সম্প্রতি নওতাপ নিয়ে একটি গুজব সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কিছু পত্রিকাও (যেমন দৈনিক ভোরের বার্তা) ফলাও করে তা প্রচার করেছে। নাসার নাম ব্যবহার করায় ব্যাপারটা অনেক মানুষ সহজেই বিশ্বাসও করে ফেলেছেন।
অল্প কিছু কথার মধ্যে অনেকগুলো ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।
প্রথমেই বলা হয়েছে, সূর্য রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করবে। কথাটা পুরোপুরি ভুল। একইসাথে বিভ্রান্তিকর। সূর্য নিজেও একটি নক্ষত্র। সাধারণত এক নক্ষত্র অন্য নক্ষত্রের কাছে-ধারেও যায় না। খুব দুর্লভ কিছু ক্ষেত্রে নক্ষত্ররা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে বা মিশে যায়। সাধারণত একই নক্ষত্রপুঞ্জের (Star cluster) নক্ষত্ররা কখনো কখনো একীভূত হতে পারে। নক্ষত্রপুঞ্জে কয়েক হাজার থেকে কয়েক কোটি নক্ষত্র মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গুচ্ছ আকারে থাকে।
রোহিণী নক্ষত্র (Aldebaran) |
আবার নক্ষত্রের জীবনের শেষ ভাগে জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নক্ষত্রের বাইরের অংশ বড় হয়ে যায়। সেক্ষেত্রেও অন্য নক্ষত্র সে স্ফীত অংশে ঢুকে যেতে (প্রবেশ করতে) পারে।
তবে সূর্যের ক্ষেত্রে কোনোটাই সম্ভব না। সূর্য কোনো নক্ষত্রপুঞ্জের অংশ নয়। আশেপাশে সূর্যকে গিলে খাওয়ার মতোও কেউ নেই। তথাকথিত রোহিণী নক্ষত্র সূর্য থেকে ৬৫ আলোকবর্ষ দূরে৷ এটা বৃষমণ্ডলের (Taurus) নক্ষত্র। ইংরেজি নাম Aldebaran। রাতের আকাশের চতুর্দশ উজ্জ্বল নক্ষত্র এটি। উপযুক্ত সময়ে (জানুয়ারি মাস ও তার আগে-পরে) সহজেই খালি চোখে দেখা যায়।
এটা ঠিক বর্তমানে সূর্য বৃষমণ্ডলে অবস্থান করছে। তার মানে এই নয় সূর্য রোহিণীর কাছে চলে গেছে। কথাটা একটু ব্যাখ্যা করতে হয়। আসলে ব্যাপারটা খুব সরল। পৃথিবীকে ঘিরে থাকা পুরো আকাশকে পৃথিবী থেকে দেখতে ৩৬০ ডিগ্রি গম্বুজের মতো লাগে। বাস্তবে তা না হলেও আকাশ পর্যবেক্ষণের সুবিদার্থে উপমাটা কাজে লাগে। পুরো আকাশকে ৮৮টা এলাকায় ভাগ করা আছে। এগুলোকে বলে একেকটি তারামণ্ডল (constellation)। নক্ষত্র, ছায়াপথ, কৃত্রিম উপগ্রহ বা দূর আকাশের বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান নির্দেশ করতে তারামণ্ডল ভাল ভূমিকা পালন করে। এই মুহূর্তে (২৫ মে) সূর্য গম্বুজের যেখানটায় আছে (বলে মনে হয়), সেটার নাম বৃষমণ্ডল। জ্যোতিষবিদরা বলবেন বৃষরাশি। আগেই বলেছি, রোহিণী এ মণ্ডলেরই তারা।
আরও পড়ুন
আবার মনে করিয়ে দেই, মণ্ডল একই হলেই মণ্ডলের বস্তুরা কাছাকাছি থাকে না। পৃথিবী থেকে আকাশের একই দিকে তাকালে দেখা গেলে একই মণ্ডলে থাকতে পারে। বাস্তবে কোনোটা সামনে আর কোনোটা অনেক পেছনে থাকতে পারে। অনেকসময় আমরা আকাশের চাঁদকে অন্য তারার পাশে দেখি। এটা আসলে পৃথিবীর আকাশে তাদের আপাত অবস্থান। একইদিকে অবস্থিত হওয়ায় পাশাপাশি দেখা যায়। বাস্তবে সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরিও (Proxima Centauri) ৪ আলোকবর্ষের বেশি দূরে। মানে সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৪ বছরের বেশি সময় লাগবে। অথচ চাঁদ থেকে আসতে সময় লাগে মাত্র ১.৩ সেকেন্ড।
পুরো বছরে সূর্য এমন ১৩টা অঞ্চল বা তারামণ্ডল ঘুরে আসে। মানে, পৃথিবী থেকে দেখতে সূর্যকে আকাশের এসব অঞ্চল দিয়ে চলতে দেখা যায়। সূর্যের চলাচলের আপাত এ পথকে বলে সূর্যপথ (ecliptic)। তেরটি অঞ্চলের সমন্বিত নাম রাশিচক্র (zodiac)। প্রচলিত জ্যোতিষবিদ্যার (astrology) রাশিচক্রে ১২টি দেওয়া আছে। তাও তারিখগুলো আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার (astronomy) হিসাবের সাথে মেলে না। জ্যোতিষবিদ্যার প্রাচীন হিসাব বলে, সূর্য বৃষরাশিতে থাকে ২০ এপ্রিল থেকে ২০ মে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক হিসাবে সময়কালটা হলো ১৩ মে থেকে ২১ জুন।
স্টেলারিয়াম সফটওয়্যার দিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে আপনি নিজেই সূর্যের গতিবিধি দেখতে পারবেন।
আরও পড়ুন
১৩ মে থেকে ২১ জুন সূর্য বৃষমণ্ডল পাড়ি দেওয়ার সময় পৃথিবী থেকে দেখতে রোহিণী নক্ষত্রের কাছ দিয়ে পার হবে। আগেই বলেছি, এ অবস্থান নিছক পৃথিবীর আকাশে সূর্য ও রোহিণীর আপাত অবস্থান। বাস্তবে কিন্তু রোহিণীর দূরত্ব সূর্য থেকে ৬৫ আলোকবর্ষই।
২
বলা হয়েছে সূর্য ও পৃথিবীর উত্তাপের জন্য রোহিণী নক্ষত্র দায়ী। অথচ সূর্য ছাড়া অন্য নক্ষত্র পৃথিবীর উত্তাপে ভূমিকা রাখে না। হ্যাঁ, রাখে। তার পরিমাণ কতটুকু জানেন? ১০ কোটি-কোটি-কোটি ভাগের ($১০^{২২}$) এক ভাগ। আরও মজার ব্যাপার হলো রোহিণীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সূর্যের চেয়েও কম। সূর্যের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ৫,৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের চেয়ে বয়স্ক লোহিত দানব ধরনের তারা রোহিণীর তাপমাত্রা ৩,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। (সূর্যের বয়স ৪৬০ কোটি বছর আর রোহিণীর ৬৬০ কোটি।)
৩
পৃথিবীর গরম বা ঠান্ডার সাথে সূর্যের নিজস্ব অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা নির্ভর করে পৃথিবী সূর্যের সাথে কীভাবে হেলে আছে তার ওপর। পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ কক্ষীয় তলের সাথে ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে আছে। ফলে কখনো উত্তর ও কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের দিকে হেলে থাকে। ইদানিং ২০ জুনে হয় উত্তরায়ন (northern solstice)। এ সময় সূর্য পৃথিবীর সর্বউত্তরে আসে। ২৩.৫ ডিগ্রি অক্ষাংশে খাড়াভাবে আলো দেয়। এসময় ও তার আগে-পরে উত্তর গোলার্ধে তীব্র গরম আর দক্ষিণে শীত থাকে। আবার ২১ ডিসেম্বর সূর্য চলে যায় সর্বদক্ষিণে। তখন উত্তরে শীত আর দক্ষিণে গরম চলে। কারণ উত্তর গোলার্ধে তখন সূর্যের আলো পড়ে বাঁকাভাবে। খাড়াভাবে পড়লে তাপের তীব্রতা বেশি থাকে। বেঁকে আসায় তা কমে যায়।
এখান থেকেই যাই পরের ভুল কথায়। ধারণা দেওয়া হয়েছে, পুরো পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠবে রোহিণীর কারণে। অথচ পুরো পৃথিবীতে কখনোই একইসাথে গরম ও ঠান্ডা থাকে না। বৃষ্টি বা আবহাওয়াহগত অন্য কারণ না থাকলে দুই গোলার্ধে তাপমাত্রা থাকবে বিপরীতধর্মী।
তবে একটা ভাল পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। গরমে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, নাসা এমন কোনো কথা বলেনি। কেউ দাবি করে থাকলে সূত্র দিতে বলুন।