Advertisement

সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪

প্রতি দিন রাতের আকাশের দিকে নজর রাখলে একটি বিশেষ জিনিস চোখে পড়বে। প্রত্যেক রাতের একই সময়ে আকাশের তারাগুলো আগের রাতের চেয়ে একটু পশ্চিমে চলে আসে। এটা হয় সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে। পৃথিবী প্রতিনিয়ত কক্ষপথে অবস্থান বদল করার কারণে একেক সময় সূর্যকে আকাশের একেক দিকে অবস্থিত মনে হয়। সূর্যের এ আপাত অবস্থান যখন যে দিকে থাকে, সেদিকের তারাগুলো সে সময় সূর্যের প্রায় সাথে সাথে ডুবে যায়। তাই এ সময় তাদেরকে দেখ যায় না। কিছু দিন পর এ জায়গায় চলে আসে অন্য তারা। এভাবে এক বছর পর আবার একই সময়ে একই তারাদের দেখা মেলে রাতের আকাশে।


 গ্রহদের উল্টো গতি

সাধারণত তারকাদের এই চলাচলের কোনো ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু গ্রহরা এই নিয়ম মানে না। দূরবর্তী আপাত স্থির নক্ষত্রেদের তুলনায় রাতের আকাশে এদের গতি সাধারণত পূর্ব দিকে। চাঁদও কিন্তু গ্রহদের মতো প্রতি রাতে আগের রাতের তুলনায় পূর্ব দিকে চলে আসে। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায়, গ্রহরা স্বাভাবিক পূর্ব দিকের বদলে নক্ষত্রদের সাথে সাথে পশ্চিম দিকে চলছে। এই ঘটনা সবচেয়ে সহজে চোখে পড়ে বুধ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহের ক্ষেত্রে। বৃহস্পতি বা শনি তুলনামূলক দূরে হওয়াতে এই উল্টো গতি (retrograde motion) দেখতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। 


প্রাচীন কালের মানুষ এই উল্টে গতির ব্যাখ্যা জানত না। তখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা প্রচলিত। পৃথিবীকে মানে করা হত মহাবিশ্বের কেন্দ্র। এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই টলেমি মহাবিশ্বের একটি মডেল দাঁড় করান। সেই মডেলে পৃথিবীর চারদিকে আটটি গোলক কল্পনা করা হলো। চাঁদ ও সূর্যের জন্যে ছিল একটি করে কক্ষপথ। সেই সময়ে জানা পাচঁটি গ্রহের জন্যে (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি) ছিল আরও পাঁচটি কক্ষপথ। আরেকটি কক্ষপথ ছিল দূরবর্তী নক্ষত্রদের জন্যে। সময় সময় গ্রহদের উল্টো গতির ব্যাখ্যা দেবার জন্যে বলা হলো, পৃথিবীর চারদিকের কক্ষপথে ঘোরার পাশাপাশি এরা কক্ষপথের মধ্যেই আরেকটি বৃত্তপথে চলাচল করে। এই বৃত্ত পথের নাম ছিল মন্দবৃত্ত (epicycle)। এই চিত্রের মাধ্যমে গ্রহদের এলোমেলো চলনের ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও ত্রুটি ছিল এতে। এই নমুনা সঠিক হলে চাঁদ মাঝে মাঝে পৃথিবীর অর্ধেক দূরত্বে চলে আসার কথা, যা বাস্তবে ঘটে না।


টলেমির মহাবিশ্ব

এখন আমরা জানি, টলেমির মডেল ভুল ছিল। গ্রহদের চলাচলের সঠিক ব্যাখ্যা দেন জার্মান গণিত ও জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার। ব্যবহার করেন ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত। কেপলারের গ্রহের সূত্র অনুসারে, পৃথিবীসহ অন্য গ্রহরা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। উপবৃত্তের কোনো একটি উপকেন্দ্রকে ঘিরে এর প্রদক্ষিণ চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হল, কেপলারের সূত্র থেকে গ্রহদের উল্টো গতির ব্যাখ্যা খুব সহজেই পাওয়া যায়।


উল্টো গতির কারণ কক্ষপথের গ্রহদের আপেক্ষিক অবস্থা 

এটা বোঝার জন্যে ওপরের চিত্রটি দেখুন। মাথায় রাখতে হবে, যে গ্রহরা সূযের অপেক্ষাকৃত কাছে, তাদের বেগ দূরের গ্রহের তুলনায় বেশি। কক্ষপথের পরিধিও ছোট। ফলে কাছের গ্রহরা অপেক্ষাকৃত কম সময়েই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেলে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মঙ্গল বা বাইরের দিকের কোনো গ্রহ পৃথিবী ও সূর্যের সাথে একই রেখায় অবস্থান করলেও একটু পরেই পৃথিবী চলে যায় সামনে। পৃথিবী থেকে ভেতরের দিকের গ্রহরা আবার এগিয়ে যায় পৃথিবীর চেয়ে। আপাতত পৃথিবীর সাপেক্ষে মঙ্গলের আপেক্ষিক অবস্থানের দিকে লক্ষ করুন। ১ থেকে ৩ নং অবস্থান পর্যন্ত স্বাভাবিক গতি দেখা যাচ্ছে। তবে ৪ নং অবস্থানে গিয়ে পৃথিবী থেকে দেখতে মঙ্গলের অবস্থান পেছনে (পশ্চিমে) সরে এসেছে। ৫নং-এও তাই। তবে তারপর আবার স্বাভাবিক পূর্ব দিকে চলছে।


বোঝাই যাচ্ছে, এরকম গতির পেছনে মূল কারণ হল, পৃথিবীর তুলনায় অন্য গ্রহদের কক্ষপথের পরিধি ও বেগের কম-বেশি।

Category: articles

মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

রাতের আকাশের দ্বাদশ উজ্জ্বল তারা। আগস্ট মাস দেখার সেরা সময়৷ রাত নয়টার দিকে প্রায় মাথার উপর জ্বলজ্বল করে তারাটা৷ পাশেই আছে আরও দুটি উজ্জ্বল তারা অভিজিৎপুচ্ছ। তিনটি তারা মিলে একত্রে নাম সামার ট্রায়াঙ্গল৷ শ্রবণার অবস্থান ঈগলমণ্ডলে৷ রূপকথার কাল্পনিক ঈগলের বুকে এর অবস্থান৷


সমার ট্রায়াংগেল ও শ্রবণা তারা। 





পৃথিবী থেকে দূরত্ব ১৬.৮ আলোকবর্ষ৷ মানে পৃথিবীর অন্যতম নিকট প্রতিবেশী এক তারা। বর্তমানে প্রধান ক্রম দশায় আছে৷ সূর্যের মতো হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম বানাচ্ছে৷ আলটেয়ার বা শ্রবণার দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।


সূর্য কীভাবে জ্বলে?

তারাটা প্রচণ্ড জোরে ঘোরে। নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে আসতে এর মাত্র দশ ঘণ্টা লাগে৷ যেখানে সূর্যের লাগে প্রায় ২৭ দিন। আর পৃথিবীর ২৪ ঘণ্টা৷ মানে পৃথিবী একবার ঘুরতে ঘুরতে তারাটা ঘোরে দুইবারের বেশি৷ দ্রুত ঘূর্ণনের কারণে শ্রবণার মেরু অঞ্চল চেপে গেছে৷ বিষুব অঞ্চলে ফুলে উঠেছে৷ এ ধরনের আকৃতিকে বলে অবলেট স্ফেরয়েড (oblate spheroid)৷ এসব আকৃতিতে মেরু অঞ্চল চেপে থাকে। বিষুব এলাকার ব্যাসার্ধ মেরু এলাকার চেয়ে বেশি হয়। শ্রবণার ক্ষেত্রে তা বিশ ভাগেরও বেশি৷ অন্যদিকে মেরু অঞ্চলের ব্যাসার্ধ হলে নাম হয় প্রোলেট স্ফেরয়েড (prolate spheroid)।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তারাটার বিষমতা। বিষম তারার অভাব নেই আকাশে। এসব তারার উজ্জ্বলতা কিছুদিন পরপর কমে-বাড়ে৷ তবে শ্রবণা এখানেও একটু ব্যতিক্রম৷ অন্যদের উজ্জ্বলতার পরিবর্তন ঘটে মোটামুটি নিয়মিত৷ সেখানে শ্রবণার উজ্জ্বলতার পরিবর্তনের হার আছে নয় নয়টা৷ খালি চোখে অবশ্য সে তারতম্য বোঝা যাবে না৷ এ বিষমতার সাথে সম্ভবত এর ঘূর্ণনের সম্পর্ক আছে৷ শ্রবণা একটি ডেল্টা স্কুটি ধরনের বিষম তারা৷

শ্রবণার আভ্যন্তরীণ উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি সূর্যের দশ গুণ। সূর্যের জায়গায় এ তারাটা থাকলে পৃথিবী বাসের অযোগ্য হত৷ ভর সূর্যের ১.৮ গুণ। চওড়াও প্রায় দ্বিগুণ৷ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৬৬২৬ থেকে ৮৮২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ বয়স দশ কোটি বছর। যেখানে সূর্যের বয়স পাঁচশ কোটি বছর৷ টেলিস্কোপে এর তিনটি অনুজ্জ্বল সঙ্গী তারা দেখা যায়৷ অল্প কিছু তারারই করা ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। শ্রবণা তার অন্যতম। এদের মধ্যে আরও আছে জ্যেষ্ঠা, রেগুলাস, মাইরা ইত্যাদি৷

ঈগলমণ্ডল ও শ্রবণা তারা। মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা এটা।

আগস্টের রাতের আকাশ শ্রবণা দেখার সেরা সময়৷ আপাত উজ্জ্বলতা +০.৭৬। ফলে মেঘমুক্ত রাতের আকাশে খালি চোখে সহজেই দেখা যাবে৷ সামার ট্রায়াঙ্গলের তিন তারার মধ্যে শ্রবণা সবার পরে উদিত হয়। এই ত্রিভুজের উপর দিয়েই চলে গেছে মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গার দৃশ্যমান বাহুটা৷ দেখতে আসলেও নদীর মতো। নদীর দুই তীরে আছে অভিজিৎ ও শ্রবণা৷ পেটের মধ্যে আছে ত্রিভুজের অপর তারা পুচ্ছ৷ শ্রবণার দুই পাশে আছে দুটি অনুজ্জ্বল তারা৷ অভিজিতের বিষুবলম্ব +৩৮, আর শ্রবণার +৮। মানে অভিজিতের চেয়ে শ্রবণা আছে দক্ষিণে। বাংলাদেশ থেকে দেখতে দুটো তারাই সোজা উপর থেকে ১৫ ডিগ্রি করে দূর দিয়ে চলে। অভিজিত উত্তরে আর শ্রবণা দক্ষিণে৷ কারণ বাংলাদেশের সোজা উপরের আকাশের বিষুবলম্ব +২৩৷ মিলিয়ে নিন। কী দারুণ!


তারা চিনতে বিষুবলম্ব


নক্ষত্রটার বৈজ্ঞানিক নাম আলফা অ্যাকুইলি৷ আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতির দেওয়া নাম আলটেয়ার (Altair)৷ শব্দটা এসেছে আরবি নাম আল নিসর আল তাইর থেকে। অর্থ উড়ন্ত ঈগল।

Category: articles

সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩

আকাশের উজ্জ্বল তারারা তৈরি করে দারুণ দারুণ নকশা৷ ৮৮টি তারামণ্ডলের একটি ধনুমণ্ডল। এটা রাশিচক্রের অন্যতম মণ্ডল। পরিচিত ধনুরাশি হিসেবে। মণ্ডলের উজ্জ্বল তারাগুলোকে দেখতে চায়ের পট বা টিপটের মতো লাগে৷ রাশিচক্রের এ মণ্ডলে সূর্য অবস্থান করে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৮ জানুয়ারি৷


ধনুমণ্ডলের টিপট তারানকশা


তারামণ্ডল বনাম তারানকশা


আগস্ট মাস একে দেখার সেরা সময়। এ সময় রাত নয়টার দিকে ধনুমণ্ডল দক্ষিণ আকাশের সর্বোচ্চ বিন্দুতে থাকে। বিষুবলম্ব -২৫ ডিগ্রি। ফলে মূলত দক্ষিণ আকাশে হলেও উত্তর গোলার্ধের অধিকাংশ এলাকা থেকেও দেখা যাবে। সর্বোচ্চ ৫৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে দেখতে পাবেন একে৷

আমাদের হোম গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের কেন্দ্র এ মণ্ডলের পশ্চিম অংশের দিকে আছে৷ এ কারণেই আকাশের এ দিকটায় প্রচুর নক্ষত্রপুঞ্জ ও নীহারিকা আছে৷ টিপটের কয়েক ডিগ্রি উত্তর দিক দিয়ে চলে গেছে সূর্যপথ৷ যে কাল্পনিক পথে পৃথিবীর আকাশে সূর্য চলাচল করে৷ ধনুর ইংরেজি স্যাজিটেরিয়াস শব্দটা এসেছে ল্যাটিন থেকে। অর্থ তীরন্দাজ৷

সূর্য কখন কোথায় থাকে?

পুরো মণ্ডলকে বিভিন্ন কালচারে সেভাবেই চিত্রায়িত করা হয়েছে৷ ছবি। গ্রিক রূপকথায় স্যাজিটেরিয়াসকে অর্ধমানব, অর্ধঘোড়া হিসেবে কল্পনা করা হয়৷ কল্পিত এ জন্তুর অন্য নাম সেন্টোর। কল্পিত চিত্রে তীরন্দাজ তীর ধনু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মণ্ডলের তীরটা চলে গেছে পাশের বৃশ্চিকমণ্ডলের বিছার বুক বরাবর৷ সেন্টোর থেকে নাম পেয়েছে আকাশের আরও একটি তারামণ্ডল। সেন্টোরাস নামের মণ্ডলটার অবস্থান আরও অনেকটা দক্ষিণে।

ধনুমণ্ডলের কল্পিত সেন্টোর। অর্ধ-মানব ও অর্ধ-ঘোড়া। 


সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা এপসাইলন স্যাজিটেরাই৷ ডাকনাম কোস অস্ট্রালিস। যার অর্থ ধনুর দক্ষিণাংশ৷ দ্বিতীয় উজ্জ্বল তারার নাম নানকি৷ বেয়ার পদবী সিগমা স্যাজিটেরাই৷ এ মণ্ডলেই আছে দূর আকাশে বিখ্যাত অনেক বস্তু৷ লেগুন নেবুলা, ওমেগা নেবুলা, রেড স্পাইডার ও ট্রিফিড নেবুলা - বিখ্যাত এই নীহারিকাদের পাওয়া যাবে এখানেই৷

ধনুমণ্ডলের তারাচিত্র

মহাকাশযান নিউ হরাইজনস এর গতিপথ বর্তমানে এই মণ্ডলের সামনে৷ বিখ্যাত বেতার সঙ্কেত ওয়াও! সিগনাল এসেছে এ মণ্ডল থেকেই৷ রহস্যময় যে সঙ্কেতকে অনেকে ভিনগ্রহের বাসিন্দার বার্তা মনে করতে পছন্দ করেন৷
Category: articles

রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০২৩

রাতের আকাশের পঞ্চম উজ্জ্বল তারা। উত্তর গোলার্ধের আকাশে দ্বিতীয় উজ্জ্বল। স্বাতীর পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা৷ লাইরা বা বীণামণ্ডলে এর অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাও এটিই৷ সূর্য থেকে দূরত্ব মাত্র ২৫ আলোকবর্ষ। 

রাতের আকাশে অভিজিৎ নক্ষত্র। আগস্ট মাসে সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। রাত নয়টার দিকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় মাথার ওপর। 

জ্যোতির্বিদরা অভিজিৎ নক্ষত্র নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন৷ এ কারণে সূর্যের পর একে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারাও বলেন অনেকে৷ সূর্যের পরে বর্ণালীর ছবি তোলা তারাও অভিজিৎ৷ প্যারালাক্স বা লম্বন পদ্ধতিতে দূরত্ব মাপা অন্যতম প্রথম তারাও এটি৷ খৃষ্টপূর্ব ১২,০০০ সালে তারাটি ছিল মেরু বা ধ্রুবতারা৷ আবারও হবে ১৩,৭২৭ বছর পরে৷ কারণ আর কিছুই নয়। পৃথিবীর মেরুরু আবর্তন৷ ঘুরন্ত লাটিমের মতো পৃথিবীও ঘুরতে ঘুরতে অক্ষ পাল্টায়৷ 





অভিজিৎ নক্ষত্রের বয়স সূর্যের দশ ভাগের এক ভাগ৷ মজার ব্যাপার হলো এর জীবনকাল বাকিও আছে সূর্যের দশ ভাগের এক ভাগ৷ এর কারণ অভিজিৎ সূর্যের ২.১ গুণ ভারী৷ ভারী নক্ষত্রদের জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এ কারণেই সূর্যের চেয়ে আগে প্রধান ক্রম দশা পার করবে অভিজিৎ৷ সবমিলিয়ে প্রধান ক্রম দশা প্রায় একশ কোটি বছর৷  তারাটা সেকেন্ডে ২৩৬ কিলোমিটার বেগে নিজের অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরে। ১২.৫ ঘণ্টায় একবার পুরোটা সম্পূর্ণ ঘোরা হয়ে যায়৷ এ কারণে  স্বাভাবিকভাবেই বিষুব অঞ্চল অনেকটা ফোলা। অভিজিৎ বিষম তারা। মানে উজ্জ্বলতা সবসময় এক থাকে না। 

সামার ট্রায়াঙ্গল তারানকশার অন্যতম তারা অভিজিৎ


বৈজ্ঞানিক নাম আলফা লাইরি৷ সাধারণত মণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারার নাম হয় আলফা। সে হিসেবেই এই নাম৷ ইংরেজি নাম ভেগা (Vega)। শব্দটা এসেছে আরবি শব্দ ওয়াকি থেকে৷ যার অর্থ পড়ন্ত বা অবতরণকারী (ঈগল)৷ ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতি তারাটার নাম ভেগা রাখে৷ বাংলা নামটি এসেছে ভগবত পুরাণ থেকে। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, নক্ষত্রদের মধ্যে তিনি হলেন অভিজিৎ৷ 


উত্তর গোলার্ধের আকাশে সহজেই দেখা যায়। দেখার সবচেয়ে ভাল সময় জুলাই-আগস্ট। আগস্টে রাত নয়টার দিকে প্রায় ঠিক মাথার ওপর থাকে তারাটা৷ সুপরিচিত তারানকশা সামার ট্রায়াঙ্গলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা অভিজিৎ৷ তিন তারা মিলে তৈরি করেছে একটি সমকোণ৷ আর সমকোণের শীর্ষেই আছে অভিজিৎ৷ পশ্চিম-উত্তর দিকে একটু গেলেই পাওয়া যাবে সপ্তর্ষি৷ একটু চেষ্টাতেই তাই অভিজিৎকে চিনে নেওয়া যাবে৷ আবার সপ্তর্ষি দিয়েও সহজেই একে খুঁজে পাওয়া যাবে৷ অভিজিতের বিষুব লম্ব +৩৮.৭৮। ফলে বাংলাদেশ থেকে দেখলে মাথার সোজা উপর থেকে প্রায় ১৫ ডিগ্রি উত্তর দিয়ে তারাটা রাতের আকাশে পশ্চিমে যেতে থাকে। দক্ষিণে সর্বোচ্চ ৫১ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত দেখা সম্ভব। তার দক্ষিণে গেলে আর দেখা যাবে না একে। অ্যান্টার্কটিকা বা এমনকি চিলি থেকেও তারাটা দেখা যাবে না। 



সপ্তর্ষি ও ধ্রুবতারা দিয়ে অভিজিৎ খুঁজে নিতে পারেন

Category: articles

রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩

আকাশের এলাকায় দুই ধরনের নকশা খুব দর্শনীয়। এক হলো তারামণ্ডল৷ যা পুরো আকাশকে ৮৮টি অঞ্চলে ভাগ করেছে। সব তারা, ছায়াপথ বা দূর আকাশে জিনিস কোনো না কোনো মণ্ডলে থাকবে।


দ্য গ্রেট ডায়ামন্ড তারানকশা 



আরেকটি মজার জিনিস হলো তারানকশা। বিভিন্ন তারার সংমিশ্রণে তৈরি তারার সুন্দর নকশা। এমনই একটি নকশার নাম দ্য গ্রেট ডায়ামন্ড। ডায়ামন্ড বা হীরার মতোই এর চারটি কোণা। বলাই বাহুল্য, চার কোণায় আছে চারটি উজ্জ্বল তারা৷

তারামণ্ডলের পরিচয়


তারানকশা কী?


এই নকশাটা মে-জুন মাস ও এর আগে পরে ভাল দেখা যায়। ডায়ামণ্ডের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা স্বাতী। রাতের আকাশের চতুর্থ উজ্জ্বল তারা। উত্তর গোলার্ধের এক নম্বর উজ্জ্বল। জুনের শুরুতে রাত নয়টার দিকে ঠিক মাথার উপর থাকে। আরেকটি তারা চিত্রা (spica)। উজ্জ্বলতায় ক্রম ১৫। কন্যারাশির সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা৷

অপর দুই তারার একটি ডেনেবোলা। সিংহরাশির দ্বিতীয় নম্বর উজ্জ্বল তারা। অবস্থান কল্পিত সিংহের লেজে। আর চতুর্থ তারার নাম কর ক্যারোলি। সারমেয়যুগল মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা।

খুঁজে পাওয়া একদম সোজা। স্বাতী ও চিত্রাকে পাওয়া যাবে সপ্তর্ষীকে কাজে লাগিয়ে। 



গ্রেট ডায়ামন্ড আকারে সপ্তর্ষির চেয়ে বড়। এর দক্ষিণের তিন তারা আবার আলাদা আরেকটি নকশা তৈরি করেছে। নাম বসন্ত ত্রিভুজ। মানে স্বাতী, চিত্রা ও ডেনেবোলা। ডেনেবোলার জায়গায় অনেকসময় সিংহমণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা রেগুলাসকে বসানো হয়।
Category: articles

সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩

বিটলজুস নিক্ষত্র এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। যেকোনো সময় এটি সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হতে পারে। ঠিক কখন সেটা আমরা জানি না। আমরা নক্ষত্রটা থেকে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে আছি৷ তাই বিস্ফোরণে ক্ষতি হবে না। দেখব শুধু সুপারনোভার অসাধারণ রূপ!


বিটলজুস



সম্প্রতি লোহিত অতিদানব নক্ষত্রটার উজ্জ্বলতা ৫০% গুণ বেড়েছে। ফলে আবারও শুরু হয়েছে জল্পনাকল্পনা৷

বিটলজুস একইসাথে একটি লোহিত অতিদানব ও অর্ধনিয়মিত বিষম ও স্পন্দনশীল তারা। মানে এর উজ্জ্বলতার পরিবর্তন কিছু নিয়ম মেনে চলে। উজ্জ্বলতার পরিবর্তনের আছে বেশ কিছু চক্র৷ মূল চক্রটি ৪০০ দিনের। তবে ১২৫ ও ২৩০ দিনের দুটি ছোট চক্রও আছে। আছে আবার ২২০০ দিনের একটি বড় চক্র৷ এসব কারণে বিটলজুসের উজ্জ্বলতার পরিবর্তন জ্যোতির্বিদদের কাছে এক মহাধাঁধা৷

কয়েক বছর আগে এর উজ্জ্বলতা কমে আসে। সবাই এর কারণ নিয়ে ভাবতে থাকল। পরে দেখা গেল, উজ্জ্বলতা আসলে কমেনি। নক্ষত্রটার পৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত পদার্থ ঠাণ্ডা হয়ে মেঘে পরিণত হয়৷ আর তাতে বাধাগ্রস্ত হয় আলো৷

এখন আবার উজ্জ্বল হচ্ছে বিটলজুস৷ এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা সম্ভবত প্রত্যাশার চেয়ে আগেই সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হবে৷ মান্থলি নোটিসেস অব দ্য রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিকেল সোসাইটি জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে মিল্কিওয়ের পরবর্তী সুপারনোভা হবে বিটলজুসই৷

বিটলজুস বর্তমানে লোহিত অতিদানব তারা। পেছনে ফেলে এসেছে প্রধান ক্রম দশা। যে সময় এটি হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম বানাত৷ ৮০ থেকে ৮৫ লাখ বছর ধরে কাজটি করে এসেছে নক্ষত্রটা৷ ভর হারিয়ে তারারা ফিউশন বিক্রিয়ার বহির্মুখী চাপকে আর ধরে রাখতে পারে না। নক্ষত্রের বাইরের দিক ফুলে ফেঁপে ওঠে৷ ভর কমলেও আকার যায় বেড়ে৷

তবে ফিউশন তখনও চলে। শুরু হয় কার্বন পোড়া। তৈরি হয় আরও কিছু ভারী মৌল। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিটলজুস এ ধাপের শেষের দিকে আছে। কার্বন পোড়ার ধাপ আছে কয়েকটি৷ বিটলজুস স্পন্দিত হয়, পদার্থ ছুঁড়ে মারে, আবর্তন করে। আবার ছুটে চলে মহাশূন্য ধরে। কার্বন পোড়ারনোর কোন ধাপে নক্ষত্রটা আছে তা না জানা গেলে সঠিক করে বলা যাবে না কবে নক্ষত্র সুপারনোভা হবে৷ জ্যোতির্বিদরা দেখেন নক্ষত্রের বাইরে অংশ৷ ভেতরের খবর সঠিক করে বলা সম্ভব হয় না।

তবে সাম্প্রতিক এ গবেষণা বলছে বিস্ফোরণটা হতে পারে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে৷ ২০০ পারসেক দূরের এ বিস্ফোরিত পৃথিবীর আকাশে অন্যতম সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণাই করবে। ছুঁড়ে দেওয়া ক্ষতিকর এক্সরে বা গামা রশ্মি থেকে আমরা নিরাপদ।



বিটলজুস রাতের আকাশের নবম উজ্জ্বল তারা। আদমসুরত বা কালপুরুষ মণ্ডলে এর অবস্থান। শীতের আকাশে সহজেই উজ্জ্বল এ তারার দেখা পাবেন। মে মাসের দিকে পশ্চিম দিগন্তে হারিয়ে যাবে। আগস্টের শেষের দিকে আবার দেখা যায় ভোরের পূবাকাশে। নিচের লিঙ্কে বিটলজুস ও অন্যান্য উজ্জ্বল তারা কীভাবে খুঁজে পাবেন দেখানো আছে। 

আদমসুরত তারামণ্ডল। উপরে বামপাশের তারাটাই বিটলজুস। 

Category: articles

বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩

রাশি শব্দটা দেখে জ্যোতিষশাস্রের কথা ভাববেন না। রাশি মানে আসলে তারামণ্ডল। তুলারাশি মানে আসলে আকাশের তুলামণ্ডল। ইংরেজিতে লিব্রা (Libra)। পৃথিবীর আকাশে ৮৮টি তারামণ্ডল আছে। বছরের একেক মাসে একেকটাকে ভাল দেখা যায়। এর মধ্যে জুন মাসের অন্যতম তারামণ্ডল তুলারাশি।



তারামণ্ডলের পরিচয়


জুনের রাত নয়টার দিকে দেখা যায় এ মণ্ডলটাকে। খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। তবে অন্ধকার মেঘমুক্ত আকাশে খালি চোখে সহজেই দেখা যায়। জুবেনেলজিনুবি ও জুবেনেশামেলি এ মণ্ডলের উজ্জ্বল দুই তারা। জুবেনেলজিনুবির বাংলা নাম বিশাখা। জুবেনেশামেলির নাম সৌম্যকীলক। খুঁজে পেতে কাজে আসবে পাশের তারামণ্ডল বৃশ্চিক।




বৃশ্চিকের হৃদয়ের তারাটির নাম অ্যান্টারেস। বাংলায় জ্যেষ্ঠা। মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাও এটাই। আর রাতের আকাশের ১৬তম উজ্জ্বল তারা। পরিষ্কার আকাশে অ্যান্টারেস ও কাঁকড়াবিছা আকৃতির পুরো বৃশ্চিক সহজেই দেখা যায়। এই মণ্ডলের উপর দিয়েই আবার চলে গেছে মিল্কিওয়ে ছায়াপথের সুন্দর দৃশ্যমান বাহুটা।

উজ্জ্বল তারাদের গল্প

অ্যান্টারেসের সামনেই আছে তুলামণ্ডল। অ্যান্টারেসের সামনে বৃশ্চিকেরই আরও তিনটি মোটামুটি উজ্জ্বল তারা আছে। অ্যান্টারেস থেকে এ তিনটির মাঝের তারাটির সাথে রেখা টেনে প্রায় তিনগুণ গেলেই পাওয়া যাবে তুলার দ্বিতীয় উজ্জ্বল তারা জুবেনেলজিনুবি। এটাই এ মণ্ডলের আলফা তারা। তারাটির অবস্থান প্রায় বরাবর সূর্যপথের ওপর। এ কারণেই সম্ভবত একে আলফা তারা নাম দেওয়া হয়েছে।


তুলামণ্ডল খুঁজে পেতে কাজে আসবে বৃশ্চিক



মণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি হলো জুবেনেশামেলি। আনুষ্ঠানিক নাম বেটা লিব্রি। যাকে পাওয়া যাবে জুবেনেলজেনুবির বাঁয়ে। অ্যান্টারেসের প্রায় অর্ধেক দূরত্বে। জুবেনেলজিনুবির চেয়ে একটু বেশিই উজ্জ্বল।

বাংলায় মণ্ডলটাকে আমরা তুলা বা দাঁড়িপাল্লা বলি। ব্যাবিলনীয়রাও একে স্কেল বা পাল্লা বলত। গ্রিকরাসহ কেউ আবার কাঁকড়াবিছার দাঁড়াও বলত। এটি রাশিচক্রের ১৩ মণ্ডলের অন্যতম রাশি। মানে পৃথিবী থেকে সূর্যের আপাত অবস্থান আকাশে যে যে অঞ্চলে মনে হয়, তুলাও সেরকম একটি অঞ্চলে আছে।

রাশিচক্রের পরিচয়

প্রাচীন মিশরে লিব্রার তিন উজ্জ্বল তারাকে একত্রে নৌকা বলা হত। আলফা, বেটা ও সিগমা তারার এই নৌকার পেটের দিকটা আছে বৃশ্চিকের দিকে। টলেমির ৪৮টি তারানকশার মধ্যে তুলাও ছিল। প্রাচীন রোমে প্রথম একে তারামণ্ডল নাম দেওয়া হয়।

স্বাভাবিকভাবেই তুলার আশেপাশে রাশিচক্রের আরও মণ্ডল আছে। সামনে আছে ভার্গো বা কন্যারাশি। বৃশ্চিকের কথা আগেই বলেছি। যা আছে পেছনে। এছাড়াও আছে সর্পধারীমণ্ডলজুবেনেশামেলির পাশে। আরেকটি মণ্ডল হাইড্রা আছে সিগমা তারার পাশে। হাইড্রা রাশিচক্রের বাইরের মণ্ডল।

অক্টোবরের ৩১ থেকে নভেম্বরের ২২ পর্যন্ত সূর্য এ মণ্ডলে থাকে। ফলে এ সময় একে দেখা যাবে না। কারণ উদয়-অস্ত হবে সূর্যের সাথে।

সূত্র: আর্থস্কাই, ইংরেজি উইকিপিডিয়া 
Category: articles

বুধবার, ১০ মে, ২০২৩

বিজ্ঞানের কাজ হলো পৃথিবী ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার পর্যবেক্ষণ। অতঃপর তার ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্ভাব্য পুর্বাভাস প্রদান। এভাবেই গড়ে ওঠে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে আগমন ঘটে প্রযুক্তির। কোয়ান্টাম মেকানিকস একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এর প্রয়োগ ঘটেছে বর্তমানে ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আমাদের হাতে থাকা মোবাইলের চিপের প্রযুক্তির গভীরে আছে কোয়ান্টাম মেকানিকসের কারিশমা। স্মার্টফোনে আছে কয়েক শ কোটি ট্রাঞ্জিস্টর। কোয়ান্টাম মেকানিকসের ধারণা কাজে না লাগানো গেলে সিলিকন-ভিত্তিক এই প্রযুক্তি কাজ করত না। ফোনের ক্যামেরার সিসিডি সেন্সর কাজ করত না আলোকবিদ্যুত তত্ত্বের ধারণা প্রয়োগ ঘটানো না গেলে। 




আবার প্রযুক্তিও অকৃতজ্ঞ নয়। বিজ্ঞান তো প্রযুক্তির পথ খুলে দেয়। প্রযুক্তিও আবার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে সহজ করে দেয়।  ছোট্ট এক প্রযুক্তি লেন্স। লেভেনহুকের হাত ধরে সেটাই সূচনা করে দেয় অণুজীববিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের শাখা। সেই ধারা এখনো আছে। বিজ্ঞানের সব শাখা উপকৃত হচ্ছে প্রযুক্তি থেকে। বিজ্ঞান গবেষণার অবিচ্ছেদ্য অংশ পরিসংখ্যানিক উপাত্ত বিশ্লেষণ। কম্পিউটার প্রযুক্তির বদৌলতে সহস্র ঘণ্টার বিশ্লেষণ ও মডেলিং করা যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা, মেশিন লার্নিং ও বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স বিজ্ঞানের তত্ত্ব তৈরি সহজ করে দিচ্ছে। 


জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বলা হয় প্রাচীনতম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সে শাখায়ও অবদান রাখছে প্রযুক্তি। খালি চোখে আকাশের কতটুকুই দেখা যায়! কত শত দূরের আলোকবর্ষের তারকারাজিকে টেলিস্কোপ হাজির করেছে আমাদের চোখের সামনে। সেসব পর্যবেক্ষণ থেকেই তো আমরা জানলাম, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আজো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। মহাশূন্যে পাঠানো অনুসন্ধানী যান দূর মহাকাশের খবর পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের কাছে। বিলিয়ন বিলিয়ন বাইটের ডেটা থেকে সুপারকম্পিউটার প্যাটার্ন বের করে দিচ্ছি। সহজেই আমরা খোঁজ পেয়ে যাচ্ছি ট্যাবির নক্ষত্রের মতো ব্যতিক্রমী জিনিসের। 


মুদ্রার উল্টো পিঠের কথাও এবার বলি। না, পারমাণবিক বোমার কথা বলছি না। প্রযুক্তি আরও বহু উপায়েই ক্ষতিকর হতে পারে। আজ শুধু মহাকাশে একটু চোখ বুলাবো। স্পেসএসক্সের মতো কোম্পানিগুলো প্রতিতিয়ত মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাচ্ছে। পাঠাচ্ছে সরকারি বেসরকারি আরও নানান সংস্থাই। কৃত্রিম উপগ্রহের আছে নানান ব্যবহার। এর মধ্যে আছে যোগাযোগ,  আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস, জিপিএস দিকনির্দেশনা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদি। ইউসিএস স্যাটেলাইট ডেটাবেজের হিসাব অনুসারে বর্তমানে ৫৪৬৫টি উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। 


এতে জ্যোতির্বিদদের আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং স্যাটেলাইট তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজেও লাগে। স্পেস টেলিস্কোপগুলো আকাশ পর্যবেক্ষণকে অনেকভাবে সুবিধাজনক করে দিচ্ছে। আলোকদূষণ, পর্যবেক্ষণে বিকৃতি নানান সমস্যার সমাধান স্পেস টেলিস্কোপ। কিন্তু সমস্যারও জন্ম দিচ্ছে স্যাটেলাইট। 


পৃথিবীর কক্ষপথের কৃত্রিম উপগ্রহরা বাধাগ্রস্থ করছে পৃথিবীভিত্তিক আকাশ পর্যবেক্ষণকে। সম্প্রতি নিম্ন-ভূ কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা বাড়ছে। এমনিতেও বেশিরভাগ কৃত্রিম উপগ্রহের অবস্থান এ কক্ষপথে। ভূপৃষ্ঠের মোটামুটি ১৬০ কিলোমিটার থেকে ১,০০০ কিলোমিটার উচ্চতার কক্ষপথকে নিম্ন-ভূ কক্ষপথ বলা হয়। এ কক্ষপথের উপগ্রহদের বাধা সবচেয়ে বেশি টের পায় অপটিক্যাল ও নিকট-অবলোহিত (অবলোহিত আলোর কাছাকাছি পাল্লার আলো দেখার মতো) টেলিস্কোপগুলো। 


উপগ্রহের উপস্থিতিতে বড় অঞ্চল জুড়ে বা দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও সকাল ও সন্ধ্যার গোধূলির সময়টায় উপগ্রহ সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে আরেকটি বিঘ্ন তৈরি করে। ইউরোপীয় সাউদার্ন অবজারভেটরি  (ইএসও) ২০২১ সালের এক গবেষণায় এ সমস্যাগুলো তুলে ধরে। দেখা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে তিনভাগ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ নষ্ট হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় আকাশের বড় এলাকার পর্যবেক্ষণ (wide-field surveys)। গোধূলির সময়ের ৩০-৫০ ভাগ পর্যবেক্ষণ এভাবে ক্ষতগ্রস্থ হয়। 


২০২০ ও ২০২১ সালের অন্য গবেষণায় দেখা হয় অপটিক্যাল ও নিকট-অবলোহিত টেলিস্কোপগুলোর ওপর প্রভাব। দেখা যায়, ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (ভিএলটি) মধ্যম মানের ক্ষতির মুখে পড়ছে। একই আকারে ক্ষতির স্বীকার হবে ভবিষ্যতের ইএলটি (এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ)। তবে চিলিতে নির্মাণাধীন রুবিন পর্যবেক্ষণকেন্দ্র আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ টেলিস্কোপগুলো অল্প সময়ে আকাশের বিশাল এলাকা স্ক্যান করে। এ কারণে সুপারনোভা ও ক্ষতিকর গ্রহাণু শনাক্ত করতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 


জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি। মহাকাশ থেকে আসা বেতার তরঙ্গ শনাক্ত ও বড় করে দেখার কাজ হয় এখানে। এ তরঙ্গকে সঙ্কেতে রূপান্তর করার মাধ্যমে মহাবিশ্বের অনেক তথ্য জানা যাচ্ছে। রেডিও টেলিস্কোপগুলো দৃশ্যমান আলোর খোঁজ করে না। ফলে দেখার সমস্যা এখানে হয় না। সমস্যা হয় উপগ্রহদের পৃথিবীর দিকে পাঠানো সঙ্কেতের কারণে। রেডিও টেলিস্কোপ শুধু রাতের মৃদু আলোরই খোঁজ করে না, কাজ করে ২৪ ঘণ্টা জুড়েই। ফলে শুধু গোধূলির সময় নয়, সারা দিনই এরা উপগ্রহের বাধায় পড়ে।  


এছাড়াও কথা আছে। উপগ্রহের পাঠানো শক্তিশালী সঙ্কেতের তুলনায় দূর মহাকাশ থেকে বেতার তরঙ্গ খুব মৃদু। ক্ষতি করার জন্য উপগ্রহকে দূরের বস্তুর সামনে না থাকলেও হচ্ছে। টেলিস্কোপের দৃষ্টির আওতায় কোনো এক জায়গায় থাকাই যথেষ্ট। সমস্যাটির সমাধান একটি আছে অবশ্য। ব্যাপারটাকে বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন বর্ণালী ব্যবস্থাপনা। এ কাজের অংশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন কিছু নীতিমালা করেছে। উপগ্রহের জন্যে নির্দিষ্ট ব্যান্ডের কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য সংরক্ষিত রাখা হয়। 


তবে যোগাযোগের নতুন এক ঝাঁক স্যাটেলাইট নতুন সমস্যাও করছে। আগামী বছরগুলোতে নিম্ন-ভূ কক্ষপথে হাজার হাজার উপগ্রহের উপস্থিতিতে অবস্থা বদলে যাবে। আকাশে ঘুরে বেড়াবে বহুসংখ্যক দ্রুত গতির বেতার তরঙ্গের উৎস। ফলে আকাশের স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণ ব্যাহত হবে। 


কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে উপাত্ত থেকে উপগ্রহের চিহ্ন দ্রুত মুছে ফেলা সম্ভব হলে খুব দারুণ হত। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়। দূর আকাশের ছবির উপরে উপগ্রহের চলাচলের দাগ পড়ে যায়। পরবর্তীতে ছবিকে শতভাগ ঠিক করা সম্ভব হয় না। আবার ছবি ঠিক করতে গিয়ে দূরের মৃদু ছায়াপথের আলো বিকৃত হয়ে যায়। 


এসব সমস্যা সমাধানের জন্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উপগ্রহের চলার পথ এড়িয়ে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে পারেন। বা উপগ্রহ ক্যামেরা সামনে চলে এলে শাটার বন্ধ করে দিতে পারেন। এটা করতে গেলে হাজার হাজার উপগ্রহের সঞ্চার পথের খোঁজ রাখতে হবে। বাস্তবে যা অসম্ভবের নামান্তর। 


তবে চাইলে উপগ্রহের অপারেটররাও সমাধানে কাজে লাগতে পারেন। দৃশ্যমান আলোর টেলিস্কোপের জন্য সমাধান হতে পারে উপগ্রহকে অন্ধকার করে রাখা, চলার পথকে টেলিস্কোপের দৃষ্টির আওতার বাইরে রাখা, নিষ্ক্রিয় উপগ্রহকে কক্ষপথ থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি। অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবে এমন সহায়তা করেছেনও তারা। 


আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতিও ব্যাপারটা সমধানের প্রয়াস চালাচ্ছে। সাথে যুক্ত হয়েছে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন। তৈরি হয়েছে সিপিএস নামে একটি কেন্দ্র। যার সংক্ষিপ্ত নাম সেন্টার ফর প্রোটেকশন অব ডার্ক অ্যান্ড কোয়াইট স্কাই। বর্তমানে সক্রিয় ও আসন্ন উপগ্রহের ক্ষতিগুলো কেন্দ্রটি তুলে ধরছে। দেখা যাচ্ছে, এখনই আকাশে ২,৯৯৪টি উপগ্রহপুঞ্জ* (স্যাটেলাইট কন্সটেলেশন) আছে।  আরও ৪ লক্ষ ৩১ হাজার যুক্ত হবার অপেক্ষায় আছে! চার বছর আগে স্পেসএক্স ৬০টি স্টারলিংক উপগ্রহ নিক্ষেপের পর খুব দ্রুত বাড়ছে উপগ্রহের সংখ্যা।  


 ইএসওর বিজ্ঞানীরাও এয়ার অ্যান্ড স্পেস ল' জার্নালের এক নিবন্ধে তাদের উদ্বেগগুলো তুলে ধরেছেন। ইএসওর হিসাব বলছে, ভবিষ্যতে খালি চোখেই ১০০টি পর্যন্ত উপগ্রহ খালি চোখে দেখা যাবে। ভাবুন তাহলে রাতের আকাশ কতটা বদলে যাবে। আর যাদের পেশাই উপগ্রহের অপর পাশের বস্তু দেখা, তাদের যে কী বেহাল দশা হতে যাচ্ছে!


তারাও চেষ্টা করছেন যাতে উপগ্রহ ও পর্যবেক্ষণভিত্তিক জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা একে অপরকে বাধাগ্রস্থ না করেই এগিয়ে যেতে পারে। কারণ দিন শেষে একে অপরকে কাজে লাগবেই। 


* উপগ্রহপুঞ্জ: একই উদ্দেশ্যে কাজ করা প্রায় একই রকম দেখতে এক গুচ্ছ উপগ্রহ 

লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

তথ্যসূত্র: কিউটি ডট ইউ, হার্ভার্ড ডট এজু, ইউসিএস স্যাটেলাইট ডেটাবেজ, ইএসএ ডট ইন্ট, আর্থস্কাই ডট অর্গ 

  1.     https://qt.eu/discover-quantum/applications-of-qt/how-your-smartphone-uses-quantum-mechanics/
  2.     https://www.hup.harvard.edu/index-maint.html?isbn=9780674975910
  3.     https://www.ucsusa.org/resources/satellite-database
  4.     https://www.esa.int/ESA_Multimedia/Images/2020/03/Low_Earth_orbit
  5.     https://earthsky.org/space/how-satellites-harm-astronomy-whats-being-done

Category: articles

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২২

পৃথিবী থেকে এত দূরের একটা জিনিস খালি চোখেই দেখা যায়! কী অসাধারণ ও অকল্পনীয় ব্যাপার। ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ নেমে যায়। তাই তো অ্যানড্রোমিডা হয়ে ওঠেছে গল্প-কবিতার উপদান।


বলা হয়ে থাকে, খালি চোখে দেখা সম্ভব সবচেয়ে দূরের বস্তু এই অ্যানড্রোমিডা। যদিও আকাশ ও দৃষ্টি ভাল থাকলে ট্রায়াংগুলাম গ্যালাক্সিও দেখা যায়। অ্যানড্রোমিডার দূরত্ব পৃথিবী থেকে ২৫ লাখ আলোকবর্ষ। আর ট্রায়াংগুলামের ২৭ লাখ।

প্রতিবেশী ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডা

চলুন দেখে নেই, রাতের আকাশে কখন কীভাবে খুঁজে পাব অ্যানড্রোমিডাকে

দেখার জন্যে প্রথমেই লাগবে একটি অন্ধকার আকাশ। কৃত্রিম আলোর ঝলক যেখানে থাকবে না। দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। এ সময় উত্তর গোলার্ধের সন্ধ্যার পূর্ব আকাশেই দেখা দেয় ছায়াপথটা। মধ্যরাতের দিকে প্রায় মাথার উপরের দিকে চলে আসে।
 
ছায়াপথটা খুঁজে পাওয়ার দুটি পথ আছে। একটি হলো ক্যাসিওপিয়ার মাধ্যমে। আরেকটি পেগাসাস বা পঙখীরাজ তারানকশার মাধ্যমে।

অক্টোবর মাসের দিকে উত্তর আকাশে ইংরেজি এম বা ডাব্লিউ (W) আকৃতির ক্যাসিওপিয়া খুব সহজেই দেখা যায়। এটা একটা তারামণ্ডল। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারার নাম শেডার। এই তারাটিই আপনাকে অ্যানড্রোমিডার দিকে নিয়ে যাবে। ছায়াপথটা আছে একই নামের তারামণ্ডলের মধ্যেই।

পেতে অসুবিধা হলে শেডার নক্ষত্রের সাথে পাশের দুটি নক্ষত্র নিয়ে একটা ত্রিভুজ বানান। এবার শেডার ত্রিভুজের যে শীর্ষে আছে সেদিকে ত্রিভুজের দৈর্ঘ্যের তিনগুণ যান।


ক্যাসিওপিয়া থেকে অ্যানড্রোমিডা
তারা পরিচিতি: শেডার

অ্যানড্রোমিডাকে আরেকভাবেও খুঁজে নেওয়া যায়। এজন্য আপনাকে বের করতে পেগাসাস ঘোড়ার বিশাল বর্গচিত্রটি। এর আলফেরাজ তারাটি পেগাসাসের সাথে অ্যানড্রোমিডাকে যুক্ত করেছে। এবার খুঁজে নিন মাইরাক ও মিউ অ্যানড্রোমিডা তারা দুটি। মাইরাক থেকে মিউর দিকে দাগ টেনে এদের দূরত্বের সমান গেলেই পেয়ে যাবেন অ্যানড্রোমিডা


পেগাসাস থেকে অ্যানড্রোমিডা

Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...