছাকাছিই আছে আরেক গ্রহ শনি। দুজনেই আছে উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্যেষ্ঠার কাছাকাছি।

বহু মাস ধরে মঙ্গল, শনি ও জ্যেষ্ঠ্যা খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে, অবস্থানের নড়চড় ঘটছে যদিও।  

সূত্রঃ
১। http://earthsky.org/astronomy-essentials/visible-planets-tonight-mars-jupiter-venus-saturn-mercury
Category: articles

সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬


জুনো মহাকাশযানের ক্যামেরায় ধরা পড়া বৃহস্পতি গ্রহের দক্ষিণ মেরুর ছবি 

২০০০ সালের দিকে ক্যাসিনি মিশনের সময় মহাকাশযান ক্যাসিনিও যেটা পারেনি, ২০১৬ সালের ২৭ শে আগস্টে এসে মহাকাশযান জুনো সেটাই করে দেখাল!

কারণ, বৃহস্পতি নামক গ্যাস দৈত্যখানার (gas giant) দক্ষিণ মেরু দেখিতে পারে নাই কেহ এযাবতকাল পর্যন্ত এতখানি চক্ষু মেলিয়া! (গুরু-চণ্ডালী দোষ মাফ করবেন, আবেগ ধরে রাখতে পারিনি)

অবশেষে মহাকাশযান জুনো এতদিনের এই অসাধ্য সাধন করে দেখাল এবং বৃহস্পতির দক্ষিণ মেরুর খুব পরিষ্কার একটি ছবি আমাদেরকে উপহার দিল।

এ সময় মহাকাশযান জুনো বৃহস্পতির মেরু অঞ্চল থেকে মাত্র ৫৮ হাজার ৭০০ মাইল উপরে ছিল।

এরই মাধ্যমে এই প্রথম বৃহস্পতির দক্ষিণ মেরু অঞ্চল সম্পর্কে এত স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া গেল! বৃহস্পতির বিষুবীয় অঞ্চলে যেমন পরিচিত "বেল্ট" বা "জোন" এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, মেরু অঞ্চলে ঠিক তেমনটা থাকে না। এখানে বরং বিভিন্ন আকারের ছোটখাটো ঝড়ের দাগ খুঁজে পাওয়া যায়। এই ঝড়গুলোর কোনটা ঘড়ির কাঁটার দিকে আবার কোনটা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে! এগুলো দেখতে অনেকটা পৃথিবীর "হ্যারিকেন" এর মত হয়।

২০০০ সালে মহাকাশযান ক্যাসিনি শনি গ্রহে যাবার পথে বৃহস্পতির মেরু অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অংশের ছবি তুলেছিলে। কিন্তু এতটা উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সেটি করা যায়নি।

সূত্রঃ
১। http://www.nasa.gov/image-feature/jpl/pia21032/jupiter-down-under
Category: articles
আজ ৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৭ সালের এই দিনে ভয়েজার ১ মহাকাশ যানকে সৌরজগতের বহিঃস্থ অঞ্চলের খোঁজখবর জানার জন্যে প্রেরণ করা হয়। এর যমজ যান ভয়েজার ২ এর ১৬ দিন পর ছাড়া হয় একে।

শিল্পীর তুলিতে ভয়েজার-১

১৯৬০ এর দশকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ‘মেরিনার প্রকল্প’ হাতে নেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বুধ, শুক্র এবং মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করা। সেই উদ্দেশ্যে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ১০টি অভিযান (মেরিনার ১ থেকে মেরিনার ১০) পরিচালনা করে নাসা। শুরুতে ভয়েজার ১ ছিল 'মেরিনার ১১' নামে মেরিনার প্রকল্পের অধীনে। কিছুদিন পর বাজেট ঘাটতির কারণে এই প্রকল্পটির কার্যক্রম শুধুমাত্র "বৃহস্পতি-শনির ফ্লাইবাই" এ নামিয়ে আনা হয় এবং নতুন প্রকল্পের নাম দেয়া হয় "মেরিনার জুপিটার-স্যাটার্ন প্রোব"।

এ প্রকল্পের কাজ এগোতে থাকলে ইতোমধ্যে "পাইওনিয়ার ১০" থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা বৃহস্পতির প্রতিকূল আবহাওয়া সম্পর্কে অবহিত হন এবং এই প্রকল্পের নাম ও কাজের ধারা আবারও পরিবর্তন করেন। এবার প্রকল্পটির নতুন নাম দেয়া হয় "ভয়েজার ১"। এই নতুন ভয়েজার ১ এর প্রকল্পের ডিজাইন ও কলাকৌশল পূর্ববর্তী অন্য যেকোনো মেরিনার প্রক্লপের চেয়ে আরও বেশি উন্নত করে করা হয়।

১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে টাইটান থ্রিই (Titan IIIE) নামক রকেট ইঞ্জিন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে উৎক্ষিপ্ত হয় ভয়েজার-১। ১৯৭৭ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে এটি মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অবস্থিত গ্রহাণু বেষ্টনিতে (asteroid belt) প্রবেশ করে। ১৯৭৭ সালের ১৯ ডিসেম্বরে এটি ওই অঞ্চলে থাকা দুই সপ্তাহ আগে উৎক্ষিপ্ত তার যমজ ভাই ভয়েজার ২ কে অতিক্রম করে।

১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ এটি বৃহস্পতির এলাকায় পৌঁছে। এ সময় এটি বৃহস্পতির উপগ্রহ আয়োর বুকে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির খোঁজ পায়। এবং এবারই প্রথম পৃথিবীর মানুষ প্রথমবারের মতো পৃথিবী ছাড়াও সৌরজগতের অন্য কোথাও সক্রিয় আগ্নেয়গিরির খোঁজ পেল।

বৃহস্পতির উপগ্রহ আয়োর বুকে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির

১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ভয়েজার-১ বৃহস্পতির এলাকা ছেড়ে শনির দিকে রওয়ানা দেয় এবং ১৯৮০ সালের ১২ নভেম্বর শনির সবচেয়ে কাছাকাছি যায়। এরপর ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরেই ভয়েজার-১ শনির এলাকা ছেড়ে দূর আকাশের দিকে পা বাড়ায়।

১৯৯৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী ভয়েজার-১ সূর্য থেকে ৬৯ এইউ দূরে থাকা "পাইওনিয়ার-১০" কে অতিক্রম করে মানুষের প্রেরিত সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তুতে পরিণত হয়। এ সময় এর বেগ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১৭ কিলোমিটার!!!
* এক এইউ হল পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব।
আরো পড়ুনঃ 
» পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত? 
» জ্যোতির্বিদ্যায় দূরত্বের এককেরা 

২০০৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী এটি টারমিনেশন শক এলাকা অতিক্রম করে এবং ২০১২ সালের জুনে হেলিওপজ এলাকায় প্রবেশ করে। ২০১২ সালের আগস্টে ভয়েজার-১ হেলিওপজ এলাকা পার হয়ে যায়। এ সময় এটি সূর্য থেকে প্রায় ১২১ এইউ দূরে ছিল এবং তখন এতে সূর্যের আলো পৌঁছতে সময় লাগত ১৬.৮৯ ঘন্টা!!!

২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নাসার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন যে ভয়েজার-১ আমাদের সৌরজগত ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এটি আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে প্রবেশ করেছে। ধারণা করা হয়, ২০২৫ থেকে '৩০ সালের মধ্যে এটি আমাদের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।

অনন্ত শূন্যতায় হারিয়ে গেলেও যদি কখনও এটি অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীদের হাতে পড়ে সে আশায় এতে উৎক্ষেপণের সময়ই সংযুক্ত করা হয়েছিল "গোল্ডেন রেকর্ড" বা "সোনালী স্মৃতি" নামক একটি গ্রামোফোন রেকর্ড। এতে পৃথিবীর কিছু ছবি, প্রাকৃতিক কিছু শব্দ এবং প্রায় ৫৫ রকম ভাষায় "সম্বোধন" রেকর্ড করা আছে, যার মধ্যে রক্তে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষাও একটি। ভয়েজার-১ এর কল্যাণে আমাদের মাতৃভাষা এখন আমাদের থেকে ২০.৩ বিলিয়ল কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে এবং যাচ্ছে আরও অনন্তের পথে।

গোল্ডেন রেকর্ড নামক গ্রামোফোন রেকর্ড
ভয়েজার ১ এর বর্তমান অবস্থা।
ছবিটি বড়ো করে দেখতে ছবির উপর বা  এখানে ক্লিক করুন। 

সূত্রঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Voyager_1
২। http://voyager.jpl.nasa.gov/
৩। ভয়েজার যান দুটির দূরত্বের আপডেট জানতে এই লিঙ্কে চোখ রাখুন।  
Category: articles

মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

আজ ৩০ আগস্ট।
১৮৭১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কিউই পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

রসায়ন থেকে পদার্থবিদ বনে যাওয়া বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড

নিউজিল্যান্ডের এই বিজ্ঞানী মূলত ছিলেন রসায়নবিদ। কিন্তু পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেন 'নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের জনক' হিসেবে । তিনিই সবার আগে ১৯১১ সালে আবিষ্কার করেন যে প্রতিটি পরমাণুর একটি চার্জিত ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস থাকে, যার চারপাশে থাকে বিশাল শূন্যস্থান। আর এই নিক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনরা সর্বদা বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই মতবাদ পরে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল (বা সৌর-মডেল) বলে পরিচিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে প্রোটন আবিষ্কার করার কৃতিত্বও তার। নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের অস্তিত্বের কথাও তিনিই প্রথম কল্পনা করেন। মৌলের ভাঙন ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের রসায়ন নিয়ে তার সফল গবেষণার জন্য তিনি ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

নিউজিল্যান্ডের নেলসন শহরের কাছে তৎকালীন স্প্রিং গ্রুভ (বর্তমান ব্রাইটওয়াটার) নামক স্থানে ক্ষুদ্র একটি কাঠের তৈরি বাড়িতে ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে রাদারফোর্ডের জন্ম। বাবা-মায়ের বারো সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তার মা মার্থা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং বাবা জেমস ছিলেন কৃষক। রাদারফোর্ড পরিবার প্রবল আর্থিক সংকটের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে কখনো দমে যাননি। বাল্যকালে হেভলক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর ১৬ বছর বয়সে নেলসন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৯ সালে বৃত্তিলাভ করে ওয়েলিংটনে ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ড এর ক্যান্টারবারি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৯৩ সালে গণিত এবং ভৌতবিজ্ঞানে দুইটি প্রথম শ্রেণিসহ এমএ পাশ করেন।

তিনি ক্যান্টারবারি কলেজে খুব অল্পকিছুদিনের জন্য গবেষণা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৮৯৪ সালে লাভ করেন স্নাতক ডিগ্রি। প্রতিটি পরীক্ষাতেই বৃত্তি নিয়ে ১৮৯৫ সালে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে এসে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। কাজ শুরু করেন জে জে থমসনের অধীনে, যিনি তার কিছুদিনের মাথায়ই ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন।

ক্যামব্রিজে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে রাদারফোর্ডের গবেষণা চালানোর সময় রাদারফোর্ড অনেক উন্নতমানের রেডিও ওয়েভ ডিটেক্টর তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন। অবশ্য পরবর্তীতে গবেষণা ছেড়ে অর্থ উপার্জনের এই পথে যেতে তাঁর মন সায় না দেওয়ায় তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। রাদারফোর্ড থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়াম এর তেজস্ক্রিয়তা থেকে দুটি ভিন্ন তেজস্ক্রিয়তার বর্ণনা দেন এবং তাদের যথাক্রমে আলফা ও বিটা নাম দেন। ১৮৯৭ সালে তাঁকে বিএ রিসার্চ ডিগ্রি এবং ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের কৌট-ট্রটার স্টুডেন্টশিপ প্রদান করা হয়।

১৮৯৮ সালের এপ্রিলে রাদারফোর্ড জানতে পারলেন যে কানাডার মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের চেয়ারটি খালি আছে। তিনি সেখানে আবেদন করে নিয়োগ পেয়ে গেলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে সেপ্টেম্বরে শেষদিকে তিনি মনট্রিলে এলেন এবং পরবর্তী ৯ বছর এখানেই থেকে গেলেন। ১৯০০ সালে তিনি ম্যারি জর্জিয়ানা নিউটনকে বিয়ে করেন। পরবর্তী বছর রাদারফোর্ড-ম্যারি দম্পতির ইলিন ম্যারি নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে রাদারফোর্ড মনট্রিলে তরুণ রসায়নবিদ ফ্রেডারিখ সোদির (যিনি ১৯২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন) সাথে একত্রে থোরিয়াম বিকিরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং প্রথাবিরোধী সিদ্ধান্ত নেন যে বিকিরণের মাধ্যমে এক পদার্থ অন্য পদার্থে পরিণত হয়। তার তেজস্ক্রিয়তার বিভেদ তত্ত্ব থেকে তিনি দেখান যে, তেজস্ক্রিয়তা কোনো আণবিক ঘটনা নয়, এটি একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়ার ঘটনা। তিনি আরো বললেন যে, তেজস্ক্রিয় মৌলের হ্রাসের হার সূচকীয় এবং যে সময় পরপর তেজস্ক্রিয় তীব্রতা আদি তীব্রতার অর্ধেক হয় তাকে অর্ধায়ু বলে।

এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি পৃথিবীর বয়স নির্নয় করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত পৃথিবীর বয়স ছিল সেই সময়ের বিজ্ঞানীদের অনুমিত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি। তেজস্ক্রিয়তার উপর তাঁর এই অসাধারণ কাজ তাকে নোবেল পুরস্কার (১৯০৮ সালে রসায়নে) এবং ম্যানচেস্টারে অধ্যাপক পদ দুটোই এনে দেয়। পারমাণবিক বোমার জনক বলে পরিচিত অটো হান রাদারফোর্ডের অধীনেই মনট্রিলের ল্যাবে ১৯০৫-০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন, যিনি পরবর্তীতে নিউক্লিয়ার ফিশান আবিস্কার করেন।

১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ড পদার্থবিদ্যার প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৮ সালের গ্রীষ্মে রাদারফোর্ড জার্মান বিজ্ঞানী গাইগারকে সাথে নিয়ে নিশ্চিত করলেন যে আলফা কণা হল দুটি ইলেকট্রন হারানো হিলিয়াম পরমাণু বা হিলিয়াম আয়ন। ১৯০৯ সালে তার অধীনেই হ্যানস গাইগার ও আর্নেস্ট মার্সডেন বিখ্যাত আলফা কণা বিক্ষেপণ (যা স্বর্ণপাত পরীক্ষণ নামেও পরিচিত) পরীক্ষণটি সম্পন্ন করেন। এই পরীক্ষা হতেই সর্বপ্রথম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ত্ব সম্বন্ধে অনুমান করা যায়।

আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা

এই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে পরমাণুর নতুন একটি মডেলের প্রস্তাব করেন। মডেলের বর্ণনামতে পরমাণুর কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র ধনাত্বক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস রয়েছে যাকে সার্বক্ষণিক প্রদক্ষিণ করছে ক্ষুদ্রতর ঋনাত্বক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। জে জে থমসনের দেয়া পরমাণুর কল্পিত চিত্রকে এই মডেল বাতিল করে দেয়। রাদারফোর্ফ তার মডেল নিয়ে এতটাই উচ্ছাসিত ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন,
Now I know what the atoms look like! It was nothing like Thomson.

১৯১২ সালে নিলস বোর রাদারফোর্ডের সাথে ম্যানচেস্টারে যোগ দেন। গুরু রাদারফোর্ডের দেয়া নিউক্লিয়াসের গঠনকে কোয়ান্টানাইজড করে বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম জগৎ উন্মোচন করেন যা আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত একটি তত্ত্ব। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বোর পরমাণুর কোয়ান্টায়ন করে সমাধান করেছিলেন। ১৯১৩ সালে রাদারফোর্ড এবং মোসলে ক্যাথোড রশ্মি দ্বারা বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর মাঝে সংঘর্ষ ঘটান এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্ণালী রেখা পান। এই পরীক্ষার পর থেকে মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা আসে যা দ্বারা প্রতিটি মৌলকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

১৯১৯ সালে রাদারফোর্ডকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদের অফার দেওয়া হলে তিনি ম্যানচেস্টার থেকে ক্যামব্রিজে ফিরে আসেন এবং পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন। তাঁকে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির সর্বকালের সেরা যোগ্য পরিচালক বিবেচনা করা হয়। একটা ছোট পরিসংখ্যান থেকে পরিচালক হিসেবে রাদারফোর্ডের দক্ষতা সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। তাঁর ল্যাবরেটরির ছাত্রদের মাঝে পরবর্তীতে ১১ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। নিলস বোর, জর্জ হ্যাভেস, চ্যাডউইক, পাওয়েল, ব্ল্যাকেট, সিজে ডারউইন সহ অনেক জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর ছাত্র এবং সহকর্মী ছিলেন।

১৯১৯ সালে তিনি তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াই কৃত্রিমভাবে এক মৌলকে অন্য মৌলতে পরিণত করে দেখাতে সক্ষম হন। তিনি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নাইট্রোজেন গ্যাসের মাঝে আলফা কণা চালনা করে অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করেন। গোল্ডস্টাইন ১৮৮৬ সালে একক ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট কণার স্রোত খুঁজে পেলেও পারমানবিক কণা হিসেবে রাদারফোর্ডই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রোটন আবিস্কার করেন। ১৯২১ সালে বোরের সাথে কাজ করার সময় রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াসের স্থায়ীত্ব ও ভর ঘাটতির ব্যাখ্যা দেবার সময় আধানহীন, একক ভরবিশিষ্ট একটি নিউক্লিয়নের কথা কল্পনা করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে বিজ্ঞানী বুথ ও বেকার খুঁজে পান এবং চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে একে নিউট্রন হিসেবে শনাক্ত করেন।

১৯১৪ সালে রাদারফোর্ডকে 'নাইট' উপাধি দেয়া হয়। ১৯২৫ সালে তিনি 'অর্ডার অব মেরিট' খেতাবও লাভ করেন। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি পদ লাভ করেন। এগুলোর মাঝে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য গবেষণা বিভাগের উপদেষ্টা মন্ডলীর চেয়ারম্যান, লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশানের প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ক্যামব্রিজের রয়্যাল সোসাইটি মন্ড ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ অন্যতম। ১৯০৩ সালেই তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর বর্ণিল জীবনে অজস্র সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। তন্মধ্যে রামফোর্ড মেডেল, ফ্যারাডে মেডেল, কপলি মেডেল, ব্রেসা পুরস্কার, আলবার্ট মেডেলসহ অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রি এবং ডক্টরেট ডিগ্রি উল্লেখযোগ্য।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯৩৭ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে ক্যামব্রিজে নাড়ির অন্ত্রের অপারেশনের পরে খুব আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এর মাধ্যমে জীবনাবসান হয় একজন মহান ভৌত ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানীর। যুক্তরাজ্যর লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিনের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর অদূরেই সমাহিত আছেন মহাবিজ্ঞানী সার আইজাক নিউটন।

তথ্যসুত্রঃ
১। http://www.physicsoftheuniverse.com/scientists_rutherford.html
২। http://www.famousscientists.org/ernest-rutherford/
Category: articles

রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬

জুনো মহাকাশযান বৃহস্পতির ঘূর্ণায়মান মেঘের মাত্র ২৫০০ মাইলের এর মধ্যে পৌঁছে গেল। এর আগে অন্য কোনো মহাকাশযানই গ্রহটির এত কাছে যেতে পারেনি।
বৃহস্পতির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া মহকাশযান 'জুনো'। 

নাসার বক্তব্য অনুসারে,
সবচেয়ে কাছে অবস্থানের সময় জুনো বৃহস্পতির ঘূর্ণায়মান মেঘের ২৫০০ মাইল (বা ৪২০০ কিমি.) উপরে ছিল। এ অবস্থায় এর বেগ ছিল গ্রহটির সাপেক্ষে ঘন্টায় ১৩০ হাজার মাইল। 

জুনোর সবগুলো যন্ত্রপাতি কার্যকর হবার পর গ্রহটির কাছ ঘেঁষে এটাই প্রথম ফ্লাইবাই। এই ফ্লাইবাইটি ছিল বৃহস্পতির উত্তর গোলার্ধের পাশ দিয়ে। যানটির গ্রহটিকে মোট ৩৬ বার ফ্লাইবাই করার কথা রয়েছে।বৃহস্পতির সম্পূর্ণ একটা ইমেজের জন্য প্রতিবার ফ্লাইবাই এর সময় এটি বৃহস্পতির আলাদা আলাদা এক একটি অঞ্চলের কাছ দিয়ে যাবে, যাত ওই সময় জুনো ওই এলাকার একটা পরিষ্কার ইমেজ তৈরি করতে পারে।

যানটির প্রথম ফ্লাইবাই এর সময় তোলা। এটি এখন পর্যন্ত বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছ থেকে তোলা ছবি
যানটি জুলাই মাসের ৪ তারিখে বৃহস্পতির কক্ষপথে প্রবেশ করে।

আরো পড়ুনঃ 
☛ এক নজরে বৃহস্পতি

ভিডিওতে জুনো মহাকাশযানঃ

Category: articles

শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬

শনির উপগ্রহ মাইমাস 

মাইমাস হল শনির একটি উপগ্রহ। ১৭৮৯ সালে উইলিয়াম হার্শেল এটি আবিষ্কার করেন। ছবিতে যে বিশাল খাদটি দেখা যাচ্ছে সেটার নামও রাখা হয়েছে তাঁর নামানুসারেই। এটি সৌরজগতের ২০তম বৃহত্তম উপগ্রহ। নিজস্ব মহাকর্ষের কারণে যেসব বস্তুরা গোলাকার আকৃতি পেয়েছে তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত জানা মতে এটিই সবচেয়ে ছোট বস্তু।
এই ছবিটি তুলেছে মহাকাশযান ক্যাসিনি, ২০১০ সালে।

আরো পড়ুনঃ
এক নজরে শনি গ্রহ
Category: articles

বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

আজকের তারিখ ২৪ আগস্ট। ১০ বছর আগের এই দিনে গ্রহের খাতা থেকে বাদ পড়ে যায় তৎকালীন নবম গ্রহ প্লুটো। তোলপাড় ওঠে পুরো পৃথিবীতে। অনেকেই বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি, এমনকি অনেক জ্যোতির্বিদও।

গ্রহের খাতা থেকে বাদ দেবার সময় বোঝা যায়, মানুষের কাছে প্লুটো বেশ জনপ্রিয় বস্তু। প্রথমবারের মতো নিউ হরাইজনস যান যখন তাই প্লুটো অভিযানে গিয়ে এতে হার্টের আকৃতি আবিষ্কার করে, ব্যাপারটি তখন পরিহাস হয়ে দাঁড়ায়। ছবিটি গ্রহের ৪৫০,০০ ০০০ কিমি. দূর থেকে তোলা।   

২০০৬ সালের এই দিনে নেপচুন হয়ে গেল সৌরজগতের সর্বেশেষ গ্রহ। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতির (IAU) দেওয়া গ্রহের নতুন সংজ্ঞা অনুসারে এল এ সিদ্ধান্ত। ২০০৬ সালের আগে কোনো বস্তুকে ভর বা আকারের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করবার কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিন্তু সৌরজগতের বাইরের অঞ্চলের দিকে হাউমেয়া ও মাকিমাকির মতো বস্তুরা আবিষ্কৃত হতে শুরু করলে এর প্রয়োজন অনুভব হওয়া শুরু হয়। ২০০৫ সালে আবিষ্কৃত এরিসের ভর আবার প্লুটোর চেয়ে বেশি। অতএব, প্লুটো গ্রহ হলে এরিস কেন হবে না?

এই প্রশ্নটিই আইএইউর মাথায় এল। এই প্রশ্নের সমধান করতে গিয়েই প্ল্যানেট ডেফিনিশান কমিটি বানানো হয়, যার ফলাফল- প্লুটোর অবনতি।

এই কমিটির সিদ্ধান্তেই বাদ পড়ে প্লুটো। সিদ্ধান্তটা অবশ্যই পরিস্থিতির দাবিই ছিল। 

কমিটির সামনে কয়েকটি রাস্তা ছিল। একটি রাস্তা ছিল ভর বা সাইজের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এক্ষেত্রে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে মেনে নিলে এরিস এবং সেরেসও (গ্রহাণু বেষ্টনির সবচেয়ে বড়ো বস্তু) তাহলে গ্রহ হয়। কিছু সময়ের জন্যে মনে হয়েছিল যে এই সিদ্ধান্তই হয়ত হবে।

আরেকটি উপায় ছিল যে নির্দিষ্ট কোন যুক্তি দিয়ে গ্রহের সংজ্ঞা দেওয়া হবে না। পৃথিবী একটি গ্রহ, প্লুটোও আরেকটি গ্রহ। এরিস গ্রহ নয়, কারণ আমাদের ইচ্ছা হয়নি তাই।

২০০৬ এর ২৪ আগস্ট তারিখে আইএইউ ফলাফল জানিয়ে দিল। ঠিক হল, গ্রহের জন্যে নতুন একটি সংজ্ঞা থাকবে। তিনটি শর্ত নিয়ে এই সংজ্ঞা তৈরি:
১। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে হবে
২। অভিকর্ষীয় বলের মাধ্যমে গোলাকার আকৃতি পাবার জন্যে যথেষ্ট ভর থাকবে
৩। কক্ষপথ থেকে অন্য বস্তুদের সরিয়ে দেবে।

আরো দেখুনঃ
গ্রহের পরিচয়
প্রদক্ষিণ বনাম আবর্তন

তিন নম্বর শর্তটিই প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে উৎখাত করেছে। কোনো বস্তুকে গ্রহ হতে হলে একে এর নিজস্ব কক্ষপথের আধিপত্য ধরে রাখতে হবে। অন্য বস্তুদেরকে হয় ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, নয়ত নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হবে।

প্লুটো এর কক্ষপথ অঞ্চলের মোট ভরের মাত্র ০.০৭ ভাগ নিজের করে রাখতে পেরেছে। অথচ পৃথিবীর কাছে রয়েছে নিজের কক্ষপথ অঞ্চলের অন্যান্য বস্তুর ভরের ১৭ লক্ষ গুণ ভর।

২০১৫ সালের ১৪ জুলাইয়ে প্লুটোর নিকটতম অবস্থানে পৌঁছার মাত্র ১৫ মিনিট পরে ছবিটি তোলে নিউ হরাইজনস। ১৮, ০০০ কিমি. দূর থেকে তোলা ছবিতে ধরা পড়েছে ১২৫০ কিমি. এলাকা। 

ঐ একই দিনে প্লুটোকে বামন গ্রহ পদবীতে ভূষিত করা হল। বামন গ্রহের জন্যেও একটি সংজ্ঞা ঠিক করা হল:
১। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরবে
২। অভিকর্ষীয় বলের মাধ্যমে গোলাকার আকৃতি পাবার জন্যে যথেষ্ট ভর থাকবে
৩। কক্ষপথের একচ্ছত্র মালিক হবে না
৪। কোনো উপগ্রহ হবে না

আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমতির মতে এখন পর্যন্ত বামন গ্রহ আছে পাঁচটি। এরা হল, প্লুটো, সেরেস, এরিস, হোমিয়া ও মাকিমাকি। তবে ষষ্ঠ বামন গ্রহ হিসেবে 2007 OR10 ছাড়াও আরো অনেক অনেক দাবিদার রয়েছে।

বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, বহিঃস্থ সৌরজগতের কাইপার বেল্ট অঞ্চলে শত শত অনাবিষ্কৃত বামন গ্রহ রয়েছে।

প্লুটোকে খোঁজা শুরু হয়েছিল কেন সেও এক মজার কাহিনী। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখছিলেন, কিছু একটা নেপচুনের কক্ষপথে বিকৃতি ঘটাচ্ছে। ১৯৩০ সালে আবিষ্কৃত না হয়ে যদি আরো এক দশক পরে এটি আবিষ্কৃত হত তাহলে কাইপার বেল্ট থাকার কারণে প্লুটো আর গ্রহ খ্যাতিই পেত না।

প্লুটোপ্রেমীরা হতাশ হলেও তাদের জন্যেও একটি সান্ত্বনা পুরস্কার রয়েছে। প্লুটো এ জন্যে বিখ্যাত যে একে কেন্দ্র করেই সৌরজগতের বস্তুরা একটি সংজ্ঞা পেয়েছে।

আরো পড়ুনঃ
প্লুটোর গ্রহত্ব হারানোর কাহিনী
Category: articles
এনজিসি ৫২৬৪ গ্যালাক্সি। ছবিঃ হাবল স্পেস টেলিস্কোপ 

এটি একটি বামন গ্যালাক্সি। পৃথিবী থেকে ১৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আকাশের হাইড্রা তারামণ্ডলীতে এর অবস্থান। এতে তারার সংখ্যা ১০০ কোটি। বলতে হবে যে ছায়াপথটি খুব গরীব, কারণ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এর একশ গুণ তারা আছে। অধিকাংশ ছায়াপথের আকার সর্পিল বা উপবৃত্তাকার হলেও এর আকার হচ্ছে অনিয়মিত (irregular)। জ্যোতির্বিদদের বিশ্বাস, এর আশেপাশে অন্যনায় গ্যালাক্সির উপস্থিতির কারণে এর আকৃতি এমন হয় গেছে।

আরো পড়ুনঃ
☛ আজকের ছবিঃ আর্কাইভ

সূত্রঃ
১। https://www.spacetelescope.org/images/potw1634a/
Category: articles

শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৬

আজকে আমরা দেখবো ব্ল্যাকহোল ভ্রমণ করতে গেলে আমাদের ভাগ্যে কী হবে? আমরা চাঁদে যেতে পারি, মঙ্গলে যেতে পারি। হয়ত কোন দিন সৌরজগৎ পেরিয়ে কোন ভিনগ্রহেও পাড়ি জমাতে পারি। আমরা না গেলেও নাসার মহাকাশযান ভয়েজার ১ এবং ২ তো ইতোমধ্যেই সৌরজগৎ পেরিয়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক জগতে বিচরণ করছে। এটা হতে পারে আমাদের দূর মহাকাশে যাবার একটি নিশানা।

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, সূর্যের চেয়ে অনেক বিশাল- সাধারণত সুপারজায়ান্ট জাতীয় নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের মাধ্যমে বহিরাবরণ ছুঁড়ে ফেলার পর বাকী অংশ গুটিয়ে গিয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। আর ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে তৈরি হয় সিঙ্গুলারিটি। এটি হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিশয় ক্ষুদ্র একটি বিন্দু।  এর দিকে আমরা যতই এগোবো, ততই মহাকর্ষের শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে অসীমের দিকে যেতে থাকবে এবং স্থান-কালের (Space-time) বক্রতাও ক্রমশ অসীমের দিকে ছুটবে। আর, ঠিক সিঙ্গুলারিটিতে স্থান-কাল আমাদের পরিচিত উপায়ে আর কাজ করবে না। তাহলে আমরা এতে গেলে কী ঘটবে?

একটি সরল ব্ল্যাক হোল নিয়ে চিন্তা করা যাক। ধরলাম, বিপুল পরিমাণ ভর থাকলেও এর কোন বৈদ্যুতিক আধান (Electric charge) বা ঘূর্ণন প্রবণতা নেই।

ব্ল্যাক হোলের বিভিন্ন অঞ্চল

ছবিতে ব্ল্যাক হোলের বিভিন্ন স্তর দেখা যাচ্ছে। সবুজ রঙ চিহ্নিত অঞ্চলটি হচ্ছে নিরাপদ অঞ্চল। এখানে আমাদের মহাকাশযান নিরাপদে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে কক্ষপথে অবস্থান করতে পারবো। চাইলে আমরা ফিরেও আসতে পারবো।  হলুদ অঞ্চলটি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে একটু গড়বড় হয়ে গেলেই আমরা ব্ল্যাক হোলের শিকার হয়ে যেতে পারি। তাই, এখানে মহাকাশযানে পাইলটকে অতিমাত্রায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। সেক্ষেত্রে, এখানেও মহাকাশযানের জন্যে একটি কক্ষপথের ব্যাবস্থা করা সম্ভব যদিও সেটা হবে অস্থিতিশীল (Unstable)।

কমলা রঙের অঞ্চল বিপদ সঙ্কেত প্রদান করছে। এখানে স্থিতিশীল বা অস্থিতিশীল- কোন রকম কক্ষপথই পাওয়া যাবে না। এখানে অবস্থান ধরে রাখতে হলে আমাদেরকে অবিরত জ্বালানী খরচ করে ব্ল্যাক হোলের বাইরের দিকে যানের ধাক্কা বজায় রাখতে হবে। এ অঞ্চলে আমরা যতই ভেতরের দিকে যাবো, ততোই রকেটের পরিশ্রম বাড়াতে হবে। লাল অঞ্চল ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত (Event horizon)। এখান থেকে ফিরে আসার কোন উপায় নেই।

ব্ল্যাক হোলের দিকে যাত্রা

উপরের ছবিতে একটি ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। আমাদের সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছার সময় মাপছে ঘড়িখানা- আমাদের প্রচলিত সময়ের হিসাব অনুযায়ী। কিন্তু আমরা যতই ভেতরে যাবো, সময় ধীরে চলার কারণে ঘড়ির কাঁটার গতি কমে যাবে।

এখন ধরা যাক এবার আমরা সবুজ অঞ্চল থেকে ভেতরে পা বাড়ালাম। সাথে সাথে আমাদের চোখে পড়বে ব্ল্যাক হোল বাইরের নক্ষত্রের আলোকে এর সীমানায় এনে বৃত্তাকার কক্ষপথে স্থান দিয়েছে। এটা আসলে গ্র্যাভেটেশনাল লেন্সিং এর প্রতিক্রিয়া।  ব্ল্যাক হোল স্থান-কালকে বাঁকিয়ে ফেলায় আমরা একই সাথে এর সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিক দেখতে পাবো। যেমন, ছবিতে ব্ল্যাক হোলের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু একই সাথে দেখা যাচ্ছে। লাল ফেব্রিক চিহ্নিত এই অঞ্চলই ব্ল্যাক হোলের সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ।
সোয়ার্জাসাইল্ড ব্যাসার্ধই হল ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তের সীমানা, যার ভেতর থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না, কোন কিছু দেখা যায় না।

আরো পড়ুন
গ্র্যাভেটেশনাল লেন্সিং কীভাবে ঘটে?
ব্ল্যাক হোল কত বড়ো হয়? (এখানে সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে)

৩ সোয়ার্জসাইল্ড দূরত্বে আমাদের কক্ষপথ সম্পূর্ণ নিরাপদ। এখানে যতক্ষণ আছি- আমরা নিরাপদ। চাইলে আবার ফিরে আসতে পারবো। যখন এটা পাড়ি দিয়ে ২ সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধে পৌঁছবো, এবার অবস্থান হয়ে যাবে ভারসাম্যহীন। এখানে যানের জ্বালানি খরচে একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই আমার হয় সোজা ব্ল্যাক হোলের দিকে চলে যাবো অথবা উল্টোদিকে- বাইরের দুনিয়ায় ধেয়ে আসবো।


এই অঞ্চলেই ফোটন স্ফিয়ার তথা আলোকমণ্ডলের (Photon sphere) অবস্থান। এখানে স্বয়ং আলো অবিরত কক্ষপথে ঘুরপাক খেতে থাকে। এটাই ছিল আমাদের প্রথম পর্বের প্রশ্ন। আশা করি, উত্তর পেয়ে গেছেন। এটাই ব্ল্যাক হোলের নিকটতম দূরত্ব যেখানে কোনো কিছু কক্ষপথ পেতে পারে। আমরা যদি এখানে (ফোটন স্ফিয়ারে) আমাদের যানকে ধরে রাখতে চাই তাহলে অসীম জ্বালানি খরচ করতে হবে।
এবার আমরা প্রবেশ করবো ১ সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধ পাড়ি দিয়ে দিগন্তের দিকে।



এখানেই ঘটবে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। লাল ঘটনা দিগন্ত দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যাবে- দিগন্ত এবং প্রতি দিগন্ত (Horizon, anti-horizon)। আমরা দিগন্ত ভেদ করলে আসল দিগন্ত আমাদের চোখে দৃশ্যমান হবে। অন্য দিকে, প্রতি-দিগন্ত আমাদের সামনেই থেকে যাবে। একে আমরা কখোনই অতিক্রম করে যেতে পারবো না। আচ্ছা, ব্ল্যাক হোলের ভেতরে চলে গেলে কি আমরা অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবো? এটা ভুল ধারণা। আমরা যতই ভেতরে যাবো, বাইরের বিশ্ব ততোই উজ্জ্বল মনে হবে।

ব্ল্যাক হোলের ভেতরে অন্ধকার নয়, বরং অনেক অনেক আলোকিত দেখাবে

এরপর আমরা আরো ভেতরে গেলাম। কী হবে- একটু পর বলছি। কিন্তু আমরা কখোনই সিঙ্গুলারিটিত দেখতে পারবো না। কেননা, কোন আলোই এর থেকে বাইরের দিকে আসতে পারে না। সব চলে যায় এর পেটের ভেতর।

আমরা কখোনই আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য তথা সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছবো না। কেন? আচ্ছা, বিস্তারিত বলছি।
মনে করুন আপনি নভোযানে চড়ে একে আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাক হোলটির দিকে চালিয়ে দিলেন। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলেন ব্ল্যাক হোলের তীরে । এবার যান বন্ধ করে দিলেন। কী ঘটবে?
প্রথমে এর মহাকর্ষ একেবারেই অনুভব করবেন না। যেহেতু আপনি মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মত করে বিনা বাধায় পড়ছেন, আপনার দেহের প্রত্যেকটি অংশ এবং তোমার নভোযান- সব কিছুই একইভাবে ব্ল্যাক হোলের দিকে ধাবিত হবে। অনুভব হবে ওজোনহীনতা। পৃথিবীর চারদিকে কৃত্রিম উপগ্রহে বসবাসরত নভোচারীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যদিও পৃথিবীর অভিকর্ষ নভোচারী এবং স্পেইস শাটল- দুটোকেই টানছে, তবু এরা কোন অভিকর্ষ বল অনুভব করে না, কারণ সব কিছু ঠিক একইভাবে টান অনুভব করছে।

ব্ল্যাক হোলের যতই কাছাকাছি হবেন, আস্তে আস্তে এর মহাকর্ষজনিত শক্তিমত্তা অনুভূত হতে থাকবে। মনে করুন, আপনার পা আপনার মাথার চেয়ে ব্ল্যাকহোলের নিকটবর্তী। ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্র থেকে কোন বস্তু যত বেশি কাছে থাকবে, তার উপর এর আকর্ষণও তত প্রকট হবে। এবার ভাবুন, আপনার পা কিন্তু মাথার চেয়ে দানবের মুখের বেশি কাছে। ফলে, ব্ল্যাক হোল আপনাকে টেনে লম্বা বানিয়ে দেবে।

ব্ল্যাক হোলের কাছে গেলে মাথা ও পায়ের প্রতি মহাকর্ষীয় আকর্ষের তারতম্যের কারণে এক অংশ লমাব হয়ে এমন সেমাইয়ের মতো হয়ে যাবে। 

যতই কাছে যাবেন, পা ও মাথার প্রতি ব্ল্যাক হোলের অসম আকর্ষণের মাত্রা বাড়তেই থাকবে।
কেমন হবে, যদি আপনার পায়ের দৈর্ঘ্য হয়ে যায় ১০ ফুট বা ১০০ ফুট। আরো মারাত্মক কথা হলো, পাতো শুধু লম্বাই হবে না, এক সময় দেহ থেকে আলাদাই হয়ে যাবে। ভয় লাগছে?

তবে, উপরোক্ত বিপদ কাটানোর একটি উপায় আছে বটে! বলছি পরে। আপনার ব্ল্যাক হোল অভিযানের স্বপ্নের কিন্তু সমাপ্তি ঘটে যায়নি। হতাশ হবেন না!

আপনি যদি অভিযানের জন্যে একটি বড় ব্ল্যাক হোল বেছে নেন, তাহলে এর কেন্দ্র থেকে ৬ লক্ষ কিলোমিটার দূরত্বের না যাওয়া পর্যন্ত লক্ষ্যণীয় প্রভাব অনুভূত হবে না। এটা হলো এর ঘটনা দিগন্তের সীমানা। কিন্তু আপনি যদি একটি ছোট, মনে করুন সূর্যের কাছাকাছি ভরের, একটি ব্ল্যাক হোল বাছাই করেন, তাহলে আপনি এর কেন্দ্রের ৬ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছতেই কাছে অসহনীয় অবস্থা অনুভূত হবে। এই ক্ষেত্রে, ঘটনা দিগন্তে পৌঁছার আগেই আপনি টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন। এই জন্যেই ব্ল্যাক হোল অভিযানে যেতে চাইলে বড়োসড়ো কোন ব্ল্যাক হোল বাছাই করাই নিরাপদ। ভেতরে গিয়ে অন্তত পৌঁছতে না পারলেতো অভিযান শুরুই হলো না!

ব্ল্যাক হোলে পতনের সময় আপনি কী দেখবেন?

মজার ব্যাপার হলো, আপনি যে বিশেষ মজার কিছু দেখে ফেলবেন- এমন কিন্তু না। আপনি যদি দূরের কোন দৃশ্য দেখতে যান, তবেই লাগবে বেখাপ্পা। বস্তুর চেহারা বিকৃত দেখাবে, কারণ ব্ল্যাক হোল এর অভিকর্ষের প্রভাবে আলোকে বাঁকিয়ে এনে আপনার চোখে ফেলবে। কাঁচের পানির গ্লাসের ভেতর দিয়ে কখনো বিপরীত দিকে তাকিয়েছেন নিশ্চয়ই? কেমন দেখায়? এবড়োথেবড়ো বিম্ব, তাই না? একই প্রভাব পরিলক্ষিত হবে এখানেও। কিন্তু ঐটুকুই। ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করার সময় আর বিশেষ কিছু ঘটবে না।

ঘটনা দিগন্ত ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করার পরেও আপনি বাইরের দৃশ্য দেখতে পাবেন। কারণ, তখনো বাইরের আলো আপনার কাছে পৌঁছতে পারবে। তবে, এখন বাইরের কেউ আপনাকে দেখতে পাবে না। কারণ, আপনার দেহ থেকে আসা আলো ঘটনা দিগন্তকে ভেদ করতে পারছে না।

এই সব কিছু ঘটতে কতক্ষণ লাগবে? ব্যাপারটা নির্ভর করে আপনার যাত্রা শুরুর অবস্থানের ওপর। মনে করুন, আপনি এমন জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করলেন, যা ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এর সোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধের ১০ গুণ দূরে অবস্থিত। তাহলে, প্রায় ১০ লাখ সৌর ভরের সমান ভরযুক্ত ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করতে আপনার সময় লাগবে প্রায় ৮ মিনিট। এই সীমানা পার হবার পরে, কেন্দ্রে পৌঁছতে আপনার আর মাত্র ৭ সেকেন্ড সময় লাগবে। ব্ল্যাক হোলের আকার বড়ো- ছোট হবার সাথে সাথে এই সময়ও কম বেশি হবে।

ঘটনা দিগন্ত পার হবার পরবর্তী ৭ সেকেন্ডে আপনার ভয় লাগা শুরু হতে পারে। আপনি হয়তো ভয় পেয়ে আপনার নভোযানকে পেছনে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা চালাবে, যাতে কেন্দ্রে যেতে না হয়। কিন্তু হায়! বৃথা চেষ্টা। কেন্দ্রে পৌঁছা ছাড়া যে উপায় নেই। কী আর করা, এই শেষ সময়টুকু উপভোগ করে নেওয়াই ভালো।
এতো গেল আপনার কথা। মনে করুন, আপনার এক প্রিয় বন্ধু (নাম দিলাম জায়েদ) আপানকে বিদায় জানাবার জন্যে ঘটনা দিগন্তের ওপারে অপেক্ষা করছিল। ও কী দেখবে? আসলে, ও আপনার চেয়ে সম্পুর্ণ ভিন্ন দৃশ্য দেখবে। আপনি দিগন্তের যত কাছাকাছি হবেন, ততই ওর কাছে মনে হবে, আপনার গতিবেগ কমে যাচ্ছে। ও যদি কেয়ামত পর্যন্তও অপেক্ষা করতে থাকে, তবু আপনাকে কোনো দিনই ঘটনা দিগন্ত পাড়ি দিতে দেখবে না ।

সত্যি বলতে, প্রথমে ব্ল্যাক হোল যে পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়েছিল তার সম্পর্কে কম বেশি- একই কথা বলা চলে। একটি সংকোচনশীল (Collapsing) নক্ষত্র থেকে সৃষ্ট ব্ল্যাক হোলের কথা ধরা যাক। ব্ল্যাক হোল গঠিত হবার জন্যে যখন এর উপাদানগুলো সঙ্কুচিত হতে থাকবে, জায়েদ একে ক্রমেই ছোট হয়ে যেতে দেখবে। ওর চোখে এর ব্যাসার্ধ আস্তে আস্তে স্কোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধের নিকটবর্তী হতে থাকবে, কিন্তু কখনো এর সমান হবে না। এই কারণেই আগে ব্ল্যাক হোলকে হিমায়িত নক্ষত্র (Frozen star) বলা হতো। কারণ, এরা স্কোয়ার্জসাইল্ড ব্যাসার্ধের কিছুটা বড়ো ব্যাসার্ধ্যে এসে জমে যায়।

ও এমন দেখবে কেন? আসলে এটা একটি আলোকীয় দৃষ্টিভ্রম (Optical illusion)। ব্ল্যাক হোল গঠিত হবার জন্যে যেমন অসীম সময়ের দরকার হয় না, তেমনি ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত ভেদ করতেও এত সময় লাগে না। আপনি দিগন্তের যত কাছাকাছি হবেন, আপনার কাছ থেকে আসা আলো জায়েদের কাছে পৌঁছতে ক্রমেই বেশি সময় লাগতে থাকবে। অন্য দিকে, আপনি দিগন্ত পাড়ি দিয়ে ভেতরে যাবার সময়ে নিঃসৃত আলোটুকু কখনোই ওর কাছে যাবে না, এটা চিরকাল ভেসে থাকবে দিগন্তেই। এর ফলে, আপনি চির দিনের জন্যে ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে গেছেন, আর কোন দিন ফিরেও আসবেন না- এই খবরটুকুও জায়েদ জানতে পারবে না। ওর কাছে মনে হবে, কোন কারণে আপনার ব্ল্যাক হোলে প্রবেশ করতে দেরি হচ্ছে।

পুরো প্রক্রিয়াটি আরেকভাবে চিন্তা করা যায়। দূরবর্তী অঞ্চলের চেয়ে ঘটনা দিগন্তের কাছে সময় অনেকটা ধীরে প্রবাহিত হয়। ধরুন, আপনি নভোযানে চড়ে ঘটনা দিগন্তের বাইরের একটি জায়গায় ভেসে থাকলেন (পতন থেকে রক্ষা পেতে বিপুল জ্বালানি পুড়িয়ে)। এবার আপনি যদি জায়েদের সাথে গিয়ে দেখা করুন, দেখা যাবে ওর বয়স আপনার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে। কারণ, ব্ল্যাক হোলের কারণে ওর তুলনায় আপনার সময়ের গতি ছিল ধীর।

আচ্ছা, দুইটির ব্যাখ্যার কোনটি আসলে সঠিক? ব্যাপারটা নির্ভর করে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কিত আপনার স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার ওপর। সোয়ার্জসাইল্ড স্থানাঙ্ক নামে পরিচিত প্রচলিত স্থানাঙ্ক বিবেচনা করলে, আপনি দিগন্তে পাড়ি দিবেন স্থানাঙ্কের মানে সময় (t) যখন অসীম হবে। ফলে, স্থানাঙ্কের এই হিসেব অনুসারে, দিগন্ত পার হতে আপনার অসীম সময়ই লাগবে। এর কারণ হচ্ছে, সোয়ার্জসাইল্ড স্থানাঙ্ক ঘটনা দিগন্তের নিকটবর্তী অঞ্চলের বিকৃত দৃশ্য প্রদান করে। আর ঠিক দিগন্তের ওপরে স্থানাঙ্ক নিরতিশয় (Infinitely) বিকৃত হবে।

আপনি যদি স্থানাঙ্ককে এরূপ বিকৃতির হাত থেকে বাঁচাতে চান, তবে বিকল্প উপায়ে হিসাব করলে ,আপনার দিগন্ত ভেদ করতে প্রয়োজনীয় সময়ের (t) সসীম একটি মান পাবেন। কিন্তু, জায়েদ যে সময় আপনাকে তা করতে দেখবে সেই সময়টি আবার অসীম। ওর কাছে আসলে আপনার খবর পৌঁছতে অসীম সময় লাগবে। আপনি যে কোনো স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে পারেন বটে, ফলাফল একই পাবেন। এ জন্যে আসলে দুটো ব্যাখ্যাই সঠিক এবং একই কথার দ্বিরূপ মাত্র।

বাস্তবে আসলে খুব বেশি সময় গড়াবার আগেই আপনি জায়েদের নজর থেকে উধাও হয়ে যাবেন। ব্ল্যাক হোল থেকে দূরে ধাবিত আলো লাল সরণ (Red shift) প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবে। আপনি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোন দৃশ্যমান আলো নির্গত করলে জায়েদের কাছে যেতে যেতে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দীর্ঘতর হয়ে পড়বে। আপনি দিগন্তের কাছাকছি হতে থাকলে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়েই চলবে। একটা সময় তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান পাল্লাকে ছাড়িয়ে যাবে। এটা হয়ে যাবে অবলোহিত বিকিরণ এবং পরে বেতার বেতার তরঙ্গে পরিণত হবে। এক সময় তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এত দীর্ঘ হবে যে জায়েদের চোখে এটি আর ধরা পড়বে না।

অন্য দিকে, আলো নির্গত হয় ফোটন নামক স্বতন্ত্র গুচ্ছ আকারে। ধরুন, আপনি দিগন্ত ত্যাগ করার সময় শেষ আলোকবিন্দু নির্গত করলেন। এই আলো জায়েদের কাছে কোন সসীম সময়েই পৌঁছবে। উপরোক্ত লক্ষ সূর্যের সমান ভরের ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে এতে সময় লাগবে ঘণ্টাখানেকেরও কম। এর পর? ও আর কিছুই দেখবে না। আপনি ভেতরে ডুব দিয়ে আর যে আলোই নিক্ষেপ করবেন, তা আপনার প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্যে আর কখনো পৌঁছাবে না। আপনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন ব্ল্যাক হোলের গভীরে। এর পর তোমার কী হবে? এটা পরের কোনো পর্বে দেখবো। ব্ল্যাক হোলে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে পড়ে নিয়েন। আর আসলে সেটাতো আপনিই আমাদের চেয়ে ভালো জানবেন, তাই না?

তবে, ব্ল্যাক হোলে গেলেই সব শেষ- ব্যাপারটি পুরোপুরি এমনও নয় কিন্তু। আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বেরই একটি সমাধান অনুসারে ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে তৈরি হয় ওয়ার্মহোল। ওয়ার্মহোল হচ্ছে স্থান-কালের এক পয়েন্ট থেকে আরেকটি পয়েন্টে পৌঁছে যাবার শর্টকাট পথ। এটা হতে পারে কোন স্থান বা সময় থেকে অন্য কোন সময় –অতীত বা বর্তমানে বা অন্য কোন সময়েরই মহাবিশ্বের অন্য কোন স্থান (যেমন অন্য কোন গ্যালাক্সি) এমনকি হতে পারে অন্য কোন মহাবিশ্বেও! আগামী কোনো পর্বে আমরা ওয়ার্মহোল ও টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে বিস্তারিত জানবো।

গত পর্বে প্রশ্ন ছিল, স্টেলার ব্ল্যাক হোলরা কেন জীবনের অন্তিম সময়েই ব্ল্যাক হোল হয়? এ সময়তো তাদের ভর অনেক কমে যায়। জীবনের শুরুতেই কেন হয় না, যখন ওদের ভর থাকে তুলনামূলক বেশি?

উত্তরঃ জীবনের শুরুতে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি নক্ষত্রে দুইটি বল কাজ করে। একটি এর নিজস্ব অভিকর্ষজনিত অন্তর্মুখী চাপ এবং অপরটি ফিউশন বিক্রিয়াজনিত বহির্মুখী চাপ। এই দুটি বলে একে অপরকে নাকচ করে দিয়ে নক্ষত্রকে স্থিতিশীল রাখে। কিন্তু জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে এটি যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন অভিকর্ষকে ঠেকানোর মত আর কোন কার্যকরী বল থাকে না। এই কথা অবশ্য যথেষ্ট ভরযুক্ত নক্ষত্রের জন্যে প্রযোজ্য। কম ভরের ক্ষেত্রে আবার সংকোচনশীল বস্তুর নিজদের সাথে সংঘর্ষজনিত ডিজেনারেসি প্রেসার অভিকর্ষকে কিছুটা প্রতিহত করে।

[লেখাটি ইতোপূর্বে কিশোরদের উপযোগী করে ব্যাপন ম্যগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।]

অন্যান্য পর্ব



Category: articles

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

আজ ১৫ আগস্ট।
১৮৯২ সালের এই তারিখে জন্মগ্রহণ করেন ফরাসী পদার্থবিদ লুই ডি ব্রগলি।

কোয়ান্টামতত্ত্ব নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজই সারা বিশ্বের নিকট তাকে পরিচিত করে তুলেছে। ১৯২৪ সালে তিনি তাঁর এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মের আবিস্কার করেছেন এবং প্রস্তাব করেন যে সকল পদার্থেরই তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে। এই কাজের জন্য ১৯২৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

পদার্থবিজ্ঞানী লুই ডি ব্রগলি

ব্রগলির বাবা-মায়ের বেঁচে যাওয়া ৪ সন্তানের মাঝে তিনি ছিলেন ৪র্থ। ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের দিপ্পে (Dieppe) শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার সামাজিক দিক থেকে অনেক উচ্চবংশীয় ছিল। তার বাল্যকালের পড়াশোনা বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের নিকট শুরু হয়। ১৯০৬ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই মরিস ডি ব্রগলির পরামর্শে ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম স্কুলে যান। স্কুল পাশ করার পর ইতিহাস নিয়ে লুই ডি ব্রগলির পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান, ফ্রেঞ্চ, দর্শন, ইতিহাস, রসায়ন ও গণিতে তার মত ভাল ছাত্র আর কেউ ছিল না। ১৯০৯ সালে ব্রগলি মাত্র ১৭ বছর বয়সেই দর্শন ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বড় ভাই মরিসের উৎসাহেই বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন লুই ডি ব্রগলি। ১৯১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানের উপর একটি ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তিনি ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাকে আইফেল টাওয়ারে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি এই স্থান হতেই বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং তরঙ্গ নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বড় ভাই মরিসের ল্যাবে তার সাথেই কাজ শুরু করেন ডি ব্রগলি।

মরিসের ল্যাবে ডি ব্রগলি যতগুলি কাজ করেছেন তার বেশিরভাগই ছিল এক্স-রশ্মি ও আলোর তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত। এইসব পরীক্ষণ হতেই ডি ব্রগলি আলোর কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave-partiucle dulaity) নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন। আরো ভালোভাবে বললে, 'যে কোনো কিছুর' কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। শীঘ্রই ১৯২৪ সালে ডি ব্রগলি পদার্থের কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা নিয়ে তত্ত্বটিকে তার পিএইচডি থিসিস পেপারে প্রস্তাব করলেন। সৌভাগ্যক্রমে এই থিসিস পেপার বিজ্ঞানী ল্যাংজেভিনের হাত হয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাতে এসে পড়ে। তিনি ডি ব্রগলির এই ধারণার অনেক বেশি প্রশংসা করেন। তরঙ্গ-বলবিদ্যার উত্থানে আইনস্টাইন এর এই প্রশংসা অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছিল।

কণা- তরঙ্গ দ্বৈততা

লুই ডি ব্রগলির এই তত্ত্ব পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের গতির হিসাব-নিকাশ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার সমাধান এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয়। কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে পৃথকভাবে জিপি থমসন, ক্লিনটন ডেভিসন এবং লেস্টার জারমারের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়। এ থেকে সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হয় যে পদার্থও তরঙ্গ ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। এই অসাধারণ কাজের জন্য ১৯২৯ সালে লুই ডি ব্রগলি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লুই ডি ব্রগলি তার ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর সরবোনেই অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত হেনরি পয়েনকেয়ার ইন্সটিটিউশনে ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি অবসরের যাবার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৫ সালে ডি ব্রগলি ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ইউনেস্কো প্রদত্ত কলিঙ্গ পুরস্কার লাভ করেন এবং ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির বৈদেশিক সদস্যপদ সাথে সাথে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমীর সদস্যপদ লাভ করেন। উনবিংশ শতকের শুরুতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিকাশে কণা-তরঙ্গের মিল প্ল্যাংক এবং আইনস্টাইনের হাত ধরে পরর বোর হয়ে লুই ডি ব্রগলির হাতে এসে পূর্ণতা পায়।

এই পূর্ণতাদানকারী বিজ্ঞানী ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ ফ্রান্সের ল্যুভেসিয়েনেসে (Louveciennes) মৃত্যুবরণ করেন। ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাও  লুই ডি ব্রগলির মত বিজ্ঞানীর জন্য খুব অল্প সময় হয়ত।

নোটঃ লুই ডি ব্রগলির নামের ফরাসি উচ্চারণ হল লুই দ্য ব্রোয়ি

তথ্যসূত্র:
১। http://www.famousscientists.org/louis-de-broglie/
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Louis_de_Broglie
৩। কণা তরঙ্গ, রেজা এলিয়েন, বর্ণায়ন, ঢাকা, ২০০৯
Category: articles
শনি সৌরজগতের ৬ষ্ঠ গ্রহ। এটিই পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ যেটি খালি চোখে দেখা যায়। তবে শনি গ্রহ সবচেয়ে বিখ্যাত এর আকর্ষণীয় বলয়ের জন্য। এই বলয় আবিষ্কৃত হয় ১৬১০ সালে, গ্যালিলিওর হাত ধরে। বৃহস্পতির মতোই শনিও একটি গ্যাস জায়ান্ট। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস এর প্রধান উপাদান।
বলয়ধারী শনি গ্রহ

এক নজরেঃ
গড় ব্যাসার্ধঃ ৫৮, ২৩২কিমি.
ভরঃ পৃথিবীর ৯৫ গুণ।
উপগ্রহের সংখ্যাঃ ৬২
উল্লেখযোগ্য উপগ্রহঃ টাইটান, এনসেলাডাস, রিয়া ইত্যাদি
বলয়ের সংখ্যাঃ ৩০ এর বেশি (৭টি গ্রুপ নিয়ে গঠিত)
কক্ষপথের দূরত্বঃ ১,৪২৬, ৬৬৬,৪২২ কিমি. (৯.৫৪ এইউ)
পর্যায়কালঃ ১০, ৭৫৬ দিন (২৯.৫ বছর)
কার্যকর তাপমাত্রাঃ মাইনাস ১৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস
অপসূরঃ ১০.১ এইউ
অনুসূরঃ ৯.০২৪ এইউ
আপাত উজ্জ্বলতাঃ (+১.৪৭) থেকে (-.২৪)
প্রথম দর্শনঃ খৃষ্টপূর্ব ৮ম শতক

পৃথিবীর তুলনায় শনি গ্রহের আকার
শনি গ্রহের তথ্য জানালাঃ
১। শনিকে খালি চোখে দেখা যায়। এটি সৌরজগতের পঞ্চম উজ্জ্বল বস্তু (পৃথিবীর আকাশে)। এর আপাত উজ্জ্বলতা (-০.২৪) থেকে (+১.৪৭) এর মধ্যে উঠা-নামা করে। রাতের আকাশে একটানা বহু দিন ধরেই একে দেখা যায়। এটি যখন সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের খুব কাছাকাছি সময়ে উদয় বা অস্ত যায়, শুধু তখনই দেখা যায় না।
আরো পড়ুনঃ 
গ্রহদের খোঁজখবর
আপাত উজ্জ্বলতা কাকে বলে? 

২। অতীতকালেও শনির সাথে মানুষের পরিচয় ছিল। ব্যাবিলনীয় এবং দূর প্রাচ্যের মানুষও একে চিনত। রোমান দেবতা স্যাটারনাস থেকে এর (ইংরেজি Saturn) নাম এসেছে। গ্রিকরা একে চিনত ক্রোনাস নামে।

৩। শনি সবচেয়ে চ্যাপ্টা গ্রহ। বিষুব অঞ্চলের তুলনায় এর মেরু অঞ্চলের ব্যাসার্ধ ১০ ভাগের এক ভাগ কম। এর অর্থ হল, মের অঞ্চলের দিকে গ্রহটি বেশ চাপা। এর কারণ হচ্ছে, এর ঘনত্ব খুব কম, কিন্তু আবর্তন বেগ খুব তীব্র। প্রতি দশ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটে এটি একবার এর অক্ষের সাপেক্ষে ঘুরে আসে। ফলে সৌরজগতের গ্রহদের মধ্যে দিনের দৈর্ঘ্যের স্বল্পতার দিক দিয়ে এর অবস্থান দুই-এ।
আরো পড়ুনঃ 
☛ আবর্তন ও প্রদক্ষিণের পার্থক্য

৪। শনি সূর্যকে একবার ঘুরে আসতে ২৯ বছরের বেশি সময় লাগে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্টারদের তুলনায় এর গতি খুব ধীর হবার কারণে একে প্রাচীন আসিরীয়রা Lubadsagush নামে ডাকত। এর অর্থ হচ্ছে পুরাতনদের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন।

৫। শনির বায়ুমণ্ডল অনেকগুলো মেঘপুঞ্জে বিভক্ত। সবচেয়ে উপরের স্তর মূলত অ্যামোনিয়ার বরফ দিয়ে গঠিত। এর নিচে রয়েছে তুষার। এর নিচে হাইড্রোজেন ও সালফারের বরফের উপস্থিতি লক্ষণীয়।


৬। শনির মূল উপাদান হাইড্রোজেন। ভেতরের দিকে হাইড্রোজেনের ঘনত্ব ক্রমশ বেশি। আরো ভেতরের দিকে হাইড্রোজেন হয়ে পড়ে ধাতব। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রমণ্ডল খুব উষ্ণ।

৭। সব গ্রহের মধ্যে শনির বলয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরা মূলত বরফ ও কার্বোনেসাস ধূলি দিয়ে তৈরি। গ্রহটিতে বলয়গুলো ১২০, ৭২০ কিমি. পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু সে তুলনায় এরা খুব সরু, পুরুত্ব মাত্র ২০ মিটারের মতো।

৮। ছোট-বড়ো মিলিয়ে শনির উপগ্রহের সংখ্যা দেড়শোর বেশি। উপগ্রহের সংখ্যা ৬২। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগ্রহের সংখ্যা আসলে কয়েকশো। এদের সবাই হিমায়িত অবস্থায় রয়েছে। টাইটান ও রিয়া এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। এনসেলাডাসের হিমায়িত পৃষ্ঠের নিচে সাগর আছে বলে মনে হয়।

৯। শনির উপগ্রহ টাইটানের বায়ুমণ্ডল নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ (অনেকটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মতোই)। উপগ্রহটি মূলত বরফ ও পাথর দিয়ে গঠিত। এর পৃষ্ঠে রয়েছে তরল মিথেনের লেক। পৃথিবীর সাথে এর উল্লেখযোগ্য মিল থাকার কারণে এতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হয়।
আরো পড়ুনঃ 
শনির উপগ্রহে মিথেন সাগর

১০। এ পর্যন্ত ৪টি মহাকাশযান শনি গ্রহ সফর করেছে। এরা হল পাইওনিয়ার ১১, ভয়েজার ১ ও ২ এবং ক্যাসিনি- হাইগেনস মিশন। এরা সবাই শনিকে নিয়ে গবেষণা করেছে। এর মধ্যে ক্যাসিনি এখনো শনির কক্ষপথে আছে। এটি এখনো গ্রহটি ও এর বলয় এবং উপগ্রহসমূহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাচ্ছে।

সূত্রঃ
[১] http://space-facts.com/saturn/
[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Saturn
Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...