জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের এই মহাবিশ্ব মূলত তিন ধরণের উপাদান নিয়ে গঠিত। একটি হচ্ছে সাধারণ পদার্থ, যা দিয়ে আমরা তৈরি। টেলিস্কোপের সাহায্যে নির্ণয় করা মহাবিশ্বের সকল দৃশ্যমান বস্তু বিভিন্ন মহাজাগতিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। এছাড়াও রয়েছে ডার্ক ম্যাটার। মহাবিশ্বের মোট মহাকর্ষ বলের প্রায় ৮৫ শতাংশের উৎস হল এই ডার্ক ম্যাটার। তবে এটার উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। আরেকটি উপাদানের নাম ডার্ক এনার্জি। ধারণা করা হয়, ডার্ক এনার্জির কারণেই মহাবিশ্ব মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে।
|
মহাবিশ্বের মোট ভরের বণ্টন |
উপরে বর্ণিত প্রতিটি উপাদানই মহাশুন্যের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। ঠিক যেমন আইনস্টাইনের
সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে বর্ণিত ছিল। এই তিনটি উপাদানের ফলে মহাশুন্যে সৃষ্ট স্থানকালের বক্রতাকে যোগ করলে দেখা যায়, মহাবিশ্ব প্রায় সমতল আকৃতির (Flat Curvature)।
|
মহাবিশ্বের মোট ভরস-শক্তির বণ্টন |
তবে গবেষকদের মতানুসারে সমতল ছাড়াও মহাবিশ্বের আরও অনেক আকৃতি থাকতে পারত। মহাবিশ্বের ঋণাত্মক বক্রতা (Negative Curvature) থাকতে পারত। সেক্ষেত্রে ঋণাত্মক বক্রতাবিশিষ্ট মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ হত ধনাত্মক। আবার মহাবিশ্ব গোলক আকৃতির বা ধনাত্মক বক্রতাসম্পন্ন (positive curvature) হলে এর নীট শক্তির পরিমাণ দাঁড়াত ঋণাত্মক।
|
মহাবিশ্বের সম্ভাব্য তিন আকৃতি |
বিষয়টি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমরা মহাবিশ্বের কোন ঘূর্ণায়মান বস্তুর কক্ষপথের শক্তির কথা চিন্তা করতে পারি। কক্ষপথে ঘূর্ণনরত কোন মহাজাগতিক বস্তু যে বস্তুকে ঘিরে আবর্তন করে তার সাথে মহাকর্ষ বল দ্বারা আবদ্ধ থাকে। এই আবদ্ধ কক্ষপথের মহাকর্ষ বল ঋণাত্মক। তখন ঘূর্ণায়মান বস্তুটির কক্ষপথ অনেকটাই বৃত্তাকার থাকে। যদি আমরা ঘূর্ণনরত বস্তুটিকে শক্তি প্রদান করি, তবে এর বেগ বেড়ে যাবে। ফলে এর উপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব কিছুটা কমবে। যার কারণে এর কক্ষপথের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাবে এবং এর আকৃতি বৃত্তাকার থেকে ধীরে ধীরে উপবৃত্তাকার হতে থাকবে।
যত বেশি শক্তি প্রদান করা হবে, উপবৃত্তাকার কক্ষপথের দৈর্ঘ্য ততই বাড়তে থাকে। এভাবে শক্তি বাড়াতে থাকলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি প্রদানের ফলে ঘূর্ণায়মান বস্তুটি এত বেশি বেগ অর্জন করে ফেলে যার কারণে সেটি আর মহাকর্ষের টানে কক্ষপথে ফিরে আসে না। প্রকৃতপক্ষে বস্তুটি অসীম মহাবিশ্বে মুক্ত হয়ে যাবে। কক্ষপথ থেকে মুক্ত হবার মুহূর্তে ঘূর্ণায়মান বস্তু এবং যে বস্তুটিকে কেন্দ্র করে সেটি ঘুরছিল তাদের মোট মহাকর্ষীয় শক্তির পরিমাণ হবে শুন্য। তখন ঘূর্ণনরত বস্তুটির চলার পথের আকৃতি হবে প্যারাবলা বা পরাবৃত্ত (parabola)।
|
বিভিন্ন আকৃতির কক্ষপথ |
ঘূর্ণনরত বস্তুটিকে আরও শক্তি প্রদান করলে সেটি মহাকাশে অসীম বিস্তৃতিতে চলতে থাকবে। তখন এর মহাকর্ষীয় শক্তি হবে ধনাত্মক। সে সময়ে বস্তুটির আবক্র পথের আকৃতি হবে হাইপারবোলা বা পরাবৃত্ত।
আমরা এই আকারগুলো বাড়িতে হরহামেশাই দেখতে পাই। একটি টর্চলাইট বা ফ্ল্যাশলাইটের কথা আলোচনা করা যাক। এটি থেকে নিঃসরিত আলোকরশ্মি যখন কোন দেয়াল বা বস্তুর উপর পড়ে তখন আলোকরশ্মিগুলো কণিকের বিভিন্ন আকৃতি গঠন করে। যদি টর্চলাইটকে একেবারে সোজাসুজিভাবে রেখে দেয়ালে আলো ফেলা হয়,তখন আলোকরশ্মি দেয়ালে বৃত্ত তৈরি করবে।
|
বৃত্তাকার আলো |
টর্চলাইট থেকে দেয়ালে কিছুটা তির্যকভাবে আলো ফেললে আলো যে গঠন দেখাবে,সেটা হবে উপবৃত্ত।
(নীচের ছবি)
|
উপবৃত্তাকার আলো |
টর্চলাইটকে দেয়ালের সাথে সমান্তরালে রাখলে দেয়ালে যে আলোকরেখার অবয়ব দেখা যায়, সেটা হবে পরাবৃত্ত। (নীচের ছবি)
|
পরাবৃত্তাকার আলো |
টর্চলাইটটিকে সমান্তরালে রেখে কিছুটা তির্যকভাবে দেয়ালে আলোকরশ্মি ফেললে দেয়ালে যে আলোকচিত্র দেখা যাবে, সেটাকেই বলে হাইপারবোলা বা অধিবৃত্ত (বাসায় চেষ্টা করে দেখতে পারেন)।
|
অধিবৃত্তাকার আলো |
সুতরাং কণিকের এই বিভিন্ন অংশ কক্ষপথ এবং কক্ষপথ সম্পর্কিত বস্তুদ্বয়ের শক্তির সাথে জড়িত। যদি কক্ষপথের প্যারাবোলা আকৃতির মত মহাশুন্য সমতল হয়, তাহলে পুরো মহাবিশ্বের সর্বমোট নীট শক্তির পরিমাণ হবে শুন্য।
মহাবিশ্বের আকৃতি যদি সমতল না হয়ে অন্য কিছু (ধনাত্মক বক্রতা বা ঋণাত্মক বক্রতা বিশিষ্ট) হত, তবে এর সর্বমোট শক্তির পরিমাণ হয় ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক হত। কিন্তু মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ বাস্তবিকঅর্থে শুন্য।
এখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে,মহাবিশ্বের আকৃতি সমতল হওয়া আমাদের জন্য ভালো নাকি খারাপ? আসলে সমতল মহাবিশ্বের ধারণার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান মিলেছে। সমতল মহাবিশ্বের তত্ত্ব থেকে বোঝা যায়, শুন্য থেকেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। কারণ শুন্যের মোট শক্তি শুন্য। ধনাত্মক বা ঋণাত্মক কোন শক্তির কারণে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলে তা অনেক বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের জন্ম দিত। যেমন, সেই শক্তির উৎস কী? যদি কিছু পরিমাণ নীট শক্তি মহাবিশ্বে অবশিষ্ট থাকত, তবে সেটি কতটুকু? কেন অতটুকু শক্তি থাকবে? কেন তার বেশি বা কম নয় ?
কিন্তু মহাবিশ্বের আকৃতি সমতল হওয়ার কারণে বিজ্ঞানীদের কখনোই এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয়নি।
সূত্রঃ
১। https://www.youtube.com/watch?v=i4UpvpHNGpM
২। https://www.youtube.com/watch?v=veU6hK3jMH4
৩। http://curious.astro.cornell.edu/about-us/103-the-universe/cosmology-and-the-big-bang/geometry-of-space-time/600-why-is-the-universe-flat-and-not-spherical-advanced
৪। https://blogs.scientificamerican.com/degrees-of-freedom/httpblogsscientificamericancomdegrees-of-freedom20110725what-do-you-mean-the-universe-is-flat-part-i/
৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Shape_of_the_universe