Advertisement

সোমবার, ৩০ মে, ২০১৬

উজ্জ্বল তারাদের গল্প

রাতের আকাশে চোখ নিক্ষেপ করলেই হাজার হাজার তারার আলো আমাদের চোখে ধরা দেয়। হাজার হাজার বলা অবশ্য ভুল। মেঘহীন পরিষ্কার রাতের আকাশে বড়জোর ২ থেকে আড়াই হাজার তারা দেখা যায়। আবার রাতের আকাশের উজ্জ্বল বস্তুদের মধ্যে কিন্তু শুধু তারারাই আছে এমনটিও নয়।

চাঁদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা যাকে শুকতারা বলি সেটিওতো আসলে তারা তথা নক্ষত্র নয় বরং শুক্র গ্রহ। এই শুক্র গ্রহই রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু (চাঁদকে বাদ দিয়ে)। অপরদিকে ২য় উজ্জ্বল বস্তুও কিন্তু কোন নক্ষত্র নয়, এটি হচ্ছে অপর গ্রহ বৃহস্পতি। যাই হোক, আমরা দেখতে চাই নক্ষত্রদের মধ্যে কারা সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।


আমরা নিশ্চয়ই জানি, রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হল লুব্ধক। এরপরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে সুহাইল, আলফা সেন্টোরি, স্বাতী, ভেগা ইত্যাদি। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে প্রাথমিক কিছু বিষয় জেনে রাখলে সুবিধা হবে।

তারা ও গ্রহের পার্থক্য কী?
সাধারণত রাতের আকাশে আমরা যা দেখি চাঁদ ছাড়া তাদের বাকী সবাইকে আমরা তারা বলি। কিন্তু এসব বস্তুদের মধ্যে ‘তারা’ যেমন আছে, তার পাশাপাশি আছে গ্রহ, বিভিন্ন সময় থাকতে পারে ধূমকেতু বা উল্কা। আবার থাকতে পারে কৃত্রিম জিনিসও। বিমানের কথা না হয় বাদই দিলাম। রাতের আকাশে পৃথিবীর সব অঞ্চল থেকেই কিছু দিন পরপর আন্তার্জাতিক মহাকাশ স্টেশন দেখা যায়।

তাহলে তারা কারা? তারার পরিচয় সঠিকভাবে দিতে হলে বলতে হবে তারকা বা নক্ষত্র। পৃথিবী বা অন্য গ্রহদের মত তারকাদের কিন্তু কোন কঠিন পৃষ্ঠ থাকে না। এদের জীবনের প্রাথমিক ভাগে অভ্যন্তরভাগে তাপ নিউক্লিয় সংযোজন (ফিউশন) বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরামভাবে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে আমাদের সূর্যসহ অন্যান্য তারকারা আলো ও তাপ উৎপন্ন করে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই রয়েছে ১০০ বিলিয়ন থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। এদের সবার আবার  আমাদের সূর্যের মত গ্রহব্যাবস্থা নেই অবশ্য। মহাবিশ্বের প্রায় ৫০% নক্ষত্রই বাইনারি স্টার সিস্টেমের সদস্য। এক্ষেত্রে দুটি নক্ষত্র একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তাহলে বলা যায় এরা একে অপরের গ্রহ?

না। অন্য কারো চারদিকে ঘুরলেই গ্রহ হয়ে যায় না। গ্রহদের নিজস্ব আলো তৈরি করার ক্ষমতা নেই। এরা কোন নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। আমরা রাতের আকাশে খালি চোখে পাঁচটি গ্রহ দেখতে পাই। এরা হল বুধ, শুক্র (শুকতারা), মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। শনি ছাড়া এদের বাকি এরা সবাই রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র লুব্ধকের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল।

আমাদেরকে আরেকটি বিষয় বুঝতে হবে- সেটা হচ্ছে রাতের আকাশের বস্তুদের আপাত উজ্জ্বলতা বা অ্যাপারেন্ট ম্যাগনিটিউড (Apparent magnitude)। একটি বস্তুকে পৃথিবী থেকে দেখতে কতটা উজ্জ্বল লাগে সেটাই হচ্ছে তার আপাত উজ্জ্বলতার পরিমাপ। এটা বস্তুর প্রকৃত উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি থেকে আলাদা জিনিস। কারণ, বাস্তবে বেশি দীপ্তিমান হলে দূরত্বসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবী কোন তারকাকে অন্য তারকার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল মনে হতেই পারে। যেমন রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র লুব্ধক কিন্তু সবেচেয়ে বেশি দীপ্তিমান ৫০টি তারকার মধ্যেও নেই। তারকার উজ্জ্বলতা পরিমাপ করা হয় লগারিদম স্কেলে। উজ্জ্বলতার মান যত বেশি হয় তার উজ্জ্বলতা হয় তত কম।

আরও পড়ুন
» আপাত উজ্জ্বলতা কাকে বলে?

আরেকটি বিষয় জেনে রাখি। আকাশের বুকে তারকাদের ঠিকানা। আপনারা নিশ্চয়ই পৃথিবীর অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা সম্পর্কে জানেন। পৃথিবীর দুই মেরুর ঠিক মাঝ বরাবর পূর্ব পশ্চিমে কল্পিত রেখার নাম নিরক্ষ বা বিষুব রেখা (Equator)। এখন আকাশকে মাথার উপরে একটি গম্বুজের মত কল্পনা করুন। যদিও আসলে তারাগুলো পৃথিবী থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত তবু রাতের আকাশে এদেরকে এরকম কোন কল্পিত গবম্বুজে ছাঁটানো লাইটের মতই মনে হয়। এটা ধরে নিলে তারাদেরকে অবস্থান নির্ঢারণ করাও সহজ হয়ে যায়। তাহলে আকাশকে গম্বুজ কল্পনা করলেন। আমরা বোঝার জন্যে যাকে গম্বুজ কল্পনা করলাম তার সঠিক নাম খ-গোলক (Celestial Spehere)। এবার বিষুব রেখার উপরে খ-গোলকের মধ্যে একটি রেখা কল্পনা করুন। একে বলা হয় খ-বিষুব।

খ-বিষুব থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে অবস্থিত তারাদের অবস্থান অনেকটা পৃথিবীর অক্ষাংশের মতই বের করা হয়। তবে পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমরা উত্তর ও দক্ষিণের জন্যে মানের আগে যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ কথাটা যোগ করি। যেমন বাংলাদেশে অবস্থান ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে। কিন্তু খ-গোলকের ক্ষেত্রে উত্তরে হলে এর আগে + চিহ্ন এবং দক্ষিণে মাইনাস চিহ্ন (-) বসানো হয়। আর এর আনুষ্ঠানিক নাম ডেক্লাইনেশন (Declination) বা বাংলায় বিষুব লম্ব।

অন্য দিকে পূর্ব পশ্চিমের অবস্থান নির্ণয়ের জন্যে দ্রাঘিমার মত একটি বিষয় আছে। এর নাম বিষবাংশ (Right ascension)। তবে এতে একটু ঝামেলা আছে এবং বোঝা একটু কষ্টকর। এর কারণ পৃথিবী নিজের অক্ষের সাপেক্ষে আবর্তন করার কারণে আমাদের সাপেক্ষে দ্রাঘিমা অপরিবর্তিত থাকলে খ-গোলক কিন্তু এই আবর্তনের জন্যেই আমাদের সাপেক্ষে ঘুরতে থাকে। তাই এই বিষয়টি আপাতত আলোচনা করলাম না। তাতে আমাদের আপাতত খুব বেশি অসুবিধাও হবে না, যদি আমরা আর একটি কনসেপ্ট বুঝে নেই।

আরো পড়ুন
» বিষুব লম্ব কাকে বলে?

এটি হল তারামণ্ডলী। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ আকাশের কাছাকাছি অবস্থানের কিছু তারকাদের একত্রে কোন প্রাণী বা কাল্পনিক চরিত্রের কথা কল্পনা করত। ১৯৩০ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতি এই চিহ্নিত অঞ্চলগুলোকে কিছুটা পরিমার্জন ও পরিববর্ধন করে পুরো খ-গোলককে মোট ৮৮টি অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেকটি তারাই এই ৮৮টির কোনটিতে পড়েছে। বিখ্যাত কিছু তারামণ্ডলী (Constellation) হল আদম সুরত বা কালপুরুষ, সপ্তর্ষীমণ্ডলী, বকমণ্ডলী ইত্যাদি।

তারামণ্ডলী অ তারাভুজের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। তারামণ্ডলী ছারাও অনেক সময় কিছু তারাকে একত্র করে কিছু প্রাণী বা জ্যামিতি চিত্র কল্পনা করা হয়। এরা হল তারাভুজ। যথাস্থানে আমরা এর প্রয়োগ দেখবো।
কোন তারা কোন তারামণ্ডলীতে অবস্থিত এর অবস্থান বের করা আর কঠিন হয় না এবং পাশাপাশি এর বিষুব লম্ব জানলে আরো নিখুঁততভাবে এর অবস্থান জানা যায়। পুরোটা নিখুঁৎ হতে হলে বিষবাংশ না জানলেও হয়। জানলে সুবিধা হয় অবশ্যই।

বিরক্তি এসে যাচ্ছে, না! , তারাদের গল্প শোনানোর লোভ দেখিয়ে এসব কী প্যাঁচাল পাতানো হচ্ছে। ঠিক আছে, এবার আমরা এক এক করে দেখছি-

থুক্কু! আরো দুয়েকটি লাইন না বললেই নয়। বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে। ফলে, আমাদের মাথার উপরে খ-গোলকের +২৩ বিষুব লম্ব অবস্থিত। তাহলে আমরা যেসব তারাকে ঠিক মাথার উপরে দেখবো বুঝতে হবে এরা খ-বিষুব থেকে ২৩ ডিগ্রি উত্তরে অবস্থিত। আর খ-বিষুব পুরো খ-গোলককে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধ- এই দুই অংশ বিভক্ত করেছে।

পুরো আকাশ গোলক ৩৬০ ডিগ্রি। আমরা একসাথে আকাশের অর্ধেক তথা ১৮০ ডিগ্রি দেখতে পারি। ফলে দুই খ-মেরুর মাঝখানে কৌণিক দূরত্ব ১৮০ দূরত্ব। আমরা উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত হলেও বিষুব রেখার ২৩ ডিগ্রি উত্তরে থাকায় আমরা উত্তর মেরুর দক্ষিণেও ২৩ ডিগ্রি দক্ষিণের তারাও দেখবো। আর দক্ষিণে দেখবো ৯০-২৩ বা প্রায় ৬৭ ডিগ্রির মত। তবে দিগন্তের কাছাকাছি অবস্থানের তারারা নানা কারণে আমাদের চোখে আসতে বাধা পায়। এর মূল কারণ ঘর-বাড়ি বা দূরবর্তী শহরের আলো। অর্থ্যাৎ বলতে চাইছি, আমরা উত্তর গোলার্ধে আছি বলে আমাদের দেখা সব তারকা উত্তর গোলার্ধেই অবস্থিত- এমনটি ভাবা ঠিক হবে না।
এবার সত্যি বলছি,  উজ্জ্বল তারাদের আলো আর পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখবো না।

১। লুব্ধক (Sirius):
নীল এই নক্ষত্রটিই রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল। এটি মূলত দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে থাকলেও সহজেই বাংলাদেশের দক্ষিণ আকাশে দেখা যায়। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস একে দেখার সেরা সময়। বিখ্যাত তারামণ্ডলী কালপুরুষ বা আদম সুরতের সাথে থাকে বলে একে খুঁজে বের করাও দারুণ সহজ। একে খুঁজে পেতে হলে আদম সুরতের (Orion) কোমরের দিকে অবস্থিত তিনটি তারকায় গঠিত ওরিনয়ন’স বেল্ট থেকে বরাবর পেছেনে যেতে হবে। সামনে পড়া উজ্জ্বল তারাটিই নির্ঘাত লুব্ধক। এর অবস্থান ক্যানিস ম্যাজর (Canis Major) তারামণ্ডলীতে।
আদম সুরত ও লুব্ধক

আপাত উজ্জ্বলতাঃ  -১.৪৬
বিষুব লম্বঃ – ১৭ ডিগ্রি (এই পরিমাপের ক্ষেত্রে ডিগ্রির ভগ্নাংশকে বাদ দিয়েছি)
দূরত্বঃ ৮.৬৯ আলোকবর্ষ (আলোর এক বছরে অতিক্রান্ত দূরত্ব। নিচের সব ক্ষেত্রেই দূরত্বের এই এককটি ব্যবহার করবো আমরা)

২। সুহাইল (Canopus):
এর অপর নাম অগস্ত্য বা ক্যানোপাস। তারাটির অবস্থান খুব বেশি দক্ষিণে (বিষুব লম্ব মাইনাস ৫২) হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে একে দেখা সহজ। শহর থেকে অবশ্য একটু কঠিন। তবে গ্রামের পরিষ্কার আকাশে একে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। একে খুঁজে পাবার উপায় হল আদম সুরতে রাইজেল ও লুব্ধক তারা দুটিকে যোগ করে লুব্ধক থেকে নিচের দিকে একটি লম্ব আঁকতে হবে। লুব্ধক থেকে রিগেলের প্রায় দ্বিগুণ দূরত্ব পাওয়া যাবে ক্যানোপাসকে।
২য় উজ্জ্বল নক্ষত্র সুহাইল

আপাত উজ্জ্বলতাঃ -.৬২
বিষুব লম্বঃ -৫২ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৩০৯ আলোকবর্ষ

৩। আলফা সেন্টোরিঃ
এটিও দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত। আলফা সেন্টোরি সিস্টেমের নক্ষত্রটি এর সঙ্গী প্রক্সিমা সেন্টোরির চেয়ে উজ্জ্বল। অথচ প্রক্সিমা সেন্টোরি সূর্যের (এবং সেই কারণে পৃথিবীরও) নিকটতম নক্ষত্র হওয়া সত্ত্বেও খালি চোখে দেখা যায় না বললেই চলে। এই নক্ষত্রকে শহর থেকে (বাংলাদেশের) দেখা প্রায় অসম্ভব। গ্রামে গেলে দেখা সম্ভব যদি নির্বিঘ্ন দিগন্ত থাকে, যেহেতু বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে সর্বোচ্চ মাইনাস ৬৭ বিষুব লম্বের তারা দেখা সম্ভব (থিওরিটিক্যালি) এবং এর বিষুব লম্ব মাইনাস ৬০ ডিগ্রি। কিন্তু দেখা যাবে খুবই সামান্য সময়ের জন্যে।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ -.২৮
বিষুব লম্বঃ -৬০ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৪.৩২

৪। স্বাতী (Arcturus):
উজ্জ্বল তারাদের মধ্যেই এটিই প্রথম যার অবস্থান আকাশের উত্তর গোলার্ধে। লাল দেখতে তারাটি খালী চোখে দৃশ্যমান লোহিত দানবদের মধ্যে অন্যতম । একে খুব সহজেই পাওয়া যায় সপ্তর্ষীমন্ডলীর সাহায্যে। সপ্তর্ষীর চামচ বা পেয়ালার আকৃতির অংশের লেজকে পেছন দিকে বাড়িয়ে এগোতে থাকলে প্রাপ্ত লাল বস্তুটিই স্বাতী। আরো সামনে গেলে পাওয়া যাবে আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র চিত্রা (Spica) যার রোল নং হচ্ছে ১৫।
সপ্তর্ষীমোণ্ডলীর মাধ্যমে স্বাতী ও চিত্রা নক্ষত্র খুঁজে পাবার উপায়

আপাত উজ্জ্বলতাঃ মাইনাস ০.০৫
বিষুব লম্বঃ +১৯ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৩৬.৭২

৫। অভিজিৎ (Vega):
৫ম উজ্জ্বল নক্ষত্রটিরও অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। ফলে বাংলাদেশ থেকে একেও দেখা খুবই সহজ। অন্য দিকে এটি আবার বিখ্যাত তারাভুজ (Asterism) সামার ট্রায়াঙ্গেল এরও উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এই তারাভুজের অপর দুটি নক্ষত্র হচ্ছে শ্রবণা (Altair) ও পুচ্ছ (Deneb)। গ্রীষ্মকাল শুরু হলেই এই তারাগুলো রাতের আকাশে হাজিরা দেওয়া শুরু করে। এমনকি শীতের শুরুতেও এদেরকে দেখা যায়। তবে এ সময় এরা থাকে পশ্চিমাকাশে- ডুবু ডুবু।



এর আপাত উজ্জজ্বলতা ০.৩।
দূরত্ব পৃথিবী থেকে ২৫.০৪ আলোকবর্ষ। অবস্থান খ-গোলকের +৩৮ ডিগ্রিতে।

৬। ক্যাপেলা (Capella):
রাতের আকাশের সবচেয়ে বিখ্যাত তারাভুজ উইন্টার সার্কেল বা উইন্টার হেক্সগনের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ায় একে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। উইন্টার সার্কেল হচ্ছে আকাশের ৬টি খুব উজ্জ্বল তারাদের নিয়ে তৈরি একটি তারাভুজ। এর তারাগুলো হল যথাক্রমে লুব্ধক, প্রভাস, ক্যাপেলা, পোলাক্স, আলডেবারান ও রাইজেল। উজ্জ্বলতায় এদের ক্রম যথাক্রমে ১, ৮, ৬, ১৭, ১৪ ও ৭।

উইন্টার সার্কেল বা হেক্সাগনে ক্যাপেলাসহ অন্যান্য নক্ষত্ররা 

আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.০৮
বিষুব লম্বঃ +৪৬ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৪২.৮

৭। রাইজেল (Rigel):
আদম সুরতের বাম পায়ে এর অবস্থান। চিনে নিতে অসুবিধা হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। অন্য দিকে ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি, এটি উইন্টার সার্কেলেরও অন্যতম নক্ষত্র। আদম সুরত বা কালপুরুষের (Orion) উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এটি। উপরের ছবিতে খেয়াল করুন, ওরিয়ন’স বেল্টের এক পাশে রাইজেল এবং আরেক পাশে বিটলজুস অবস্থিত। তবে এটি খ-বিষুবের দক্ষিণে অবস্থিত। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ থেকে দেখতে বিন্দুমাত্রও অসুবিধা নেই।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.১৮
বিষুব লম্বঃ -৮ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৮৬৩

৮। প্রভাস (Procyon)
এর অপর নাম সরমা। এটিও উইন্টার সার্কেলের অন্যতম নক্ষত্র। শখের জ্যোতির্বিদদের আরেকটি সহজ শিকার। লুব্ধক ও রাইজেলকে উইন্টার সার্কেলের বৃত্তচাপের অংশ মনে করে লুব্ধক থেকে রাইজেল যে দিকে তার উল্টো দিকে গেলেই দেখা মিলবে প্রভাসের। [উপরের চিত্র দেখুন]
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৪০
বিষুব লম্বঃ +৫ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ১১.৪৬

৯। আর্দ্রা (Betelgeuse):
আদম সুরতের মধ্যে থাকা একটি লাল নক্ষত্র।  রাতের আকাশে চোখে পড় অন্যতম লোহিত দানব (Red giant)। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের খুব প্রিয় তারকা। কারণ, এটি যে কোন মুহূর্তে আতশবাজির মত ফেটে উঠবে। কারণ রেড জায়ান্ট দশায় থাকা তারকারা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সমগ্র গ্যালাক্সিকে উজ্জ্বল করে তোলে। চিনে নিতে উপরের ছবি দেখুন। আগেই বলেছি ওরিয়নের বেল্ট থেকে রাইজেল যে দিকে তার উল্টো দিকে থাকে বিটলজুস। তবে এটি একটি বিষম তারা। এর মানে হল, এটি সময় সময় উজ্জ্বলতার পরিবর্তন করে। তাই অনেক সময় এর রোল নং ৯ এর বদলে ১০ হয়ে যায়।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৪৫
বিষুব লম্বঃ +৭ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৪৯৮

১০। আখেরনার (Acherner):
এটি খুব বেশি দক্ষিণে অবস্থিত। তবু বাংলাদেশ থেকে দেখা অসম্ভব নয়। কিন্তু শহর থেকে দেখা একটু কঠিন। আদম সুরতের ডান পাশ থেকে নদীর মত দেখতে ইরিডেনাস বা যামীমন্ডলীর যাত্রা শুরু। এর একেবারে প্রান্তে আখেরনারের অবস্থান।
 



আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৪৫
বিষুব লম্বঃ -৫৭ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ১৩৯

১১। হেডার (Hadar):
আমাদের উত্তর গোলার্ধের জন্যে এটি দেখা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এটি সেন্টোরাস তারামণ্ডলীতে অবস্থিত। আর এই তারামণ্ডলীটি সর্বোচ্চ ২৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। আমরা ২৩ ডিগ্রিতে থাকায় বুঝতেই পারছেন একে দেখার জন্যে কেমন বেকায়দায় আছি আমরা। একে দেখার মত নির্বিঘ্ন দিগন্ত পাওয়া হবে সোনার হরিণ পাবার মত।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৬১
বিষুব লম্বঃ -৬০ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৩৯২

১২। শ্রবণা (Altair):
আগেই বলেছি  সামার ট্রায়াঙ্গেলের অন্যতম নক্ষত্র এটি। ফলে শীত কাল আসতে থাকলে এটি আস্তে আস্তে পশ্চিমে যেতে থাকে। এক সময় আর রাতের আকাশে একে দেখা যায় না। আবার দেখায় যায় গ্রীষ্মের শুরুতে। তবে যাদের ভোরে ওঠার অভ্যাস আছে তারা এপ্রিলেই ভোরের পূব আকাশে একে দেখতে পারেন। একে খুঁজে নিন পূর্বের অভিজিতের মত সামার ট্রায়াঙ্গেলে।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৭৬
বিষুব লম্বঃ +৯ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ১৬.৭৩

১৩। অ্যাক্রাক্স (Acrux):
বাংলাদেশ থেকে একে দেখার আশা করা অনুচিত। এটি ক্রাক্স তারামণ্ডলীতে অবস্থিত যেটি ২০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের উত্তরে দেখা যায় না। তাই একে নিয়ে আপাতর বেশি মাথা ঘামাতে চাই না।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৭৭
বিষুব লম্বঃ -৬৩ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৩২২

১৪। আলডেবারান (Aldebaran):
আরেকটি বিখ্যাত লোহিত দানব। আদম সুরতের মাধ্যমে একেও খুব সহজেই খুঁকে নেওয়া যায়। আদমের বেল্ট থেকে প্রায় সোজা ডানে গেলেই একে পাওয়া যাবে। আর বাঁইয়ে গেলে? লুব্ধক। আগেই দেখেছি আমরা। এটিও উইন্টার সার্কেলের সদস্য। এটি বৃষমণ্ডলীর উজ্জ্বলতম তারা।
আদম সুরতের মাধ্যমে আলডেবারান নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায়
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৮৭
বিষুব লম্বঃ +১৬ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৬৬.৬৪

১৫। চিত্রা (Spica):
সপ্তর্ষীর চামচ থেকে লেজ বরাবর বৃত্তচাপ এঁকে প্রথমে স্বাতী (রোল নং ৪) এবং আরো সামনে গিয়ে পাওয়া যাবে চিত্রাকে। এটি আবার রাশিচক্রের সদস্য কন্যামণ্ডলীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে কক্ষপথে ঘোরার সময় ১২ মাসের বিভিন্ন সময় আকাশে বিভিন্ন তারা দেখা যায়। আর পৃথিবীর এই গতির কারণে খ-গোলকে সূর্যের একটি কাল্পনিক চলন পথ তৈরি হয় যাকে ইক্লিপ্টিক বা সূর্যপথ বলে। এই অঞ্চলে থাকা তারামণ্ডলীগুলোকে রাশিচক্র বলে। তাই বলে কিন্তু আমরা জ্যোতির্বিদ্যা ছেড়ে জ্যোতিষবিদ্যায় চলে যাইনি। ওদের করা রাশিচক্রে হিসাব সম্পূর্ণ ভুল ও অবৈজ্ঞানিক। তাদের মতে রাশিচক্রের তারামণ্ডলী ১২ টি, কিন্তু এর আসল সংখ্যা হবে ১৩।

আপাত উজ্জ্বলতাঃ ০.৯৮
বিষুব লম্বঃ -১১ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ২৫০

১৬। জ্যোষ্ঠা (Antares):
কাঁকড়াবিছার মত দেখতে তারামণ্ডলী বৃশ্চিকের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এটি। এই তারামণ্ডলীটি সব সময় আদম সুরতের উল্টো দিকে থাকে। আদম সুরত ডুবলে এর উদয় ঘটে। বৃশ্চিকের বুক বরাবর তারাটির অবস্থান। এটি কিছুটা দক্ষিণে হলেও সহজেই বাংলাদেশ থেকে দৃশ্যমান।
বৃশ্চিক মণ্ডলী 
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ১.০৫
বিষুব লম্বঃ -২৬ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৫৫৪

১৭। পুনর্বসু (Pollux):
মিথুন মণ্ডলীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। উইন্টার সার্কেল বা হেক্সাগনের (শীতের ষড়ভুজ) একটি শীর্ষে এটি বসে আছে বলে একে চেনাও দারুণ সহজ কাজ। তবে এর সাথেই এর জমজ তারা ক্যাস্টরও বসে আছে। আগের উইন্টার সার্কীলের ছবিটি দেখুন। যে তারাটির অবস্থান প্রভাসের দিকে সেটি হচ্ছে পোলাক্স, আর যেটি ক্যাপেলার দিকে আছে  সেটি হচ্ছে ক্যাস্টর। ‘ক্যা-ক্যা’ দিয়ে মনে রাখা যেতে পারে।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ১.১৬
বিষুব লম্বঃ +২৮ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ৩৩.৭৮

১৮। মৎস্যমুখ (Fomalhaut):
একে বলা হয় নিঃসঙ্গ তারা। এর কারণ এর আশেপাশে কোন উজ্জ্বল তারা নেই। বছরের শেষের মাসগুলোতে দক্ষিণ আকাশে একে দেখা যায়।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ১.১৬
বিষুব লম্বঃ -২৯ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ২৫.১৩

১৯। পুচ্ছ (Deneb):
এর আগেও এর কথা বলেছি। অভিজিৎ ও শ্রবণার সাথে মিলে এটি গড়ে তুলেছে সামার ট্রায়াঙ্গেল। এটি আবার বিখ্যাত তারামণ্ডলী বকমণ্ডলীতে অবস্থিত। প্রথম আবিষ্কৃত ব্ল্যাক হোল সিগ্নাস এক্স-১ এই বকমণ্ডলীর দিকে অবস্থিত।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ১.২৫
বিষুব লম্বঃ +৪৫ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ১৪১২

২০। মিমোসা (Mimosa):
এটিও দক্ষিণে অবস্থিত। ফলে বাংলাদেশের জন্য এটি সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। এটি আবার বিষম তারা। এর গড় উজ্জ্বলতা ১.২৫ হলেও এটি ১.২৩ থেকে ১.৩১ এর মধ্যে উঠা-নামা করে।
আপাত উজ্জ্বলতাঃ ১.২৫
বিষুব লম্বঃ -৬০ ডিগ্রি
দূরত্বঃ ২৭৯
রাতের আকাশের অসংখ্যা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মধ্যে মাত্র ২০টি নিয়ে আমরা আলাপ করলাম। অন্য কোম সময় বাকি তারাদের গল্প করার সুযোগের আশা রেখে আজকে বিদায় নিচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ।

সূত্রঃ
[১] https://en.wikipedia.org/wiki/Apparent_magnitude
[২] http://www.ianridpath.com/brightest.htm
[৩] এই লিঙ্কে ৩০০টি সেরা উজ্জ্বল নক্ষত্রের তালিকা পাওয়া যাবে 


Advertisement 02

আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ

লেখকের পরিচয়

আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ। প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, সিলেট ক্যাডেট কলেজ। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত বই পাঁচটি | সব লেখা | ফেসবুক | পারসোনাল ওয়েবসাইট

4 comments

Write comments
Ad
AUTHOR
২৯ জুন, ২০১৬ এ ৭:৪৫ AM delete

এখানে তারাদের বিষুবলম্ব দেওয়া আছে ।।।আমাদের মাথার উপরকার বিষুবলম্ব 23 ডিগ্রি।। এটা থেকে কীভাবে তারাটিকে নির্ণয় করব? 1ডিগ্রি পার্থক্যের জন্য কতটুকু উত্তরে বা দক্ষিণে যাব?

Reply
avatar
Ad
AUTHOR
২৯ জুন, ২০১৬ এ ৭:৪৯ AM delete

এখানে তারাদের বিষুবলম্ব দেওয়া আছে ।।। আমাদের মাথার উপরকার বিষুবলম্ব +23 ডিগ্রি ।।এটা হতে কীভাবে তারাদের নির্ণয় করব? 1ডিগ্রি পার্থক্যের জন্য কতটুকু উত্তর বা দক্ষিণে যাব?

Reply
avatar
৩০ জুন, ২০১৬ এ ১১:০১ AM delete

প্রশ্ন করার জন্যে ধন্যবাদ। এ বিষয়ে এমনিতেই লেখার ইচ্ছে ছিল। আপনার কমেন্ট পেয়ে ইচ্ছেটা ত্বরান্বিত হল।
আপনার প্রশ্নের উত্তর এই লিঙ্কেঃ
http://sky.bishwo.com/2016/06/measure-sky-with-hand.html

Reply
avatar

জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিভাষা: জেনে নিন কোন শব্দের কী মানে

এখানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োজনীয় পরিভাষাগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। সাজানো হয়েছে অক্ষরের ক্রমানুসারে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেট...