আমরা জানি, সূর্যের আলোই পৃথিবীর আকাশকে আলোকিত করে। সূর্যের আলো ৭টি আলোর সমন্বয়ে তৈরি। বেগুনি নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। এক কথায় বেনীআসহকলা। কিন্তু সব রঙ ছাড়িয়ে আমরা আকাশ দেখি নীল। কারণ হিসেবে বলা হয়, নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। তাই বায়ুকণায় ধাক্কা লেগে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে। আলোর এ বিক্ষেপণের কারণে সবদিকে নীল দেখি আমরা।
সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে আকাশের দৃশ্য |
এখন, কথা হলো দৃশ্যমান সাত আলোর বর্ণালীতে সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেগুনি। নীল নয়। আমাদের না দেখা অনেক আলো আছে। এই যেমন গামা, অবলোহিত ইত্যাদি। তবে বেগুনি আলো তো আমাদের চোখে দৃশ্যমান। আর এর বিক্ষেপণ বা বিচ্ছুরণ সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা। নীল আলোর চেয়েও বেশি। তাহলে তো আকাশের সবদিক বেগুনি আলোয় ভরপুর হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু কেন বেগুনি না হয়ে নীল হলো?
চিত্র ১: দৃশ্যমান বর্ণালী |
ব্যাপারটা কয়েকটি কারণে হয়। প্রথমত, সূর্য থেকে নীলের সাথে বেগুনি আলোও বের হয় তা ঠিক। তবে সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর নির্গমন একই হারে হয় না। সূর্য থেকে আসা আলোকশক্তির খুব সামান্য একটি অংশই বেগুনি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। আরেকটি কারণ হলো, বায়ুমণ্ডল বেগুনি আলোকে শোষণ করে নেয়। এই কারণেই আমরা সূর্যের অদৃশ্য ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও রক্ষা পাই। আর বেগুনি আলো দেখিও কম।
তবে এগুলোই একমাত্র কারণ নয়। রংধনুতে আমরা কিন্তু নীল বা আসমানীর পাশাপাশি বেগুনি রংও দেখি।
আকাশকে বেগুনি না দেখানোর আছে জীববৈজ্ঞানিক কারণও। আমাদের চোখ বেগুনি আলোর প্রতি অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল। আমাদের চোখের রেটিনায় তিন ধরনের কালার রিসেপ্টর বা বর্ণগ্রাহক আছে। এগুলোকে বলে কোন। জ্যামিতির কোণ নয়। আকৃতি কোন বা শঙ্কুর মতো। কলার মোচার নিচেরটা দেখতে যেমন।
তিন ধরনের কোন কোষের নাম লাল, নীল ও সবুজ। এ নাম দেওয়ার কারণ কোষগুলো এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সাড়া দেয়। আমরা কী রং দেখব তা নির্ভর করে এই কোষগুলোর উদ্দীপনার ওপর।
ছবি ২: তিন ধরনের আলোর প্রতিক্রিয়া |
লাল কোন কোষ আকাশের লাল আলো দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়। পাশাপাশি একটু কম মাত্রায় উদ্দীপ্ত হয় কমলা ও হলুদ রং দ্বারাও। সবুজ কোন কোষ হলুদ আলোর প্রতিও সাড়া দেয়। আরেকটু বেশি মাত্রায় উদ্দীপ্ত হয় সবুজ ও নীল-সবুজ আলো দিয়ে। নীল কোন কোষ মূলত নীল ও এর আশেপাশের কিছু রংয়ের আলোর প্রতি সাড়া দেয়। এ আলোগুলো খুব বেশি বিক্ষিপ্ত হয়। বর্ণালীতে গাঢ় নীল ও বেগুনি না থাকলে আকাশ নীলের সাথে হালকা সবুজ হত।
গাঢ় নীল ও বেগুনি রং সবচেয়ে বেশি বিক্ষিপ্ত হয়। এ দুই রং লাল কোন কোষের পাশাপাশি নীল কোনকেও উদ্দীপ্ত করে। এ কারণেই এদেরকে নীল ও সাথে মৃদু লাল আভা দেখা যায়। সার কথা হলো, সবুজ ও লাল কোন কোষ আকাশের আলোয় প্রায় সমান সাড়া দেয়। তবে নীল কোন সাড়া দেয় এদের চেয়ে অনেক বেশি তীব্রভাবে। এ কারণেই আকাশকে মলিন নীল দেখায়। বেগুনি দেখায় না।
আর কোন কোষের এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই ক্যামেরা কিন্তু আকাশকে আমাদের চেয়ে ভিন্ন দেখে। ডিজিটাল ক্যামেরায় আকাশকে কিছুটা রক্তবর্ণের বা গাঢ় নীল দেখা যায়৷ পাহাড় বা বিমান থেকে তোলা ছবিতে ব্যাপারটা আরও বেশি স্পষ্ট। ক্যামেরার চোখ বেগুনি আলোর প্রতি মানুষের চোখের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। এ কারণে ক্যামেরায় ইউভি বা অতিবেগুনি ফিল্টার থাকে।
** নীল ও আকাশী রং নিয়ে বাংলা ভাষায় কিছু বিভ্রান্তি আছে৷ আমরা সাধারণত যাকে নীল বলি সেটা আসলে আসমানী। যেমন আকাশ আসলে নীল নয়, আসমানী। নীল রংয়ের প্রকৃত কিছু উদাহরণ হলো ব্লুবেরি, কালো আঙ্গুর বা বেগুন। ইংরেজি blue এর বাংলা আসমানী। আর নীলের ইংরেজি indigo। আকাশের রং হলো ব্লু বা আসমানী। ইন্ডিগো বা নীল নয়। তবে লেখায় বোঝার সুবিদার্থে আসমানীকে নীল লিখেছি। মানে আকাশকে আসমানী না বলে নীল ধরে নিয়েছি। আর নীলকে লিখেছি গাঢ় নীল।
লেখাটি ইতোপূর্বে দৈনিক বাংলা পত্রিকার বিজ্ঞান পাতা ইউরেকায় প্রকাশিত।
সূত্র
- http://www.atmo.arizona.edu/students/courselinks/fall14/atmo170a1s2/lecture_notes/scattering/why_not_violet.html
- https://math.ucr.edu/home/baez/physics/General/BlueSky/blue_sky.html
- https://www.quora.com/Why-isnt-the-sky-violet-since-violet-light-has-an-even-shorter-wavelength