Advertisement

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ব্ল্যাক হোল কী জিনিস? ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয় কিভাবে? ব্ল্যাক হোলের সাথে অভিকর্ষের কী সম্পর্ক? আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে ব্ল্যাকহোলের কোন সম্পর্ক আছে কি? ব্ল্যাক হোলকি টাইম ট্র্যাভেল ঘটাতে পারে? ওয়ার্মহোলের সাথে ব্ল্যাক হোলের সম্পর্ক কোন দিক দিয়ে? আলোর মতো এমন গতিমান জিনিস কিভাবে ব্ল্যাক হোলের গর্তে আটকা পড়ে?

ব্ল্যাকহোল নিয়ে এমন আরো নানান কিছু জানতে নিয়মিত আয়োজন ব্ল্যাক হোলের গভীরে।

ব্ল্যাক হোল

শুরু করি মহাকাশের মহাদানব এই ব্ল্যাকহোল তথা কৃষ্ণগহ্বরদের পরিচতি দিয়ে।

আপনার নিশ্চয়ই ক্রিকেট খেলার বা দেখার অভ্যাস আছে, তাই না? নিশ্চয়ই আছে ছক্কা মারারও অভ্যাস। অনেক সময় দেখা যায় ব্যাটসম্যানের বেধড়ক পিটুনি খেয়ে বেচারা বল অনেক উপরে উঠে যায়। কিন্তু অভিকর্ষ সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় কথা প্রচলিত আছে- What goes up must come down। অর্থ্যাৎ, উপরে যে উঠবে, নিচেও তাকে নামতেই হবে। এই কথার প্রতিধ্বনি বাজাতেই যেন একটু পরেই বলটি আছড়ে পড়ে গ্যালারিতে, অথবা ভাগ্য খারাপ হলে ফিল্ডারের হাতে!

কেন উপরে ছুড়ে মারা বস্তু নিচে নেমে আসে? সহজ উত্তর- পৃথিবীর অভিকর্ষ। আচ্ছা, বলটিকে যদি আরেকটু জোরে মারা হতো, তাহলে কী হত? তখনও এটি নিচে নামত। তবে, একটু দেরিতে। আরেকটু জোরে মারলে? আরেকটু পরে। আরেকটু জোরে মারলে? আরেকটু পরে। এভাবেই কি চলতে থাকবে? না। সবকিছুরতো একটা সীমা আছে! (সব সময় অবশ্য না, গণিতবিদেরা আপত্তি করে বসবে!)

ধরুন, কোন ব্যাটসম্যানের গায়ে মিস্টার ইউনিভার্সের শক্তি ভর করেছে। সে বলটাকে এমন জোরে উপরে পাঠিয়ে দিল যে বলটি পৃথিবীর অভিকর্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহাশুন্যে হারিয়ে গেল। এটাকি সম্ভব যে কোন বস্তুকে নির্দিষ্ট কোন বেগে মারলে এটি আর ভূমিতে ফিরে আসবে না? হ্যাঁ সম্ভব। এটা করার জন্যে পৃথিবী থেকে খাড়া উপরে ছোড়া বস্তুর ক্ষেত্রে প্রাথমিক বেগ হতে হবে প্রতি সেকেন্ডে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার। এই বেগকে তাই বলা হয় মুক্তি বেগ (Escape Velocity)।

প্রকৃতপক্ষে মহাশুন্যে রকেট ও স্পেসশিপ পাঠানোর সময় এই মুক্তি বেগের কথা মাথায় রাখতে হয়। রকেটের প্রাথমিক বেগ দিতে হয় মুক্তি বেগের চেয়ে বেশি। নইলে কিন্তু “হোয়াট গোজ আপ, মাস্ট কাম ডাউন” কথাটি সত্য হয়ে যাবে।
 
এবার ধরুণ, কোনো গ্রহের ভর পৃথিবীর চেয়েও বেশি। তার ক্ষেত্রে এই মুক্তি বেগ হবে আরো বেশি [কেন?]। যেমন সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির কথাই ধরুণ। এর পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৫৯.৬ কি.মি.। অন্য দিকে সূর্যের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৬১৭.৫ কিলোমিটার। অর্থ্যাৎ সৌরপৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত কোন বস্তুকে সূর্যের আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরে চলে যেতে হলে প্রাথমিক বেগ এই পরিমাণ হতে হবে। অবশ্য সমগ্র সৌরজগতের মুক্তি বেগ আরো খানিকটা বেশি।

আমরা এও জানি, সূর্য একটি সাধারণ ভরের তারকা। এর চেয়েও বিশাল ও বাঘা বাঘা তারকাদের উপস্থিতি রয়েছে খোদ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই।

কোন বস্তুর মুক্তিবেগ নির্ভর করে দুটো জিনিসের উপর- সংশ্লিষ্ট বস্তুর ভর ও ব্যাসার্ধ। ভর বেশি হলে পৃষ্ঠে মুক্তি বেগ বেশি হবে, কিন্তু ব্যাসার্ধ বাড়লে কমে যাবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ভর বাড়লেই যে ব্যাসার্ধও বাড়বে- এমনটি কিন্তু বলা যাবে না। কারণ, একেতো ঘনত্ব বেশি হলে কিন্তু ব্যাসার্ধ কমে যাবে। উপরন্তু ভর বেশি হবার অর্থ দাঁড়াবে অভিকর্ষ শক্তিশালী হয়ে যাওয়া। ফলে বস্তুটি নিজেরই অভিকর্ষের চাপে গুটিয়ে গিয়ে ছোট্টতর হয়ে যাবে। পর্যায় সারণির একই পর্যায়ে ডানে গেলে যেমন ঘটে অনেকটাই তেমন, তাই না?

এখন ধরুণ এমন একটি নক্ষত্র আছে যার ভর সূর্যের চেয়ে এত বেশি যে হিসেব করে এর পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ যা পাওয়া গেল তা আলোর বেগের চেয়েও বেশি। তার অর্থ দাঁড়াবে ঐ নক্ষত্রের পৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না। অবশ্য নক্ষত্রের জীবনের শুরুর দিকে এই অবস্থা ঘটে না, ঘটে যখন হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে যায়। কেন? সেটা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে বিস্তারিত জানবো, ইনশা-আল্লাহ।

এখন, আমরা কোন বস্তু দেখি তখনই যখন বস্তুটি থেকে নির্গত আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে। কিন্তু কোন বস্তু থেকে যদি আলো আসতে না পারে তাহলে তাকে আমরা দেখবো না। ফলে, যে নক্ষত্রের মুক্তি বেগ আলোর চেয়ে বেশি সেটি আমরা দেখতে পাবো না। তখন এর নাম হবে ব্ল্যাক হোল। ঠিক এ কারণেই ব্ল্যাক হোল আমরা দেখি না। আর এ এজন্যেই এর নাম ব্ল্যাক হোল (Black hole) বা ‘অন্ধকার গর্ত’ যাকে বাংলায় ডাকা হয় কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণগহ্বর বলে।

তাহলে, ভর অল্প হওয়াতে গ্রহরা কিন্তু কখোনই ব্ল্যাকহোল হবার সুযোগ পাবে না। সব তারকারাও পাবে না। সুযোগ শুধু তারাই পাবে যাদের ভর সূর্যের অন্তত ১৫-২০ গুণ। অর্থ্যাৎ আমাদের সূর্যও কখনো ব্ল্যাক হোল হতে পারবে না।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জোরালো অনুমান হচ্ছে প্রত্যেকটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে অনেক বিশাল বিশাল ভরের ব্ল্যাকহোল যাদের ভর হতে পারে সূর্যের কয়েকশো বিলিয়ন গুণ পর্যন্ত! যেমন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার (Sagittarius A*) নামক অবস্থানে একটি ব্ল্যাকহোল আছে বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস।
 
আমরা একটু আগে দেখলাম, ব্ল্যাকহোল থেকে কোন কিছু বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের রাজত্বতো নিশ্চয়ই পুরো মহাকাশজুড়ে বিস্তৃত নয়। এর কেন্দ্র থেকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্ছলের বাইরের কোন বস্তুকে এটি গ্রাস করতে পারবে না। সেই সীমানার নাম ইভেন্ট হরাইজন (Event Horizon) বা ঘটনা দিগন্ত। এটাই মূলত সেই পয়েন্ট যেখান পর্যন্ত বস্তুটির অভিকর্ষ এত বেশি শক্তিশালী যে এর মুক্তি বেগ আলোর বেগের চেয়েও বেশি। আর কোনো কিছুরই বেগ যেহেতু আলোর বেগকে অতিক্রম করতে পারে না, তাই ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের অভ্যন্তরস্থ কোনো ঘটনা আমরা দেখতে পাবো না। এই সীমার বাইরের ঘটনা কিন্তু দেখবো।

কিন্তু মুক্তিবেগতো নির্ভর করে বস্তুর অভিকর্ষের উপর। আবার অভিকর্ষ কাজ করে ভরযুক্ত বস্তুর উপর। আলোরতো ভর নেই। তাহলে আলো কিভাবে ব্ল্যাক হোলের কবলে আটকা পড়ে? এটা জানতে হলে অভিকর্ষ ও আপেক্ষিকত তত্ত্বের একটু ইতিহাস জেনে আসতে হবে।

১৭৮৩ সালে বিজ্ঞানী জন মিচেল ‘ডার্ক স্টার’ (dark stars) শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ভাবলেন যে কোন বস্তুর ভর এত বেশি ঘনীভূতওতো হতে পারে যে আলোও এর ফাঁদে আটকা পড়ে যাবে। তাঁর সেই ডার্ক স্টারকেই এখন আমরা ব্ল্যাকহোল বলে ডাকি।
 
একই রকম ভাবনা আসে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী মারকুইস ডে লাপ্লাসের মাথায়ও। তবে মজার বিষয় হলো, তিনি তাঁর বই The System of the World এর ১ম এবং ২য় সংস্করণেই শুধু ভাবনাটি ছাপেন এবং তুলে দেন পরবর্তী সংস্করণগুলো থেকে। কারণ, তখনকার সমাজে এই ধরণের ভাবনাকে মানুষ পাগলের প্রলাপ মনে করত। আর বিজ্ঞানী হকিং এর ভাষায়, তিনি নিশ্চয় চাননি পাগলের খ্যাতি পেতে।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের পর কার্ল সোয়ার্জসাইল্ড এই ধরনের বস্তুর জন্যে একটি গাণিতিক সমাধান বের করেন। এর বেশ কিছু দিন পরে, ১৯৩০ এর দশকের দিকে ওপেনহাইমার, ভলকফ ও সিনডার মহাবিশ্বে এই ধরণের বস্তু থাকার সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন।

এই  তিন গবেষক প্রমাণ করে দেখালেন, একটি যথেষ্ট ভরযুক্ত নক্ষত্র যখন সব জ্বালানী হারিয়ে ফেলে তখন এতে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার বহির্মুখি চাপ থাকে না বলে এটি এর নিজস্ব অভিকর্ষের চাপে চুপসে যেতে থাকে।
এভাবেই আস্তে আস্তে বিকশিত হতে থাকে ব্ল্যাকহোলের ধারণা।
 
তবে, মিচেল এবং ল্যাপ্লাস- দু’জনেই আলোকে কণা বলে ধারণা করতেন যা অভিকর্ষ দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু ১৮৮৭ সালে দুই আমেরিকান বিজ্ঞানী মিচেলসন এবং মোরলের বিখ্যাত একটি পরীক্ষা থেকে জানা গেল, আলো সব সময় একটি নির্দিষ্ট বেগে চলে, এর উৎস কোথায় সেটা মোটেই বিবেচ্য নয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় অভিকর্ষ কিভাবে আলোকে প্রভাবিত করে? অভিকর্ষ বল বস্তুর ভরের সাথে সম্পৃক্ত। চার প্রকার মৌলিক বলের মধ্যে একটু ভিন্ন ‘বল’ অভিকর্ষ আকর্ষণ করে শুধু ভরযুক্ত বস্তুকে।

কিন্তু আলোরতো কোনো ভরই নেই। তাহলে তার কী দোষ? বেচারা ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাবে কেন?  
এই প্রশ্নের সমাধান নিয়ে এসেছিলেন আইনস্টাইন সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের (General theory of relativity) মাধ্যমে। এটা জেনেই আজকে বিদায় নিচ্ছি।
 
১৬৬৫ সালে সালে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন দিয়েছিলেন মহাকর্ষ-অভিকর্ষের ধারণা। বলা হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরকে নিজ দিকে আকর্ষণ করে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তার অভিকর্ষ ততোই শক্তিশালী হবে। নিউটনের এই সূত্র দিয়ে সূর্যের চারদিকে গ্রহদের গতিপথ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও কয়েকটি বিষয়ের নিখুঁত ব্যখ্যা পাওয়া সম্ভব হয়নি। এর অন্যতম উদাহরণ ছিল সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধের কক্ষপথের স্থানচ্যুতি।

এরকম আরো কিছু বিষয়ের নিখুঁত ব্যাখ্যা দিতে ব্যার্থ হয় নিউটোনিয়ান মহাকর্ষ।

এবার মহাকর্ষের হাল ধরেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে তিনি প্রদান করেন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (Special Theory of Relativity)। এর ১০ বছর পর ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব।
১ম তত্ত্ব মতে, আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলমান বস্তুর কাল দীর্ঘায়ন ও দৈর্ঘ্য সঙ্কোচন ঘটে। বেড়ে যায় ভরও।  আর ২য় তত্ত্বে তিনি মহাকর্ষকে তুলে ধরলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। মহাকর্ষ কোন ‘বল’ নয়। এটি হচ্ছে স্থান-কালের (Space-Time) বক্রতা। স্থান এবং কাল আলাদা আলাদা কিছু নয়। স্থানের তিনটি স্থানাঙ্কের সাথে চতুর্থ স্থানাঙ্ক  ‘সময়’ মিলিত হয়ে কোনো একটি ঘটনাকে পূর্ণাংগভাবে ব্যাখ্যা করে।

আপেক্ষিকতার এই নীতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি ভরযুক্ত বস্তুই তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়।

মহাকর্ষ (যেমন পৃথিবীর অভিকর্ষ) এভাবে স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়

নিউটোনিয়ান মহাকর্ষের মতই অবশ্য ক্ষুদ্র ভরবিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে এই বক্রতা হবে সামান্যই। অবশ্য এই নীতি আবার আমরা যখন পরমাণুর গহীণে অতি-পারমাণবিক কণিকার জগতে নিয়ে যাবো, তখন এটি একেবারেই খাটবে না। সেখানে আবার রাজত্ব করে বেড়ায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব। মহাবিশ্বের ম্যাক্রো (বৃহৎ) ও মাইক্রো (ক্ষুদ্র)- এই দুই জগতের শাসনভার যথাক্রমে তাই এই দুইটি আলাদা তত্ত্বের হাতে।

যাই হোক, বিশাল ভরের বস্তু কতৃক স্থান-কাল লক্ষ্যণীয়ভাবে বেঁকে যায় বলেই নক্ষত্রদের চারদিকে গ্রহদের আর গ্রহদের চারপাশে উপগ্রহের কক্ষপথ তৈরি হয়।

কিন্তু কোনো বস্তু স্থান এবং কালকে বাঁকিয়ে দেয়- এটা বললেই কি মানতে হবে? এর সপক্ষে প্রমাণওতো থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, প্রাচীন কালে প্রদত্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক (বা অবৈজ্ঞানিক) তত্ত্বের তুলনায় আপেক্ষিকতাকে অনেক বেশিই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।

সাধারণ আপেক্ষিকতার ভাষ্য মতে, ভর যেহেতু স্থান কালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেহেতু বড় বড় ভরের বস্তুদের লেন্সের মতো আচরণ করা উচিৎ।

অর্থ্যাৎ ধরুণ, আমরা কোনো নক্ষত্রের পেছনে অবস্থিত অন্য কোন বস্তু দেখতে চাই। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় সেই বস্তুকে দেখা না গেলেও মাঝখানের বস্তুটি যেহেতু স্থানকে বাঁকিয়ে দেবে, তাই অপরপাশের বস্তু থেকে আসা আলো সেই বক্রপথ অনুসরণ করে দর্শকের চোখে ধরা পড়বে। প্রমাণিত হবার পর এখন এই ঘটনাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং।
 
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর বদৌলতে আড়ালে লুকিয়ে থাকা বস্তু পর্যবেক্ষণ করা যায়

১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণের সময় সার্বিক আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়ে গেল। সূর্যের আলোর কারণে সাধারণ অবস্থায় দৃশ্যমান না হলেও সূর্যগ্রহণের সময়ের অন্ধকারে সূর্যের পেছনে অবস্থিত দেখা গেল হায়াডিজ তারাস্তবককে (Hyades Star Cluster)। প্রমাণিত হল আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। এই পরীক্ষণটি পরিচালনা করেছিলেন স্যার আর্থার এডিংটন।

 
উল্লেখ্য, সূর্যগ্রহণের সময়ের এই ঘটনা ও বুধের কক্ষপথের নিখুঁৎ বর্ণনাসহ আরো কিছু বিষয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতার পূর্বানুমানের সাথে বাস্তব ঘটনা মিলে গেল অবিকলভাবে যেখানে তা নিউটোনিয়ান তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ন ছিল না।
 
অতএব, বলা যাচ্ছে, অভিকর্ষ তার চারপাশের স্থানকে বাঁকিয়ে দিয়ে ঐ স্থানগামী যেকোনো কিছুকে সেই বক্রপথ অনুসরণ করতে বাধ্য করবে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে বক্রতার পরিমাণও হবে ততো বেশি।

এবার চিন্তা করা যাক ব্ল্যাকহোলদের মতো দানবদের কথা। এদের ভর এতই বেশি যে এরা এদের আশপাশের স্থানকালকে নির্দয়ভাবে এমনভাবে বাঁকাবে যে বক্রতা হবে শুধুই অন্তর্মুখী। অর্থ্যাৎ, এই বক্রতায় প্রবেশের দরজা থাকবে কিন্তু বেরুবার দরজা থাকবে না। গ্রামে বর্ষা মৌসুমে পুকুরে মাছ ঢোকানোর জন্যে দুটি বেড়া এমনভাবে মুখোমুখি লাগানো থাকে যে পুকুরে প্রবেশের সময় মাছ ঐ বেড়ার ফাঁক গলে চলে যেতে পারবে কিন্তু পুকুর থেকে বেরোতে পারবে না। ব্ল্যাকহোলের কাজও অনেকটাই এরকম।

ব্ল্যাক হোলে স্থান কালের বিকৃতি
এ কারণেই আলোর কোনো ভর না থাকলেও এটি ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে পড়ে যায়। দূর থেকে আসা আলো ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ভেতরে চলে গেলে আর বের হবার রাস্তা পাবে না। ফলে ঘটনা দিগন্তের ভেতরের কোন কিছু আমরা দেখতে পাবো না।

এ তো গেল ব্ল্যাকহোলের ভেতরের অবস্থা। ঘটনা দিগন্তের একটু বাইরে এমন একটি অঞল থাকা সম্ভব যেখানে বক্রতা ভেতরের দিকে অসীম না হয়ে একটি বৃত্তপথ তৈরি করবে। এই বৃত্তের বাইরের অঞ্চলগামী আলো অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এই বৃত্তাঞ্চলের আলোর কী হবে? এই আলোককণিকাটি ব্ল্যাকহোলের চারদিকে ঘুরে মরবে। অবিরত ব্ল্যাকহোলকে প্রদক্ষিণ করবে।

 
এই আলোকে কি তবে আমরা ব্ল্যাকহোলের উপগ্রহ বলতে পারি? নাহ! উপগ্রহ তো থাকে গ্রহদের। কী বলা যায় ভাবতে থাকুন। ততক্ষণে আমি আজকের মত বিদায়!!!
অন্যান্য পর্ব



Category: articles

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

অধিকাংশ অন্যান্য গ্যালাক্সির মতই এনজিসি ৪৮৮৯ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বাস করছে একটি বিশাল ভরযুক্ত ব্ল্যাক হোল। জ্যোতির্বিদদের ধারনা, এটি নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে।
শত শত গ্যালাক্সির ভীড়ে এনজিসি ৪৮৮৯ গ্যালাক্সির ছবি। এরই কেন্দ্রে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি ব্ল্যাক হোল। 
উপরের ছবির সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বড় গ্যালাক্সিটিই এনজিসি ৪৮৮৯। ৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে কোমা গ্যলাক্সি ক্লাস্টারে এর অবস্থান। এর কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটি আগের অনেক রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। এর ভর সূর্যের ২১ বিলিয়ন (বা ২ হাজার ১০০ কোটি) গুণ।
অন্য দিকে এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাস ১৩ হাজার কোটি কিলোমিটার। এই পাল্লাটি সূর্য থেকে নেপচুনের কক্ষপথের দূরত্বের ১৫ গুণ।  ঘটনা দিগন্ত হচ্ছে একটি ব্ল্যাক হোলের বাইরে সেই অঞ্চল যেখান থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে এর ভেতরের কিছু দেখা সম্ভব হয় না। অন্য দিকে, আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা সম্ভাব্য ব্ল্যাক হোলখানির ভর সূর্যের ৪০ লাখ গুণ। এর ঘটনা দিগন্তের পাল্লা বুধের কক্ষপথের এক পঞ্চমাংশ মাত্র।
কিন্তু আলোচ্য গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোলের রাক্ষুসে আচরণের সমাপ্তি ঘটেছে। এনজিসি ৪৮৮৯ এর খাবার কক্ষে এটি এখন বিশ্রামরত। বর্তমানে এর আশেপাশে নতুন জন্মানো তারকারা শান্তিতে বেড়ে উঠছে এবং একে প্রদক্ষিণও করছে। 
অন্য ব্ল্যাক হোলের মতই এটি বিভিন্ন গ্যালাকটিক বস্তু যেমন গ্যাস, ধূলিকণা ও অন্যান্য ধ্বংশাবশেষ সাবাড় করে করে একটি আক্রেশন ডিস্ক (Accretion disk) গঠন করে। গ্যাস-ধূলিকণার ঘুর্ণায়মান এই চাকতিকে ব্ল্যাক হোলটি তীব্র অভিকর্ষীয় ত্বরণে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। পরিণামে চাকতির তাপমাত্রা উঠে যায় লক্ষ ডিগ্রি পর্যন্ত। এই উত্তপ্ত বস্তু কতৃক নির্গত হয় দানবীয় এবং শক্তিশালী জেট বা ফোয়ারা । 
সক্রিয় থাকায় সময় জ্যোতির্বিদরা ব্ল্যাক হোলটিকে কোয়াসার শ্রেণিতে নাম তালিকাবদ্ধ করেন। ব্ল্যাক হোলটির ডিস্ক মিল্কিওয়ের চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তি নির্গত করত। ডিস্কটি ব্ল্যাক হোলের খাবারের যোগান দিয়ে দিতে দিতে এক পর্যায়ে আশেপাশের সব গ্যালাকটিক বস্তু নিঃশেষ করে ফেলে। ফলে, এটি এখন সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। তবু, রহস্যময় কোয়াসাররা মহাবিশ্বের শৈশবকালে কিভাবে গঠিত হয়েছিল তা জানতে ব্ল্যাক হোলটি জ্যোতির্বিদদের গবেষণার কাজে আসবে। 
আলো বেরিয়ে আসতে পারে না বলে ব্ল্যাক হোলকে সরাসরি দেখা না গেলেও পরোক্ষ উপায়ে এর ভর বের করা যায়। এনজিসি ৪৮৮৯ গ্যালাক্সির চারদিকে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্রদের বেগ পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে। এই বেগ থেকেই জানা গেছে ব্ল্যাক হোলটির বিশাল ভরের তথ্য।  


Category: articles

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ইতোপূর্বে আমরা বিভিন্ন ধরণের তারকার পরিচয় জেনেছিলাম। এতে অন্যতম শ্রেণী ছিল বাদামী বামন (Brown Dwarf)। এদেরকে বলা হয় ব্যর্থ তারকাকেন এরা ব্যর্থ? বাদামী বামনদের সাথে বড় বড় গ্রহের পার্থক্য কী? এদেরকে গ্রহ বলা হয় না কেন? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে আজকের পোস্ট।
গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল পুঞ্জ সংকুচিত হয়ে জন্ম হয় একেকটি তারকার। তারকার প্রধান লক্ষণই হচ্ছে এর কেন্দ্রের নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো, তাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু বাদামী বামন তারকাদের ভর (Mass) এত বেশি নয় যে অভিকর্ষীয় চাপ নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া সংঘটিত করতে পারবে। আর এই ব্যর্থতাই তাদের কপালে ব্যর্থ তারকার তিলক পরিয়ে দিয়েছে।
অন্যান্য প্রধান ক্রমের তারকাদের মতই জীবন শুরু হয় বাদামী এই তারাদের। প্রধান ক্রমের তথা Main Sequence নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে অভিকর্ষীয় চাপে বস্তুপিণ্ডটি ভেতরের দিকে সংকুচিত হতে থাকে যতক্ষণ না এটি হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। কিন্তু বাদামী বামনের কখোনই সেই ধাপে পৌঁছতে পারে না। হাইড্রোজেন ফিউশন শুরু হবার আগেই সে পৌঁছে যায় স্থিতিশীল অবস্থায়।

বিভিন্ন ভর ও তাপমাত্রার বাদামী বামনদের দেখা মেলে। এদের ভর বৃহস্পতির ১৩ থেকে ৯০ গুণ বা সূর্যের প্রায় এক দশমাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আমরা জানি তারকাদেরকে তাদের বর্ণালীর ভিত্তিতে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়। M জাতের তারকারা হল সফল তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে শীতল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। বেশিরভাগ এম তারকারাই লোহিত বামন হলেও কিছু আছে বাদামী বামন।
পরিচিত বামনদের মধ্যে Y dwarfs হচ্ছে সবচেয়ে শীতল। এদের কোনটার তাপমাত্রা বাসার উনুনের সমান, কোনটা আবার মানবদেহের সমান উষ্ণ। ফলে, এরা সামান্য আলো ও শক্তি বিকিরণ করে। ফলে, এদেরকে শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত এদের আলোচনা শুধু বই পুস্তকেই সীমিত ছিল, দেখা যায়নি চাক্ষুষ। সম্ভবত, এ কারণেই এদেরকে আগে কালো বামন (Black Dwarfs) বলে ডাকা হত। কিন্তু, এখন এই নামে ডাকা হয় শ্বেত বামনদের চূড়ান্ত দশাকে যখন তারা সবটুকু তাপ বিকিরিত করে ফেলে।

এতই যখন সমালোচনা, তখন বেচারারদের কেন গ্রহ বলা হয় না?
এদের এত অল্প ভরের কারণের এদের পরিচয়কে গ্রহের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলার সুযোগ আছে। উপরন্তু, দিন দিন গ্যাসীয় দৈত্য জাতের গ্রহদের সংখ্যা বাড়ছে। একই সাথে এই তারকাগুলোতে ফিউশনের অভাবের ফলে, অনেকে তাদেরকে গ্রহ বলার সাহস দেখাতে পারেন।
গ্রহদের সাথে অন্যতম পার্থক্যটি হচ্ছে নিজস্ব আলো থাকা। গ্রহদের কিন্তু নিজের আলো নেই। তাহলে, সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা বা ভোরে শুকতারাসহ কত গ্রহই তো আলো দেয়? আরে ভাই! ওগুলোতো চাঁদের মতই সূর্যের আলোই প্রতিফলিত করে। বাদামী বামনের অতিরিক্ত শীতল হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত লাল এবং অবলোহিত আলো (Infrared ) বিকিরণ করে। শীতল হয়ে গেলে দেয় এক্সরে এবং অবলোহিত আলো।
এরপরেও, গ্রহ এবং বাদামী বামনদের মাঝখানের সীমানা রেখা খুবই চিকন। কিছু বাদামী বামন ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাস দানব গ্রহদের মত বায়ুমণ্ডল তৈরি করেছে। বাদামী বামনদের চারদিকে প্রদক্ষিণরত গ্রহ থাকতে পারে, আর গ্রহদের থাকে উপগ্রহ। এখন পর্যন্ত জানা বৃহত্তম গ্রহ ওয়াসপ-১৭বি (WASP-17b) হচ্ছে। এর আকার বৃহস্পিতির দ্বিগুণ হলেও ভর প্রায় অর্ধেক। অন্য দিকে, সবচেয়ে ভারী গ্রহ হচ্ছে ডেনিস পি (DENIS-P )। এর ভর বৃহস্পতির ২৮ গুণেরও বেশি। ফলে, এই গ্রহ হয়ে পড়েছে বিতর্কিত। অনেকে একে দাবী করছেন বাদামী বামন বলে।  তাহলে, গ্রহ এবং বাদামী বামন নক্ষত্রদের উপযুক্ত সীমারেখা কী?


মহাকাশের বস্তুপিণ্ডদের সংজ্ঞা দেবার দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহাকাশবিজ্ঞান সমিতির (International Astronomical Union)। তাদের মতে যে বস্তুপিণ্ড ডিউটেরিয়াম (হাইড্রোজেনের ২ ভর বিশিষ্ট আইসোটপ) জ্বালাতে পারে, তাকে তারকা বলা যাবে। আর বৃহস্পতি গ্রহের ১৩ গুণ পর্যন্ত ভর বিশিষ্ট বস্তুকে বলা হবে গ্রহ (এটা গ্রহের সংজ্ঞা নয়, সীমানা)।
সূত্রঃ
[১] space.com
[২] উইকিপিডিয়া 
Category: articles

শনিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৫

তারকাদের শ্রেণীবিভাগ জানার আগে জেনে নিই, তারকা কারা? 
সহজ ভাষায় যেসব মহাজাগতিক বস্তুপিণ্ড এর কেন্দ্রস্থলে (সাধারণত) তাপ নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ আলো, তাপ ও বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে তাকে মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় তারকা বা নক্ষত্র (Star) বলে। গ্রহদের (Planet) এর পার্থক্য হল, গ্রহদের নিজস্ব আলো থাকে না। বড় বড় গ্রহদের আকার তো প্রায় বামন তারকাদের কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে বাউন্ডারিটা এখানেই। নচেৎ, গ্রহদের উপগ্রহদেরকে গ্রহ বানিয়ে গ্রহকে কেন্দ্র করে একটি গ্রহমণ্ডল বা আরেকটি সৌরজগত গড়ে উঠত।
কিন্তু নিজস্ব আলো না থাকায় গ্রহরা সেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিতে ব্যর্থ হয়। যেমন আমাদের সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির কথাই ধরা যাক। অল্পের জন্যে বেচারা তারকা হতে পারেনি। কাছাকাছি কিন্তু গিয়েছে। সে কিন্তু এখনও একটি গ্যাস দানব। আর সব তারকাই কিন্তু গ্যাসীয় প্লাজমায় গঠিত। অন্তত জীবনের প্রথম দিকে একটি উল্লেখযোগ্য সময় জুড়ে তাই থাকে।
কি বলতে বলতে কোথায় চলে এলাম!
এখানে আমরা ভর বিবেচনায় রেখে উল্লেখযোগ্য কিছু তারকার পরিচয় জানবো।
তারকাদের শ্রেণির কথা আসলে প্রথমেই আসবে প্রধান ক্রম বা মেইন সিকুয়েন্স (Main Sequence Star) দের কথা।
এরা হল, একেবারে যুবক তারকা। আমরা সাধারণত জানি যে, তারকারা অবিরাম হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করে আলো, তাপ ও অন্যান্য বিকিরণ নির্গত করে। আসলে কথাটি প্রযোজ্য এই মেইন সিকুয়েন্স নক্ষত্রদের জন্য। বর্তমানে মহাবিশ্বে এই যুবকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারকাদের ৯০ ভাগ। এদেরকে যুবক বললাম কারণ, এটাই তারকাদের বয়সের যুবক কাল। এর পর আস্তে আস্তে এরা জীবনের সম্পাতির দিকে পৌঁছে যাবে। অর্থ্যাৎ, মারা যাবে। মারা গেলে কী হবে? এই প্রশ্ন থাকুক আপাতত হিমাগারে।
সূর্য হলো একটি প্রধান ক্রমের নক্ষত্র

এই তারকারা যত বেশি উষ্ণ হয়, তত বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এই লেখা পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে, আমাদের সূর্য মামা কোন ধরণের তারকা। হ্যাঁ, সেই এই দলে। তার মানে আমরা মহাবিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের সদস্য। অবশ্য আকারের দিক থেকে সূর্য মাঝারি মানের তারকা।
মেইন সিকুয়েন্স তারকারা সাধারণত বামনাকৃতির হয়।[১] এদের ভর সূর্যের ২০ গুণ পর্যন্ত হতে পারে এবং উজ্জ্বলতা হতে পারে ২০ হাজার গুণ পর্যন্ত।
এই বামনেরা আবার কয়েক প্রকার হতে পারে।
প্রথম বলা যাক হলুদ বামনদের (Yellow Dwarf) কথা। এরা আকারে ছোট। আমাদের সূর্য পড়ে এই দলেই। এদের ভর সূর্যের খুবই কাছাকাছি (০.৮ গুণ থেকে ১.২ গুণ এর মধ্যে) থাকে। আর তাপমাত্রা থাকে ৫৩০০ থেকে ৬ হাজার কেলভিন এর মধ্যে। এদের অপর নাম জি-টাইপ মেইন সিকুয়েন্স স্টার বা সংক্ষেপে G dwarf star। এই নামের উৎস এদের বর্ণালী।
আরেক ধরণের প্রধান ক্রমের তারকারা হল লোহিত বামন (Red Dwarf)। এরা আরো ক্ষুদ্র, সত্যি বলতে ক্ষুদ্রতম। এদের ভর টেনেটুনে সূর্যের প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত হতে পারে। পাশাপাশি এরা আবার দুর্বল ও ঠাণ্ডা নক্ষত্রও বটে, এদের পৃষ্ঠতাপমাত্রা থাকে ৪ হাজার কেলভিন এর নিচে। অন্য দিকে সূর্যের পৃষ্ঠতাপমাত্রা কিন্তু ৬ হাজার কেলভিনের কাছাকাছি, ৫৭৭৮ কেলভিন। তবে, এই তারকাদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। প্রায় ৭৭ ভাগ তারকার পরিচয়পত্রেই লোহিত দানব লেখা।  এমনকি, সূর্যের নিকটতম তারকা প্রক্সিমা সেন্টৌরিও একটি লোহিত বামন।
প্রধান ক্রমের তারকাদের মধ্যে এছাড়াও কমলা, সাদা ও নীল তারকাদের দেখা মেলে। এদের মধ্যে কমলাদের সংখ্যা মোটামুটি ভালো থাকলেও সাদা ও নীলের সংখ্যা যথাক্রমে স্বল্পতর।
তারকাদের ৯০ ভাগ সম্পর্কে এখন আমরা জানি। বাহ!
এরা তো সবাই ছিল বামন তারকা। এবার আসা যাক দানবদের (Giant Star) জগতে। এদের ব্যাসার্ধ সূর্যের কয়েকশো গুণ পর্যন্ত হতে পারে।  মূলত, মেইন সিকুয়েন্স নক্ষত্রদের হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তখন এদের মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে, কিন্তু বহিঃস্থ অংশ তখনও প্রসারিত হতে থাকে। এতে করেই এর ব্যাসার্ধ বেড়ে যায়। জীবনের এই সময়েই এদের নাম হয় দানব তারা। এখন থেকে ৫ বিলিয়ন বছর পরে সূর্য এই রকম দানব হয়ে যাবে। তখন, সূর্য বুধ, শুক্র এবং (সম্ভবত) পৃথিবীর কক্ষপথকেও গিলে খাবে। আমার মনে হয়, বলাটা অপ্রাসংগিক হবে না, যে সম্ভবত তখনই কিয়ামত হবে। কারণ, কুর;আন বলছে, এক সময় চন্দ্র ও সূর্য মিশে যাবে। এছাড়াও, হাশরের দিন সূর্য মাথার খুবই নিকটে থাকবে। যাই হোক, আমি ধর্মে অতটা বিশেষজ্ঞ নই।
দানব (Giant Star) নক্ষত্রদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচত হল লোহিত বামন তারকা (Red Giant)। এরা হয় অপেক্ষাকৃত শীতল। ভর হতে পারে সূর্যের আট গুণ পর্যন্ত।। এদের বয়সও কিছুটা বেশি।  পৃথিবী থেকে ৮৮ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গামা ক্রুসিস (Gamma Crucis) হচ্ছে আমাদের নিকটতম লোহিত দানব।

দানব নক্ষরদের মধ্যে এছাড়াও সাবজায়ান্ট, হলুদ দানব ও নীল দানব নক্ষত্রদের দেখা মেলে। নীল দানবেরা প্রধান ক্রম শেষ করে হিলিয়াম পোড়াতে থাকে।  দানব নক্ষত্ররা খুব দ্রুত এই ধাপ পেরিয়ে যায়।
এবার আসি আরো ভারী তারকা সুপারজায়ান্টদের (Supergiant) জগতে। এদের ভর হতে পারে সূর্যের ৮ থেকে ১২ গুণ। আর, ব্যাসার্ধ হয় সূর্যের ৩০ থেকে ১০০০ গুণ অবধি। এরাই তারকাদের জগতে সবচেয়ে ভারী ও বড়। বড় ভাই আর কি। এদের কেউ কেউ এত বড় যে সে একাই আমাদের সমগ্র সৌর জগতের সমান। পৃথিবী থেকে ৬০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত বিটলজুস (Betelgeuse) নক্ষত্রটি একটি সুপারজায়ান্ট। এর নামটি এসেছে يد الجوزاء আরবী কথা থেকে যার অর্থ কালপুরুষের হাত (The hand of Orion)। ভুলক্রমে, আরবি অক্ষর ইয়াকে ইংরেজি B এর প্রতিনিধি মনে করায় এর নাম এমন হয়ে গেছে। 
বিটলজুস নক্ষত্রের অবলোহিত ছবি
 এছাড়াও অ্যান্টারিস, রিজেল নক্ষত্ররা হল সুপারজায়ান্ট তারকার উদাহরণ। এদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, এই তারকাদেরই পরবর্তী দশা হল, আমাদের সকলের প্রিয় টপিক ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। কেউ কেউ অবশ্য সুপারনোভা দশায়ও থেকে যেতে পারে। সুপারজায়ান্টরা লাল, নীল বা হলুদ হতে পারে।  যেসব সুপারজায়ান্টরা অত্যাধিক হারে ভর হারাতে থাকে, তাদেরকে আবার ডাকা হয় হাইপারজায়ান্ট বলে।

এবার আবার একটু বামনদের জগতে ফিরে যাই। প্রথমে আসি শ্বেত বামনদের (White Dwarf) কথায়। এদের আকার অনেক ক্ষুদ্র, এমনকি প্রায় পৃথিবীর সমান! ভাবা যায়! একটি তারকা একটি গ্রহের সমান। তবে না, ওকে অবহেলা করা যাবে না। কারণ ওর ঘনত্ব অত্যাধিক বলে ভর কিন্তু অনেক বেশি। প্রধানত কার্বন দ্বারা গঠিত এই তারকাদের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। 

যেসব দানব নক্ষত্রের ভর দুই সৌর ভরের কম থাকে তারা  ধাপের শেষের দিকে যখন বহিঃস্থ আবরণ ছুড়ে দেয় তখনই পরিণত হয় শ্বেত বামনে। ভর আরো বেশি হলে এরা সুপারনোভা বা নিউট্রন স্টার হতে পারতো। ধীরে ধীরে এরা তাপমাত্রা হারিয়ে কালো বামনে পরিণত হয়। আমাদের সূর্যের এক দিন এই দশা হবে। রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম তারকা লুব্ধক ( Sirius ) ইতোমধ্যেই শ্বেত বামন হয়ে বসে আছে। 

এবার বলবো এক ব্যর্থ তারকার কথা। ব্যর্থ হলে তাকে আবার তারকা বলা হয় কেন? 
ব্যর্থ বলার কারণ হচ্ছে, বেচারাদের ভর এত কম যে নিজস্ব অভিকর্ষের প্রভাবে ধসে গিয়ে যে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করবে, সেই ক্ষমতা পায়নি। এদের ভর হয় বৃহত্তম গ্রহদের ভর থেকে সবচেয়ে কম ভরের প্রধান ক্রমের তারকাদের মধ্যে। তবে, নিজস্ব উজ্জ্বলতা কিছুটা আছে বৈকি। তাই, আবার গ্রহের খাতায়ও নাম লেখাতে পারেনি। এদের নাম হচ্ছে বাদামী বামন (Brown Dwarf)। সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির ১৩ গুণ ভরযুক্ত বাদামী বামনরা ডিউটেরিয়াম জ্বালিয়ে এবং ৬৫ গুণ ভরবিশিষ্ট বাদামী বামনরা লিথিয়াম জ্বালিয়ে কিছু আলো উৎপাদন করে। এ কারণেই গ্রহদের শ্রেণিশিক্ষক খাতায় এদের নাম তোলেনি। 
বাদামী বামনের তুলনা


এবার বলবো নিউট্রন স্টারদের কথা। এদেরকে এই নামে ডাকার কারণ, সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর এদের কোর বা মূলবস্তুর চাপ এত অত্যাধিক হয় যে, প্রোটন ও ইলেকট্রন একত্রিত হয়ে নিউট্রন গঠন করে। যেসব দানব নক্ষত্রের ভর দুই থেকে পাঁচ সৌর ভরের মধ্যে থাকে, তারাই এই পরিণতি লাভ করে। এদের ঘনত্ব হয় অনেক বেশি।  মজার কথা হলো, এদের ব্যাস হয় মাত্র ৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার, কিন্তু ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টি মিটারে প্রায় ১ টেরা কেজি (১ টেরা কেজি = ১০০০,০০০,০০০,০০০ কেজি)। চমকে গেলেন? স্বাভাবিক। আমিও নিজেও তাই।  এদের হাইড্রোজেন নির্মিত একটি হালকা বায়ুমণ্ডলও থাকে।

এবার যাই পালসারের কাছে। না, আর বলতে না পেরে মোটর সাইকেলে চেপে রণে ভঙ্গ দিচ্ছি না। নিউট্রন নক্ষত্রের সাথে জড়িত থাকে অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র। তাই, একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এটি বেতার স্পন্দন (Radio Pulse) নির্গমণ করে। আর, তখন একে বলে পালসার। 

যাবার আগে আরেক ধরণের তারার কথা বলে যাই। এরা হল, ডাবল স্টার। অনেক সময় দুটো তারকা পৃথিবী থেকে প্রায় একই রেখা বরাবর অবস্থিত হলে এ রকম মনে হয়। আবার অনেক সময় এরা প্রকৃতই একে অপরের সাথে আবদ্ধ। এদেরকে বলা হয় দ্বিমিক তারকা (Binary Star)। এরা উভয়ের ভরকন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে। মনে করা হয়, মহাবিশ্বের অর্ধেক তারকাই এমন আচরণ করে থাকে। বর্তমানে ধ্রুব তারা (North Star) একটি বাইনারি স্টার জগতের অংশ। 
বাইনারি স্টার জগত

অনুমতি নিয়ে আরেক ধরণের তারকার কথা বললে, তালিকাটা কিছুটা পূর্ণতা লাভ করতো। তাই জোর করে অনুমতি নিলাম। বলবো, চলক তারকার (Variable Star) কথা। এরা দুই ধরণের। Cepheid variable হচ্ছে সেই সব অস্থিতিশীল তারকা যারা ঘন ঘন নিয়মত ভিত্তিতে আকার ও উজ্জ্বলতা পরিবর্তন করে। আকার বাড়লে উজ্জ্বলতা কমে।
অন্য দিকে, Mira variable হলো, সেই সব তারকা যাদের আকার ও দীপ্তী পাল্টাতে অনেক মাস লেগে যায়। ১৫৯৬ সালে প্রথম আবিষ্কৃত এই ধরণের নক্ষত্র মিরার নামে এদের নামকরণ। 
 

[১] উইকিপিডিয়া 
[২]  EnchantedLearning
Category: articles

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪

যাঁকে আধুনিক কসমোলজির জনক বলে প্রায়শই অভিহিত করা হয়, সেই বিজ্ঞানী এডুইন হাবল এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন যা মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধ্যানধারণা আমূল পাল্টে দেয়।
বিজ্ঞানী এডুইন হাবল
জন্ম ১৮৮৯ সালে। পেশাগত জীবন শুরু আইনজীবী হিসেবে। কিন্তু যার মন পড়ে রয়েছে মহাকাশের দূর সীমানায়, তার কি আর আইনের ধারায় মন বসে?  কয়েক বছর পরেই নিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় ডক্টরেট । গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে (Observatory) কাজ করার দাওয়াত পেলেন। কিন্তু তিনি আবার ১ম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকও যে! তাই কাজে যোগ দিতে কিছু দিন দেরি হয়ে গেল। তবে, ফিরে এসেই লেগে গেলেন। এখানেই তিনি বিশ্বের বৃহত্তম দুটি আকাশবীক্ষণ যন্ত্র (Telescope) নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেন। এগুলো হল যথাক্রমে ৬০ ও ১০০ ইঞ্চির হুকার টেলিস্কোপ।

সৈনিক জীবন বুঝি বড্ড ভালো লেগেছিল!  ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা শুরু হয়ে গেলে ১৯৪২ সালে আবারো মানমন্দির ছেড়ে গেলেন।  পেলেন বীরত্বের প্রতিকও।

মিল্কিওয়ের বাইরে উঁকিঃ
১৯২০ এর দশকেও আকাশে ছড়ানো ছিটানো ছোপ ছোপ আলোকে মনে করা হত নীহারিকা (Nebula)। মনে করা হত এগুলোর অবস্থানও মিল্কিওয়েতেই। আলাদা আলাদা করে NGC 6822, M33 ও এনড্রোমিডা গ্যালাক্সির ছবি নিরীক্ষা করার সময় হাবল এগুলোর প্রতিটির ভেতরে একটি সেফেইড ভেরিয়েবল নামক স্পন্দনশীল (Pulsating) নক্ষত্র (Star) দেখতে পেলেন। হাবল সাহেব হিসেব কষে বের করলেন নক্ষত্রগুলো কত দূরত্বে আছে। এতে করে বের হল নীহারিকাদের  দূরত্বও। দেখা গেল, মিল্কিওয়ে থেকে তাদের দূরত্ব অনেক বেশি দূরে।

মহাকাশবিদরাও বুঝলেন, এই নীহারিকাগুলোও আসলে মিল্কিওয়ের মতই ছায়াপথ (Galaxy)। প্রতিটি ছায়াপথে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন তারকা। আগে যেখানে মিল্কিওয়েকেই 'মহাবিশ্বের সব' মনে করা হত, সেখানে এবার মহাকাশবিজ্ঞানীদের চোখ আরো অনেক দূর প্রসারিত হয়ে গেল। 
প্রায় একই সময়ে হাবল গ্যলাক্সিদের শ্রেণিবিভক্ত করার একটি স্টান্ডার্ড উপায়ও বার করলেন। তিনিই প্রথম পরিষ্কার করে গ্যালাক্সিগুলোকে ৪টি শ্রেণিতে ফেললেন। এগুলো হল, ডিম্বাকৃতির (Elliptical), প্যাঁচানো তথা সর্পিলাকার (Spiral) , Barred Spiral ও অনিয়াতাকার (Irregular) গ্যালাক্সি। হাবল শুরুতে ধারণা করেছিলেন সর্পিল গ্যালাক্সিরা  ডিম্বাকৃতিরগুলো থেকে বিকশিত হয়। এখন অবশ্য বিজ্ঞানীরা জানেন সব গ্যলাক্সিদের আকৃতিই এদের জীবনের শুরুতেই নির্ধারিত হয়।

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বঃ
গ্যালাক্সিদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হাবল দেখলেন, ওগুলো স্থির হয়ে বসে নেই। উপরন্তু এরা প্রায় সবাই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অবশ্য এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের সাথে পারস্পরিক মহাকর্ষীয় টানে কাছে আসছে এবং আরো ৫০০ কোটি বছর পরে একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে।

ফলে জানা গেল, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার বের করা হয় তাকে বলে হাবলের নীতি (Huble's Law)। অবশ্য জর্জ লেমিটরও এর আগে ১৯২৭ সালে এই নীতি প্রস্তাব করেছিলেন। হিসেব করে পাওয়া গেল, মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট হারে প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীর সম্মানে এই হারটিকে বলা হয় হাবল ধ্রুবক (Huble Constant)।

হাবলের এক দশক আগে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও সাধারণ আপেক্ষিকতার নীতির মাধ্যমে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ সময়ে তার কোন প্রমাণ না পাওয়া যাওয়াতে তিনি সেই প্রস্তাবের সমীকরণগুলো প্রত্যাহার করেন। কিন্তু হাবল সেই ধারণা প্রমাণিত করবার পরে আইনস্টাইন মাউন্ট উইলসনে গিয়ে বলেন, ঐ সমীকরণগুলো প্রত্যাহার ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল

অন্যান্য অবদানঃ
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যার জগতেই হাবলের রয়েছে আরো অবদান। পেয়েছেন অসংখ্যা পুরস্কার। কিন্তু মহাবিশ্বের পরিচয় উন্মোচিত করার পরেও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। তাঁর জীবদ্দশায় নোবেল প্রাইজের জন্য  মহাকাশবিদ্যাকে পদার্থবিদ্যার একটি ফিল্ড মনে করা হত। তিনি আজীবন চেষ্টা করে গেছেন যাতে এই ধারণা চেঞ্জ হয়ে জ্যোতির্বিদরাও নোবেলের সুযোগ পান। সুযোগটি তৈরি হল ১৯৫৩ সালে। কিন্তু একই বছর মারা গেলেন তিনিও । যেহেতু নোবেলের ক্ষেত্রে মরণোত্তর (Posthumous) পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা নেই, তাই নোবেলের তালিকায় হাবল আর স্থান পেলেন না।

১৯৫৩ সালে, ৬৩ বছর  বয়সে মারা যান মহাবিশ্বের নব দিগন্ত উন্মোচনকারী এই জ্যোতির্বিদ। মৃত্যুর আগে তিনি পালোমার পর্বতে ২০০ ইঞ্চির হ্যালি টেলিস্কোপের নির্মাণ দেখে গিয়েছিলেনীর১৯৭৬ সালে রুশ BTA-6 টেলিস্কোপ তৈরি আগ পর্যন্ত এটিই ছিল বৃহত্তম টেলিস্কোপ।

হাবলের জন্মের ১০১ বছর পর ১৯০০ সালে নাসা পৃথিবীর কক্ষপথে হাবল স্পেইস টেলিস্কোপ বসাল। এই আকাশবীক্ষণ যন্ত্র মহাবিশ্বের হাজার হাজার ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর নিখুঁত বয়স নির্ণয়, গ্যালাক্সিদের ক্রমবিকাশ ও মহাবিশ্বকে প্রসারণের জন্য দায়ী ডার্ক এনার্জির আবিষ্কারের ক্ষেত্র প্রভূত  অবদান রয়েছে এই টেলিস্কোপ্টির।

সূত্রঃ
১. স্পেইস ডট কম
২. উইকিপিডিয়াঃ Edwin Hubble

Category: articles

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...